‘বিজয়’ তুমি কার?

আহমদ রফিক
Published : 15 Dec 2010, 02:20 PM
Updated : 15 Dec 2010, 02:20 PM

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে ছিল বাঙালি-জাতীয়তার আবেগ। সে আবেগ ঊনসত্তর হয়ে একাত্তরে এসে এতটা প্রবল হয়ে ওঠে যে সে স্রোত শ্রেণীচেতনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গ্রাম-গ্রামান্তরের, তৃণমূল-স্তরের গায়ে-খাটা মানুষের মুখেও বাঙালিয়ানার কথা, বাঙালিয়ানা নিয়ে আবেগের কথা। শহুরে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এ আবেগ তো তখন আকাশ ছুঁয়েছে–যেমন সাহিত্য সংগীত চর্চায় তেমনি পোষক-পরিচ্ছদে, খদ্দরে পাজামা-পাঞ্জাবিতে এমন কি আহারে বিহারে।

অতি অল্প সময়ে অর্থাৎ বছর পাঁচেকের মধ্যে এ পরিবর্তন অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এ ধরনের জাতীয় সংহতি এর আগে এতোটা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে বলে মনে হয় না। দলমত বিবেচনা উপস্থিত থাকলেও স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে দ্বিমত ছিল খুবই কম। ছিল ধর্মীয় চেতনা ও পাকিস্তানবাদী রাজনীতির মধ্যে যেমন জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের মত রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে। আর ঐ রক্ষণশীল চেতনার টানে বাঙালি-নিধনের মত অপকর্মে লিপ্ত হতে তাদের বিবেকে বাধেনি। বাধেনি নিষ্ঠুরতম অমানবিক কাজে নিজেদের জড়াতে। বাঙালিয়ানার আবেগ কতটা ব্যাপক হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ মেলে ছোট একটি ঘটনায়। একাত্তরের শুরুতে আমার ঘনিষ্ঠ চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নের এক তরুণ নেতা আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিল: 'সামনে এক দফার যুদ্ধ। যুদ্ধে জিতলে আমি কিছু না পাইলেও আমার বাঙালি ভাইতো পাইবো।' কী গভীর বাঙালি জাতীয়তাবোধ! কিন্তু ক্ষুধা আর জীবন যাপনের চাহিদা যে ঐ আবেগের চেয়ে বড়ো তার প্রমাণ মেলে বছর তিনেকের মধ্যেই ঐ তরুণের কণ্ঠে ভিন্ন উপলব্ধির উচ্চারণে। 'বড় ভুল করেছি। দরকার আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ।'


কারণ ঐ মুক্তিযোদ্ধা লুটপাটের পথ ধরতে পারেনি, সুবিধাবাদের আশীর্বাদ তার কপালে জোটেনি বলে তার বোধোদয়-'এ বিজয় আমাদের জন্য নয়, বড়দের জন্যে'। অর্থাৎ শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণীর এলিট আমলাদের ভোগেই লেগেছে বিজয়। বাঙালি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় প্রকৃতই শ্রেণীবিশেষের স্বার্থ-নির্ভর রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। তাই অতিদ্রুত মধ্য শ্রেণী থেকে অতি বিত্তবান ধনিকশ্রেণীর আবির্ভাব বা উত্থান। কথিত বাইশ পরিবারের শাসনশোষন সংখ্যায় বহুগুন বেড়ে এক অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অবিশ্বাস্য আবেগ থেকে অবিশ্বাস্য অর্জন। এখনো সেই 'ট্রাডিশন'ই চলছে।

এ আবেগের গভীরতা সত্যি বলতে কি জাতিসত্তার শিকড় ছুঁতে পারেনি। সামাজিক চেতনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। পারলে এত দ্রুত, দু-চার বছরে বাঙালিয়ানার আবেগের স্থান সম্প্রদায় চেতনা ও পাকিস্তানবাদিতা ফের দখলে নিতে পারতো না, যেমন নিয়েছিল ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ সালে। জাতি বিভাজিত হতে পারতোনা ধর্মীয় রাজনীতির স্লোগান তুলে। সবচেয়ে বড়ো বিস্ময় একশ্রেণীর বামরাজনীতির নেতাকর্মীদের আত্মবিক্রয়, আদর্শ বিক্রয়। মোটা দানার খুঁদকুড়োর লোভে একদা বিপ্লবীর বাংলাদেশী জাতীয়তার নামে রক্ষণশীল রাজনীতিতে ভোল বদল! অবিশ্বাস্য তো বটেই।

পেছনের কথায় ফিরি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে (যদিও সুচনা বায়ান্ন থেকে) ভাষা সংস্কৃতি অর্থনীতি ঘিরে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, এলিট আমলা, হবু মুৎসুদ্দি শ্রেণীর বাঙালিজাতীয়তা ভিত্তিক আত্মশাসনের আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল উল্লিখিতদের শ্রেণী স্বার্থের লড়াই। পাকিস্তানের অবাঙালি আমলা, মুৎসুদ্দি, শিল্পপতি ধনিক ও শাসক শ্রেণীর সঙ্গে বাঙালি অনুরূপ শ্রেণীর আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাঙালি জাতীয়তার বিষয় অর্থাৎ জাতিচেতনা তথা বাঙালিয়ানা সামনে এসে দাঁড়ানোর ফলে আত্মশাসনের ঐ লড়াই শ্রেণীবিশেষের নয়, বাঙালির সর্বশ্রেণীর সর্বজনীন স্বার্থের লড়াই বলে মনে হয়েছিল।

এ ভুলের নেপথ্য কারণ অবাঙালি পাক শাসক গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থক সামরিক বাহিনীর প্রকাশ্য বাঙালি-বিরোধিতা। শুধু বিরোধিতাই নয় জাতি জাতীয়তা, সাহিত্য সংস্কৃতি ঘিরে বাঙালির প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা এবং তা বিজাতীয় বোধ থেকে। নিুস্তরের বাঙালি কর্মজীবী থেকে উচুঁস্তরের এলিট, বুদ্ধিজীবী, শেপাজীবী বাঙালির (অবশ্য কিছু সংখ্যক পাক-তাবেদার ও ধর্মীয় রক্ষণশীল বাদে) তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ধর্মীয় ঐক্য বাদে আর সব দিক থেকে পাকিস্তানের বাঙালি অবাঙালি যে আলাদা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যে সচেতন বাঙালির কাছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

ক্রমে অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রভেদ এতো স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে নিরক্ষবিন্দুতে দাঁড়ানো বাঙালিও বুঝে নেয় যে লড়াই ছাড়া, আন্দোলন ছাড়া প্রাপ্য অধিকার আদায় করা যাবে না। তা সে ভাষা সংস্কৃতি হো বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধাই হোক। তাছাড়া অবাঙালিদের তরফ থেকে এক ধরনের বিজাতীয় অবজ্ঞার ভাব বরাবর সক্রিয় ছিল। যা এক শ্রেণীর বাঙালির আত্মমর্যাদায় আঘাত করে।

পাকিস্তানে বাঙালি-অবাঙালির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব জাতিগত দ্বন্দ্বের রূপ নিয়ে দেখা দেয়। শ্রেণী স্বার্থের বিষয়টা পিছু হটে। জাতীয়তার চেতনা যে কতটা শক্তিমান বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসেও তা পরিস্ফুট। জাতি জাতীয়তার শ্লোগানে লড়াই, কখনো যুদ্ধজয় কোনো অভাবিত ঘটনা নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক টানা পোড়েনের ইতিহাস এটা স্পষ্ট করে দেয় যে বাঙালির জাতীয়তার লড়াইটা অনেকাংশে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক নেতাদের উপহার। অর্থাৎ তারাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।

সে পরিস্থিতি যেমন ক্রমশ সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি সত্তর একাত্তরে পৌঁছে পাক সামরিক জান্তা যুদ্ধটা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল এবং দিয়েছিল বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর নয়, গোটা বাঙালি জাতির ওপর। তাই শ্রেণী নির্বিশেষে বাঙালির আত্মসচেতন অংশের পিছু হটার কোনো উপায় ছিল না। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে হোক বা অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রত্যাশায় হোক বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে।

কিন্তু লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে নানা স্তরের শিক্ষিত শ্রেণীর বাঙালি-বেসামরিক ও সামরিক আমলা, পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বনিক এবং সর্বোপরি তা রাজনৈতিক সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায়। উপনিবেশে যেভাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের সূচনা ঘটে অনেকটা সেভাবেই শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তার স্লোগান উচ্চারণে আমাদের আত্মশাসনের লড়াই শুরু। পাক শাসকদের শোষন পীড়নের প্রেক্ষাপটে এবং জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রচারে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে হয়েছিল এ লড়াইয়ে তাদেরও স্বার্থ রয়েছে। এমন বোধ প্রাধান্য পেয়েছে শহরে বন্দরে, মাঠে ঘাটে: 'এ লড়াই তোমার আমার। এ লড়াই সব বাঙালির' এমন উচ্চারণে।

এভাবে পাক সেনাদের পোড়ামাটি নীতি এবং হত্যা ধর্ষণ ও নির্যাতনের কারণে ছয় দফার স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন জনযুদ্ধের চারিত্র অর্জন করে। এবং পাকিস্তানি নয়া-উপনিবেশবাদী শাসনের (এক দেশে দুই অর্থনীতি ভিত্তিক) বিরুদ্ধে একাত্তরের রণাঙ্গনে বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামের সফল সমাপনে যেমনটা ঘটতে দেখা গেছে এদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জন্ম নিয়েছে বিজয় শেষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

স্বাধীন স্বদেশে পরবর্তী কয়েক দশকের আত্মশাসন ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী প্রমান করেছে যে যুদ্ধের ফলাফল অর্থাৎ বিজয় সর্বশ্রেণীর সর্বস্তরের জনতার দাওয়ায় পৌঁছতে পারেনি। এমনকি জাতীয়তাবাদী চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে জাতীয় বুর্জোয়ার চরিত্রও অর্জন করতে পারেনি স্বাধীন দেশের স্বশাসন। ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ এবং শ্রেণীস্বার্থ–এ তিন স্বার্থই প্রধান হয়ে থেকেছে। নিম্নবর্গীয় জনতার প্রতারিত হওয়াই যেন অনিবার্য ছিল। বাঙালিয়ানা তখন শিক্ষিত শ্রেণীর উচ্চশ্রেণীর বৃত্তে বাঁধা পড়ে গেছে।

এ অবস্থার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির জন্য শুভ পরিণাম বয়ে আনেনি। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এর সুযোগ ভালোভাবে নিয়েছে। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নতুন করে চাপিয়ে দিয়ে, আত্মপরিচয়ের (আইডেনটিটি'র) নামে সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বাতাস দূষিত করে জাতিকে বিভক্ত করতে পেরেছে। ঊনসত্তর একত্তরের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যাপক দূষণ ও বিনাশ নিশ্চিত করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবোধ এখন বৃত্তাবদ্ধ, আর প্রগতিবাদী রাজনীতি এক ঘরে, জনবিচ্ছিন্ন।

শিক্ষিত সমাজের একাংশে বাঙালি জাতীয়তার চেতনা পরিত্যক্ত, এবং বিস্ময়কর যে সেখানে রয়েছে বামপন্থীদের একাংশ কিন্তু কোন হিসাবে, কোন আদর্শের বিচারে তা বোঝা কঠিন। বিশ্ব রাজনীতির প্রভাবে ও পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে গণতন্ত্রের নামে ধর্মীয়চেতনার রাজনৈতিক প্রকাশ অন্যদিকে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে বেহাল দশায় পৌঁছে দিয়েছে। বাঙালি জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ এখন সংস্কৃতি অঙ্গন ও শিক্ষিত সমাজের একাংশে সীমিত পরিসরে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে রয়েছে।

বিভাজিত রাজনৈতিক চেতনার সংঘাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এত ধুলো উঠছে যে তাতে পরিবেশ দূষণ রাজনীতির জন্য, দেশের জন্য এবং তা কোনো সুসংবাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে না। তার চেয়েও বড়ো দুঃসংবাদ যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৃতীয় রাজনীতির কোনো সুস্থ আবির্ভাবের সম্ভাবনাও চোখে পড়ছেনা। দুর্নীতি সর্বখাতে। রাজনীতি অনিবার্যভাবেই যে দূষণ থেকে মুক্ত নয়। তাই দেশের মঙ্গল নিয়ে যারা ভাবেন তারা বড়ো অসহায় অবস্থায়। এমন পরিবেশেই 'বিজয়' আসছে ও যাচ্ছে, হয়তো ভাবছে এক সময় শুদ্ধ শুভ নির্মল দিনের দেখা মিলবে। আর রাজনীতি সচেতন নির্দল মানুষের মনে প্রশ্ন: 'বিজয়, এখন তুমি কার?'