শেষ হোক ছায়ামানবীদের বেদনার আখ্যান

শাহমিকা আগুন
Published : 16 March 2014, 07:26 AM
Updated : 16 March 2014, 07:26 AM

'বীরাঙ্গনা' ও 'বীরপুরুষ' সমার্থক শব্দ। অথচ 'বীরপুরুষ' শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে একজন বীরের প্রতিচ্ছবি। একই সঙ্গে 'বীরাঙ্গনা' শব্দটি উচ্চারণের পর আমরা দেখি পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতিচ্ছবি। তাদের কথা আমরা ফিসফাস করে আড়ালে বলি; তাদের আমরা ভাবি দেশ, জাতি, সমাজ ও পরিবারের 'কলঙ্ক'।

বীরাঙ্গনা, বীর জননী যে নামেই তাদের সম্বোধন করা হোক না কেন, এখানে শব্দগুলো কোনো দ্যোতনা সৃষ্টি করে না। তাদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বলে ডাকা হলেও আমাদের সামনে একজন লাঞ্ছিত মেয়ের প্রতিচ্ছবিই ভেসে উঠত, দেশের জন্য লড়াই করা কোনো বীরের ইমেজ নয়।

বীরাঙ্গনাদের কথা আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়িনি, তাদের দেখিনি টেলিভিশনে। আমাদের মতো একটি গোটা প্রজন্ম বড় হয়েছি শুধু এই জেনে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীনির্যাতন হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্যাতনের ধরন যে কী বিভীষিকাময় ছিল সে সত্যটি জানা এবং পরের প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা কেউ উপলব্ধি করেননি। ত্রিশ লাখ শহীদের করোটির মতোই এই বীরাঙ্গনারা তাই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন।

ইংল্যান্ডে আসার পর ২০০৭ সালে পাকিস্তানের একজন এনজিওকর্মীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। কথায় কথায় তিনি আমাকে জানালেন যে, একাত্তরে পাক আর্মির সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যাওয়া বেশ ক'জন বাংলাদেশি নারীকে তিনি চেনেন। শুনে হোঁচট খেলাম। পাকসেনারা যে যুদ্ধশেষে ফেরার পথে আমাদের কিছুসংখ্যক নারীকে সঙ্গে নিয়ে গেছে– সে তথ্য আমাকে চমকে দিল। আমি উৎসুক হলাম তাদের সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্ত যা জানলাম তা শুনে নিজের ওপর, নিজের প্রজন্মের ওপর, নিজের জাতির ওপর তীব্র ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

পাকিস্তানি সেই এনজিওকর্মীর তথ্য অনুযায়ী, ওই বাঙালি নারীরা ওখানে যৌন পেশায় নিয়োজিত আছেন। এক অসহ্য আক্রোশে আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। আমার বীরমাতা বীরাঙ্গনারা তাদের কাছে 'পতিতা'! আমার দেশের সোনার মেয়েদের ঘর থেকে, দেশ থেকে টেনে বের করে নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে ছুঁড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা ওদের কে দিয়েছে?

সেই এনজিওকর্মীকে অনুরোধ করলাম আমার দেশের অহংকারদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তিনি জানালেন যে, আমাদের সেই বীরাঙ্গনারা বাংলাদেশে ফিরতে সম্মত হননি। যে দেশের মানুষ তাদের সবচেয়ে দুর্দিনের সময়, তাদের চরম প্রয়োজনের সময় তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নেয়নি, জীবনের শেষ বয়সে সে দেশে ফিরে যেতে তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

সেদিন থেকে আমি কখনও ভুলতে পারিনি যে এখনও এই বীরাঙ্গনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাম প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে দিয়ে যাচ্ছেন। এই দায় কার? সব দোষই কি পাকিস্তানিদের ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থাকা যায়! পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ওপর যে অত্যাচারের সূচনা করেছিল তার শেষ কি আমরা করতে পেরেছি?

তা যদি হতই, তাহলে 'কুলটা' অপবাদ দিয়ে বীরজননী রমা চৌধুরীকে শিক্ষকতার চাকরি থকে বহিষ্কার করা হত না। তার স্বামী সমাজের ভয়ে বীরাঙ্গনা স্ত্রী ও নবজাতক শিশু রেখে পালিয়ে যেতেন না। আজ তিয়াত্তর বছর বয়সে সেই বীরাঙ্গনা মাতাকে খালি পায়ে পথে পথে হেঁটে বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত না। রাহেলা আর সুরাইয়ারা অভুক্ত থাকতে থাকতে আলসারের থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে একঘরে জীবন যাপন করতেন না। বার্ধক্যের ভারে নতজানু কমলা আর হালিমাদের এই বয়সেও শুনতে হত না যে 'মিলিটারিরা' তাদের 'ভাতার'!

রাজু বালা বীরাঙ্গনা বলে তার স্বামীর দাহ হয়নি। হয়নি ধর্মীয় কোনো সৎকার। জীবদ্দশায় রাজু বালাকে নিয়ে ঘর করায় তার স্বামীর মৃত্যুর পর শাস্তি হিসেবে তার দেহটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় যমুনা নদীতে। রাজু বালা কেঁদে বুক ভাসান। কারণ তিনি জানেন, মৃত্যুর পর তার জন্যেও পালন করা হবে না কোনো ধর্মীয় আচার। তাকেও ভাসিয়ে দেওয়া হবে কোনো নদী-নালা কিংবা খালে-বিলে!

মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে লাঠি হাতে এক বীরাঙ্গনা পুরুষ দেখলেই তাড়া করে বেড়াতেন আর বলতেন, 'সর সর, তুই পাকিস্তানি'। তাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা (হায়েনার বদলে সৈন্য) দীর্ঘ তিন মাস পাশবিকভাবে নিপীড়ন করেছে। অত্যাচার আর অপমানের যন্ত্রণায় এক পর্যায়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাকে কিন্তু 'পাগলি' আখ্যা দিয়েই বেঁচে যাই আমরা। কখনও কখনও হয়তো ভাবি, এই পাগল-ছাগলের উৎপাত কবে বন্ধ হবে!

শোনা যায়, স্বাধীনতার পর যে ক'জন বীরাঙ্গনাকে রাজারবাগ ক্যাম্প থেকে সিলিং-এর সঙ্গে ঊর্ধ্বফাঁসে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, তিনি তাদেরই একজন। সে সময় উদ্ধার পাওয়া মেয়েদের দু-তিনজন ছাড়া বেশিরভাগই ছিলেন মৃত।

সুসান ব্রাউনমিলার ও ড. জিওফ্রে ডেভিসের গবেষণা এবং বাংলাদেশ অবজারভার (১৯৭২)-এর তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি নারী পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন। এই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পেছনে পাকিস্তানি বাহিনী শুধু যৌন কামনা দ্বারা তাড়িত হয়েছে, তা কিন্তু নয়– স্বাধীনতাকামী জাতিকে চরমভাবে অপমান করাই ছিল এ জাতির নারীদের ওপর এ ধরনের নিপীড়ন চালানোর মূল উদ্দেশ্য। এটি 'এথনিক ক্লিনজিং'-এর অংশ। যেন যুদ্ধে জয়ী হলেও জয়ী বাহিনী বা জাতির শরীরের এই দগদগে ঘা চুইয়ে রক্ত ঝরে।

আর তাই পাকবাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে আট বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ নারীকেও নিপীড়ন করেছে। কিছু কিছু ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক। মা ও কন্যাকে একই সঙ্গে ধর্ষণ করা হয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনেই– এমন ঘটনা ঘটেছে। বার থেকে চৌদ্দ বছরের হাজার হাজার সদ্যকিশোরী (বর্তমানের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় তারা শিশু) সংঘবদ্ধ নিপীড়নের ফলে যুদ্ধের সময় বা পরে হয়ে পড়েছিল সন্তানসম্ভবা।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র বলছে, ধর্ষণের ফলে প্রায় দুই লাখ নারী ও কন্যাশিশু গর্ভধারণ করেছিলেন। এছাড়া প্রায় এক লাখ পঁচাত্তর হাজার ধর্ষিতা নারী ও কন্যাশিশুর গর্ভপাত ঘটানো হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক লাখ বাষট্টি হাজার নারী-কন্যাশিশু অদৃশ্য হয়ে যান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে। ছায়ামানবী হয়ে যান তারা। মুছে দেওয়া হয় তাদের নাম, পরিচয়। সতীত্বের লেবাসে ঢাকতে গিয়ে অস্বীকার করা হয় তাদের অস্তিত্ব।

ধর্ষণের নামে তাদের ওপর অন্য যেসব শারীরিক অত্যাচার করা হয়েছে সেগুলোও ভয়াবহ। গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে আঘাত করা, শরীরের নানা অংশ সিগারেট দিয়ে ঝলসে দেওয়া, মাথার চুল দিয়ে ঊর্ধ্বফাঁসে বেঁধে রাখা, দিনের পর দিন অভুক্ত রাখা, আত্মহত্যা করতে পারে এ আশঙ্কার নামে তাদের সবসময় নগ্ন করে রাখা– এসবের কোনো বিচার হয়নি। এসব বীভৎস অত্যাচারের খবরও আমরা কেউ রাখতে চাইনি। ধর্ষণের আড়ালে এসব লোমহর্ষক অত্যাচারগুলো কী ন্যাক্কারজনকভাবে চাপা পড়ে গেছে!

যুদ্ধশেষে আমাদের দামাল ছেলেরা ফিরে এল এবং জাতি তাদের বরণ করে নিল বীর বেশে। কিন্তু আমাদের বীরাঙ্গনারা পেলেন আর্মি ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া 'অসতী' কিংবা 'কলঙ্কিনী'র আখ্যা। তাদের জন্য ছিল না কোনো স্বাগত বারতা, বরং তাদের মৃত্যুই যেন ছিল কাম্য। কেউ জানতে চায়নি কী বিভীষিকাময় দিনরাত্রি পার করে তারা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

বীরাঙ্গনা সূর্য বেগম তার ওপর বাংলাদেশের রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নিপীড়নের বীভৎসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ''আমরা মিলিটারির ভয়ে পুকুরের পানিতে লুকাই থাকতাম। রাতের বেলা মিলিটারি আইল। রাজাকাররা আমরারে পানি থেইকা উঠাইল। আমরার কাপড়-চোপড় সব ভিজা। আমরা চাইরজনরে তারা অত্যাচার কইরা চইলা গেল। তারপর সমাজ আমরারে নিল না। আমরার কী দোষ?''

বীরাঙ্গনা রাজু বালার সামনে পাকিস্তানি আর্মি আছড়ে মেরে ফেলে তার দেড় বছরের শিশুসন্তানকে। তার আরেক সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কুয়ার ভেতর। সে সময় একজন মায়ের মানসিক অবস্থা কেমন হয়? সে রকম অবস্থায় ওই মাকে গণধর্ষণ করে পাষণ্ডেরা। রাজু বালার মতো এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে হাজার হাজার বীরাঙ্গনাকে। অনেক নারী ও কন্যাশিশুর চোখের সামনে পরিবারের সদস্যদের হত্যার পরপরই তাদের গণধর্ষণ করা হয়েছে। স্বজন হারানোর ব্যথা লালন করার পরও দিনের পর দিন যে অকথ্য নির্যাতন তাদের সইতে হয়েছে তা অকল্পনীয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা সইতে না পেরে ও অত্যাচারের ফলে হাজার হাজার বীর নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।

এত ভয়াবহ নির্যাতন শেষেও যারা ফিরে এসেছিলেন তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল নিষ্ঠুর বাস্তবতা। নিজের পরিবারের মানুষজনের তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, পিছুটান, পরিবারের লজ্জা বলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া– এসব দেখতে হয়েছে তাদের। সমাজ বলেনি যে, তারা বীর, কারণ তারা ফিরে এসেছেন বীরদর্পে। পরিবার ও সমাজের এই বৈরী আচরণ সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্নহত্যা করেছেন। যুদ্ধের পর এক মাসে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার নারী আত্নহত্যা করেছেন। তার মানে একদিনে গড়ে এগারশ ছেষট্টিটি অপমৃত্যু!

কিন্তু দীর্ঘ কয়েক মাসের নিপীড়ন সয়ে বেঁচে থাকার পর একটুখানি আদর দিয়ে তাদের বুকে টেনে নেয়নি পরিবারের সদস্যরা। কেউ এগিয়ে এসে ছোট্ট একটা ঠাঁই দিয়ে বলেনি, ''ওরে সোনা, ওরে বীরকন্যা, এবার থাম। দেশের জন্যে, এর স্বাধীনতার জন্যে অনেক করেছিস তোরা''। হাজার হাজার ধর্ষিতার আত্মহত্যার কথা শুনেও সমাজে কি কোনো ছাপ পড়েছিল? জানতে ইচ্ছা করে, কী তাদের পরিচয় ছিল তখন– শুধুই 'মৃত' নাকি 'শহীদ'?

আসলে সত্যটা তো এই যে, বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ এই সমাজে কাউকে দোলায়িত করেনি, কাউকে আবেগে ভাসায়নি। তাদের অপমান কাউকে আক্রোশে দু'হাত মুঠিবদ্ধ করে চিৎকার করে বলতে শেখায়নি, ''আমি এই অপমানের, এই অন্যায়ের, এই শোষণের প্রতিশোধ চাই, বিচার চাই''। তাদের ওপর অত্যাচারের বিচারের দাবিতে কোনো মামলা হয়নি। তাদের মঙ্গলকামনায় আজও কেউ মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালায় না। বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাদের স্থান নেই। তাদের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বা চাকরির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কোটা তো পানই না বরং 'কুলটার সন্তান' বলে ভীষণ এক অসম্মানের, একঘরে একটা জীবন কাটাতে হয় তাদের।

বীরাঙ্গনাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্মৃতিসৌধ তৈরি করার কথা কি আমরা ভেবেছি? এমনকি এদেশের একটি সড়কের নামও তো কোনো বীরাঙ্গনার নামে হয়নি। এদেশের কত শত মসজিদ-মন্দির অসংখ্য রাজাকার-আলবদর, খুনী ও দুর্নীতিবাজের দ্বারা বারবার কলঙ্কিত হয়। অথচ ধর্মস্থানে গিয়ে প্রভুর সামনে একবার মাথা তুলে দাঁড়াবার অনুমতিও আমরা বীরমাতাদের দিইনি! বড় হৃদয়বিদারক!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন 'আমি ওদের বাবা'। বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপও তিনি নিচ্ছিলেন। তাকে হত্যার পর আরও কত সরকার এল-গেল! আমাদের দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার মসনদে বসলেন তিন বার করে। সবাই কী করে ভুলে গেলেন বীরাঙ্গনাদের এই কঠিন আত্নত্যাগের কথা?

যে দেশ, যে সমাজের মানুষেরা দেশের জন্যে বীরদর্পে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনল– ইতিহাসের সাক্ষী সেই মানুষেরাই কেন আবার দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনদের পাশে দাঁড়ানোর বীরত্ব দেখাতে পারল না? আমাদের আয়মনা বিবি, সুফিয়া, হাসিনা, জয়নব, রাজু বালা, সূর্য বেগম, পদ্মা রহমান, রমা চৌধুরীর মতো বীরাঙ্গনারা তেতাল্লিশ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের ওপর সংঘটিত অন্যায়ের বিচারের আশায়।

আজ সময় এসছে সমাজের কোণায় বড় অনাদরে পড়ে থাকা সেই বীর নারীদের খোঁজ করার। রুয়ান্ডা ও সিয়েরালিওনে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন অসংখ্য নারী ও কন্যাশিশু। তাদের বেশিরভাগই পরবর্তীতে এইচআইভি পজিটিভ বলে চিহ্নিত হন। আমরা কখনও জানতে চাইনি কীভাবে আমাদের বীরাঙ্গনা মায়েরা বেঁচে আছেন, কীভাবে মারা গেছেন! ধর্ষণের ফলে তারাও নানা ব্যাধির সহজ শিকার হয়ে থাকতে পারেন। সেসবের খোঁজ আমরা নিইনি। আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা বীরাঙ্গনা মমতাজকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এর ফলে তার গর্ভস্থ সন্তানটি মারা যায়। মমতাজ বেঁচে থাকলেও তার যোনিপথ ও পায়ুপথ এক হয়ে যাওয়ায় তাকে এ পর্যন্ত ষোলটি অপারেশন করাতে হয়েছে।

এই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নকশী কাঁথায় আমাদের বীরাঙ্গনাদের বেঁচে থাকার কাহিনী! তাদের বীরত্বের যে কাহিনিগুলো আমরা জানি, তারপর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন রাখব– বীরনারী হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা এবং তাদের ওপর সংঘটিত যাবতীয় অন্যায়ের বিচার চাওয়ার মতো সৎসাহস আমরা কবে দেখাতে পারব।

দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বীরাঙ্গনাদের অবদানের কথা একটি লাইনে স্বীকার করে বাকিসব ভুলে থাকার দিন এখন শেষ হতেই হবে।

শাহমিকা আগুন: লেখক, অ্যাকটিভিস্ট।