অযোধ্যা মামলার রায় নিয়ে রোমিলা থাপারের প্রতিক্রিয়া ও একটি ভিন্ন পাঠ

রিফাত হাসান
Published : 8 Oct 2010, 04:32 PM
Updated : 8 Oct 2010, 04:32 PM

বিশ্বপরিমণ্ডলে ইণ্ডিয়া নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও মহত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে, যদিও সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচে বড়ো এবং নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহ এই রাষ্ট্রেই বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়েছে- রাষ্ট্রটির নেতৃত্বের প্ররোচনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায়, আবার দেশটি এমনই গণতান্ত্রিক যে, এর সাতকন্যা রাজ্য ও কাশ্মির জুড়ে চলছে সামরিক ফরমান- উনিশশ আটান্ন সালের দুই সেপ্টেম্বর ইণ্ডিয়ার কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট এর পাশকৃত আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার (অসম, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল ও নাগাল্যান্ড) অ্যাক্ট এর মাধ্যমে, রীতিমত আইনীভাবেই।

তাই, এহেন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের রাজনীতিতে অযোধ্যা মামলার রায় গুরুত্বপূর্ণ হবে সন্দেহ নেই, বিশেষত যখন রায়ের আগে এবং পরে সাম্প্রদায়িক নৈরাজ্যের ভয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক সারা দেশজুড়ে পূর্বসতর্কতামূলকভাবে রীতিমত এক জরুরী অবস্থা জারির ঘটনা ঘটে- বুঝা যায় ইণ্ডিয়ার নেতৃত্বও এটিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। সারা দেশ জুড়ে এই এলার্ট জারি একই সাথে একটি ভয়ার্ত, ভঙ্গুর ও পর্যুদস্ত ইণ্ডিয়াকেও হাজির করে। নির্দেশ করে ভাঙনের সেই গভীর খাদ, যে খাদে এই রাষ্ট্র ও তার জনগণ পতিত হয়েছে বেশ আগে, দেশটির নেতৃত্বের প্ররোচনায়- সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার পর।

অবশেষে মামলার রায়ের মাধ্যমে বোঝা যায় দেশটির নেতৃত্ব এর জনগণকে এমন একটি না ফেরার জায়গায় নিয়ে গেছে- যেখানে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের পেশিশক্তিই আইন-আদালত এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী জায়গায় ভূমিকা রাখে, ফলত জনগণের বিবেচনার মাপকাঠি এইসবই হতে হবে- অন্যকোন ন্যায়-আচার নয়। এটি এমন, যে, এর গভীর ক্ষত আরোগ্যের ক্ষমতা শুধু একটি বাবরি মসজিদ বা রাম মন্দির নয়, এমনকি আরও একশটি মন্দির কিম্বা মসজিদ এর নাই। সাম্প্রদায়িকভাবে সংখ্যাগুরুর পেশীশক্তি এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে তার পরাগায়ন, আর স্বাধীনতাকামী রাজ্যগুলোতে রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস এর চাষাবাদ- এইসবই এর কারণ। ফলত, পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, স্রেফ একটি মন্দির কিম্বা মসজিদ হয়তো আর বাঁচাতে পারবে না ইণ্ডিয়াকে- যদিনা ইণ্ডিয়া নিজের এই গভীর অসুখের সুশ্র"ষা না করে।

এরই প্রেক্ষিতে অযোধ্যা মামলা সম্পর্কে ভারতের প্রভাবশালী দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত রোমিলা থাপারের লেখাটা পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। প্রাচীন ভারত-বিশেষজ্ঞ রোমিলা থাপার তো, কী জ্ঞানী কথা বলেন তাই নিয়ে উৎসাহ। রোমিলা থাপার সাধারণ কেউ নন, দি হিন্দু তাঁর লেখার উপশিরোনামে দিয়েছে: অযোধ্যা মামলার রায়: একজন ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে (The verdict on Ayodhya: a historian's perspective ) । ইরফান হাবিব বা অরুন্ধতী রায়ের মতই তিনি রায়টিকে "রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত" ইত্যকার মন্তব্য করেছেন- কিন্তু তার বাইরেও কয়টি আগ্রহউদ্দীপক কথা বলেছেন। প্রথমত, প্রশ্নের ভাবটা এমন যে, ধর্মীয় ও অন্যান্য মিথ কীভাবে আইনের বিষয় হতে পারে? আদৌ পারে কি? দ্রষ্টব্য: 'এই রায় আদালতের আইনে এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো, যাতে একটি স্থানকে ঐশ্বরিক ও প্রায় ঐশ্বরিক ব্যক্তির জন্মস্থান বলে দাবি করা যায় এবং এটি করতে পারে এমন একটি গোষ্ঠী যারা ওই দেবতার পূজক হিসেবে একটি সম্প্রদায়ভুক্ত।' সত্য কথা। আমারো একই প্রশ্ন হাজির আছে।

এ বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়া সংগত মনে করি, বাংলাদেশের হাইকোর্টে কোরবানির ইতিহাস নিয়ে জনৈক দেবনারায়নের করা রিট আবেদনটির কথা, আমরা সেই মামলা আমলে নেওয়ার আগে এ বিষয়ে হাইকোর্টের এখতিয়ারের প্রশ্ন করেছিলাম। মানে, আদালত কি মিথ ও ইতিহাস লিখে দেবে? হাঁ, এমনকি ইতিহাসতর্কের বিবাদ্ওে আমাদের আদালত যখন সিদ্ধান্ত দেবার অধিকার চেয়ে বসে, যেমন স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্ন, সেখানেও এই এখতিয়ারের  প্রশ্নটি সবচে মৌলিক বৈকি। সেই সাথে তাঁর এই কথাটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বলছেন, 'আমরা আজকের রাজনীতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য অতীতকে পরিবর্তন করতে পারি না। হাঁ, তাঁর বক্তব্য এদ্দুর পর্যন্ত আমি জোর গলায় সমর্থন করব।

এর পরপরই রোমিলা এই বলে শেষ করছেন, যে, প্রকৃত মিটমাট হবে আইনে, আর আইনকে কথা বলতে হবে নিশ্চিত তথ্য-প্রমাণ এর উপরে ভর করে। দ্রষ্টব্য: 'মিটমাট একমাত্র তখনই হতে পারে যখন এ দেশের আইন শুধু বিশ্বাস ও ধর্মের ওপর নয়, নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণের ওপর দাঁড়াবে।' এটাও নিশ্চয় ভাল কথাই হবে। যদিও আইনে আমার অত ঈমান নেই, কিন্তু, আইনেই বসবাস করি বাধ্যগতভাবে, কাজেই তার গুরুত্বও কম নয়। যেহেতু রোমিলা থাপার বলছেন, তাঁরও গুরুত্ব আছে বৈকি-। তাঁর ভরবিন্দুগুলাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখা দরকার তাই। সব তত্ত্বালোচনা শেষে রোমিলা শেষমেষ আইনের উপর ঈমান- সাথে তথ্য-প্রমাণকে সহ প্রাসঙ্গিক করে নিয়েছেন- এই অটল ধর্ম-বা-ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাসে যে, যদি ঐতিহাসিকভাবে ঐ জায়গাখানি রাম এর জন্মস্থান হিশেবে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়- তাহলে ঠিকই আছে। রামের জায়গা রামকে ফিরিয়ে দেওয়া কর্তব্য। ৫০০ বছর আগে মসজিদ নির্মাণ এর 'ধর্মীয় অপরাধ' এর প্রতিকার এই 'তথ্যপ্রমাণভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ-রাম' এর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সারতে হবে। লেখার শুরুতে তাই রোমিলা এই রায়ে অনেকটাই আকাদেমিক সুশিলতার ভাব নিয়ে স্বস্থিমিশ্রিত বুদ্ধিজীবীসুলভ সুরে বলছেন, 'রাষ্ট্র চাইলে এ সিদ্ধান্ত অনেক আগে সহজেই নিতে পারতো'। সত্য বটে। তবে আমার আরো কথা আছে, সবিনয়ে।

প্রথম হলো- শুরুতে যেইসব এখতিয়ার ইত্যকার বিষয়কে আলোচনায় আনলাম, রোমিলা থাপারকেও সাথে নিয়ে, সেই এখতিয়ার এর প্রশ্ন। রোমিলা এই বিষয় নিয়ে বহুত দামী ও ভারিক্কি অথচ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আলোচনার পর শেষে রাম মন্দিরের তথ্য-প্রমাণে এসে এমনভাবে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ালেন, যেন এতক্ষণ হুদাই মিথ্যে কথা বলেছেন। যাক, আমি কিন্তু তাঁর উপরের তত্ত্বালোচনাকে ভুল ভাবি না- তাই পরের এই অনুসিদ্ধান্তটিকে  প্রশ্ন করতে বসলাম। পাঁচশত বছর ধরে একটি মসজিদ চলার পরে- এইটা কীভাবে, কোন উপায়ে প্রতিষ্ঠা  হয়েছে সেই তত্ত্ব ও ইতিহাস কি আর মালিকানা নির্ধারণী আইনের বিষয় বা এখতিয়ারের অধীন থাকে? নাকি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণের অধীন? আইনে মালিকানা মিটমাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই বিষয়খানা পরিস্কার হওয়া দরকার- সর্বাগ্রে। এইটা এখতিয়ারের প্রশ্ন, তারপর মামলায় নামার বিষয় আসবে।

এক্ষেত্রে 'এখতিয়ারে' ঈমানদারদের জন্য দুনিয়ার ইতিহাসের নাড়াচাড়া একটু বাছবিচার করে দেখা দরকার। আইনের এলেম নেওয়ার আগে, যেমন বুঝা দরকার আইন মানে বলপ্রয়োগের ক্ষমতাশালীর আদেশ- তেমনি ক্ষমতার সব প্রয়োগ এবং বৈধতা আইনের মাধ্যমে ঘটে না- সেটিও জানা জরুরী। ক্ষমতার নায্যতা মূলত ক্ষমতা উৎপাদনই- ইতিহাসে বৈপ্লবিক রূপান্তর এর কোন আইনি প্রতিকার সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জির এক সময়ে দেখা যায় ইসলামের মহানবি স. কাবাঘরকে মুসলমানদের ক্বেবলা ঘোষণা দিয়ে তার মধ্যকার পুরাতন সমাজে পূজ্য লাত, মানাত ও ওজ্জার মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এইভাবে কাবাঘর ইসলামের হলো।- এখন কোন আদালত যদি রায় প্রদান করে বলে যে কাবাঘর এর এই মূর্তি ভেঙে ফেলা এবং ইসলামের ক্বেবলা বানানো অবৈধ- এবং এই ঘর পবিত্র লাত, মানাত ও ওজ্জার পূজারীদের ফেরত দিতে হবে- তাহলে এটি কি কোন মালিকানা তৈরী করবে? একই যুক্তি শৃঙ্খলায় ইজরায়েল নামে যে প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রের কথা ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে থাকেন- এইরকম বলাবলি করে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে তাদের দখলদারিত্বও নায্য বটে। রোমিলাও হয়ত এই আশঙ্কাতেই বলছেন, 'এখন হয়তো এমন বহু জন্মস্থানের খোঁজ পাওয়া যাবে যেখানে দাবি করার মতো যথার্থ সম্পদ পাওয়া যাবে এবং সেসব বিষয়ে দাবি তোলা যাবে।'- যদিও তাঁর অনুসিদ্ধান্ত এই মতামতটাকে সেই অর্থে ধারণ করে না।

দ্বিতীয় হলো, বিচার্য বিষয়ের ফাঁকি। একটি মামলায় বিচার্য বিষয় কী হবে- তার রাজনীতি। ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর মালিকানা নির্ধারণকে মামলার বিষয়বস্তু বানিয়ে এই মামলার ফলকে প্রভাবিত করতে ১৯৯২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা, মসজিদ ধ্বংসের ফৌজদারী অপরাধ সংগঠন, যার কোন ফৌজদারী  প্রতিকার রাষ্ট্রপক্ষ করে নাই- বরং সংস্লিষ্ট অপরাধীরা সর্বোচ্চ সম্মান ও গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র কর্তৃক। এবং এই ফৌজদারী বিষয়বস্তুকে ভুলিয়ে দিয়ে দেওয়ানী মামলায় বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক ভিত্তি খোঁজাখুঁজিতে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে এখানে।

এবং এই রায়ে বঙ্গাল বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াকর্মীরা রীতিমত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ইণ্ডিয়ার সন্ধান পাচ্ছেন- যে, ইণ্ডিয়া মুসলমানদের উপাসনাগৃহ ও প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি এই রায়ে তাদের বঞ্চিতও করে নাই- কিছুটা জায়গাও দেওয়া হয়েছে । হাঁ, বটেইতো। মূলত পাঁচশত বছর ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রার্থনার গৃহ বাবরি মসজিদ এর জায়গা ভাগ করে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া, তার সমর্থনে বিচারপতিদের দশ হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠার রায়- যেখানে হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ ভগবত গীতা ও মহাভারত ইত্যকার কাব্য মহাকাব্যের শ্লোক বিশ্লেষণ করে বিরানব্বই এর ধ্বংসজজ্ঞ পরবর্তী দখলদারী পক্ষগুলোকে রাজনৈতিক বৈধতা দান করা হয়েছে এবং যে দেশের প্রায় অর্ধেক অংশেই চলে 'আইনি' সামরিক শাসন- সেটিতো অবশ্যই পৃথিবীর সবচে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ইণ্ডিয়া গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় সত্যিই সয়লাব হয়ে আছে। জয় হো।