তবুও সংলাপ, কোন পথে

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 24 Oct 2013, 10:06 AM
Updated : 24 Oct 2013, 10:06 AM

আসন্ন নির্বাচনকালে কোন ধরনের সরকার বা প্রশাসন থাকবে তা নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক সংঘাতের পটভূমিতে, প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে, এখন দুই টেবিলে দুই প্রস্তাব।

একটি সরকারি দল ও মহাজোটের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আরেকটি বিরোধী দল ও ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে বেগম খালেদা জিয়ার। দুটি প্রস্তাবকে এক টেবিলে এনে দুই পক্ষের সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাব দুটি উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরুর মতো দুই দিকে মুখ করে আছে। তাদের একমুখো করে সমাধান বের করা যাবে কীভাবে?

প্রধানমন্ত্রী ১৮ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয়ভাবে সম্প্রচারিত ভাষণে যে প্রস্তাব প্রকাশ করেন তার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বিরোধী দল ৭২ ঘণ্টা সময় নেয়। বিরোধী দলের নেতা ২১ তারিখ সোমবার বিকেলে একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা প্রস্তাব তুলে ধরেন।

প্রস্তাব দুটিতে রাজনৈতিক, নীতিগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান-ব্যবধান দুস্তর। দু'দিন সময় নিয়ে বিএনপি ও ১৮-দলীয় জোটের সভায় সরকারি প্রস্তাব খতিয়ে দেখে তবেই পাল্টা প্রস্তাবটি দেওয়া। কাজেই বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা চিন্তাভাবনা করেই যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেজন্য প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করতে হবে।

নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব খালেদা জিয়া সরাসরি প্রত্যাখান করেননি। তবে গ্রহণ করেননি, সেটাই বড় সত্য। তাঁর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে 'প্রত্যাখান' শব্দটি নেই। এটি রাজনৈতিক সৌজন্য হতে পারে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সম্পর্কে 'জাতির আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়', 'অস্পষ্ট ধারণা' এবং 'জাতি হতাশ হয়েছে' বলে মন্তব্য করেছেন।

প্রধানন্ত্রীর সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার বিপরীতে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবটির মূল কথা হল, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক "সরকারের ২০ জন উপদেষ্টার মধ্য থেকে বর্তমান সরকারি দল ৫ জন ও বিরোধী দল ৫ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করবেন।" এঁরাই নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা হবেন এবং "সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিককে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হবে।"

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলন করে এলেও এই প্রস্তাবে দীর্ঘদিনের বা গভীর চিন্তাভাবনার কোনো লক্ষণ নেই।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি সম্পর্কে 'গ্রহণের চেয়ে প্রত্যাখান কঠিন' শিরোনামে আমি একটি পর্যালোচনা লিখে মতপ্রকাশ করেছিলাম যে, প্রস্তাবটি বিরোধী দলের নীতিগতভাবে গ্রহণ করে নিয়ে, নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী কে থাকবেন ইত্যাদি বিষয়গুলো উভয় পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় নিষ্পত্তি করা হলে দেশের মঙ্গল। সেদিন প্রবীণ আইনজীবী রফিকুল হক এবং সাবেক এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান প্রমুখ বিশিষ্ট নাগরিক সংবাদমাধ্যমের কাছে বলা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক অভিহিত করে বিএনপির সাড়া দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন।

আমার লেখায় ছিল, "বিএনপি যদি হঠকারিতা না করে তবে এই প্রস্তাব গ্রহণ তাদের জন্য প্রত্যাখানের চেয়ে সহজ পথ দেখাবে" এবং প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকার ভারসাম্য রেখে নির্বাচনকালে বিএনপির আকাক্ষিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই ভূমিকা পালন করতে পারবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সরে দাঁড়ালে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন অন্য একজন সাংসদের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব বলেও আশা প্রকাশ করেছিলাম।

আমরা বা দেশবাসী যা-ই আশা করি না কেন, সরকার ও বিরোধী দলের দুই মেরুর দুই প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আড়াই বছরের অচলাবস্থা যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল। রাজনৈতিক হানাহানি, রক্তারক্তি ও জবরদস্তির একতরফা নির্বাচনের আশংকাও রয়ে গেল। শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তা বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে যুক্তির পথে এগুতে পারলেই কেবল এ আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।

আমাদের জানা আছে যে, সরকারপক্ষ সংবিধানের মধ্যে থেকেই সমাধান চায়। অনির্বাচিত ব্যক্তি দ্বারা সরকার গঠন সংবিধানসম্মত নয়। এজন্যই ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছিল।

আবার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একই আইন সংসদ পাশ করতে পারে না। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক দাবি করলেও এই সাংবিধানিক প্রশ্নটির সমাধান গত আড়াই বছরে কখনও উচ্চারণ করেনি। বিএনপি এই প্রথম একটি লিখিত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিল। সেটা কেমন?

(১) প্রস্তাবটির প্রধান অসুবিধার দিক হল, এটা কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। একান্ত অপরিহার্য ও দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য ছাড়া বারবার সংবিধান সংশোধন অভিপ্রেত নয়। অতীতের বিশেষ দুটি সরকারের ২০ জন উপদেষ্টাকে ধারণ করার উপযোগী সাংবিধানিক বিধান তৈরি করা খুবই দুরূহ। কীভাবে তা সম্ভব সে প্রস্তাবও বিএনপির থাকা উচিত।

(২) প্রস্তাবে খালেদা জিয়া 'উপদেষ্টা' ও 'প্রধান উপদেষ্টা' শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তাঁদের 'নির্বাচিত করে দিতে' পারার জন্য সংসদ যেমন রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যদের নির্বাচিত করে সে রকম ব্যবস্থা সুপারিশ করেছেন।

অর্থাৎ সংসদ-সদস্যদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের কথা বলেছেন। তিনি সাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেই থাকলেন, শুধু সেটা নির্বাচিত দেখানোর একটা গোঁজামিল ধরনের পথ বাতলে দিলেন, যার জন্য সাময়িক প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

খালেদা জিয়া প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রতিবার তো সংবিধান সংশোধন করার আজগুবি কথা বলবেন না। তাই এই ইলেকটোরাল কলেজের বিধানটি কি ভবিষ্যতের জন্যও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থা হবে? তাহলে তো সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনমতোই প্রতিবার 'নির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার' হবে!

এবার না হয় ১৯৯৬-২০০১এর উপদেষ্টাদের কথা বলা হল, ভবিষ্যতে কী হবে?

(৩) ওই উপদেষ্টাদের সঙ্গে কোনো আলাপ না করেই খালেদা প্রস্তাব দিলেন। প্রকৃতপক্ষে দুই সরকারের উপদেষ্টা ২০ জন নন, ১৮ জন। কারণ ব্যরিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ ও মঞ্জুর ইলাহী দুই সরকারেই ছিলেন। ১৮ জনের মধ্যে ইশতিয়াক আহমেদসহ চারজন ইন্তেকাল করেছেন। অবশিষ্ট ১৪ জনের সকলেই প্রবীণ।

প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও এম. হাফিজউদ্দিন সোমবারই সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক নেতারা ডাকলে তাঁরা এ দায়িত্ব নেবেন না। হাফিজ সাহেব বলেছেন, তাঁর সাবেক সহকর্মীদের অনেকেই এ দায়িত্ব নেবেন না। কাজেই বিএনপি চেয়ারপারসন ও তাঁর রাজনৈতিক-সাচিবিক বিজ্ঞ সহায়তাকারীরা মোটেই প্রস্তুতি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে এই প্রস্তাব তৈরি করেননি।

(৪) প্রস্তাব অনুসারে সাবেক উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে বর্তমান সরকারি ও বিরোধী দল ৫ জন করে উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবেন। এই প্রস্তাব বিস্ময়কর, কারণ জ্ঞাতসারেই 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ' সরকারের অর্ধেক আওয়ামী লীগ ও অর্ধেক বিএনপি সমর্থিত! এখানেও দলীয়করণ ও দলীয় ভাগাভাগি!! তাহলে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার চাওয়ার অর্থ কী?

(৫) বিএনপি নেতারা যে প্রশ্নকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আসছেন, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, সে প্রসঙ্গে প্রস্তাব হচ্ছে 'সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিক'। আমাদের রাজনীতিবিদরা এই দুর্লভ ঐকমত্যে কীভাবে উপনীত হবেন তা একটি কোটি টাকার প্রশ্ন এবং প্রস্তাবেও এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিতমাত্র নেই।

খালেদা জিয়ার প্রস্তাবটি মেনে নিলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, কিন্তু তা করতে পারলেও প্রস্তাবটি কার্যকর করার মতো বাস্তবভিত্তিক কি-না সে আলোচনার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

তবে সরকারপক্ষ সমালোচনা করলেও প্রস্তাবটিকে পত্রপাঠ নাকচ করে দেয়নি। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের কথা বলছে এবং মঙ্গলবার প্রস্তাবের কপি দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দু'পক্ষের আলোচনায় বসার জন্য চিঠি পাঠালে দ্বিতীয়জন সঙ্গেহ সঙ্গেই পত্রদাতাকে ফোনে প্রাপ্তিস্বীকার করেছেন।

পত্রদাতার সংবাদ সম্মেলনে বসে থাকা অবস্থায় টিভি ক্যামেরার সামনে এই নাটকীয় ফোনালাপের ঘটনা দেশবাসী দেখেছে। আমাদের বিদেশি বন্ধুরাও সংলাপে নতুন করে উৎসাহ দিচ্ছেন। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়ম আনা এবং ওয়াশিংটন থেকে জাতিসংঘের উপমহাসচিব ফার্নানদেস তারানকো প্রমুখ যাঁরা দুই পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁরা বলেছেন– উভয় পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়াই ইতিবাচক অগ্রগতি; এখন সরাসরি কথা বলে সমাধান হোক।

উভয় পক্ষ এখনও স্ব স্ব অবস্থানে মূলগতভাবে অনড় থাকলেও, সংলাপে বসার বাস্তবতা এড়াতে পারছেন না। কারণ সংলাপ জনগণ চায়, বহির্বিশ্বও চায়। তাছাড়া সরাসরি সংঘাতে দু'দলের কেউই জিতবেন না– এটাও তাঁরা বুঝে গেছেন। এটা যুদ্ধক্ষেত্র নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতি। এখন সংলাপ এগুতে পারে কোন পথে?

দুটি প্রস্তাব সামনে রাখলে দেখা যায় যে, শেখ হাসিনা একান্তভাবে দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার চাচ্ছেন না, তিনি সংবিধান থেকে একচুলও নড়েননি, সংবিধানে থেকেই নির্বাচনকালীন একটি কার্যকর ভারসাম্যপূর্ণ প্রশাসন চাচ্ছেন। এ ধরনের সমাধান গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রকে আরও পূর্ণতা দেওয়ার সুযোগ রাখছে।

আর খালেদা জিয়া সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকার চাইছেন, অর্থাৎ তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। কিন্তু দুই বছর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না রেখে শেষ মুহূর্তে যা রাখলেন তা বাস্তবায়নের অযোগ্য এবং জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা তাতে নেই।

এখন যে কোনো সচেতন নাগরিকই তাঁর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, রাজনীতিবিদদের সংলাপ কোন পথে এগুনো উচিত।

মোজাম্মেল হোসেন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।