রামপাল অভিযোগনামা: পর্ব ২

বৃন্দলেখক
Published : 15 Oct 2013, 09:36 AM
Updated : 15 Oct 2013, 09:36 AM

সুন্দরবন ধ্বংস-সংক্রান্ত বিভ্রান্তি

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে অর্থাৎ কয়লা থেকে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে তা থেকে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। এই প্রচারণা শিরোধার্য করেই প্রধানত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরে বিভিন্ন সময়ে আরও বিভিন্ন ইস্যু (EIA আন্তর্জাতিকমানের নয়, জায়গা আগেই ঠিক করা ছিল, ভারতের গাইডলাইন ফলো করা হয়নি ইত্যাদি) এর সঙ্গে যোগ করা ও পরবর্তীতে এই আনুষঙ্গিক ইস্যুগুলোই মূখ্য করে তোলা হয়েছে।

যে কোনো সমস্যার গুরুত্ব বোঝাতে তার মূলে যাওয়াটা জরুরি, কার্যকারণ সামনে আনাও তেমনই। তা না করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টানাটানি করলে কিন্তু 'আদৌ' কোনো সমস্যা আছে কিনা সেই প্রশ্নটা অবশম্ভাবী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। তো চলুন মূল দাবি 'কয়লা থেকে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে' তা থেকে কীভাবে 'সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে' এটি আগে বিশ্লেষণ করি। তারপর যেসব আনুষঙ্গিক বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে তা না হয় দেখব।

মূল দাবির অংশ দুটো: ১) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, ২) সুন্দরবন ধ্বংস হওয়া। প্রথমটির জন্য পরেরটি ঘটবে। প্রথমটি কার্যকারণ (Cause) এবং পরেরটি পরিণতি (Effect)। খুবই ক্লাসিক একটি গবেষণা-পরিস্থিতি।

অনেকভাবেই কার্যকারণিক পরিণতি (causal effect) প্রমাণের চেষ্টা করা যেতে পারে।

পদ্ধতি-১ (তত্ত্ব প্রমাণে উপাত্তের ব্যবহার)-– কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে কী কী দূষণ ঘটে তার তালিকা করা। ১৪ কিমি দূরে ওইসব দূষণের মাত্রা নিরূপণ করা। ম্যানগ্রুভ ফরেস্ট ওইসব দূষণের কারণে কী ধরনের হুমকিতে পড়ে তা এক্সট্রাপুলেট করা। সবশেষে সেই এক্সট্রাপুলেটের অর্থ যে নিশ্চিত ধ্বংস সেটা এসটাবলিশ করা।

পদ্ধতি-২ (উপাত্ত থেকে তত্ত্ব নির্মাণ)-– পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ম্যানগ্রুভ ফরেস্ট ধ্বংস হয়েছে। সেইসব ধ্বংসের কারণ অনুসন্ধান করে দেখানো যে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কারণে কত দ্রুত সেসব রামপাল ছাড়িয়ে, বাফার জোন ছাড়িয়ে সুন্দরবন স্পর্শ করবে এবং ওইসব ধ্বংসপ্রাপ্ত ম্যানগ্রুভ ফরেস্টের মতো সুন্দরবনও ধ্বংসের মুখে পড়বে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই দুটি লাইনের কোনো একটিতেও সুন্দরবন ধ্বংসের দাবিদাররা হাঁটছেন না। সুন্দরবন ধ্বংসের দাবি করে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন তো আছেনই। দাবি করলে যে প্রমাণের দায় দাবিকারীর উপরে বর্তায়, আর প্রমাণ করতে না পারলে যে দাবিটার আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না সেটা ভুলে গেলে কি চলবে?

আসুন একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক, সমস্যাটা কোথায়।

কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্টের দূষণ মূলত দুই প্রকার: ১) বায়ুদূষণ, ২) পানিদূষণ।

বায়ুদুষণের জন্য দায়ী কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড।
সালফার-ডাই-অক্সাইডের ছড়িয়ে পড়াটা ঘটে নিচের চিত্রের মতো করে–

তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৪-১৫ কিমি দূরত্ব অতিক্রমের পর যে পরিমাণ সালফার-ডাই-অক্সাইড সুন্দরবনে পৌঁছুবে তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও অনেক নিচে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটা আরও কমিয়ে আনাও সম্ভব।

নাইট্রোজেনের অক্সাইড বিদ্যুৎ উৎপাদনকালে আরও কম পরিমাণে উৎপন্ন হয় বলে এটা সুন্দরবনে পৌঁছুনোর আরও আগেই (সাড়ে চার কিলোমিটার পরেই) গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নেমে আসবে। দেখুন–

অতএব দেখা যাচ্ছে SOx ও NOx রামপাল থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সুন্দরবনে পৌঁছুনোর অনেক আগেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে নেমে আসবে। যেহেতু ম্যানগ্রুভ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের জন্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাই সুন্দরবন ধ্বংসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা সম্পূর্ণ অমূলক।

এ ক্ষেত্রে আসে এসিড বৃষ্টির ধারণা যেটি আসলে কেমিস্ট্রি সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাব থেকে তৈরি হওয়া। এসিড বৃষ্টির সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কোনো সম্পর্কই নেই। এ ব্যাপারে "রামপালঃ কিছু অভিযোগ, কিছু উত্তর" শিরোনামে লিখেছি বিধায় আর এখানে বলছি না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রথম পদ্ধতি ব্যবহার করে সুন্দরবনের ধ্বংস হওয়া প্রমাণ করাটা আসলেই বেশ কঠিন। মোটামুটি অসম্ভবই। স্বাভাবিক মাত্রার বায়ুদূষণে যদি বনের গাছপালার ক্ষতিই হবে তাহলে সেই মাত্রার নাম স্বাভাবিক হয় কী করে?

এখানে কথিত সংবেদনশীল স্থান (পড়ুন সুন্দরবন) থেকে ১০ কিমি বনাম ২৫ কিমি নিরাপদ দূরত্ব নিয়ে কিছু কথা বলাটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ভারতে কোনো কোনো গাইডলাইনে ২৫ কিমি দূরত্বে স্থান নির্বাচনের 'উপদেশ' দেওয়া দেখে কেউ কেউ এদেশেও সেটা করার জন্য তাগাদা দেন। এটা করা কতটা জরুরি?

উপরের চিত্র দুটি দেখলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে উৎসের থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে গেলেই গ্রহণযোগ্য নিরাপদ মানেরও অর্ধেক বা তার কাছাকাছিতে নেমে আসে দূষণের মাত্রা। এটা কি যথেষ্ট নিরাপত্তা নয়? তা যদি মনে না করে আরও ১৫ কিলোমিটার দূরে যেতে চানই, কী এমন নিরাপত্তা বাড়বে, ভেবে বলুন তো?

দূরে গিয়ে অহেতুক নিরাপত্তা বাড়ানোর বিলাসিতা বড় দেশের জন্য বাস্তবসম্মত হলেও হতে পারে, কিন্তু ভারতের চেয়ে আয়তনে ২৩ গুণ ছোট আর জনসংখ্যার ঘনত্বে প্রায় আড়াই গুণ বেশি চাপে থাকা একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তা জন্যে নিতান্তই একটি অযৌক্তিক বাহুল্য বিষয়।

গ্যাস ডিসপারশন কীভাবে ঘটে আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন–

আসি একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিঃসরিত বর্জ্য দ্বারা কী কী ভাবে পানিদূষণ হতে পারে সে ব্যাপারে। হুম, ব্যাপারটি একটু ঝামেলার বটে। আসলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে নিঃসরিত পানির চেয়ে কয়লাচালিত পাওয়ার প্ল্যান্টের থেকে বের হওয়া পানির কোয়ালিটির কোনো পার্থক্য নেই, দুটোই বিশুদ্ধ।

পাম্প দিয়ে পানি টানা হয়, কয়লা জ্বালিয়ে তাপ উৎপন্ন করা হয়ে, সেই তাপে পানি বাস্পীভূত হয়ে যে হিউজ প্রেসার তৈরি হয় তা দিয়ে টারবাইন জেনারেটর ঘোরে আর উৎপন্ন হয় বিদ্যুৎ; অন্যদিকে বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বিশুদ্ধ পানিতে পরিণত হয় যা আবার বয়লারে পাঠানো হয় বাস্পীভূত হওয়ার জন্যে।

পুরো পদ্ধতিতে অন্য কোনো জটিল কেমিক্যালস ব্যবহার হয় না, তাই দূষিত পানির চিন্তা নিতান্তই অমূলক। এছাড়া সার কারখানা বা ঔষধ কারখানার মতো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারকারী প্ল্যান্টগুলো থেকেই যেখানে কোনো পানি বা অন্য কোনো তরল যে কোনো নিঃসরণ এখনকার সময়ে প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার, সেখানে বিদ্যুৎ কারখানা থেকে পানিদূষণের দুশ্চিন্তার বিষয়টি আরও কয়েকবার ভেবে নিয়ে বিচার-বিবেচনার ভার পাঠকদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

তার উপর আছে বর্তমান সময়ের উন্নত সব পানি শোধনের টেকনিক। পানিদূষণের সামান্যতম যে সম্ভাবনা আছে তা ডিসচার্জ ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দূর করা হবে। রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে ছোট আকারের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও তৈরি করা হবে।

এবার আসি দ্বিতীয় পদ্ধতির বিষয়ে অর্থাৎ উপাত্ত থেকে তত্ত্ব নির্মাণ করে সুন্দরবন যে ধ্বংস হবে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে সেই ব্যাপারে। প্রথমেই দেখে নিই ম্যানগ্রুভ ফরেস্ট কী কী কারণে ধ্বংস হয়।

ম্যানগ্রুভ ফরেস্ট ধ্বংসের এখন পর্যন্ত জানা কারণগুলো এ রকম–

১) অধিক মৎস্য আহরণ, ২) সৌর-বিকিরণ, ৩) গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে ওয়াটার লেভেল বেড়ে যাওয়া ৪) বাষ্পীভবনে হেরফের, ৫) লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ৬) পুষ্টি সরবরাহ হ্রাস, ৭) বৃক্ষনিধন ও পোড়ানোতে ব্যবহার, ৮) চাষাবাদে বনের জমি ব্যবহার, ৯) নগরায়ন, ১০) খনি থেকে পেট্রোলিয়াম নিঃসরণজনিত দূষণ।

সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত পাওয়ার প্ল্যান্টের কারণে বন ধ্বংসকারী এই দশটি কারণের কোন কোনটি ত্বরান্বিত হবে বলে মনে হয়? একটাও নয়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে জাহাজ চলাচলে কোনো ক্ষতি হবে কিনা। যে পশুর নদ দিয়ে এই জাহাজ চলাচল করবে তা তো গত ষাট বছর ধরে এই জাহাজ চলাচলের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

যদি কোনো ক্ষতি হয়েই থাকে, সেটার সঙ্গে সুন্দরবন অ্যাডপ্ট করে নিয়েই বেঁচে আছে, একটি বা দুটি অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল নতুন করে কোনো সমস্যা তৈরি করছে না বনের জন্যে। আর যদি অতিরিক্ত দু-চারটা জাহাজ চলাচলের কারণে ক্ষতির কথা চিন্তা করতে হয় তাহলে পশুর নদের পাড়ের কোনো জায়গাতেই এই কেন্দ্র তৈরির কথা চিন্তা করা যাবে না।

আর সে ক্ষত্রে সুন্দরবনকে আরও নিরাপদ করার জন্য মংলা বন্দর বন্ধ করে দিতে হবে। মংলা বন্দর বন্ধ করার চিন্তা করাই যায়। সে ক্ষেত্রে জাহাজের হাত থেকে বনকে হয়তো বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু বন্দর বন্ধ হয়ে গেলে যে পরিমাণ বেকারত্ব, কর্মহীনতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হবে এবং তা কাটাতে বনের উপর যে চাপ পড়বে তা থেকে বন বাঁচাবে কে?

সুন্দরবন ধ্বংস নিয়ে এতসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য মূলত এটা দেখানো যে এই দাবিটি একটা জনপ্রিয় শ্লোগান হিসেবে তুলে ধরতে যে পরিমাণ শ্রম-মেধা ব্যয় করা হয়েছে তার ন্যুনতম অংশও ব্যয় করা হয়নি দাবিটি প্রমাণ করার জন্য। কেন হয়নি?

সম্ভবত রামপালের বিরোধীরা নিজেরা খুব ভালো করেই বুঝেছেন যে দাবিটা কতটা অযৌক্তিক, ছেলেভুলানো। আর তাই অনেককেই আজকাল এই দাবি না করে অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় সামনে নিয়ে আসতে দেখি। বিশাল এক প্রতিবাদ শেষ করার সময় একজন লেখক এটা মাত্র একবার বলেন, তাও অন্যের রেফারেন্সে, এভাবে, "যে প্রকল্পের ফলে সুন্দরবন ধ্বংস হবে বলে সারা দেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে…।"

এখন আসি মূল দাবি 'সুন্দরবন ধ্বংস'-এর সঙ্গে সাপ্লিমেন্টাল হিসেবে বিভিন্ন সময়ে অন্য যেসব বিভিন্ন ইস্যু এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সেই ব্যাপারে। সেই দাবিগুলো এই ধ্বংস-তত্বকে কতটা যুক্তিযুক্ত ও শক্ত করেছে আর কতটা অযৌক্তিক ও দুর্বল করেছে-– তা বোঝার জন্য কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

নিচের ঘটনা দুটি দেখুন–

ঘটনা-১:

ভালো লাগছে না।
(কেন) শরীর খারাপ।
(কী হয়েছে?) জ্বর এসেছে।
(কতটা?) ১০৪ ডিগ্রি
(এবং?) শীতে কাঁপছি
(আরও কিছু??) গায়ে ব্যথাও আছে, নাক বন্ধ, গলা খুশ খুশ করছে…… ইত্যাদি।

ঘটনা-২:

ভালো লাগছে না
(কেন) শরীর খারাপ।
(এবং) কাজের লোক আসেনি।
(এবং) কাল হরতাল।
(এবং) উইকএন্ড বাতিল হয়ে গেছে, ওইদিন অফিসে যেতে হবে।
(এবং) ইলেকট্রিসিটি তো থাকেই না, জিনিসপত্রের দাম বেশি …… ইত্যাদি।

প্রথম ঘটনায় নতুন তথ্য দিয়ে মূল সমস্যাটা (শরীর খারাপ) আরও পরিষ্কার, সুনির্দিষ্ট ও প্রকট করার মধ্য দিয়ে বোধগম্য করতে দেখা যাচ্ছে যে শরীর আসলেই খারাপ ও কতটা খারাপ। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় ইনকোহেরেন্ট কিছু সমস্যা-সংশ্লিষ্ট কথা তোলায় মূল সমস্যাটা ঠিক কী তা যেমন আর বোঝা যাচ্ছে না, একইভাবে মূল সমস্যা বুঝানোর প্রচেষ্টা হালকা হয়ে যাচ্ছে।

এবার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধীদের সে রকমই কিছু সুনির্দিষ্ট সাপ্লিমেন্টারি কিন্তু ইঙ্কোহেরেন্ট আপত্তির/যুক্তির ব্যাপারে আলোকপাত করছি।

প্রথম আপত্তি:

যেহেতু সুন্দরবন পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এলাকা, এখানকার গ্রহণযোগ্য দূষণমাত্রা নির্ধারণের জন্য 'আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা নয়', 'সেনসিটিভ বা সংবেদনশীল' এলাকার নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য দূষণমাত্রা প্রযোজ্য।

মতামত:

The Environment Conservation Rules, 1997-এর সেকশন ৩ অনুযায়ী বারো ধরনের ফ্যাক্টর গণ্য করে একটি স্থানকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ECA) বা প্রতিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এই ফ্যাক্টরসমূহের মধ্যে অন্তত পাঁচটি সুন্দরবনকে ECA-র যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।

দেখুন এখানে–

আবার ওই আইনের সিডিউল-২ অনুসারে 'সেনসিটিভ বা সংবেদনশীল' স্থানসমূহের জন্য বায়ুদূষণের গ্রহণযোগ্য সীমার উল্লেখ আছে। সুন্দরবনের জন্য এই 'সংবেদনশীল' স্থানের নির্ধারিত মান সরাসরি পেতে হলে এককভাবে ECA হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, সংবেদনশীল স্থানের শর্তও পূরণ করা জরুরি।

উপরোল্লিখিত সিডিউল-২ তে সংবেদনশীল স্থানের যে বর্ণনা আছে তাতে জাতীয় পর্যায়ের সৌধ্, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, পুরাকীর্তি-সম্বলিত স্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার-নির্দেশিত অন্য কোনো স্থান অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

প্রশ্ন হল, সুন্দরবনকে কি এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে? না, হয়নি। শুধু সুন্দরবনই নয়, ECA হবার যোগ্য আরও অন্তত চারটি ফ্যাক্টর পরিবেশগতভাবে 'স্পর্শকাতর' গণ্য হলেও তারা 'সংবেদনশীল' হিসেবে গণ্য হয়নি। কেবল দুই ধরনের ECA (সৌধ ও পুরাকীর্তি) কে সরাসরি সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ECA–র বাইরে আরও তিন ধরনের স্থাপনাকে সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

সুন্দরবনকে সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য হতে গেলে একমাত্র উপায় হল, সিডিউল-২-এর নোট (১) অনুযায়ী পৃথক স্বীকৃতি প্রাপ্তি। যেহেতু সে রকম কোনো স্বীকৃতি EIA তৈরির সময় ছিল না, আইনানুযায়ী EIA প্রস্তুতকারীদের সুন্দরবনকে সংবেদনশীল গণ্য করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

কেবলমাত্র দুই প্রকারের ECA স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেনসিটিভ বলে বিবেচিত হওয়ায় একথা আরও নিশ্চিত করে যে বাকি ECA সমূহকে পদ্ধতিগতভাবে সেনসিটিভ হতে হবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে নয়।

এখন সমস্যা হল, সুন্দরবনের জন্য প্রযোজ্য গ্রহণযোগ্য দূষণমাত্রা নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? সিডিউল-২-এ যে শ্রেণিবিভাগ আছে সেখানে বনাঞ্চল, অভয়ারণ্য, জলাভূমি, ম্যানগ্রুভ, বন্যপ্রাণির বিচরণক্ষেত্র ইত্যাদির জন্য কোনো দূষণমাত্রার উল্লেখ নেই। সেখানে সবচেয়ে রক্ষণশীল মানটি দেওয়া আছে সেনসিটিভ বা সংবেদনশীল স্থানের জন্য — যেটার শর্ত সুন্দরবন পুরণ করে না।

আবার দ্বিতীয় রক্ষণশীল মানটি দেওয়া আছে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকার জন্য। সুন্দরবন তো আক্ষরিক অর্থে তাও নয়। এই অবস্থায় মান প্রদানকারীরগণের জাজমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে পারতেন এবং সংবেদনশীল স্থানের মান ব্যবহার করতে পারতেন। তবে না করায় তাদের কোনো অন্যায় হয়নি।

জাজমেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধরা যাক তারা SOx নিয়ে বিবেচনা করছেন। এটা সর্বজনবিদিত যে SOx-এর তারতম্যে শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। সংবেদনশীল স্থান হিসেবে যে স্থানগুলোর উল্লেখ আছে ওইগুলির মধ্যে SOx এর কারণে সৌধ ও পুরাকীর্তির ক্ষেত্রে সৌন্দর্যহানির বিষয়টা বোধগম্য।

অন্যগুলির ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টে ভোগা সংবেদনশীল মানুষ তুলনামূলকভাবে উচ্চতর হারে পাওয়া বেশ স্বাভাবিক। যারা অ্যাজমাটিক নন তাদের এই মাত্রার তারতম্যে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। বৃক্ষের ক্ষেত্রে এই তারতম্যের কি কোনো প্রভাব আছে? থাকার বিষয়টি প্রমাণ করা গেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আপত্তি কোথায়? কিন্তু প্রমাণটা তো আগে চাই।

EIA প্রস্তুতকারী টিমে যে বিশেষজ্ঞগণ আছেন তারা বলছেন চারমাস SOx ৫৩ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিক মিটারে থাকলে কোনো সমস্যা নেই। EIA যারা অনুমোদন করবেন তারাও বিশেষজ্ঞ। তাদের তো সুযোগ থাকছেই ওই EIA টিমের প্রদত্ত বক্তব্য খণ্ডনের। এমনকি ওটা ৫৩ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামানোর, যদি ওই যুক্তি তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়। যতদূর বোঝা যায় এটা বন, উদ্ভিদ ও উদ্যান বিশেষজ্ঞদের চর্চাক্ষেত্র।

এখানে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বা ইকোনমিস্ট মিলে রায় দিয়ে দেবেন এই বলে যে ''এই টানা চারমাস ধরে শুষ্ক মৌসুমে সালফার ও নাইট্রোজেনসহ বিষাক্ত গ্যাস একটানা সুন্দরবন অঞ্চলে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি থাকবে বলে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এই চার মাসই যথেষ্ট" আর তা সবার জন্য শিরোধার্য হয়ে যাবে– এটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিনই। আর তাছাড়া সুন্দরবনের জন্য অনুমোদিত মাত্রাটা কী? সেটা তিনি কোথায় পেলেন? তাও তো জানা দরকার।

প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে, লক্ষ বছরের পুরনো ৬০০০ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন যে মাত্র ২৩ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিকমিটার SOx এর তারতম্য সহ্য করতে না পেরে মাত্র চারমাসেই 'পরিবেশ বিপর্যয়ের' মধ্যে পড়ে যাবে, এ তথ্যই-বা উনি পেলেন কোথায়? সুন্দরবন যদি এতই সংবেদনশীল হয়, সে তথ্য তো আরও অনেক আগেই অন্যদের জানা উচিৎ ছিল। কিন্তু আর কেউ তা জানে না কেন?

এটা কি তাহলে আরেকটা অতিরঞ্জিত দাবি, গুণমুগ্ধদের কেবলই আবেগে সিক্ত করার লক্ষ্যে?

দ্বিতীয় আপত্তি:

খুলনা মহানগর রামপাল প্রকল্পের মাত্র ২৩ কিমি উত্তরে। বছরে ৮-৯ মাস প্রকল্প থেকে দখিনা বাতাসে দূষিত বায়ু বাহিত হয়ে এই শহরের বাসিন্দাগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

মতামত:

রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকার নিকটে সীমান্ত থেকে ১২-১৪ কিমি দূরত্বে ভারতে কমপক্ষে দুটি কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট অবস্থিত যেগুলির ক্যাপাসিটি সম্মিলিতভাবে ২৭০০ মেগাওয়াট। উভয় পাওয়ার প্ল্যান্ট হতে ওই দুটি জেলা শহরের দূরত্ব ৩০-৩৫ কিমি।

সীমান্ত থেকে এই জেলা শহর দুটির ১৫-২০ কিমির মধ্যে যে বাংলাদেশি বাসিন্দাগণের বাস তারা ওই দুটি পাওয়ার প্লান্টের জন্য কী ধরনের বায়ুদূষণের সম্মুখীন হন? সম্ভবত তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। যদি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দূষণের সম্মুখীন তারা হতেন, এতদিন তা কারও অজানা থাকত না। আর আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা নিশ্চয়ই ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ সম্পর্কে আমরা অবগত নই।

রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে খুলনা ও বাগেরহাট জেলা শহরের 'কথিত' দূষণও এর বাইরে কিছু হবে না বলেই অনুমিত হয়। সোজা ভাষায় এখানে আমরা যেটাকে 'গ্রহণযোগ্য মাত্রা' বলে উল্লেখ করেছি তার মধ্যেই থাকবে।

তৃতীয় আপত্তি:

২০১০ সালে জমি অধিগ্রহণ করে তা ২০১২ সাল বলে চালানো হচ্ছে।

মতামত:

এখানে আপত্তিটি আসলে কী তা বুঝাই বেশ জটিল ছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত বুঝা গেল যে সমস্যা আসলে জমির উপর অধিকার বা 'অধিগ্রহণ' ও হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা এবং সেই কনফিউশনের কারণেই এই আপত্তির জন্ম।

জমির উপর অধিকার স্থাপন বা অধিগ্রহণ এবং জমির দখল নেওয়া এই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ছাড়পত্র চেয়ে অ্যাপ্লিকেশনে IEE রিপোর্টের সঙ্গে ভূমি অধিকারের সত্যতাপত্র বা "Proof of land Ownership" সরবরাহ করতে হয়। এটি একটি "Legal Requirement for IEE/EIA application for site/environmental clearance" এবং সব দেশের জন্যেই এটি প্রযোজ্য।

কোনো জায়গায় কাজ করার ছাড়পত্র চেয়ে আবেদন করতে গেলে ওই জায়গায় কাজ করার অধিকার আসলেই কর্তৃপক্ষের আছে কিনা সে বিষয়টি ভূমিমালিকদের সঙ্গে আগেই সুরাহা করে নিতে হয় এবং IEE ক্লিয়ারেন্সের জন্যে আবেদনপত্রের সঙ্গে "Proof of land ownership" দাখিলও বাধ্যতামূলক। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ছাড়পত্র পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভূমির অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা যায় না, অর্থাৎ জমি হস্তান্তর করা যায় না বা জমির দখলও নেওয়া যায় না।

২০১০ সালে যখন রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ছাড়পত্র চেয়ে আবেদন করা হয় তখন IEE রিপোর্টের সঙ্গে legal requirement হিসেবে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে প্রাপ্ত দাগ নাম্বার ও জমির মালিকদের তালিকাসহ take over certificate দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু IEE রিপোর্টের ভিত্তিতে ছাড়পত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন বা জমি হস্তান্তর করা হয়নি। ২০১১ সালের মে মাসে "Location Clearance" পাওয়ার পরই ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়।

জেলা প্রশাসন ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কবে থেকে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বা চলছে? তারা বলবেন ২০১০ থেকে। এখন এটা শুনে কেউ যদি মনে করেন, ২০১০-এ জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়ে গেছে, এটা তার সমস্যা, প্রকল্প প্রস্তাবকারীর নয়। নিচের দখল হস্তান্তর দলিলে (EIA রিপোর্টে সংযুক্ত) এই অধিগ্রহণ সম্পর্কিত কনফিউশনটি আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা করছি–

এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত যে ফেব্রুয়ারি ১, ২০১২ তে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সচিবের প্রতিনিধির কাছে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির দখল হস্তান্তর করা হয়।

চতুর্থ আপত্তি:

পরিবেশ ছাড়পত্র পাবার আগেই জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে।

মতামত:

প্রথমেই দেখে নিই জলাভূমির সংজ্ঞা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ধারা-২ অনুযায়ী জলাভূমির সংজ্ঞা নিম্নরূপ–

EIA র পৃষ্ঠা ৮৬ তে ভরাট সম্পর্কে পরিকল্পনার কথা লেখা আছে। সেখানে ভূমি ৫ মিটার উঁচু করার ও 'জলাভূমি' ভরাট 'না' করার কথাও স্পষ্টভাবে বলা আছে। আশি লক্ষ কিউবিক মিটার মাটি দিয়ে ৪২০ একর 'জমি' ভরাটের কথা উল্লেখ করা আছে।

এই 'জমি' ভরাটের সঙ্গে অবস্থানগত ছাড়পত্রে উল্লেখ করা 'জলাভূমি' ভরাটের কী সম্পর্ক, সেটা একেবারেই বোঝা গেল না। তাছাড়া জমির বর্তমান কাস্টডিয়ান, পিডিবি নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক এত বিশাল জমি-ভরাট কার্যক্রম নিশ্চয়ই গোপনে করছেন না। সে ক্ষেত্রে EIA তে উল্লেখ করা পরিকল্পনা লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা এমন কঠিন কিছু নয়।

তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী? ব্যাপার হল এখানে 'জমি' উঁচু করার কাজ চলেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ছাড়পত্রে উল্লিখিত 'জলাভূমি' ভরাট না করার আদেশের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে দাবি করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হচ্ছে?

উপরের ছবিতে প্ল্যান্টের জমি ও লে-আউট দেওয়া আছে যা ভরাট করার কথা। ঠিক কোন কোন অংশ 'জলাভূমি'র সংজ্ঞা পুরনো করে যা ভরাট করলে অবস্থানগত ছাড়পত্রে উল্লেখ করা 'চ' ও 'ছ' নং শর্ত ভঙ্গ হয়, অনেক চেষ্টা করেও তা বের করতে পারলাম না।

তবে কি জলাভুমি ভরাটের এই অভিযোগও আরেকটা মনগড়া বিষয়? প্রতিবাদকারীরা একবার বলেন এই রামপাল কৃষিজমি; এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। আবার কখনও বলেন চিংড়ির ঘের। আবার এখন শুনছি রামপালে নাকি 'জলাভূমি' ভরাট হয়ে গেছে। এটা কি আপাতত কাজ বন্ধ রাখার বা প্রকল্প স্থগিত করতে চাপসৃষ্টিতে আবেগ-জাগানিয়া আরেকটা অপচেষ্টা? বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।

কিছু মনগড়া বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ:

"পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় ভারতে তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রস্তাব প্রত্যাখান করা হয়" –- এটা হল সবচেয়ে জনপ্রিয় মনগড়া দাবি। যে তিনটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যাপারে এই মনগড়া দাবিটা করা হয় তার একটি অধিক সুবিধাজনক বিকল্প স্থানে প্রস্তাবকারীর উদ্যোগে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

এই সম্পর্কিত প্রস্তাব প্রত্যাখানের দাবি শুনে মনে হয় যে তাদের প্রস্তাব গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ঘটনা মোটেও তা নয়। মূল অবস্থানের মিটিগেশন প্ল্যানের করণীয়সহ টোটাল কস্ট তুলনামূলকভাবে বেশি অনুভূত হওয়ায় তারাই উদ্যোগী হয়ে বিকল্প অবস্থানে প্রকল্পটি স্থানান্তর করে।

কর্ণাটকের প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল রাজ্য সরকার। দো-ফসলি জমি ব্যবহৃত হওয়া এবং বিদ্যুৎ বণ্টনে অব্যবস্থাপনা– জনগণের এ জাতীয় দাবির মুখে রাজ্য সরকারই গো-স্লো নীতি অবলম্বন করেছে। প্রথমত, তা বাতিল করার দাবিটি মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, রিজার্ভ ফরেস্ট জাতীয় পরিবেশের কারণটিও এখানে মিথ্যা।

তৃতীয় প্রকল্পটি পরিবেশ আদালত স্থগিত করে রেখেছে নিকটস্থ আরেকটি কেমিক্যাল প্ল্যান্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বাড়তি ঝুঁকি আছে কিনা সেটা নির্ধারণজনিত সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এটাও বাতিলের দাবিটি মিথ্যা। রিজার্ভ ফরেস্ট জাতীয় পরিবেশের কারণ উল্লেখও মিথ্যা।

এইসব মিথ্যাচারের পাশাপাশি যত্রতত্র অপ্রয়োজনে আতঙ্ক ছড়ানোর প্রচেষ্টা সম্বলিত শব্দচয়ন কোনো সদিচ্ছা প্রণোদিত হয়ে করা হচ্ছে, সেটাও পরিষ্কার করা উচিত। এই রকম কিছু শব্দ হল: সুন্দরবন ধ্বংস, পরিবেশ বিপর্যয়, বিষাক্ত বাতাস, বিষাক্ত গ্যাস, বিষাক্ত ভারী ধাতু, বিষাক্ত ছাই, বিষাক্ত পানি ইত্যাদি।

মুখে বললেই কোনো কিছু বিষাক্ত হয়ে যায় না। সেজন্য টক্সিক লিমিট অতিক্রম করা লাগে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করলে যে বিষক্রিয়া হয় তাকে 'ডিলুশনাল হাইপোনাট্রেমিয়া' বলে। পানি পানজনিত এই বিষক্রিয়ার জন্য পানি দায়ী নয়, দায়ী পানের মাত্রাধিক্য। আবার আর্সেনিক যে বিষ, তা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু পানিতে তার পরিমাণ যতক্ষণ ৫০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার-এর কম থাকে, এটা কোনো বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম নয়। তাহলে ওই সময়ে তাকে বিষাক্ত বলা যাবে কোন বিচারে?

যতদূর তথ্য পাওয়া যায় তা পর্যালোচনা করে এই মত দেওয়া যায় যে প্ল্যান্ট থেকে উৎপন্ন, নির্গত, উদগীরিত যাবতীয় বাতাস, গ্যাস, ধাতু, ছাই, পানি ইত্যাদির মাত্রা যেন টক্সিক লিমিট অতিক্রম না করে তা কঠোরভাবে নিশ্চিতের সকল দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সবকিছু পুরোপুরি না জেনে বিষাক্ত-বিষাক্ত, ধ্বংস-ধ্বংস বলে আতংক ছড়ানো কার কল্যাণে?

আরও নানান অভিযোগের উপরে আলোকপাত করে হাজির হব শিগগিরই আবার। আপনাদের উৎসবের দিনগুলো হোক নিরাপদ ও আনন্দময়। সবাইকে ঈদুল আযহা এবং দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।


ড. আঞ্জুমান ইসলাম:
পানি পরিশোধন ও পরিবেশ প্রকৌশলী।

কাজী আহমেদ পারভেজ: শিক্ষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।