রামপাল অভিযোগনামা: পর্ব ১

বৃন্দলেখক
Published : 11 Oct 2013, 08:44 PM
Updated : 11 Oct 2013, 08:44 PM

রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত আমার দুটি আর্টিকেলের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু মতামত এসেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষ সুন্দরবন অঞ্চলে সম্ভাব্য পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করছেন। তাই এটি নিযে ব্যাপক আলোচনা হওয়া জরুরি। তবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত না করে সঠিক তথ্য জানানোর জন্য আমরা প্রকৃত চিত্রটি দেখাতে চাই। সে জন্য চারটি পর্বে আমরা বিভিন্ন অভিযোগ ও প্রকৃত তথ্যের ফারাক তুলে ধরব।

ইআইএ-সংক্রান্ত বিভ্রান্তি

অভিযোগ ১

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি বলা হচ্ছে তা হল এই যে, প্রকল্পে নিচের ছবির সিকোয়েন্সটি মানা হয়নি।

আসুন দেখি আসলে কী ঘটনা। দেখুন কোন তারিখে কী ঘটেছে।

সুতরাং এটি স্পষ্ট যে এখানে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। এ জন্যই উচ্চ আদালতে তাদের অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ ২

আমার বক্তব্য "প্রস্তাবিত কতিপয় স্থানের মধ্যে থেকে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইনিশিয়াল এনভায়রেনটাল এক্সামিনেশন (IEE)-এর ভিত্তিতে কোনো একটি জায়গার ব্যাপারে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়। ফারদার এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) প্রয়োজন কিনা আর যদি প্রয়োজন হয় তার (TOR) কী হবে এর ভিত্তিতে তখন EIA প্রস্তুত করা হয়" … এটি সঠিক নয়।

এর জন্য মোহাম্মদ আবদুস সোবহান (এডিশানাল ডিরেক্টর জেনারেল, ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রেনমেন্ট)-এর বরাত দিয়ে www.aecen.org নামের একটি ওয়েবসাইটের একটি প্রেজেন্টেশনের লিঙ্ক দেখানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জনাব মোহম্মদ আবদুস সোবহান জানিয়েছেন, তিনি এই প্রেজেন্টেশন বা এই ধরনের কোনো প্রেজেন্টেশন সম্পর্কে কিছু জানেন না এবং এটি উনার নয়।

প্রথমত আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে যে কেউ যে কারও নাম দিয়ে যা কিছু প্রকাশ করতে পারে। তাই সব রেসপনসিবল মানুষের প্রতি অনুরোধ থাকবে, যে কোনো জায়গায় কিছু পেলেই যাচাই-বাছাই না করে তার উপর ভিত্তি করে বক্তব্য প্রকাশ না করতে।

সাইট ক্লিয়ারেন্স ও এনভায়রেনমেন্ট ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে কোন ধাপের পর কোন ধাপ আসে সে বিষয়ে জনাব আবদুস সোবহান নিজে এবং ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট (DOE) থেকে আবারও জানানো হয়েছে–

"The sequence to get both site and environmental clearance is: Do IEE, get site clearance and TOR, finish EIA, get environmental clearance"

এরপরেই প্রজেক্ট কন্সট্রাকশন ফেইজে যায় এবং শুরু হয় প্রজেক্ট ডিজাইন। ডিজাইনের সময় EIA রিপোর্টের সমস্ত বিষয় আমলে নিয়ে কাজ শুরু হয়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পাওয়া EIA রিপোর্টটি পরবর্তী কাজের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। তাই ছাড়পত্র দেওয়ার আগে DOE এটা নিশ্চিত করে যে ওই লোকেশনে প্রজেক্টটি নির্মাণের আগে যেন কোনোক্রমেই কোনো বিষয় চোখ এড়িয়ে না যায়।

খুবই দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে ইদানিং কোনো একটি পক্ষ যদি কোনো বিষয়ের বিরোধী হয় তাহলে যেভাবে নানান ধরনের twisted, অর্ধসত্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই কালচারটি দিন দিন ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হচ্ছে। কীভাবে এটা বন্ধ হবে আমি জানি না।

দ্বিতীয়ত, রেফারেন্সটি যে মিথ্যে তা তো বুঝা গেল, কিন্তু তারপরও কথা থাকে। ড. তানভীর না হয় বুঝে উঠতে পারেননি যে প্রেজেন্টেশনটি ভুল। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুর ব্যাপারে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি লেখায় শুধুমাত্র একটি বিশেষ প্রেজেন্টেশনের রেফারেন্স ব্যবহার কতটা সঙ্গত?

ওই প্রেজেন্টেশনের বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ মেনে নেওয়ার নির্ভরতা ড. তানভীর ইসলামের লেখার প্রধান দুর্বলতা। প্রেজেন্টেশনের একই সিরিয়ালে IEE এবং EIA দেওয়া আছে বলে ওই দুটি একসঙ্গে দেওয়া বাধ্যতামূলক, এটা ধরে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক?

FAO ওয়েবসাইটে IEE কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে–

Initial Environmental Examination (IEE): A preliminary attempt to evaluate environmental impacts in order to determine whether a full-scale environmental impact assessment is needed. Also called Initial Environmental Investigation (IEI), partial EIA or "Preliminary EIA".

দেখুন–

ড. সেলিম মমতাজ ও এস. এম যোবায়দুল কাদেরের লেখা "Evaluating Environmental and Social Impact Assessment in Developing Countries" গ্রন্থের ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় দেওয়া ছকটি সাইট ছাড়পত্র ও পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যাপারটি বুঝতে সাহায্য করবে।

যেহেতু রেড প্রজেক্টগুলোর জন্যে IEE করার উদ্দেশ্যই হল EIA করা লাগবে কী লাগবে না তা নির্ধারণ করা, তাছাড়া কেবল IEE গ্রহণযোগ্য না হওয়ার জন্যও প্রকল্প প্রস্তাব বাতিল হয়ে যেতে পারে, যায়ও– সে ক্ষেত্রে IEE-র সঙ্গে EIA তৈরি করে প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতার যে দাবি করা হল তা কতটা যুক্তিগ্রাহ্য? যেহেতু IEE-র গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে প্রকল্পের প্রাথমিক অস্তিত্ব, তাই IEE অনুমোদন সাপেক্ষে EIA তৈরি শুরু করাটাই যৌক্তিক ধাপ যা সকল ক্ষেত্রেই করতে দেখা যায়।

রামপাল প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে শুরুতেই EIA করতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি, কারণ তারা আগে এটা নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে আসলেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্যে উপযুক্ত কিনা। যদি উপযুক্ত হয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় মনে করে যে Initial Environmental Examination এ রামপাল উত্তীর্ণ হয়েছে তবেই তারা নির্দেশনা অনুযায়ী Environmental Impact Assessment করবেন। না হলে অন্য জায়গা বিবেচনা করা হবে।

সুতরাং রামপালকে পূর্বনির্ধারিত বলে যে গুজবটি ছড়ানো হচ্ছে তা একেবারেই বানোয়াট। রামপাল জায়গাটি IEE তে উত্তীর্ণ হয়েছে বলেই ওখানকার Environmental Impact Assessment করা হয়েছে যেন পরিবেশগত সকল ঝুঁকি ও তার নিয়ন্ত্রণে সকল পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খ আমলে নিয়ে সেই অনুযায়ী প্ল্যান্টের ডিজাইন করা যায়। আগে থেকে EIA-এর মতো একটা জটিল শ্রমসাধ্য কাজ করে অনুমোদনের জন্যে জমা দিলে সেটাকেই বরং লোকদেখানো বলা যেত।

সবশেষে বলছি, কোনো এক প্রেক্ষাপটে কেউ একজন একটি প্রেজেন্টেশনে কী লিখল (যে প্রেজেন্টেশন কিনা যার নামে তৈরি, তিনি নিজেও সে সম্পর্কে অবগত নন), সেটাকে মহাপবিত্র, অনড় ভাবার মধ্যে কী কৃতিত্ব থাকতে পারে তাও বোধগম্য হল না। কনফারেন্সে জেনেরাল অডিয়েন্সকে অ্যাড্রেস করার জন্য প্রেজেন্টাররা সাধারণত মূল সোর্স তথ্য নিয়ে এ জাতীয় সরলীকরণ চিত্রের মাধ্যমে বুঝানোর কাজটি করে থাকেন। এটাকে কেউ মহাপবিত্র ও অনড় জ্ঞান করলে সেটা তার সমস্যা।

তার উপর এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেখানে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর স্পষ্ট আলামত পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সোর্স ভেরিফাই না করে এ রকম মন্তব্য করা কতটা গ্রহণযোগ্য? এটি মোটেও স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস নয়। ড. তানভীর ইসলামের মতো একজন মানুষ কি এটা শুধুই না জানা বা কম জানা থেকে করলেন?

প্রজেক্টের কাজের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা

(এটি তাদের জন্যে যারা জানতে চান কবে কীভাবে কত সিস্টেমেটিক্যালি ও প্রফেশনালি Pre-Construction phase এর কাজগুলো করা হয়েছে। এই লেভেলের একটি EIA নিয়ে যারা দায়সারা বা উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রশ্ন তুলছেন, সুন্দরবন রক্ষার নামে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী সেটা নিয়ে সত্যিকার অর্থেই আমাদের ভাবা প্রয়োজন)।

১) প্রথমত ২০০৯ সালে খুলনা অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে তিনটি সম্ভাব্য স্থান নির্বাচন করা হয় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে–

• সুবিধাজনক জমির প্রাপ্যতা
• নাব্যতাসহ কয়লা পরিবহণের সুবিধাদি
• প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির উৎস/যোগান
• বিদ্যুৎ সঞ্চালন সুবিধা
• নির্মাণসামগ্রীর প্রাপ্যতা
• নিকটবর্তী বিমান বন্দরের এয়ার ফানেলে চিমনির অবস্থান না থাকা
• প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি হতে ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী
• পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি-বিধান অনুসরণ
• নিকটবর্তী কয়লার উৎস বা বন্দর সুবিধা
• ঘনবসতি পরিহার করা

এসব ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী যে তিনটি জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল তা নিম্নরূপ–

ক) লবণছড়া, খুলনা
খ) রামপাল, বাগেরহাট
গ) চুনকড়ি, দাকোপ, খুলনা

উপরের তিনটি জায়গার মধ্যে থেকে চুনকড়ি জায়গাটি 'ইনিশিয়াল স্ক্রিনিং'-এর অংশ হিসেবেই বাদ পড়ে যায়।

২) জানুয়ারী ২০১০ এ সম্ভাব্য জমি নির্বাচনের পর জমির এনভায়রেনমেন্টাল ও ফিসিবিলিটি স্টাডির জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং নিচের দুটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়–

এনভায়রেনমেন্টাল স্টাডির জন্যে CEGIS এর সঙ্গে এবং ফিসিবিলিটি স্টাডির জন্যে NTPC এর সঙ্গে।

৩) এরপর লবণছড়া ও রামপালের মধ্যে বিদ্যুৎ নির্মাণ গাইডলাইন অনুসরণে বিভিন্ন সীমারেখা, পরিবেশগত ও ফিসিবিলিটি স্টাডির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষাতে রামপাল উত্তীর্ণ হয়। নিচে লবণছড়ার বাদপড়া আর রামপালকে নির্বাচন করার কারণগুলো দেওয়া হল–

ক) লবণছড়ার উত্তীর্ণ না হতে পারার কারণ–

• জায়গার অপ্রতুলতা (৫০০/৬০০ একর)
• প্রায় ৫০০ পরিবার উচ্ছেদ করার প্রয়োজন
• জনবসতি প্রতি বর্গ কিলোমিটারের ৬৪৭ জন
• খুলনা বিভাগীয় শহরের মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান
• নদীর নাব্যতা মাত্র ২ থেকে ৩ মিটার
• নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং খরচ প্রায় ৪/৫ গুণ বেশি
• কয়লা পরিবহণে অতিরিক্ত দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং পরিবহণ খরচ অনেক বেশি।
• বিকল্প কয়লা পরিবহণের সহজ মাধ্যম রেলওয়ে যোগাযোগের সংস্থান নেই।

খ) দ্বিতীয় অপশন রামপালে জায়গা নির্বাচনের যৌক্তিকতা–

• প্রয়োজনীয় জমির প্রাপ্যতা (১৮৩৪ একর)
• মাত্র ১২৫ টি পরিবার পুনর্বাসন
• জনবসতি প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ১২১ জন
• খুলনা বিভাগীয় শহর হতে ২৩ কিলোমিটার দূরে
• নাব্যতা প্রায় ৬.৫ থেকে ৭.৫ মিটার
• কয়লা পরিবহণ খরচ তুলনামূলকভাবে কম
• খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণকাজ প্রক্রিয়াধীন

উপরক্ত দিকগুলো বিবেচনাতে নিয়ে সেপ্টেম্বর, ২০১০ এ বাগেরহাট জেলার রামপালকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে নির্বাচন করে ছাড়পত্রের জন্যে আবেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

৪) এরপর আসে প্রকল্পের ছাড়পত্রের জন্যে Legal Requirement পূরণ করার ধাপ। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে এই প্রকল্পটি রেড ক্যাটাগরিতে পড়ে। তাই Environmental Conservation Act 1995 (ECA '95) ও the Environmental Conservation Rules 1997 (ECR'97) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় ছাড়পত্রের জন্যে। রেড ক্যাটাগরি হওয়াতে নিচের দুটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক–

ক). An Initial Environmental Examination (IEE)

খ) An Environmental Impact Assessment (EIA) and an Environmental Management plan (EMP)

নিচের ছকে IEE এর শর্তপূরণের পর্যায়ক্রমে যা যা করা হয়েছে তা দেওয়া হল–

রিক্যুয়ারমেন্ট অনুযায়ী সকল ডকুমেন্টসহ IEE রিপোর্ট পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয় সাইটের বা লোকেশনের ছাড়পত্রের জন্যে। ২৩/৫/২০১১ তে পরিবেশ মন্ত্রণালয় "Location Clearance Certificate" প্রদান করে Terms of Reference (TOR) সহ। সেই TOR অনুসরণ করে EIA ও EMP করা হয় এবং তার জন্যে নিম্নোক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা হয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয় ছাড়পত্রের জন্যে।

IEE এবং EIA এর শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়–

Land Acquisition and Site Establishment এর জন্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয় ০২/০১/২০১২ সালে এবং Site Establishment এর চুক্তি করা হয় ১৫/০২/২০১২ সালে।

৫ ) জানুয়ারী ২০১৩ তে CEGIS তাদের করা EIA সম্বলিত রিপোর্টটি কর্তৃপক্ষের কাছে অফিসিয়ালি জমা দেয়।

৬) EIA এর অংশ হিসেবে জনমত ও গণশুনানি করা আবশ্যিক একটি বিষয় এবং এ জন্য বেশ কয়েকবার মতবিনিময় সভা, গণশুনানি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। যথা–

• স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়া
• পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১০/১২ বার আলোচনায় বসা
• ১২ এপ্রিল ২০১২ তারিখে ঢাকার সকল পরিবেশবাদী, আন্দোলনকারী, সুশীল সমাজ, শিক্ষকসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় বসা

এ সকল আলোচনার মূল আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয় "Comments and Responses on EIA" শিরোনামে EIA রিপোর্টের অ্যাপেন্ডিক্স VIII এ সংযুক্ত আছে।

এ রকম স্টেপের মধ্যে দিয়ে EIA তৈরি হয়েছে। আর এই EIA এর উপর ভিত্তি করেই ১৫ আগস্ট, ২০১৩ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয় "রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ" প্রকল্পটিকে নির্মাণের ছাড়পত্র দেয়।

সুতরাং এটি বলার কোনো সুযোগই নেই যে এই EIA টি লোকদেখানো বা দায়সারা বা উদ্দেশ্যপূরণের জন্যে তৈরি।

যদি এরপরও একই কথা বলেন তাহলে তার জন্যে নিচের অংশটুকু

— আচ্ছা বলুন তো, লোকদেখানো কী কী কাজ মানুষ সচরাচর করে থাকে?

— কিছু কিছু ধর্মীয় আচার, দান-খয়রাত, হাসিকান্না, ভালোমানুষী এইসব আর কী।

— মানে দাঁড়াচ্ছে সেই সব কাজই লোকদেখানোভাবে করা সম্ভব যেসব কাজ কোনো প্রয়োজনে বা আগ্রহে করা হচ্ছে না। "আমিও এটায় আছি", শুধু সেটা জানাতেই করা হচ্ছে কাজটা, তাই তো? আচ্ছা, একজন মানুষের বিয়ের প্রয়োজন নেই, ইচ্ছাও নেই। সে কি একটা লোকদেখানো বিয়ে করতে পারে?

— না পারে না। কারণ যত লোকদেখানো ইচ্ছা নিয়ে, শর্ত বেঁধে ওটা করা হোক না কেন, ওটা করার সঙ্গে সঙ্গে ওটার সঙ্গে জড়িতদের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য এসে যায়। সেগুলো চাহিদা অনুযায়ী পালন না করলে জেল-জরিমানারও ভয় থাকে।

— আচ্ছা প্রফেশনালরা যে কাজগুলো করেন, যেমন আইনজীবী তার মক্কেলকে ডিফেন্ড করা, চিকিৎসক তার রোগীর চিকিৎসা করা, শিক্ষক তার ছাত্রদের পড়ানো, এইসব কি লোকদেখানোভাবে করা যায় না?

— সেটা কীভাবে হবে যতক্ষণ মক্কেল, রোগী বা ছাত্র সত্যিকারের এক একটা এনটিটি। তবে তারা যদি সত্যিকারের মক্কেল, রোগী বা ছাত্র না হন তাহলে অন্য কথা।

— একটা রিপোর্ট কি লোকদেখানো হয়? হতে পারে?

— অবশ্যই পারে। হচ্ছেও তো দিনরাত। সারা পৃথিবী জুড়েই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্লেজিয়ারিজম গুরুতর মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো কাজ করা নেই, ফিল্ডে যাওয়ার নামগন্ধ নেই, ঘরে বসে ফেইক ডেটা তৈরি করে রিপোর্ট রেডি করছে। এগুলো তো লোকদেখানোই, তাই না?

— না না আমি ওগুলির কথা বলছি না। ওগুলির ক্ষেত্রে কাজটাই তো ফেইক, ভুয়া। রিপোর্ট তো ভুয়া, লোকদেখানো হবেই। আমি জানতে চাইছি, কাজ ঠিক হবে, প্রফেশনালরাই কাজ করবে, সব স্টেপ টেক্সট বুক ধরেই হবে, কিন্তু রিপোর্ট হবে লোকদেখানো।

— রাখো রাখো, কী বলতে চাচ্ছ? বিয়ে হবে ধর্মমতে, আইনত, ঘর-সংসার করবে, সন্তান-সন্ততি হবে কিন্তু সেটা আবার লোকদেখানো মানে ফেইক বিয়ের আয়োজন? কী এইসব উল্টাপাল্টা বলছ? এ রকম হয় নাকি আবার?

— কিন্তু তাই তো শুনছি। এই যে ৩০-৩৫ জন প্রফেশনাল, বিশেষজ্ঞ মাসের পর মাস ফিল্ড স্টাডি করে যে রিপোর্টটা দাঁড় করালেন, তা নাকি লোকদেখানো? ফেইক? আর ফেইক কাজের সঙ্গে তারা তাদের নাম আর পদবি ব্যবহার করতে দিলেন?

কিছু টেকনিক্যাল ইনফরমেশন:

(এটাও সবার জন্যে নয়… যারা জানতে চান, বুঝতে চান তাদের জন্যে)–

প্রফেশনালগণ, বিশেষজ্ঞগণ মাসের পর মাস ফিল্ড স্টাডি করে একটা এনভায়রমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA) রিপোর্ট তৈরি করলেন। কেউ যদি এটাকে লোকদেখানো, মনগড়া, ফেইক মনে করে আমি প্রথমেই সন্দেহের চোখে দেখব যে সত্যিই কি তিনি বোঝেন, EIA মানে কী? এটা কেন করা হয়?

যে কোনো একটি EIA সম্পর্কে কারও কোনো মন্তব্য করার আগে যে বিষয়গুলোর ওপর পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার, তা হল–

১) EIA করাটা সকল প্রকল্পের জন্য জরুরি নয়।

২) যে সকল প্রকল্পে EIA করা প্রয়োজন হতে পারে বলে অনুমিত হচ্ছে, প্রথমে সেগুলোতে IEE (ইনিশিয়াল এনভায়রমেন্টাল এক্সামিনেশন) করা হয়। IEE-তেই প্রস্তাবিত প্রকল্পটি পরিবেশের জন্য গ্রহণযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য অথবা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। পরিবেশের জন্য অগ্রহণযোগ্য প্রকল্প তাৎক্ষণিকভাবেই অবাস্তবায়নযোগ্য বিবেচিত হয় এবং সেক্ষেত্রে EIA করাটাও অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আবার IEE-তে পরিবেশের জন্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে EIA করাটা আর জরুরি থাকে না। তবে IEE-তে একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প যখন ঝুকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে, EIA করাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিতভাবেই।

IEE-তে একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পকে ঝুকিপূর্ণ চিহ্নিত করার ও EIA চাওয়ার সঙ্গে প্রকল্পটির ঝুলে যাওয়ার, বাস্তবায়ন না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা বাধ্যতামূলকভাবে যে কটি অর্থ প্রকাশ করে তা হল এই–

(ক) প্রকল্পটি পরিবেশের ওপর কী ধরনের কুপ্রভাব রাখতে সক্ষম তা চিহ্নিত করা, নিরুপণ করা (এটাই ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট)।

(খ) চিহ্নিত কুপ্রভাবসমুহ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা ও সেই গ্রহণযোগ্য অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য প্রকল্প প্রস্তাবকারী কী কী করণীয় নির্ধারণ করছেন তা প্রকাশ করা (এটা মিটিগেশন মেজারস)।

(গ) প্রকল্প প্রস্তাবকারীর অঙ্গীকার করা করণীয়গুলির সঠিক প্রতিপালন হচ্ছে কিনা এবং তার মাধ্যমে পরিবেশের অবস্থা নির্দেশকারী সূচকগুলি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকছে কিনা তা নিশ্চিত করা (এটা হল মনিটারিং প্ল্যান)।

৩) সচরাচর দেখতে পাওয়া অন্যান্য রিপোর্টগুলির মধ্যে কোনো অঙ্গীকার থাকতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু EIA–র বিশেষত্ব এখানেই যে এতে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণের পর, মিটিগেশন মেজারস এবং মনিটারিং প্ল্যান থাকাটা জরুরি। যদি একান্তই না থাকে সেই ইআইএ-টি গণ্য হবে অসম্পূর্ণ EIA হিসেবে। কিন্তু কোনোক্রমেই লোকদেখানো EIA হিসেবে নয়।

৪) EIA করার অর্থ এই নয় যে পরিবেশকে তার মতো আনকোরা, ভার্জিন অবস্থায় রাখাটা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা এবং এর মাধ্যমে উন্নয়নের যে কোনো প্রচেষ্টাকে পরিবেশগত ঝুঁকির অজুহাতে প্রতিহত করা। বরং EIA রিপোর্ট তৈরি করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল এটা জানা যে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কারণে পরিবেশের উপর আদৌ কোনো ঝুঁকি আছে কিনা। যদি থাকে সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? আর যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনা কীভাবে সম্ভব?

EIA করা পর্যন্ত একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পকে আসতে দেওয়ার অর্থ মূলত এই নয় যে যেনতেন একটা অজুহাতে তা বাতিল করে দেওয়া। বরং অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই বার্তা দেওয়া যে পরিবেশগত জনস্বার্থ একটি গ্রহণযোগ্য মানের মধ্যে রাখা নিশ্চিত করা গেলে প্রকল্পটি নিয়ে আরও অগ্রসর হবার সুযোগ আছে।

একটু ভাবনার খোরাক

রামপালসহ যে কোনো প্রস্তাবিত প্রকল্পের একটি EIA রিপোর্ট একটু লক্ষ্য করে পরখ করলে দেখা যাবে যে তাতে সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিতে বিবেচনায় আসে না এ রকম অনেক বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারা ন্যুনতম ইস্যুকেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। এমনকি এগুলো দেখে প্রকল্পের কোনো কোনো ছিদ্রান্বেষী সমালোচক "পাইছি ছিদ্র" বলে বিপুল উৎসাহে এই বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যে, "EIA-তে স্বীকার করা হয়েছে ব্লা ব্লা ব্লা…"।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে এর মাধ্যমে তারা নিজেদের EIA সম্পর্কিত অজ্ঞতা এবং EIA-টি প্রস্তুতকারীদের পেশাগত উৎকর্ষতাই প্রমাণ করেছেন। কোয়ালিটি EIA হওয়ার প্রধান শর্তই হলো তা যথাসম্ভব কমপ্রিহেনসিভ হওয়া। সেজন্য যত অ-গুরুত্বপুর্ণ মাইনর ডিটেইল সেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে তার কোয়ালিটি ততই উচ্চমানের বলে ধরা হবে।

এই পর্বের উদ্দেশ্য হল পাঠকের সামনে এই ধারণাটি তুলে ধরা যে, মনগড়া, লোকদেখানো, মিথ্যা, ইত্যাদি বিশেষণ EIA নামক রিপোর্টের জন্য কতটা অনুপযুক্ত। একটি EIA প্রস্তুতকালে প্রস্তুতকারীদের অযোগ্যতা-অবহেলার-অমনোযোগের কারণে তাতে ত্রুটি থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে অবজেকটিভ বিশ্লেষকই শুধু নয়, অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষও তাকে অসম্পূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে EIA-টি সম্পূর্ণকরণের-সংশোধনের তাগাদা দিতেই পারেন।

কিন্তু বাস্তব জ্ঞান বিবর্জিতভাবে সেটাকে 'প্রত্যাখ্যান করলাম' বলায় আর যাই থাকুক, সুবিবেচনাপ্রসূত কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

আরেকটা কথা না বলে পারছি না, যাদেরকে বিপুল উৎসাহে EIA-র বিরোধিতা, ছিদ্রান্বেষণ, আইন-রীতি ভঙ্গ ইত্যাদি করতে দেখছি, তারা তো জানতাম যে কোনো মূল্যে 'রামপাল ঠেকাতে' পথে নেমেছেন। তাদের মূল এজেন্ডাই হল, সুন্দরবনকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো।

ছিদ্রান্বেষণ না করে তাদের কি উচিত নয় "ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংসের ১০১টি কারণ" জাতীয় তথ্য-তত্ব-উপাত্ত খুঁজে বের করা এবং সেই আলোকে প্রমাণের চেষ্টা করা, কীভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস খু-উ-বই উচ্চমাত্রায় কো-রিলেটেড?

সেসব না করে গুটিকয়েক সমাধানযোগ্য দোষ-ত্রুটি বের করে শেষ পর্যন্ত কী উপকার হবে আন্দোলনের? সুন্দরবন রক্ষার?

সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবার গল্প ফেঁদে মানুষকে আবেগাপ্লুত করা যত সহজ, তা প্রমাণ করা তত সহজ যে নয়, তা কি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন? প্রমাণের জনপ্রিয় দুটি পদ্ধতি–

"জানা থেকে অজানা" এবং "সম্পর্কিত বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা", এর কোনোটারই তো অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি না। অভিযোগ হিসেবে যে সব বিষয় সামনে নিয়ে আসছেন তা হয় নিস্পত্তিকৃত নয়তো নিস্পত্তিযোগ্য। আবেগাক্রান্ত অনুসারীগণ এই সব খুচরা অভিযোগের মাজেজা যদি ধরে ফেলে আর পাল্টা প্রশ্ন করে-–

— EIA টি লোকদেখানো না হলেই কি সুন্দরবন আর ধ্বংস হত না? পাওয়ার প্লান্ট-ফ্লান্ট আসলে কোনো উপলক্ষ নয়? নির্ভুল EIA প্রস্তুতিই তাহলে মূল কথা?

— সঠিকভাবে সিকোয়েন্স মানা, সঠিক সময়ে মাটি ভরাট করাই তাহলে মূল কথা? শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ আসলে কিছুই নয়? কেবলি গাল-গপ্পো?

কী উত্তর দেবেন, ভেবে রেখেছেন তো?

[পরের অভিযোগগুলোর উত্তর নিয়ে হাজির হব শিগগিরই]

ড. আঞ্জুমান ইসলাম : পানি পরিশোধন ও পরিবেশ প্রকৌশলী।

কাজী আহমেদ পারভেজ : শিক্ষক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।