ঢাকা থেকে কায়রো হয়ে দামেস্কের দূরত্ব কত

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 8 Sept 2013, 06:46 PM
Updated : 8 Sept 2013, 06:46 PM

'আরব-বসন্ত' বলে অভিহিত মধ্যপ্রাচ্যীয় কয়েকটি দেশের স্বৈরশাসন-বিরোধী সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের সময় কিছু বৈশিষ্ট্য ও ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেকে তুলনা করেছেন। যেমন, কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কথা অনেকের মনে এসেছে শাহবাগের তরুণদের গণজাগরণ মঞ্চ দেখে। ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার তুলনীয়। অথবা খানিকটা নৈরাজ্যধর্মী রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ বা কট্টর ইসলামপন্থীদের কার্যকলাপ ইত্যাদি।

তবে আমাদের দেশে তথা একই ইতিহাসের অংশীদার উপমহাদেশে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক গণসংগ্রাম ও প্রাথমিক স্তরে হলেও, গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য আরবদের তুলনায় অনেক জোরদার একথা মনে রাখতে হবে।

দেশে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রচুর কলামলেখক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টক-শোতে প্রতিদিন অনেক আলোচক দ্রুত চলমান ঘটনা সম্পর্কে নানা মন্তব্য করে চলেছেন। বিশ্লেষণ তথ্যনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ ও সুচিন্তিত হলে পাঠক-শ্রোতা উপকৃত হবেন ও জনমত গঠনেরও সহায়ক হবে।

কিন্তু প্রায়শ উপরভাসা, ঢালাও মন্তব্য শোনা যায় ও পড়তে হয়। উচ্চশিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীরাও এমনটা করছেন। 'গৃহযুদ্ধ' বা 'আকার্যকর রাষ্ট্র' প্রভৃতি চরম শব্দও অহরহ প্রয়োগ হচ্ছে।

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সভায় আগামী সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ও তৎকালীন শাসনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যা বর্তমান সাংবিধানিক বিধানেরই ব্যাখ্যা-বিবরণ। বিরোধী দলের সঙ্গে তথা রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক আছে। আবার নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ারও অবকাশ রয়েছে।

একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ পরের দিনই লিখলেন, "প্রধানমন্ত্রীর সচিব-বৈঠকের পর এটা স্পষ্ট যে সুষ্ঠু নির্বাচন আর সম্ভব নয়। … তাদের (বিরোধী দলগুলোর) সিদ্ধান্ত কী হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচন হবে একতরফা।" অর্থাৎ তিনি নিশ্চিত যে বিরোধী দলগুলো ভোটে অংশ নেবে না।

শেষ প্যারাটিতে আচমকা সিরিয়ার কথা: "আজতক বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় এক লাখের বেশি নিরীহ নাগরিক নিহত হয়েছে সরকার আর বিরোধীদের লড়াইয়ের ফলে। ২০ লাখ লোক আশপাশের দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে আরও ৫০ লাখ লোক স্থানান্তরিত হয়েছে…। রাসায়নিক বোমায়ও নিরীহ নাগরিক নিহত হচ্ছে।"

শেষ মন্তব্য, "…ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ঢাকা থেকে দামেস্কের দূরত্ব হয়তো অনেক বেশি। আমার কাছে অনেক কম। আর সময় তার থেকেও কম।"

নির্বাচনকালে কোন ধরনের সরকার থাকবে তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে একাধিক নির্বাচনের আগে ঝামেলা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ২০০৬ সালে জবর হাঙ্গামা হয়েছে। রাজপথের সহিংসতায় প্রায় এক ডজন প্রাণ ঝরে গেছে। আবার শেষতক ২০০৯ সালে উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।

ভোটের সময়ের সহিংসতা গত বিশ বছরে ক্রমাগতই কমে এসেছে। ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাই, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি নিকট অতীতের কুকর্মগুলো ঘটানো এখন অসম্ভবই বলা চলে। এবার একটি সমাধানে আসতে সাহায্য করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবও ভূমিকা রাখছেন। এসব কিছুই কলামিস্টের বিবেচনায় এল না।

ঢাকা-দামেস্কের দূরত্ব যখন মাপা হল, তখন কায়রো বাদ থাকবে কেন? বরং কাছাকাছি সময়ে ঢাকা ও কায়রোয় সংঘটিত দুটি বড়মাপের ঘটনা প্রায় একই ধরনের হওয়ায় অনেক বেশি তুলনীয়।

১৪ আগস্ট, ২০১৩ টেলিভিশনে যখন কায়রোর দুটি নগর চত্বর– রাবা' আল-আদাবিয়া মসজিদ প্রাঙ্গন ও আল-নাহদা স্কোয়ারে অবস্থানরত মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকদের হঠিয়ে দিতে সেনা অভিযানের খবরগুলো শুনেছি, দেখেছি, তখন আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল তিন মাস আগের ঢাকার শাপলা চত্বরের ঘটনাটি।

বিবর্ণ শাপলাফুল

হেফাজতে ইসলাম নামের কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের হাজার হাজার হুজুর ও তালেব-ই-ইলম ৫ মে বিকেলে মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে শাপলা চত্বর ঘিরে বসে পড়ে ঘোষণা দেন, তাদের ১৩ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত তারা নড়বেন না। সারাদিন ছিল রাজধানীর প্রবেশপথগুলো আটকিয়ে অবরোধ কর্মসূচি। পুলিশের কাছে নেওয়া অনুমতির শর্ত ছিল, হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমেদ শফী ভাষণ দিয়ে মোনাজাত শেষে সন্ধ্যার মধ্যেই সমাবেশের ইতি টানবেন। এই ওয়াদা ভঙ্গ করে আল্লামা সমাবেশে আসেননি। সমাবেশ শেষ করতে সরকারের বারংবার আহ্বান তারা অগ্রাহ্য করেন।

১৩ দফা ইসলামের নামে এক কট্টর মৌলবাদী শাসনবিধান চালুর দাবি যার মধ্যে রয়েছে নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও পেশাগত কাজ ছেড়ে সম্পূর্ণ অবরোধবাসিনী থাকার কথা। রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র ও সংবিধান বদলে ফেলার এমন একটি দাবি যে রাতারাতি এক অবস্থান ধর্মঘটে আদায় করা যায় না তা তারাও জানেন। দিনের বেলা সহিংসতায় অন্তত ১১টি প্রাণ ঝরে গেছে।

একদিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে হেফাজতের ওই সমাবেশের সঙ্গে কৌশলে তার ১৮ দলের রাজনৈতিক আন্দেলনের শক্তিকে যুক্ত করে দিয়েছেন। আর ওই সন্ধ্যায় তিনি ঢাকাবাসীকে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে হেফাজতীদের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দেন।

সকল মহলে তখন উৎকণ্ঠা, হেফাজতীরা যদি লাগাতার অবস্থান রেখে রাতটা পার করতে পারে তাহলে পরের দিন সকাল থেকে পরিস্থিতি আমূল বদলে যাবে। প্রধান প্রধান সব ব্যাংক ও করপোরেট সংস্থার সদর দফতর বুকে নিয়ে মতিঝিল বাণিজ্যকেন্দ্র অচল হয়ে যাবে। কাছেই সরকারের মূল প্রশাসনকেন্দ্র সচিবালয়।

বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী হরেক শক্তি, এমনকি ছদ্মবেশে জঙ্গিরাও, রাজপথে নেমে আসবে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সরকার ও শাসনযন্ত্র অকার্যকর করাই লক্ষ্য। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, শাপলা চত্বরের বেআইনি বিপজ্জনক সমাবেশ হঠাতে বুঝি-বা কার্ফু, সেনা নামানো, গুলি চালনা ইত্যাদি অনভিপ্রেত ঘটনাবলী ঘটবে।

কিন্তু না, সকালেই দেশবাসী জানতে পারে যে কার্ফু, ব্যাপক রক্তারক্তি, সেনাবাহিনী তলব ইত্যাদি ছাড়াই বর্ডার গার্ডের সহায়তা নিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব ওই বিশাল জমায়েত ছত্রভঙ্গ করে দিতে পেরেছে। প্রাণঘাতি অস্ত্র নয়, মাইকযোগে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাত তিনটের পরে ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট, শব্দশেল ও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছে। তিন দিক আটকিয়ে গোপীবাগের দিকটা খোলা রাখা হয়েছিল সমাবেশকারীদের চলে যাওয়ার জন্য।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনগণের কাছে ঘটনা বিবৃত করে যথাসময়ে প্রেসনোট না দেওয়া এবং দুটো টিভি চ্যানেল বন্ধ করা সরকারের ভুল কাজ বলে অনেকে যথার্থই সমালোচনা করেছেন। তবু এত অল্প শক্তি প্রয়োগে এত বড় একটি সমাবেশ ভাঙা সম্ভব হল বলে স্বস্তিই দেখা দেয়।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে গুজব, সন্দেহ, দোষারোপ, বিবৃতি, বিভ্রান্তি এক হতবাক অবস্থা সৃষ্টি করে। হেফাজতের বর্ষীয়ান আলেমগণ, উচ্চশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতারা দাবি করলেন, রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দুই-তিন হাজার মানুষ মেরে ফেলা হয়েছে।

দু'একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নজরদারি সংগঠনও উপস্থিত বিভ্রান্ত হয়। অভিযান শেষ হতে হতে ভোরের আলোই ফুটে উঠেছিল। দু'হাজারের বেশি লাশ কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রাকভর্তি করে গুম করা ও রাজপথে এত মানুষের রক্ত নিমেষে মুছে ফেলার মতো ম্যাজিকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না।

তবে গুজব নিশ্চয়ই পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ছিল। পরবর্তী মাস দু'একে বিভ্রান্তি কেটে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানায় যে, গণহত্যার অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। ঢাকার সংগঠন 'অধিকার' ৬১ জন এবং বিদেশি মিডিয়া 'আল-জাজিরা' ও 'দি ইকোনমিস্ট' সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ৫০ জন নিহত হওয়ার দাবি রক্ষা করেছে। তবে ঘটনার তিন মাস পরও কোনো 'নিহত' ব্যক্তির নাম-ধাম বা আত্মীয়-স্বজনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কেউ আদালতেও যাননি।

তবে তাৎপর্যপূর্ণ যে, ওই গুজব বা অবিশ্বাস্য দাবি ও প্রচারণার প্রভাব পড়েছিল। অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন যে, ১৫ জুন ও ৬ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা যে গো-হারা হারলেন, বিএনপির প্রার্থীরা যে কলাগাছে ভোট পাওয়ার মতো জিতে গেলেন– এর পেছনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারানোর অন্যান্য কারণের মধ্যে 'আলেম-ওলামাদের হত্যা' একটি বড় কারণ। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের 'নাস্তিক' বলে প্রচার চালানোর পাশাপাশি এই 'মুসল্লি গণহত্যা'র প্রচার ভোটে কাজে লাগানো হয়েছে সরকারকে 'ইসলামবিরোধী' প্রতিপন্ন করতে।

এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের কর্মীরা বেশি দক্ষ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনার লাশের স্তূপের ছবি ল্যাপটপে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের দেখিয়ে উত্তেজিত করা হয়েছে। অনেক মানুষ বিশ্বাস করেছে, বিভ্রান্ত হয়েছে।

রক্তাক্ত মসজিদ প্রাঙ্গন

কায়রোর দুটি বিক্ষোভ শিবিরে ব্রাদারহুড সমর্থকরা অবস্থান করছিল দেড় মাস ধরে। ৩ জুলাই সামরিক বাহিনী প্রেসিডেণ্ট মোহামেদ মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করার পর থেকে তার পুনর্বহালের দাবিতে চলছিল বিক্ষোভ।

'আরব বসন্তে' অর্ধশতাব্দীর স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পরে মোরসি মিশরের ইতিহাসে প্রথম অবাধ নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট। আর ৭০ বছর আগে জন্ম নেওয়া ইসলামী আন্দোলনের প্ল্যাটফরম মুসলিম ব্রাদারহুডও এই প্রথম মিশরে সরকার গঠন করেছিল 'ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি' নামের রাজনৈতিক দল গঠন করে।

কিন্ত মোরসি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জরুরি কাজ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রযন্ত্রের 'ইসলামিকরণে' বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ায় এক বছরেই মিশরীয় জনগণের বিরাট অংশ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মোরসি-বিরোধী জনমত অধৈর্য হয়ে পড়ার সুযোগ নেয় সেনাবাহিনী যারা স্বৈরশাসনামলে ঘি-মাখন খেয়েছে। মিশরীয় পরিস্থিতির জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক আরও সমীকরণ রয়েছে যার বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।

অনমনীয় মোরসি সমর্থকরা ওই দুটি বিক্ষোভ শিবিরে তাঁবু খাটিয়ে, রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে, পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য পাথর ও ককটেল মজুত করে বসেছিল। নারী ও শিশুরাও ছিল। সামরিক কর্তৃপক্ষ ১২ আগস্ট স্থানত্যাগের চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিয়ে ১৪ আগস্ট ভোর থেকে বিতাড়ন অভিযান শুরু করে।

প্রথম সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ধীরে ধীরে বিক্ষোভকারীদের চলে যেতে দেওয়া হবে, মিশরীয়দের রক্তপাত সরকার চায় না। কিন্তু শুরুতেই অভিযানে সাঁজোয়া গাড়ি, বুলডোজার, আগ্নেয়াস্ত্র, কাঁদানে গ্যাস, এমনকি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। সমাবেশ সবদিক থেকে ঘিরে ফেলে ভবনগুলোর ছাদ থেকেও গুলি করা হয়।

রয়টার্স ও বিবিসির খবর অনুসারে, অধিকাংশ মৃতের মাথায় ও বুকে-পিঠে গুলি লেগেছে। অভিযানটি ১২ ঘণ্টা চলে এবং সন্ধ্যায় কায়রোসহ বড় বড় শহরে রাতের জন্য কার্ফু এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

বিবিসির প্রায় মিনিটে মিনিটে দেওয়া টুইট নিউজে তাদের মধ্যপ্রাচ্য সম্পাদক জেরেমি বাওয়েন সকালেই অভিযানকে 'হেভি-হ্যানডেড অপারেশন' বলে উল্লেখ করেছিলেন। নিকটস্থ এক ফ্ল্যাট বাসিন্দার ই-মেইল থেকে বিবিসি পরিস্থিতিকে 'অবিশ্বাস্য বিভীষিকাময়' বলে বর্ণনা করে।

বাওয়েন সন্ধ্যার পোস্টে লেখেন, "সেনাবাহিনীর হিংস্রতা দেখে মনে হচ্ছে তারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে একেবারে শেষ করে দিতে চায়। যা ঘটেছে তা মিশরের সংকট সমাধানে একটুও সাহায্য করবে না, বরং সংকট আরও ঘনীভূত করবে।"

ওই অভিযানে সরকারিভাবে নিহত শেষ পর্যন্ত ৬৩৮ ও আহত দু' হাজার বলা হয়। মুসলিম ব্রাদারহুড দাবি করে ২ হাজারের বেশি নিহত ও ৫ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। মিশরে রক্তপাত অব্যাহত রয়েছে।

ঝাপসা ভবিষ্যৎ

শাপলা চত্বরের ঘটনায় যে আমাদের সরকার সেনাবাহিনীকে না ডেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের অভিযানে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতিতে লক্ষাধিক হেফাজতী বিক্ষোভকারীকে বেআইনি সমাবেশ থেকে হঠিয়ে একটি বিরাট রাজনৈতিক সংকট ও সম্ভাব্য নৈরাজ্য ঠেকাতে পারল– এ ব্যাপারটির স্বীকৃতি ও সেজন্য সরকারের প্রশংসা আমরা খুব কম পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক, কলামিস্টের কাছে পেয়েছি।

প্রতি রাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টক-শোতে হাজির ডজনখানেক বুদ্ধিজীবী-বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞ-সাংবাদিকের মধ্যে দু'-একজন ছাড়া কারও মুখে আমি এ ব্যাপারে প্রশংসাসূচক বাক্য শুনিনি। সরকার কেন রাতের অন্ধকারে অভিযান চালাল, কেন দিগন্ত-ইসলামী টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করল, হতাহতের সংখ্যা নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, কেন সরকার নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করছে না, কেন বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি করছে না– এমন ঝাঁজালো মন্তব্যই বেশি শুনেছি। বিশ্লেষণের লক্ষ্য কি শুধুই ছিদ্রান্বেষণ, না বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন?

সরকারের সমালোচনা করার ন্যায্য বিষয় অবশ্যই আছে। গণবিরোধী কাজ করলে সরকারকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আস্তিক-নাস্তিক প্রশ্ন উত্থাপন ও ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে মিথ্যা প্রচার যে পাঁচ সিটি নির্বাচনকে প্রভাবিত করল, জাতীয় জীবনে তার সুদূরপ্রসারী বিপদের দিকটির প্রতি বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকদের মনোযোগ কই?

পাঁচ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের ফলাফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রায় নিশ্চিত জয়ের ব্যাপারে বিএনপি আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য ভরাডুবি সম্পর্কেও দেশি-বিদেশি বহু পর্যবেক্ষক নিশ্চিত হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ বিশাল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে।

আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে সে জয়ের ভাগিদার জামায়াতে ইসলামীও হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কারণে প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে জামায়াত। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন যদি বাতিল হয়ে যায় তবে তারা দলগত প্রতীক নিয়ে লড়তে পারবে না। কিন্তু তাদের প্রার্থীরা, তাদের সংগঠিত শক্তি বিএনপির সঙ্গেই থাকবে।

'অরাজনৈতিক' হেফাজতে ইসলাম এবং আরও দৃশ্য-অদৃশ্য নানা ইসলামি নামধারী মৌলবাদী জঙ্গি গ্রুপ নির্বাচনে এ মোর্চার পক্ষেই সক্রিয় থাকবে। পরবর্তী নির্বাচনী রাজনীতিকে তাই 'দুই নেত্রীর ঝগড়া' বা একান্ত আওয়ামী লীগ-বিএনপির হারা-জেতার মতো সরলভাবে দেখা কতটা ঠিক?

সংবাদপত্রের পাতায় ও টিভি পর্দায় কলামিস্ট-পর্যবেক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা অনেক বাক্যব্যয় করছেন আশু নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির বিতর্ক ও রাজনৈতিক নেতাদের সকাল-বিকালের মেঠো বক্তৃতা নিয়ে মন্তব্যে। দলীয় ও গড়পড়তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের যেখানে সীমাবদ্ধতা সেই জায়গাটি পূরণ করাই বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার, তার ভবিষ্যৎ, তার প্রতি হুমকি, রাষ্ট্রের চরিত্র, জাতীয় ঐক্য, মূল্যবোধ, সমাজকাঠামোর ভাঙন-গড়ন ইত্যাদি বিষয় এবং এগুলো কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে বর্তমান রাজনীতিতে সেকথা ব্যাখ্যা করে প্রত্যাশা পূরণ করেন অতি অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী।

সমসাময়িক আরব মুসলিম বিশ্বে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক ও মিশরে নির্বাচনে মৌলবাদী ইসলামি দলের বিজয়ের পরে দেশগুলো রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনী মঞ্চে আসছে। মৌলবাদীরা প্রথমবারের মতো ক্ষমতা পেয়েই কী রকম আচরণ করে তা আমরা মোরসির ক্ষেত্রে দেখলাম।

আমাদের জামায়াতে ইসলামী ও আরব বিশ্বের মুসলিম ব্রাদারহুড একই ঘরানার রাজনৈতিক দল। জামায়াতের ধর্মীয়-রাজনৈতিক দর্শন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে কী পৈশাচিক রূপ নিয়েছিল তা আমরা দেখেছি। রাজনৈতিকভাবে সেখান থেকে তারা একচুলও নড়েনি। আর আগামী নির্বাচনে তারা যুক্ত থাকছে বিএনপির সঙ্গে।

আগামী নির্বাচনের এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেশের তরুণ সমাজ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, নারীসমাজ ও সিভিল সমাজের নেতাদের অনুধাবন করতে হবে, জাতীয় স্বার্থে যথাযথ ভূমিকাও রাখতে হবে।