ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জিএম খাদ্য

কিউ আর ইসলাম
Published : 18 August 2013, 08:57 AM
Updated : 18 August 2013, 08:57 AM

জেনিটিক্যালি মডিফায়েড সংক্ষেপে জিএম প্রযুক্তি জীবনরক্ষার জন্য ঔষধ তৈরিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য ইনসুলিন তৈরি এবং জেনিটিক বা বংশানুগতিক বৈকল্য চিকিৎসার জন্য। তবে খাদ্য উৎপাদনে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছে। শস্য পরিবর্ধন নতুন কিছু নয়। কৃষি উৎপাদনের শুরু থেকেই শস্য প্রজননবিদরা এটা করে আসছেন। বিভিন্ন ধরনের গোল আলু এই শস্যের নানা জাতের সংকরের ফলাফল।

এমনিভাবে নানা আকৃতির ও রংয়ের বেগুন উদ্ভাবিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রোকলি, ব্রাসেল স্প্রাউট, কোহলরবি ও ক্যালে একই প্রজাতি থেকে উদ্ভুত। আমাদের দেশে সেচ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে আধুনিক জাতের ধান উৎপাদিত হচ্ছে। হাইব্রিড ধানচাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। মোট ধান আবাদি এলাকার চার-পঞ্চমাংশের বেশি আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের দখলে চলে গেছে। ভাটিয়াল, বালাম, লতাশাইল, দাঁতখানি চাল বাজারে আর দেখা যায় না। গম, জোয়ার, কাউন, সরিষা, ছোলা, মুগ, মসুরি ইত্যাদি শস্যের চাষ প্রায় উঠে গেছে। সব্জির উৎপাদনে হাইব্র্রিড জাতের ব্যবহারই বেশি। কাঁটাযুক্ত গোল দেশি বেগুন এখন আর পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে একই জমিতে বারবার আধুনিক বা হাইব্রিড জাতের চাষে ফসলে কীটপতঙ্গ ও রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর অতি নির্ভরশীলতা মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি করেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নানারকম বিতর্ক শুরু হয়েছে। বায়োটেক বা জৈবপ্রযুক্তির সমর্থকরা জিএম অর্থাৎ বংশানুগতিক বা কৌলগত ধারায় পরিবর্ধিত ভিটামিন সমৃদ্ধ, উচ্চফলনের ও দ্রুত বর্ধনশীল শস্যের আবাদে উৎসাহিত করছে। পরিবেশবিদরা এই ফসলকে 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' (মোহরাঙ্কিত বা সিল মারা) খাদ্যের রেসিপি অর্থাৎ প্রস্তুতপ্রণালী হিসেবে আখ্যায়িত করে জিএম প্রযুক্তি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশংকা করছে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণিপ্রজাতির বিলুপ্তি শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি বিলুপ্তির পথে। বনও অনেকাংশে উজাড় হয়ে গেছে। এটা বন্ধ না হলে চলতি শতাব্দী পূর্ণ হওয়ার আগেই বেশিরভাগ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির অনেকগুলোই খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করে। এই বিলুপ্তির ফলে প্রতিবেশ নষ্ট হবে। অনেক দেশেই এই ধরনের বিলুপ্ত সম্পদ পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে। ফিজিতে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের পুনরুদ্ধার চলছে। কেনিয়াতে মৌমাছি পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। চিলি পানি ও বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য। জাপানে পরিবেশবান্ধব গাড়ি ক্রয়ে ঋণ দিচ্ছে।

আধুনিক মলেক্যুলার বায়োলজি প্রযুক্তিতে আমরা একটি প্রাণিসত্তার নির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্যের জিন আলাদা করে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তর করতে পারি। এই পদ্ধতিতে একটি উদ্ভিদকে কোনো প্রাণী বা ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বহিরাগত জিন দিয়ে রুপান্তরিত করা হয়। এটাই হল জিএম খাদ্য নিয়ে বিতর্কের কারণ।

জিএম প্রযুক্তিতে তিনটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট একটি আগাছানাশক সহনশীল বা প্রতিরোধক জিন নিয়ে কোনো শস্যে স্থানান্তর করতে পারে। জিনটি স্থানান্তরের ফলে এই ফসলের আগাছানাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে ওই ফসলের জমিতে রাসায়নিক আগাছানাশক স্প্রে করা হলে আগাছা ধ্বংস হলেও ফসল রক্ষা পাবে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল, এই ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়ায় ফসলের জমিতে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব পড়বে। কারণ ফসলের জমির আগাছার উপর অনেক পোকামাকড়, পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তু খাদ্য ও বসবাসের জন্য নির্ভরশীল থাকে। আর একটি ভয় হল, জিএম ফসলের বহিরাগত জিন সংশ্লিষ্ট জাতের বন্য উদ্ভিদজগতে সংক্রমিত হতে পারে। যেহেতু বাতাসে প্রবাহিত পরাগ থেকে উদ্ভিদ ভ্রুণ গঠন করে, ফলে জিএম ফসলের পরাগ প্রবাহিত হয়ে অনেক দূরবর্তী স্থানেও অন্য উদ্ভিদের ফুলে ঢুকে পড়তে পারে। ফলে এই সমস্ত বন্যজাত উদ্ভিদের আগাছানাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে 'সুপার' আগাছাতে পরিণত হতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। অস্বাভাবিকভাবে আগাছানাশক সহনশীল হওয়ায় এই উদ্ভিদজাত অন্যান্য জীবজন্তুর খাদ্য হিসেবে অনুপোযোগী হয়ে পড়বে। এতে 'ফুড চেইন' ব্যাহত হবে।

তৃতীয়ত পরবর্তী ফসল উৎপাদনে জিএম ফসলের বীজ উপযোগী হবে না। এমনকি অঙ্কুরিতই হবে না। ফলে বীজ কোম্পানিগুলো এই সুবিধা নেবে। প্রতিবার ফসল উৎপাদনে নির্দিষ্ট কোম্পানিগুলো থেকে বীজ ক্রয় করতে হবে। কৃষকদের বিদেশি জিএম বীজের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। এভাবে জিএম প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

অনেকেই হয়তো-বা জিএম খাদ্য খেতে দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু জীবজন্তুর জিন খাদ্য ফসলে স্থানান্তরকরণ নিরামিষভোজী ও নির্দিষ্ট কোনো পশুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ ধর্মানুসারীদের জন্য নৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ জন্য হয়তো জিএম খাদ্যের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে বিদেশি ফসলের জিন থেকে সৃষ্টজাত অন্য দেশের স্থানীয় ফসলে সংক্রামিত হতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও অনেক দেশে তা দুরূহ হয়ে পড়বে। এতে প্রতিবেশে প্রকটভাবে বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকবে। এই সমস্ত প্রতিকূলতা জিএম প্রযুক্তিকে বিরাগভাজন করে তুলতে পারে। অন্যদিকে জিএম বীজ কোম্পানিগুলো কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ও সমস্য যাচাই ও পরীক্ষা ব্যতিরেকেই দ্রুত তাদের পণ্য বাজারজাত করতে চাচ্ছে। এসব কারণে বিশ্বে জিএম খাদ্য নিয়ে বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশেও এই বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করা হয়েছে। মৃত্তিকাবাহিত ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস সংক্ষেপে 'বিটি' নামক ব্যাকটেরিয়াম এর জিন স্থাপন করে 'বিটি বিরিঞ্জাল' নাম দিয়ে এই বীজ তৈরি করা হয়েছে। বিটি বেগুন বীজ থেকে আবাদি জমির ফসল মাজরাপোকা প্রতিরোধশীল হবে। উল্লেখ্য মাজরাপোকা বেগুন ফসলের বড় শত্রু। এই পোকা বিটি বেগুন ফসল আক্রমণ করলে বিটি টক্সিন বা বীষাক্ত পদার্থ তার পরিপাকতন্ত্র নষ্ট করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। এ থেকে আশংকা করা হচ্ছে যে জিএম প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত বীজ ব্যবহার করে উৎপাদিত শস্য সাস্থ্যশূল হতে পারে। ভারতে বিভিন্ন পরীক্ষায় যে জিএম খাদ্য দিয়ে পালিত গবাদিপশুর বৃদ্ধি, অঙ্গ বর্ধন ও রোগপ্রতিরোধে সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। বিগত ২০০২ সালে বিমুক্ত বিটি কটন বা তুলার কারণে মধ্যপ্রদেশে খামার ও ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখে গেছে। যেমন চুলকানি, মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে সোচ্চাররত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'গ্রিনপিস' বিটি বেগুন চাষের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারত সরকার বিটি বেগুন বিমুক্ত করতে আরও সময় নিতে থাকে। উল্লেখ্য যে আমেরিকাভিত্তিক বহুজাতিক কৃষি বায়োটেকনোলজি সংস্থা মনসাটো হোল্ডিং প্রাইটেট লিমিটেড ও ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে মহাইকো-মনসান্তো বায়োটেক প্রতিষ্ঠা করে জিএম শস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করছে।

ভারতের জিনেটেক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভাল কমিটি (জিইএসি) ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে বাণিজ্যিকভিত্তিতে বিটি বেগুন চাষের জন্য এগিয়ে যাওয়ার জন্য সম্মতি দেয়। এ ব্যপারে ভারত সরকারের পরিবেশমন্ত্রী জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করলে কোনো কোনো পক্ষ আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে বিটি বেগুন প্রযুক্তি সমর্থন করে।
অনেকেই আবার খাদ্যশস্যে বিষাক্ত জিন স্থাপনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলাসহ আটটি রাজ্য সরকার বিভিন্নভাবে এই পক্ষে অবস্থান নেয়। মাঠ পর্যায়ে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি বিধায় জিইএসি কর্তৃক অনুমোদনের বিপক্ষে সুপ্রীম কোর্ট অন্তবর্তীকালীন ইনজাংশন জারি করে। যাহোক বিটি বেগুন নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ফলে এক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

এদিকে নয়াদিল্লিতে কৃষক ফেডারেশনের দক্ষিণ এশিয়ার কনফারেন্সে ভারতের যেখানেই হোক না কেন মাঠ পর্যায়ে জিএম বীজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কনফারেন্সে আহব্বায়ক জিএম বীজ সনাতন বীজের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে উল্ল্যেখ করেন। জিএম বীজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কনফারেন্সে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের কৃষক নেতারা এশিয়াবাসী কৃষকদের ফসল উৎপাদনে জিএম বীজ ব্যবহার প্রতিরোধ করতে এবং সনাতন পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য আহ্বান করে।

ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত জিএম শস্যে যেমন তুলা, ভুট্টা বিটি জিন সংযোজিত। ভারত জিএম খাদ্যে নিরাপদমূলক ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী। এই দেশ ২০০২ সালে বিটি তুলা অনুমোদন করলেও জিএম ভুট্টা আমদানি বন্ধ রাখে। ফ্রান্স থেকে শুরু করে জিম্বাবুয়ের জনসাধারণ, এমনকি ভারতীয়রাও জিএম খাদ্যের উপর আস্থাশীল নয়। তাদের ভয় বিদেশি জিন সংক্রমিত হয়ে তাদের নিজ দেশের ফসল ও মাঠ দূষিত করবে। তাছাড়া কৃষকেরা জিএম বীজের জন্য আমেরিকান কোম্পানিগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

এক দশক আগে দিল্লিভিত্তিক 'ফোরাম ফর বায়োটেকনলজি এন্ড ফুড সিকিউরিটি'র চেয়্যারম্যান দেবিন্দর শর্মা জিএম প্রযুক্তি ভারতীয় কৃষিকে আমেরিকার কর্পোরেশনগুলোর কর্তৃত্বাধীন নিয়ে আসবে বলে আশংকা করেন। আমেরিকা থেকে জিএম খাদ্য আমদানির ব্যাপারে চীন বেশ সাবধান। চীন নিজ দেশে জিএম প্রযুক্তি গবেষণায় চীন যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। জিএম তামাক উদ্ভাবন করেছে। ইউরোপ অবশ্য এই তামাক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।

মহাইকো-মনসান্তো শুধু ভারতেই নয় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহেও বিটি বেগুনচাষে বীজ বাজারজাতকরার লক্ষ্য স্থির করে। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে মাজরাপোকা প্রতিরোধশীল বিটি বেগুন বীজ বাজারজাতের চেষ্টা চলছে। কয়েকটি বৃহত্তর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে বছরে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বেগুনের চাষ হয়। এই বেগুন চাষে প্রায় ১০ হাজার কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। গত দুই দশকে বেগুন আবাদি জমির পরিমাণ শতকরা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে বেগুনের চাহিদা ও আবাদ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বীজের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মহাইকো ইতিমধ্যে বাংলাদেশে স্থানীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বীজ কোম্পানির সহায়তায় বিটি বেগুন বীজে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রতিবাদ করা হয়েছে। আদালতে মামলা দায়েরও হয়েছে। উল্লেখ্য বিগত দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল যে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যতিরেকে বাংলাদেশে জিএম বীজ ব্যবহার করা হবে না।

এটা অনস্বীকার্য যে জিএম প্রযুক্তির পরিবর্তে প্রচলিত পদ্ধতিতে উত্তম শস্য আবর্তন ও সেচ দিয়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণে ও ক্ষয়রোধ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। পুরানো পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত সংকরজাত স্থানীয় উপযোগী, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক ও প্রকৃতিবান্ধব হতে পারে। তবে জিএম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ফসলের জাতও ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদাপূরণে সহায়ক হতে পারে। তাই বলে পশ্চিমা দেশসমুহে সৃষ্ট ও উপযোগী জিএম প্রযুক্তি ব্যবহারে অন্য কোনো দেশকে বাধ্য না করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। বরং উচিত হবে নিজ নিজ দেশে উপযোগী জাত উৎপাদনে বায়োটেক অবকাঠামো উন্নয়ন। জিএম পদ্ধতিতে ফসলের জাত উদ্ভাবন যে বড় বড় বায়োটেক ফার্মকেই করতে হবে তা নয়।

কোনো প্রতিষ্ঠান বা গবেষক টিম যারা স্থানীয় চাহিদা সম্পর্কে অবগত তারাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন উগান্ডাতে জাতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা এমন একটা ভুট্টার জাত তৈরি করেছে, যেটা শুধুমাত্র রোগবালাই সহনশীলই নয়, যে জমিতে নাইট্রোজেনের অভাব আছে, সে জমিতেও ভালো ফলন দেয়। কেনিয়ার এগ্রনমিস্টদের উদ্ভাবিত মিষ্টি আলুর জাত ভাইরাস আক্রমণ ঠেকায়। একইভাবে পশ্চিমা দেশসমূহ খরা সহনশীল, রোগ প্রতিরোধক এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। সুতরাং ভিন্ন দেশের নির্দেশে, প্রযুক্তি বা নীতির ভিত্তিতে যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে তা নয়। নিজস্ব বায়োটেক অবকাঠামো উন্নয়ন করে প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব। ব্রাজিল ও চীন নিজ নিজ দেশে জিএম প্রযুক্তিতে বীজ তৈরি করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে।

জিএম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত জাতের ফসল উৎপাদন করে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হল আমেরিকা। সারাবিশ্বে উৎপাদিত ভুট্টার একটা বড় অংশ এই দেশে উৎপাদন হয়। আমেরিকা সয়াবিন উৎপাদনেও এগিয়ে। এই সমস্ত ফসল রফতানি করে আমেরিকা আয় বৃদ্ধি করেছে। আমেরিকানদের মতে জিএম ভুট্টা নিরাপদ। কোনো রকম প্রাণঘাতী বিকিরণ থেকে এটা উদ্ভাবন করা হয়নি। সাধারণ ভুট্টার মতো। ব্যতিক্রম শুধু যোগ করা হয়েছে একটি জিন যা বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বিটি ব্যাকটেরিয়া থেকে স্থানান্তর করেছে। এই জিন ভুট্টার কীটপতঙ্গ আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।

আমেরিকার কৃষিশিল্পের মতে এই প্রযুক্তি এক বিরাট সফলতা। এতে কীটনাশক ব্যবহার কমে গেছে। আমেরিকার স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটি ভুট্টাতে কোনো দোষ পায়নি। তাদের মতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির আশংকা নেই। আমেরিকা ২০১০ সালে বিশ্বে উৎপাদিত মোট ভুট্টার শতকরা ৩২ ভাগ, সয়াবিনের ৫০ ভাগ ও তুলার ৩০ ভাগ উৎপন্ন করেছে। উৎপাদিত ভুট্টার শতকরা ২০ ভাগ রপ্তানি করেছে। গম উৎপাদন এবং রফতানিতেও আমেরিকার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভুট্টা, সয়াবিন, গম ও তুলা রপ্তানি থেকে ২০১০ সালে আমেরিকার আয় হয়েছিল যথাক্রমে ৬৪, ৩৮, ১৫ ও ৮ বিলিয়ন ডলার।

অনেক দেশ আমেরিকাতে উৎপাদিত এই জিএম ফসল আমদানি থেকে বিরত থেকেছে। সারাবিশ্ব এই মোহরাঙ্কিত খাদ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। উন্নত দেশে জিএম খাদ্যের উৎপাদন আধিক্যে ও রপ্তানিতে অন্যান্য দেশে ফসলের মূল্য কমিয়ে দেবে। এই সমস্ত দেশের কৃষকরা পড়বে বিপদে। গত দশকের শুরুতে আমেরিকায় জিএম পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক জিন দিয়ে উদ্ভাবিত ভুট্টা, সয়াবিন ও টমাটো দেখে ইউরোপিয়ানরা মুখ ঘুরিয়েছে। ভারত আমেরিকা থেকে খাদ্য সাহায্য হিসেবে ভুট্টা ও সয়াবিন নেওয়া বন্ধ করে দেয়। জাম্বিয়া আমেরিকার ভুট্টা নিতে অস্বীকার করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাম্বিয়ার এই অস্বীকৃতি এক বিরাট উদাহরণ সৃষ্টি করে। গ্রিন পিস এটাকে এক বিরাট সাফল্য বলে অভিহিত করে। জিএম-এর বিপদ নিয়ে গ্রিন পিস সরব রয়েছে।

মানুষের জীবনরক্ষার জন্য জিএম প্রযুক্তি হয়তো সহায়ক হতে পারে। তবে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার যেন না হয়, তার জন্য মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ ও সাবধানতা জরুরি। উপযোগিতা যাচাই না করে 'অলক'-সহ কয়েকটি ভারতীয় হাইব্রিড ধানের বীজ বিগত নব্বই দশকের মাঝামঝি থেকে বাজারজাতে পরবর্তী কয়েক বছর অনেক কৃষক বেশ খেসারত দিয়েছে। একইভাবে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা নেরিকা ধানের বীজ সরবরাহের ফলে কৃষকরা বিপাকে আছে। এরমধ্যে বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতিরেকে নতুন করে বিটি শস্য চাপিয়ে দিলে কৃষকেরা আর এক বিড়ম্বনার শিকার হতে পারে।


কিউ আর ইসলাম
: কৃষি, পানি ও পল্লীউন্নয়ন বিশ্লেষক।