একটি রায় এবং একটি সাক্ষাৎকার

আসিফ মুনীর
Published : 31 July 2013, 01:09 PM
Updated : 31 July 2013, 01:09 PM

সাম্প্রতিক দুটি ঘটনায় আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারিনি। একটি হল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের প্রতীক হিসেবে কুখ্যাত গোলাম আযমের বিচারের রায়। আরেকটি হল আল জাযিরা গণমাধ্যমে দেওয়া বিচারাধীন পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সাক্ষৎকার।

আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্ত সেখানটাতেই গোলমাল বাধছে। এই যে বিশেষ আইন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বিশেষ বিচারকাজ চলছে– সেটার প্রতি, দেশে-বিদেশে সরকার ও সরকারের বাইরের কে কতটুকু আস্থা রাখছেন, সে ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। নানা মুনির নানা মত থাকতেই পারে, কিন্তু স্বাধীন দেশে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন রাখা যাবে না বা রাখতে দেওয়া হবে না, এমন নজির বোধকরি বিশ্বের খুব কম জায়গায় দেখা যায়।

আর সব কথা বাদ দিলাম, সাম্প্রতিক রায় ও বিচারকাজ নিয়েই বলছি। সেদিন দেখলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইউরোপের যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করতে নতুন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। তার মানে সেই আদালতে আগের মতোই সম্ভাব্য 'বুড়ো' যুদ্ধাপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এবং প্রমাণ অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তি দেবে। এটা আশা করছি, কারণ সেটাই লজিক্যাল বা স্বাভাবিক বা আগেও তাই হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে গোলাম আযমের রায়ের সময় বলা হল তার অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য, প্রমাণিতও; কিন্তু তার বেশি বয়সের কথা বিবেচনা করে সেই শাস্তি একটু লঘু করা হল! তখন ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের আস্থাটা একটু নড়বড়ে হয়ে ওঠে না কি?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গুম, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ বা ধর্ষণ করেছিল বা সেসব কাজে ইন্ধন জুগিয়েছিল, সহায়তা করেছিল– তারা তো বয়স বিবেচনা করে অপরাধের মাপকাঠি কমায়নি। আমি তখন ছিলাম নিতান্তই শিশু। আমার মতো অনেক শিশু পিতৃহারা হবে বা বুদ্ধিজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বুড়ো মানুষ বলে তাকে মারা যাবে না এসব তো গোলাম আযমেরা ১৯৭১-এ বিবেচনা করেননি। আমার বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরীর আত্মা কি এ রায় থেকে শান্তি পেলেন, না একটু কেঁপে উঠলেন? বোধকরি দ্বিতীয়টি।

তবু বিচারকবৃন্দের রায় মেনে নিলাম। কারণ আমি এ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু আমি বিস্মিত আইনমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রায়ে সন্তুষ্ট জানতে পেরে। শহীদদের আত্মা কি তাদের সন্তুষ্টির কথায় কষ্ট পায়নি? আইনের বিধান থেকেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় সে কথা আইনমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন না। তাতে আদালত অবমাননাও হয় না।

আবার রায় থেকে জানা গেল, গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের পরও সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশে প্রচারণা চালিয়েছেন। সে ব্যাপারে আইনমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেন না। রায়ে শুধু সন্তুষ্টি জানিয়ে তারা দুজন শহীদ পরিবারগুলোকে কিছুটা আশাহত করলেন বলেই মনে করি।

পারলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতাম, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বয়সের কারণে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলেও কি তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন? না-জেনেই বলতে পারি, মনে হয় না। তাই আইনমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি জানতে পেরে হাসি পেল যেমন, মনের কোণে একটু ক্ষোভও জমা হল।

অন্য ঘটনাটি ঘটল ২১ জুলাই, ২০১৩। সেদিন আল জাযিরায় প্রচারিত হল চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সাক্ষাৎকার। সেখানে সে আমাদের ট্রাইব্যুনালকে 'ক্যাঙ্গারু কোর্ট' বলেছে। আমি তাকে এটা প্রমাণ করার জন্য এখানে চ্যালেঞ্জ করলাম। সকল দেশপ্রেমিকেরই তা করা উচিত। আমাদের যে কোর্টকে সে 'ন্যায়বিচারের পরিপন্থী' বলছে, সেই কোর্টে আমার পরিবারের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছি আমি। সে সময় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নিয়োজিত চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষের আইনজীবী আমাকে যেভাবে জেরা করেছেন– তা দেখে ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমার আস্থা বরং আরও বেড়ে গেছে।

আগ্রহী পাঠকরা আল জাযিরায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সাক্ষাৎকারটি দেখতে পারেন।

গত বছরের এক স্কাইপ-কেলেঙ্কারির ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালকে তিরস্কার করা হাস্যকর ব্যাপার। যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ নিয়ে একের পর এক সাক্ষ্যগ্রহণ যেভাবে চলছে, তা মিথ্যা প্রমাণ করতে একজন চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের মুখের কথাই যথেষ্ট নয়।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীন সাক্ষাৎকারে বলেছে, সে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ঢাকায় 'পূর্বদেশ' পত্রিকায় কাজ করত। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযান সে সমর্থন করেনি। সে ইসলামী ছাত্র সংঘ থেকে পদত্যাগ করেছিল। সে আল বদরের নেতা ছিল না। এটা প্রমাণ করার জন্য নাকি তার হলের রুমমেটরা সাক্ষ্য দিতে আসবে।

আমার প্রশ্ন হল– তাহলে যে পরিবারগুলো স্বজন হারাল এবং স্বজনদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছেন বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তারা কি ভূত দেখেছেন না মিথ্যা বলছেন? এতজন মানুষ তাহলে মিথ্যাবাদী আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির! আর ঢাকায় পত্রিকায় কাজ করলেই যে সে বদর বাহিনীর নেতা হতে পারবে না, গোপনে ফেনী ও ঢাকার নির্যাতন ক্যাম্প পরিচালনা করতে পারবে না, এ কথা প্রমাণ হয় না।

আমি বিশ্বাস করি যে সত্য চিরকালের জন্য ধামাচাপা দেওয়া যায় না। প্রায় ২৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলেছে এবং তার নির্দোষ হওয়ার পক্ষে যথাযথ প্রমাণ দিতে পারেনি। সাহস থাকলে, নির্দোষ হলে তার উচিত হেবে দেশে ফিরে ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হওয়া। নয়তো সে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিস্তারিত প্রমাণ দাখিল করুক। কিন্তু আমরা জানি, কোনোটাই সে করবে না। কারণ তার মন পরিষ্কার নয়। সে তো অপরাধী।

আমি বলব, সন্তুষ্টির কথা বেশি বেশি না বলে সরকারের উচিত ন্যায়বিচারের জন্য যা-যা করা দরকার তাই করা। তাতে যেন সবার আগে আমরা, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারি। তার মধ্যে রয়েছে গোলাম আযমের রায় নিয়ে আপিল করা; ১৯৭১-এর পর গোলাম আযমসহ অন্যরা যারা বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা বলেছে, তাদের বিচারকাজ নতুন করে শুরু করা; ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে আলাপ সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিকল্পনা পেশ করা; একইভাবে বিচারপ্রক্রিয়া ও আদালতের আইনগত ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ তৈরি করা এবং ট্রাইব্যুনাল ও বিচার সম্পর্কে রাজনৈতিক স্টান্টবাজিমূলক বক্তব্য পরিহার করা।

আশা করি এ দেশের নাগরিক ও শহীদ পরিবারের একজন হিসেবে আমি খুব বেশি কিছু চাইনি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে হচ্ছে না, এটা ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জাতির দায়মুক্তি। আমাদের মা-বাবারা প্রাণ দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ছাড়া সেই স্বাধীনতা পূর্ণ হয় না।

সে রকম পরিপূর্ণ এক বাংলাদেশের প্রত্যাশায় রইলাম।

৩০ জুলাই, ২০১৩

আসিফ মুনীর: শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ৭১-এর সহ সভাপতি।