অর্থমন্ত্রীর পাঁচ বাজেট ও স্যানিটেশনের তৈলাক্ত বাঁশ-বাওয়া

ডা. মো. খায়রুল ইসলাম
Published : 19 March 2011, 03:23 PM
Updated : 13 June 2013, 05:24 PM

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য ব্যয়-বরাদ্দও বিভিন্ন বাজেটে রেখেছেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে বেশ মনোযোগী ছিলেন।

তবে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করেছে বা তাকে এসব ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে তারা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে বলে মনে হয় না। বরং উদ্ভট ও পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করেছেন। অর্থমন্ত্রীর পাঁচটি বাজেট-বক্তৃতা একে একে বিশ্লেষণ করলে তা বের হয়ে আসবে।

২০০৯-১০ সালের অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী তার প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় (১১৫ অনুচ্ছেদ) ২০১৩ সালের মধ্যে সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে বললেন, "বর্তমানে দেশে প্রায় ৮৮ শতাংশ পরিবার স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করছে। এ হার আগামী বছরের মধ্যে ১০০ শতাংশের কাছাকাছি উন্নীত করার চেষ্টা থাকবে।"

ভালো কথা। এক বছর পর দেখা গেল পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। তাহলে কী বলবেন তিনি? তাই আমাদের অর্থমন্ত্রী ২০১০-১১ সালের বাজেট-বক্তৃতায় অগ্রগতির কোনো খতিয়ান না দিয়ে ৫ লাখ এবং ২০১০-১১ বছরে প্রায় ২ লাখ স্যানিটারি ল্যাট্রিন বানানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন (অনুচ্ছেদ ১০০)।

দু বছর পরে তার তৃতীয় বাজেট-বক্তৃতায় (২০১১-১২) (অনুচ্ছেদ ৮৯) তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, "আমরা ২০১৩ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।"

তিনি আবার শতাংশে ফেরত গেলেন এবং দেশবাসীকে জানালেন, "বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহারকারী পরিবারের হার প্রায় ৯০.৬ শতাংশ।"

আমরা বুঝতে পারলাম, দুটি অর্থবছরে স্যানিটেশনে ২.৬ শতাংশ পয়েন্ট উন্নতি হয়েছে; এ হারে যদি সরকারের মেয়াদকালে উন্নতি থাকে তবে শতভাগ স্যানিটেশন হতে আরও ৭ বছর লাগবে। অর্থাৎ সরকারের এ সংক্রান্ত নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন হবে না। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব খানিকটা উদ্যোগী হলেও মন্ত্রীদ্বয় মহাব্যস্ত নানাবিধ কাজে; আর স্যানিটেশন-সংক্রান্ত কর্মকর্তারা ব্যস্ত পরিতোষণমূলক পরিসংখ্যান দিয়ে নীতিনির্ধারকদের তুষ্ট করে রাখতে।

তার পরিণতি দেখা গেল অর্থমন্ত্রীর পরের বছরের, অর্থাৎ ২০১২-১৩ সালের বাজেট-বক্তৃতায় (অনুচ্ছেদ ১০০)। আবারও ২০১৩ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সন্তোষজনক উল্লেখ করে তিনি জানালেন, "বর্তমানে ৯১ শতাংশ পরিবার স্যানিটেশনের কভারেজের আওতায় এসেছে যা সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ।"

উন্নয়ন বিষয়ে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে তারা জানেন যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীশিক্ষা, নারীস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পুষ্টি ইত্যাদি নানা বিষয়ে শ্রীলংকা শুধু সার্ক দেশসমূহের মধ্যে নয় বরং অন্যান্য দেশের চেয়েও অগ্রগামী। যারা বাজেট-বক্তৃতার রসদ যোগান দেন তাদের বস্তুনিষ্ঠতা উচ্চমানের হওয়া বাঞ্ছনীয়; কিন্তু তারা যদি তোষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তবে সরকারের সমূহ বিপদ। সরকার তাই শুনতে পান যা শুনতে মন যায়; তা বাস্তব নাও হতে পারে। তাই হচ্ছে; এবং শেষ বছরে এসে তাদের পরম্পরা জ্ঞানও সম্ভবত বিপাকে পড়েছে।

তাই অর্থমন্ত্রী তার পঞ্চম, অর্থাৎ ২০১৩-১৪ বাজেট-বক্তৃতায় (অনুচ্ছেদ ৮০) আর ২০১৩ সালের মধ্যে সবার জন্য স্যানিটেশনের কথা উল্লেখ না করেই বললেন, "আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ৯০ শতাংশ পরিবারকে স্যানিটেশনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫ জেলা, ১১৪ উপজেলা, ৫৮ পৌরসভা এবং ১ হাজার ৩৮৭ ইউনিয়নে শতভাগ স্যানিটেশন কাভারেজ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।"

অর্থাৎ আমাদের অর্থমন্ত্রী জানালেন, বাংলাদেশে স্যানিটেশনের কভারেজ গত এক বছরে ১ শতাংশ কমেছে অর্থাৎ ৯১ শতাংশ থেকে কমে ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা যেন স্যানিটেশন বানরের মতো তৈলাক্ত বাঁশ বেয়েছে; তিন বছরে ৩ শতাংশ বেড়ে আবার এক শতাংশ কমেছে। স্যানিটেশনের সার্বিক হার ১ শতাংশ কমে যাওয়া সত্ত্বেও কী করে হঠাৎ ৫ জেলা, ১১৪ উপজেলা, ৫৮ পৌরসভা এবং ১ হাজার ৩৮৭ ইউনিয়নে শতভাগ স্যানিটেশন কাভারেজ অর্জন করে ফেলল তা রহস্য থেকে গেল!

অর্থমন্ত্রীর পাঁচটি বক্তৃতার ভাষ্য থেকে উপসংহার টানা যায় যে বাংলাদেশে গত চার বছরে স্যানিটেশনে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এবং তা বর্তমানে ৯০ শতাংশে আছে। প্রতি বছরে ০.৫ শতাংশ হারের অগ্রগতির এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্যানিটেশন-সংক্রান্ত নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন ২০১৩ সালে তো হবেই না; সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ২০ বছর লাগবে।

প্রকৃত বাস্তবতা হল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালে প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনের হার ৫১.৫ শতাংশ। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ২০১১ সালের আদমশুমারী ও গৃহগণনার হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনের হার ৬১.৬ শতাংশ।

ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের সদ্যপ্রকাশিত যৌথ প্রতিবেদন ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশে উন্নত ল্যাট্রিনের হার ৫৫ শতাংশ। স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে এমডিজি অর্জনের যাচাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ীই করা হয়ে থাকে। অর্থমন্ত্রীকে যারা এ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেছেন তারা সম্ভবত ভিন্ন কোনো সংজ্ঞা বা তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন যার সঙ্গে সেক্টরের জ্ঞানের মিল নেই।

বাংলাদেশ সুপেয় পানির ক্ষেত্রে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে থাকলেও স্যানিটেশনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পথচ্যুত। স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তৃণমূল মানুষ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নানা পেশাজীবী ও সরকারি কর্মকর্তারা মিলে বাংলাস্যান ২০১১ ঘোষণার মাধ্যমে সকলের জন্য স্যানিটেশনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। গত তিন বছরে তার প্রতি তেমন সুবিচার করা হয়নি; দেওয়া হয়নি তেমন কোনো গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় অর্থায়ন।

সময় এসেছে মূল্যায়নের। স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে পরিতোষণমূলক পরিসংখ্যানের কৃত্রিম আত্মতৃপ্তিতে তুষ্ট না থেকে কঠিন বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন থেকে সুস্পষ্ট যে বানরের কিংবা স্যানিটেশনের তৈলাক্ত বাঁশ বাওয়ার অংক জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ পছন্দ করে না।

তাই আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে স্যানিটেশনে শতভাগ লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতির ব্যাখ্যার পাশাপাশি আগামীদিনের করণীয় সম্পর্কে জানাতে হবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ।

বিষয়টি সরকারি এবং বিরোধী দল উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ডা. মো. খায়রুল ইসলাম : জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ।

(নিবন্ধে উল্লিখিত মতামত লেখকের নিজস্ব, প্রতিষ্ঠানের নয়)