কর্নেল তাহের কেন জাসদে যোগ দিয়েছিলেন

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 30 Nov 2012, 03:02 PM
Updated : 30 Nov 2012, 03:02 PM

শিরোনামের বিষয়ে বিশদে বলার আগে জাসদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাটি বলে নেই। তা এই জন্য যে, জাসদের সঙ্গে তাহেরের সংযোগ আমার মাধ্যমেই হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির কিছুদিন পরই একটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। আমরা কয়েকজন ছাত্র লেখাপড়া ছেড়ে টেকনাফ অঞ্চলে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের নেতা ছিলেন প্রয়াত সিরাজ শিকদার। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সদ্য তিনি পাশ করে বেরিয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তিনি। তাঁর যে রাজনৈতিক তত্ত্ব আমাদের আকৃষ্ট করেছিল, তা তখনকার দিনে প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেছিলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ। শুধুমাত্র একটি সশস্ত্র জাতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন মাতৃভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘাটি এলাকা গড়ে তুলতে হবে। টেকনাফ অঞ্চলকে বেছে নেয়ার কারণ, ঐ অঞ্চলে নাফ নদী পার হলেই ওপারে আরাকান রাজ্য। বার্মার বহু বিস্তৃত জায়গা তখন সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে। সে সময়টায় সারা পৃথিবী জুড়ে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছে। সমাজতান্ত্রিক চীন তাতে সক্রিয় সমর্থন দিচ্ছে। বার্মীজ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির। নাফ নদী পেরিয়ে আরাকান ও পেগু পাহাড় অতিক্রম করে আমরা চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথাও ভেবেছি।

সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করবার সিরাজ শিকদারের চিন্তা আমাদের পরিবারের আবাল্য লালিত স্বপ্নের সাথে মিশে গেল। কারণ আমাদের পরিবারেও আমার ভাই কর্নেল তাহের, আমার বড় বোন শেলী আপা এই সব কথা বলতেন। তাহের শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন না, ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। কমান্ডো বাহিনীর অফিসার তাহের ছুটিতে বাড়ি এলেই আমাদের শেখাতেন অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল, খালি হাতে যুদ্ধ ও নানা যুদ্ধ সরঞ্জাম বানাবার পদ্ধতি। গেরিলা যুদ্ধের নীতি কৌশলের উপর আমাদের ক্লাশ নিতেন।

১৯৬৯ সালে যখন সারাদেশে আইয়ুব-বিরোধী প্রবল গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে এবং দেশে চলছে ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল, তখন দ্বিতীয়বারের মত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগ করেছি। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে আমাদের বিপ্লবী প্রচেষ্টায় আমরা তাহেরকেও যুক্ত করেছিলাম। চট্টগ্রামের টু কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান থেকে তাহের দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ঢাকায় কলাবাগানে আমাদের মেঝভাই আবু ইউসুফের বাসায় প্রতিদিন তিনটি ব্যাচে বিপ্লবী যুবকদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নীতি-কৌশল শেখানো শুরু করেছেন। সাথে আছেন সিরাজ শিকদার। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তাহের এবং আমার সম্পর্ক স্থায়ী হলো না। প্রশিক্ষণ চলাকালে মত পার্থক্য ঘটলো। সেই ১৯৬৯ সালেই আমরা বুঝে ছিলাম সিরাজ শিকদার নিঃসন্দেহে একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহসী বিপ্লবী হলেও তিনি সম্পূর্ণরূপে একজন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তি। গণতান্ত্রিকতা ও যৌথ নেতৃত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল নন। সে সময়ে হাস্যকর এই যুক্তি তিনি হাজির করলেন যে, তাহের যেহেতু একজন পেটিবুর্জোয়া সামরিক অফিসার, তাই তার কাছ থেকে কোন সামরিক শিক্ষা নেয়া যায় না। তাঁর এই ভ্রান্ত মতের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। ১৯৬৯ সালেই সিরাজ শিকদারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতি ঘটে আমাদের। পুনরায় লেখাপড়ায় চলে আসি আমি।

এ পর্যায়ে আমার সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঐ অংশটির সঙ্গে যারা সেই ১৯৬২ সাল থেকে আমাদের পরিবারের মত স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা তারা ভাবছে। তাহের তখন পশ্চিম পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন দেশে। ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের আমার বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছি সূর্যসেন স্কোয়াড। গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা ইতোমধ্যেই বন্ধুরা জেনে গেছে। জেনেছে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্কের শুরু এবং তা ছিন্ন হওয়ার কথাও। সূর্যসেন স্কোয়াড নামটি আমার দেয়া। তবে আমাকে এ স্কোয়াডের অধিনায়ক মনোনীত করেছে ছাত্রলীগের বন্ধুরা। সে কঠিন সময়ে এদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক ঐক্য ও বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তারই পথ বেয়ে স্বাধীনতার পর আবারও তাদের সঙ্গে গড়ে উঠলো যোগাযোগ। মাঝখানে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাত থেকে ২৭ মার্চের সকাল পর্যন্ত সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের। আমি ও আমার স্কোয়াডের কয়েকজন সদস্য অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে। ২৭ মার্চ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা এই দ্ইু ঘন্টার জন্য যখন কারফিউ শিথিল করা হয়, তখন আমরা নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করি। তার পূর্বে প্রতিজ্ঞা করি, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করবো।

আমাদের পরিবারের বড় বড় দুর্ভাগ্যের একটি হলো, ১৯৭১-এর যুগসন্ধিক্ষণে তাহের ছিলেন সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে। আজ দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা বলতে পারি, সে সময় যদি তাহের এ দেশে থাকতেন, তাহলে একদিকে যেমন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রবক্তা 'নিউক্লিয়াসের' সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে যেত আমার মাধ্যমে। অন্যদিকে এই বিপ্লবী ধারার পেছনের মানুষটি যার আহ্বানে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার মন্ত্রে জেগে উঠেছিল, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাহেরের সংযোগ হতো আবশ্যিকভাবেই। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানী আক্রমণের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। কিন্তু তাঁর গ্রেফতার এবং সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টি অন্তরীণ থাকার ফলে জাতি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল অর্থাৎ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্ছিত হয়। যে কর্নেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু তাঁর সামরিক পরামর্শদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন (স্মরণযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাকের ডিফেন্স এ্যাডভাইজার হয়েছিলেন এই ব্যক্তিটি), বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া অরাজনৈতিক ও প্রচলতি সেনাবাহিনীর ধ্যান-ধারণার অফিসারগণ মুক্তিযুদ্ধের নীতি-কৌশল প্রণয়নে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সে সময় তাহের বাংলাদেশে থাকলে ভ্রান্ত সমরনীতির কারণে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতিটি হয়েছিল, তা হয়তো হতো না। ১৯৭১ সালের ২০ জুলাই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আগস্ট মাসে তাহের যখন ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন ইতোমধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে নিয়মিত বাহিনীর ব্রিগেডের আদলে জিয়াউর রহমানের নামে 'জেড ফোর্স', খালেদ মোশাররফের পক্ষে 'কে ফোর্স' এবং শফিউল্লার নামে 'এস ফোর্স'। বাংলাদেশের মাটিতে নয়, ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে গড়ে তোলা জনগণ-বিচ্ছিন্ন এই তিনটি বিগ্রেড নিয়েই পরবর্তীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়। সেই ষাটের দশক থেকে এ দেশকে স্বাধীন করবার জন্য তাহেরের সঠিক চিন্তা – জনযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের বাহিনী গড়ে তোলা, যা হবে স্বাধীন দেশের জনগণের সেনাবাহিনীর ভিত্তি – তা কর্নেল ওসমানী ও উল্লিখিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচলিত ভাবনার সেনানায়কেরা গ্রহণ করতে পারেন নি। মুক্তিযুদ্ধের সে সময় থেকেই তাহের স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কতটা সংকটাপূর্ণ হয়ে গেছে।

আমাদের পরিবারের আরও একটি দুর্ভাগ্য আছে। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ১৪ নভেম্বর তারিখে ঢাকার প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত কামালপুর শত্রুঘাটি দখলের সম্মুখ যুদ্ধে মারাত্মকভাবে তাহেরের আহত হওয়া এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে চিকিৎসাধীন থাকা। মুক্তিযুদ্ধে আমি ১১ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে অধিনায়ক তাহেরের একজন স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সেই সূত্রে তাহেরের যুদ্ধ পরিকল্পনা জানবার বিরল সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাহের জানতেন, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রলম্বিত হতে দেবে না। একটি স্বল্পস্থায়ী নির্ধারক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অতিদ্রুত স্বাধীন করতে চাইবে তারা। বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তে ময়মনসিংহ ও রংপুরের একাংশ নিয়ে বিস্তৃত ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব তাহের এ কারণে গ্রহণ করেছিলেন যে, এই সীমান্তের সব চাইতে দূর্ভেদ্য কামালপুর শত্রুঘাটির পতনের পর শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করা যাবে দ্রুততম সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভারতীয় পরিকল্পনার কথা তাহের জানতেন বলে তিনি ঠিক করেছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তি দলগুলোকে রাজধানী ঢাকার দিকে আগে ভাগে পাঠিয়ে দেয়ার। অন্যদিকে যোগাযোগ রাখছিলেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা যুদ্ধ নেতাদের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে ছিলেন রংপুরের রৌমারী মুক্তাঞ্চলের সুবেদার আফতাব, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী এবং ভালুকার মেজর আফসার। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন ভারতীয় মিত্র বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করবার আগেই ১১ নম্বর সেক্টর ও উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবেন। আহত হয়ে গৌহাটি, লখ্নৌ এবং পুনা সামরিক হাসপাতালে তাহেরের সাহায্যকারী হিসেবে আমাকে সেক্টর থেকে পাঠানো হয়েছিল। সে সময়ে যুদ্ধের ডামাডোলের বাইরে তাঁর কাছ থেকে সেইসব পরিকল্পনা শুনবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজী যখন মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করছেন, তখন পুনা হাসপাতালে শয্যাশায়ী তাহের আক্ষেপ করে বলছেন, তিনি আহত না হলে পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হতো যৌথ বাহিনীর কাছে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তাঁর নিজস্ব বাহিনী এবং ঢাকার চারপাশ থেকে ও বিভিন্ন সেক্টর থেকে আগুয়ান মুক্তি বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ঢাকায় সেই অবস্থার সৃষ্টি করতে পারতেন, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন ছাড়া পরাজিত পাকিস্তান ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা থাকতো না।

১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে নকল পা লাগিয়ে তাহের বাংলাদেশে ফিরে এলে কর্নেল ওসমানী তাঁকে নিয়োগ দেন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে। ওসমানীর ইচ্ছা ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে থেকে পুরো নয় মাস আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এমন একজন সিনিয়র অফিসার কর্নেল মাসুদকে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল করে তার অধীনে ডেপুটি হিসেবে তাহেরকে দায়িত্ব দেয়া। তাহের তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাধ্য হয়ে ওসমানীকে তাঁর মত পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং তাহের হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। কিন্তু ইতোমধ্যেই স্বাধীন দেশে নতুন সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে গুরুতর ভুলগুলো হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভুলের কথা আগেই বলেছি। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশে এমন সেনাবাহিনীর গোড়াপত্তন করা হলো, যা অবিকল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি বাংলাদেশ কপি মাত্র। এ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেসামরিক গেরিলাদের নেয়া হলো না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার বাহিনীর যারা সহযোগিতা করেছে, সেইসব বাঙালি সামরিক অফিসারদের নেয়া হলো। তাহেরের ভাষায় যাদের স্থান হবার কথা ছিল শ্রম শিবিরে বা কারাগারে। স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করবার তাহেরের স্বপ্ন এবং লক্ষ কোটি মানুষের স্বপ্ন এভাবেই একেবারে গোড়া থেকে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করে। অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে থাকা কালেই আমার মাধ্যমে তাহের জানতে শুরু করেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ধারাটির কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাহের প্রথমে একটি বেলুচ ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ান এবং পরে স্পেশাল সার্ভিস গ্র"প হিসেবে পরিচিত দুর্ধর্ষ কমান্ডো বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিনি চেয়েছিলেন সক্রিয় অধিনায়কত্ব। সে সুযোগটিও তিনি পেয়েছিলেন। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত ৪৪তম ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব দেয়া হয় তাহেরকে। অন্যদিকে ঢাকায় অবস্থিত ৪৬তম ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক হয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে তাহেরের সঙ্গে পালিয়ে আসা তাঁর বিপ্লবী চিন্তার অনুসারী কর্নেল জিয়াউদ্দিন।

কুমিল্লাতে সক্রিয় অধিনায়কত্ব গ্রহণের পূর্বে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ট্রাইবুনালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহেরকে। আসামীর কাঠগড়ায় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৯ম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এমএ জলিল। কথিত আছে, বাংলাদেশ থেকে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী বাহিনীর ভারী অস্ত্রসস্ত্র ভারতে নিয়ে যাবার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মেজর জলিল। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষি হিসেবে আনা হয়েছিল ঐ সব ব্যক্তিদের, যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাগারেও ছিল। ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে তাহের মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে সসম্মানে ম্ুিক্ত দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তারিখে যখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা হলো, তখন সে দলের সভাপতি হয়েছিলেন মেজর এমএ জলিল। কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার থাকাকালে তাহের তাঁর অধীনস্থ ৪৪তম ব্রিগেডের অফিসার ও সিপাহীদের নিয়োজিত করেছিলেন নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগে।

এ সময়ের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে অবস্থানকালে তাহের এবং ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সম্মিলিত চেষ্টায় একটি সামরিক অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করে দেয়া। পরবর্তীতে তাহেরকে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে ডাইরেক্টর ডিফেন্স পার্চেজ পদে নিয়োগ দেন। তাহের স্পষ্ট বুঝেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে, তা থেকে কি ভয়াবহ বিপদ ধেয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকদের প্রতি। সক্রিয় অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুর কাছে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক পদত্যাগপত্রে তাহের তাঁর সকল শংকার কথা লিখেছেন। আজ ভাবতে অবাক লাগে, কি নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছিলেন তাহের সেদিন। ৪৪তম এবং ৪৬তম এই দুইটি ব্রিগেডের দুইজন প্রগতিশীল সেনানায়ক যথাক্রমে, কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে সেনাবাহিনী ছেড়ে যেতে হলো। অন্যদিকে তাহেরের পদত্যাগপত্রে উল্লিখিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের রেখে দেয়া হলো সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে।

স্মরণ করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি যখন সেনাবাহিনীর ভিতরে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করছে, তখন এইসব অফিসার যথাক্রমে চীফ অব স্টাফ শফিউল্লাহ, ডেপুটি চীফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান এবং চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ, যারা সেই মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের নামে তিনটি ব্রিগেড গড়ে তুলেছিলেন, তাদের কেউ সেদিন জাতির জনককে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। শুধু তাই নয়, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী ও ইতোপূর্বে অজানা ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র বিষয়ে এরা কম বেশি জানতেন। কিন্তু তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবার কোন উদ্যোগ তারা নেননি। সেনাবাহিনীতে স্বল্পকালীন সময়ে অবস্থানকালে তাহের এধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের কোন ষড়যন্ত্র করবার ইচ্ছা থাকলে তাহের কিংবা জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনীতে তাঁদের উচ্চ পদ থেকে কখনই পদত্যাগ করতেন না। এঁরা উভয়ে সেনাবাহিনী ছেড়ে বিপ্লবী রাজনীতিতে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন যুক্ত হয়েছিলেন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দলের সঙ্গে এবং তাহের জাসদের সঙ্গে।

জাসদে যোগদানের পূর্বেই তাহের বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে ব্যাপক মত বিনিময় করেছিলেন। এ সকল বৈঠকে আমি নিজেও অংশ নিয়েছি। তাহের যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন জনাব বদরুদ্দিন উমর, কমরেড তোয়াহা, মনজুরুল আহসান খান, আবুল বাশার, সিরাজুল হোসেন খান, দেবেন শিকদার এবং সিরাজ শিকদার ছাড়াও অন্যান্য বামপন্থী নেতৃবৃন্দ। পূর্বে উল্লেখ করেছি আমার মাধ্যমে তাহের জেনেছিলেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিপ্লবী ধারাটি সম্পর্কে যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এ ধারাটি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটিকে প্রবলভাবে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। স্বায়ত্ত্বশাসন বা পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন দাবির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধকালে এরাই গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যা মুজিব বাহিনী নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিল। বাম বিপ্লবী রাজনীতির ধারকদের সঙ্গে তাহেরের মতবিনিময়কালে আমি জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে এসেছিলাম তাঁর কাছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে 'ফরিদপুর হাউজ' নামে পরিচিত বাড়ির একটি ফ্লাট যেখানে আমার মেঝভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম থাকতেন, সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সমাজ বদলের লড়াইয়ের রূপরেখা প্রশ্নে সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছালেন তারা। আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য পরে আরো বহু বৈঠক হয়েছে। ড. আখলাকুর রহমান, মেজর জলিল, আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, কামরুজ্জামান টুকু ও এবিএম শাহজাহানসহ সে সময়ের তরুণ বিপ্লবীরা এসেছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁরা আলোচনা করেছেন বিপ্লবের নীতি ও কৌশল নিয়ে। তাহের আমাকে বলতেন, তার মনে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাঁর সহযোগিদের তিনি পেয়ে গেছেন।

রাজনৈতিক বিতর্কের ধারায় সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থার রূপটির কথা তাহের জানলেন এবং তাঁর ভিত্তিতে বিপ্লবের স্তর কি হবে তা জ্ঞাত হলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য থেকে উঠে আসা এই দারুন প্রতিবাদি তরুণ বিপ্লবী শক্তি সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবচেয়ে যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত কথা বলছেন। এর তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে একটু বলি – সিরাজুল আলম খানের আদর্শিক নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের প্রগতিশীল তারুণ্য যারা মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামি অংশ ছিল, তারা শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণতা দানের বলিষ্ঠ ঘোষণা নিয়ে হাজির হয়েছিল তখন। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার রূপটি চিহ্নিত করতে তারা তখন ব্যাপকভাবে চিরায়ত প্রগতিশীল সাহিত্য অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেছে। এ পর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমানের সঙ্গে। ১৯৭২-এ ড. আখলাক 'সাপ্তাহিক হলিডে' পত্রিকায় বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এ লেখার মাধ্যমে ভবিষ্যত জাসদ নেতৃত্বের সাথে তার সংযোগ ঘটে। পরে ড. আখলাকের নেতৃত্বে তারা "বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ" শীর্ষক প্রবন্ধটি রচনা করেন। এ প্রবন্ধে দেখানো হয়, কিভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল খাত কৃষিতে ইতোমধ্যেই পুঁজিবাদ প্রধান প্রবণতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে এবং তা সমগ্র অর্থনীতির নিয়ামক হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে জাসদের নবীন নেতৃত্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আওয়াজ তোলেন। সমাজ সম্পর্কে মুখ্যত পুঁজিবাদি বিকাশের কথা বললেও এখানে বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ সম্পর্কেও জাসদ নেতৃত্বের উপলদ্ধি ছিল। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অপূর্ণতার বিষয়েও তারা সচেতন ছিলেন। তাই সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অপূর্ণ জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে পূর্ণতা দেয়ার কথা তারা বললেন। বিদেশি আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খবরদারি ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে জাসদ নেতৃত্ব জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অপূর্ণতার দিক হিসেবে চিহ্নিত করতেন।

রাজনৈতিক রণকৌশল হিসেবে তারা গণতান্ত্রিক জাতীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে সংগ্রামে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঘটিয়ে তার অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশের কথা বলা হয়। এই বিপ্লবের মাত্রা নির্ভর করবে নিপীড়িত শ্রেণী কতটুকু সংগঠিত হলো তার মাত্রার উপর। গ্রাম এবং শহরের শ্রমিক শ্রেণী ও গরিবেরা বিপ্লবের শক্তি হিসেবে কতটুকু সংগঠিত হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে জাসদ নেতৃবৃন্দ গণঅভ্যুত্থানকে ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে মাওসেতুং-এর প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের চৈনিক মডেল নয়, বরং বলশেভিক ধাঁচের অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে যথার্থ বলে মনে করেছিলেন তারা।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরে সমাজে পরিবর্তনের চাহিদা তখন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত হাজার হাজার তরুণ যারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিলো, নতুন রাজনৈতিক ঐসব আহ্বান তাদের দ্রুত আকৃষ্ট করে। সেনাবাহিনীতেও সাধারণ সৈনিকেরা জাসদের উত্থানকে আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। এসব বাস্তবতায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ঝাঁক নবীন বিপ্লবীর রাজনৈতিক সংযোগটি দৃঢ় হতে থাকে। আমার মনে আছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন বাম বিপ্লবীদের সঙ্গে তুলনা করে তাহেরের মনে হয়েছে বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাসদের এই নবীন শক্তির পক্ষেই কেবল সম্ভব হবে সবচেয়ে সফলভাবে সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের প্রতিভাবান তরুণ সংগঠকদের মধ্যেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন সেই সম্ভাবনা যাদের নেতৃত্বে এ দেশের নিপীড়িত মানুষ সমাজ বদলের লড়াইয়ে সংগঠিত হবে। তাই বলা যায়, জাসদের বিপ্লবী নেতৃত্বের আহ্বানের মধ্যে তাহের দেখেছিলেন তার আবাল্য-লালিত স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা। তিনি মনে করেছিলেন, ছাত্রলীগের যে রেডিক্যাল অংশটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে, তাদের পক্ষেই সম্ভব সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরও একটি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জাসদের রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গেও তাহের একমত হয়েছিলেন। তাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নব উত্থিত বিপ্লবী শক্তি জাসদে তাহেরের যোগ দেয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল। অত্যন্ত সচেতনভাবেই গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাহের তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

জাসদের ৪০ বছর পূর্তিতে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, জাসদে যোগদান প্রশ্নে তাহেরের সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল কি না। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জাসদ ঘোষিত রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী রচিত আন্দোলনসমূহ সময়ের কষ্টি পাথরে যাচাই করে তার যথার্থতা বিচার করতে হবে। জাসদ সূচিত বড় বড় আন্দোলন, বিশেষ করে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে জাসদের সহযোগিতায় তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থান বিষয়ে গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। ঐ অভ্যুত্থান সফল হয় নি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লব সফল হয়েছিল। এর মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে প্রগতি-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগটি পেয়ে যায়। তবে শুধুমাত্র প্রগতিশীল শক্তির এই পরাজয়ের মধ্যে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ না করে আমাদের ভাবতে হবে সামনের দিনগুলোর কথা। নভেম্বর অভ্যুত্থানে পরাজয় এবং তাহেরসহ অগণিত বিপ্লবীদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে জাসদের বিপ্লবী রাজনীতির ইতি হয়ে গেছে, তা ভাববার কোন কারণ নেই। যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজ প্রগতির ধারায় আমরা দেখেছি সমাজের নবতর শক্তি কিভাবে পরবর্তী অবস্থার উপযোগি করে পরিবর্তনের ধারায় নিজেদের তৈরি করেন ভবিষ্যৎ নির্মাণে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই পাঠ নিতে হবে জাসদের আপসহীন ধারাটির সংগ্রামী ইতিহাস থেকে। বিশেষ করে ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান এবং এর সাথে সামরিক শাসন-বিরোধী গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে। তাহেরের ফাঁসির মঞ্চে জীবনদান এবং তার উদ্দীপ্ত উচ্চারণ-"নিঃসঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোন সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারি। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই" নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রজন্মকে আলোড়িত করবে। যেমন বলিভিয়ায় চে'গুয়েভারাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। চে' কিংবা তাহেরের মৃত্যুহীন লাশই আমাদের তরুণদের স্বপ্ন দেখায়, পথ বাতলে দেয়, আগামী সমতার পৃথিবীর।

সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে জাসদের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নি কোনভাবেই। বরং সারা পৃথিবী জুড়ে অন্যায়, অবিচার, আধিপত্যের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের যে ঢেউ ও দোলাচল আমরা লক্ষ্য করছি, যা থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয় – সেই প্রেক্ষাপটে জাসদের বিপ্লব ও সংগ্রামের সমৃদ্ধ ইতিহাস বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে হবে। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবে, স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর একদল একনিষ্ঠ বিপ্লবী কি প্রবলভাবেই না মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে সংগ্রামী ইতিহাস রচনা করেছেন। অকাতরে জীবন দিয়েছেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও সমাজ বদলে জাসদের বিপ্লবী প্রচেষ্টা সফল হয় নি। কিন্তু যে সমৃদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস তারা রচনা করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের বাস্তবতায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার লড়াইয়ে সামিল করা জাসদের পোড় খাওয়া সংগ্রামী এবং আপোষহীন নেতা ও সংগঠকদের এক ঐতিহাসিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে তাঁরা কতটুকু সমর্থ হবেন, মুখ্যত তার উপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতের বিপ্লবী আন্দোলন ও সংগ্রামের সম্ভাবনা।

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন : কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ।