সাঁওতাল বিদ্রোহ ও সমতলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 1 July 2015, 07:35 AM
Updated : 1 July 2015, 07:35 AM

সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। ঘন মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূর্য। তবু চনকালির মাঠে ভিড় জমিয়েছেন আদিবাসীরা। হাতে হাতে ফুলের তোড়া। নামিদামি ফুল নেই তাতে। অচেনা সব ফুলের মাঝে মুখ তুলে আছে কেবল কয়েকটি চেনাফুল, জবা। মাঠের পাশে ছোট্ট একটি স্মৃতিসৌধ। তাতে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নানা বয়সী আদিবাসী। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছেন সিধু-কানুকে।

দিনাজপুরের এই গ্রামটি সাঁওতালদের। প্রতি বছরের ৩০ জুন আদিবাসী এই গ্রামে চলে এ রকম আয়োজন। এরা নিজেদের 'সানতাল' বলতে বেশি পছন্দ করেন। তাই তাদের কাছে দিনটি 'সানতাল বিদ্রোহ দিবস'। অনেকে আবার বলেন, 'সিধু-কানু দিবস'।

শ্রদ্ধা শেষে শুরু হয় কলাগাছে তীর বিদ্ধ করার খেলা। নানা ঢঙে তীর-ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা অংশ নেন খেলাটিতে। একটি শেষে শুরু হয় আরেকটি। চোখ বেঁধে হাঁড়িভাঙ্গা। এটি সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী খেলা। কলাগাছে তীরবিদ্ধ ও লাঠি দিয়ে হাঁড়িভাঙ্গাকে এরা অপশক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করেন।

হঠাৎ মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। খেলা থামিয়ে সবাই ছুটে পালান মাঠ থেকে। কেউ বটের তলায়, কেউ রাস্তার পাশে বা দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নেন। আমাদের ঠাঁই মেলে মাঠের পাশের একটি বাড়িতে।

এখানকার আদিবাসী সমিতি প্রতিবারই ঘটা করে পালন করে সিধু-কানু দিবস। সমিতির সভাপতি বিমল মার্ডি। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। পরিবারে বাবা মা ধর্মান্তরিত না হলেও বছর দুয়েক আগে তিনি গ্রহণ করেছেন খ্রিস্টান ধর্ম। আদিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়ে বেশ ভালো তথ্য জানেন তিনি। মিশন থেকে আনা বই সমৃদ্ধ করেছে তার জ্ঞানভাণ্ডার। বৃষ্টির সময়টাতে বিমলের সঙ্গে সিধু-কানুকে নিয়ে আমাদের আলাপ জমে। কান পেতে শুনি ইতিহাসের নানা তথ্য।

সাঁওতালরা সে সময় জঙ্গল কেটে চাষাবাদের জমি তৈরি করতে। সে জমিতে চোখ পড়ে কোম্পানির অনুগত জমিদারদের। সাঁওতালরা মেহনত করে ফসল ফলাতেন, কিন্তু ব্যাপারি আর মহাজনরা সামান্য দেনার অজুহাতে তাদের ঠকাত। ফলে সাঁওতাল কৃষকদের দেনা কখনও শেষ হত না। দেনা পরিশোধের জন্য অনেককে মহাজনের বাড়িতে পরিবারসহ গোলামি করতে হত। শুধু তাই নয়, এরা আদালত আর পুলিশ থেকেও কোনো সাহায্য পেতেন না। বরং পুলিশ কাজ করত শোষক শ্রেণির স্বার্থে। এতে ক্রমেই সাঁওতালদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।

১৮৫৪ সালের প্রথম দিকের কথা। গোপনে সাঁওতালরা শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। বীর সিংএর নেতৃত্বে তৈরি হয় একটি দল। কিন্তু টিকতে পারেন না তাঁরা। পাকুড় রাজার দেওয়ান জগবন্ধু রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় বীর সিংকে ধরে আনা হয়। জরিমানা করেও পরে সবার সামনে তাঁকে জুতাপেটা করা হয়।

বিমল এবার শুরু করেন গোচ্চোর কথা। গোচ্চো ছিলেন ধনী সাঁওতাল। তাঁর টাকার ওপর ছিল মহাজনদের বিশেষ লোভ। তাই তারা মহেশ দারোগাকে দিয়ে তাঁকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া হয় চুরির মামলা। জমিদার, মহাজন আর পুলিশের এ জুলুম-পীড়নের কাহিনি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাঁওতালরা ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হতে থাকেন।

সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ছিলেন চার ভাই। সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে এঁদের জন্ম। এক সময় এঁরা বেশ সচ্ছল ছিলেন। একবার ফসল না হওয়ায় মহাজনদের কাছে তাদের দেনা বেড়ে যায়। ফলে ক্রমেই তাঁরা দরিদ্র হয়ে পড়েন।

বীর সিং আর গোচ্চোর অপমান ও পীড়ন সিধু-কানুর মনে দাগ কাটে। সাঁওতালদের ওপর জুলুম আর অত্যাচার দেখে তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। জমায়েত হবার জন্য চারপাশের সাঁওতালদের কাছে পাতাসমেত ছোট শালের ডাল পাঠান তাঁরা। এভাবে ডাক দেওয়ার রীতিটি ছিল সাঁওতালদের ঐতিহ্য।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিধু-কানুর ডাকে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল একত্রিত হন ভাগনাদিহি গ্রামে। সেদিন তাঁরা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। সবাই শপথ নেন, জমিদার মহাজন, ইংরেজ শাসক, পুলিশ-পাইক-পেয়াদা আর জজ ম্যাজিস্ট্রেটদের নিপীড়ন ও দাসত্ব সহ্য করবেন না। সে সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় খাজনা না দেওয়ার। বিদ্রোহী কণ্ঠে সবাই স্লোগান দিতে থাকেন, 'জমি চাই, মুক্তি চাই'।

সেদিন সাঁওতাল চরিত্রের বিদ্রোহী রূপ সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়। এ নিয়ে বীরভূমের সমসাময়িক কবি কৃষ্ণদাস রায় 'সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া' লিখেন। তার কয়েক চরণ:

শুন ভাই বলি তাই সভাজনের কাছে

শুভবাবুর হুকুম পেয়ে সাঁওতাল ঝুঁকেছে

বেটারা কুক্ ছাড়িল জড়ো হৈল হাজারে হাজারে

কখন আসে কখন লুটে থাকা হৈল ভার।

গেল কুমড়াবাদে সকল ফদে হৈল একাকার

ঘরে অগ্নি দিয়ে বেটারা করলে ছারখার।

পোড়াইলে ধানের গোলা, তিল জুল্যা সরিষা আদি যত

গরু মহিষ ছাগল ভেড়া পুড়িল কত শত।

আর সাঁওতালরা? তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন:

নেরা নিয়া, নুরু নিয়া
ডিডা নিয়া ভিটা নিয়া…

ভাবার্থ:

স্ত্রী-পুত্রের জন্য

জমি-জায়গা বাস্তু-ভিটার জন্য,

হায়! হায়! এ মারামারি, এ কাটাকাটি

গো-মহিষ লাঙ্গল ধন-সম্পত্তির জন্য,

পূর্বের মতো আবার ফিরে পাবার জন্য

আমরা বিদ্রোহ করব।

বিমল জানালেন, তারা বিশ্বাস করেন সিধু-কানুর সংগ্রামে পরাজয় ছিল, আপস ছিল না। সে সময় ইংরেজ শাসকবর্গও এ কথা স্বীকার করেছে। ওল্ডহাম সাহেব লিখেছেন:

''পুলিশ ও মহাজনের অত্যাচারের স্মৃতি যাদের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিল, আন্দোলন তাদের সকলকেই আকৃষ্ট করল; কিন্তু যে মূল ভাবধারা কাজে পরিণত করবার চেষ্টা চলছিল তা ছিল সাঁওতাল অঞ্চল ও সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা।''

সে সময় বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন ছটরায় দেশমাঝিও। বিদ্রোহের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:

''বিদ্রোহ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে সিধু-কানু জাহির করল, আমরা মহিষ-টানা লাঙ্গল ৮ আনায় ও বলদে টানা লাঙ্গল ৪ আনায় দেব আর সরকার আমাদের কথা না রাখলে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব, দোকোদের খতম করব এবং আমরাই রাজা হব।''

অরণ্যরাজ্যে সুখশান্তিতে বসবাস করার জন্য সাঁওতালরা জমি করেছে, গ্রাম বসিয়েছে, শান্তির দেশ গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেই শান্তির দেশে তাদের শ্রমের অংশ লুট করে নেবার জন্য কোম্পানির অনুগত জমিদার ও মহাজনরা হাত বাড়ায়। তারা প্রতিবাদ জানালে ব্রিটিশ শাসকরা কর্ণপাত করে না। তাদের সহ্যের সীমা যখন অতিক্রম করল তখন তারা বহুদিনের জমানো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাই সিধু-কানুর ডাকে হাজার হাজার সাঁওতালদের কণ্ঠ থেকে সেদিন উচ্চারিত হয়:


নুসাসাবোন, নওয়ারাবোন চেলে হঁ বাকো তেঙ্গোন,

খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো

খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো,

দিশম দিশম দেশমৗঞ্জহি পারগানা

নাতো নাতো মাপাঞ্জিকো

দঃ বোন দানাং বোন বাং গেকো তেঙ্গোন

তবে গেবোন হুলগেয়া হো।

ভাবার্থ:

আমরা বাঁচব, আমরা উঠব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না

আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব

আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব

দেশের মাঝি ও পারগানারা

গ্রামের মোড়লরা

আমাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে, কেউ পাশে দাঁড়াবে না

তবে আমরা নিশ্চয়ই বিদ্রোহ করব।

এভাবে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহ। বারহেট দখলের পরই সিধু-কানু সাঁওতাল বাহিনী গড়ে তুলতে লাগলেন। সে সময় রেলপথ তৈরি হচ্ছিল বলে জোয়ান জোয়ান সাঁওতাল ছেলেরা কাজে গিয়েছিল। তাদের ডেকে আনা হল যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। এছাড়া সাঁওতাল নেতারা গ্রামে গ্রামে শালডাল পাঠাতে লাগলেন। সাঁওতালদের কাছে শালডাল হল একতার প্রতীক। তারা দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান গেয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার জন্য। গ্রামের নাম উল্লেখ করে তারা গাইলেন:

ধানজুড়ি হে

ঢোল বাজে হে

ঢাক বাজে হে

সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো

হুলে হু……. লে।

ভাবার্থ:

শুন হে ধানজুড়িবাসী, ঢোল বাজছে, ঢাক বাজছে, সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো, বিদ্রোহ, বি… দ্রোহ।

গ্রামবাসীর কাছ থেকে যদি সাড়া না মিলত তখন তারা খোঁচা দিয়ে গাইতেন:

ধানজুড়ি হে

জানি হইল ম… রদ

মরদ হইল জা… নি

হে হে হে…. হে'।

সিধু-কানুর কী হয়েছিল? দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সে ইতিহাস বলেন বিমল:

''নভেম্বরের শেষভাগে জামতাড়া এলাকা থেকে বন্দি হয় কানু। সিধু ধরা পড়ে তার আগেই ঘাটিয়ারিতে। পরে তাকে ভাগনাদিহি গ্রামে নিয়ে হত্যা করা হয়। কানুর বিচার হয় আদালতে। বিচারে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।''

বিমল মার্ডি মনে করেন, সাঁওতাল বিদ্রোহীরা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের উদ্দেশ্য বিফলে যায়নি। এ সংগ্রাম বাংলার ও ভারতের কৃষক সংগ্রামের ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করেছে। বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনি পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণা জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে সাঁওতালদের সংখ্যালঘুর স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাদের জন্য পৃথক সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয়, সেখানে জমির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পায়।

সময় গড়িয়েছে। কিন্তু এদেশে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা আজও পায়নি তাদের ভূমির নায্য অধিকার। বিশেষ করে সমতলের আদিবাসীদের অধিকাংশ জমি ছিল কালেকটিভ। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর সেগুলো জমিনদারি খাস হয়ে যায়। এখনও অনেক এলাকায় আদিবাসীরা থাকছে, চাষ করছে এমন জমিকে সরকার খাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এছাড়া ব্যক্তিমালিকানার জমিগুলোও আদিবাসীরা দখলে রাখতে পারছে না। প্রশাসনের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আদিবাসীদের জমিগুলো দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালিরা। এ নিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই।

সমতলের আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় আলাদা কার্যকরী ভূমি কমিশন গঠন করা এখন জরুরি। সে সঙ্গে জমির ওপর তাদের প্রথাগত মালিকানারও স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। তাহলেই সাঁওতাল জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সত্তা ও সংস্কার নিয়ে টিকে থাকার প্রণোদনা পাবেন।

ছবি: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।