যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৩৩ ‘‘রাজাকারদের দলও নিষিদ্ধ করতে হবে’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 26 June 2015, 10:38 AM
Updated : 26 June 2015, 10:38 AM

এক মুক্তিযোদ্ধার পায়ের ভেতর একাত্তরের গুলি। চুয়াল্লিশ বছর ধরে তিনি তা বয়ে বেড়াচ্ছেন। জোরে হাঁটতে পারেন না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলেই গুলিটি মাংসের ভেতর কামড়ে ধরে। তখন যন্ত্রণায় ছটফট করেন। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি মুক্তিযোদ্ধার দেহে। কোনোভাবেই এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাই নিভৃতে সে বেদনা মনে পুষে রেখে দিন কাটাচ্ছেন।

খবরটি জানলাম আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সুধীর চন্দ্র রায়ের কাছ থেকে। আগ্রহী হয়ে ওই নিভৃতচারী বীরের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিই। অতঃপর এক বিকেলে পা রাখি মিরপুরে ওই মুক্তিযোদ্ধার ভাড়াবাড়িতে। তাঁর জীবনপ্রবাহ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা বিষয় নিয়ে চলে আলাপচারিতা।

তাঁর নাম দেলোয়ার হোসেন। বাবা ডা. আলতাফ হোসেন মোল্লা এবং মা সাজেদা বেগম। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাড়ি পটুয়াখালির বাউফল উপজেলার রাজনগর গ্রামে। বাবা ছিলেন হোমিও চিকিৎসক।

দেলোয়ারের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বগা হাইস্কুলে। সেখানে তিনি পড়েন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। অতঃপর চলে যান খুলনার খালিশপুরে। সেখানকার ক্রিসেন্ট জুটমিলে চাকরি করতেন তাঁর বড় ভাই আনোয়ার হোসেন। প্রথমে খালিশপুর চরেরহাট হাই স্কুল এবং পরে তিনি ভর্তি হন পটুয়াখালী সরকারি কলেজে। কলেজে তিনি ছাত্র সংসদের সদস্য ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওই কলেজেরই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র।

ছোটবেলার কথা উঠতেই দেলোয়ার বলেন:

''পাশের বাড়ির বন্ধু সিরাজ মৃধা ও বাচ্চুর কথা এখনও মনে পড়ে। বাচ্চুর পড়ার ঘরটি ছিল পুকুরপাড়ে। সেখানে আমরা একত্রিত হতাম। রাত জেগে আড্ডাও দিতাম। শীতের রাতে দলবেঁধে রস জ্বাল দিয়ে খাওয়ার মজাটা ছিল অন্য রকম। মাঝে মাঝে চাঁদা তুলে চলত মুরগি-ভোজন।

স্কুলে পড়ার সময় স্কাউট করতাম। কলেজে পড়ার সময় ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিলাম। সেটি করান পাকিস্তানি এক সুবেদার মেজর। ট্রেনিংয়ের সময় মাঠে তিনি সবাইকে বলেছিলেন, 'জীবনের কোনো এক সময় এই ট্রেনিং তোমাদের কাজে আসবে।' সত্যি তাই ঘটল! ক্যাডেট প্রশিক্ষণটি পরে কাজে লেগে গেল মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে।''

দেলোয়ার দেশের সব খবর পেতেন রেডিওতে। ১৯৭০ সালের ২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন পটুয়াখালীতে, বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে। দেলোয়ার তখন খুব কাছ থেকে দেখেন নেতাকে। তাঁর ভাষায়, 'এমন চেহারা, এমন চাহনি আমি এ যাবত কারও দেখিনি।'

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাঁকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। ''বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে… আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি….। এর পরপরই পটুয়াখালী শহরে গঠন করা হয় সংগ্রাম কমিটি। গোপনে শতাধিক যুবককে দেওয়া হয় ট্রেনিং। ট্রেনিং চলত জুগলি স্কুলের মাঠে। তোহা নামে এক আনসার কমান্ডার ছিলেন প্রশিক্ষক।''

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হয় নারকীয় গণহত্যা। পটুয়াখালীতে সে খবর আসতেই দেলোয়ারসহ অন্যরা শহরের চারপাশে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মহিলা কলেজ ছিল তাদের সেন্টার। সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন কাশেম উকিল (আওয়ামী লীগের কাশেম উকিল নামে খ্যাত)। দেলোয়ার বলেন:

''এলাকায় বিহারির সংখ্যা ছিল বেশি। তাদের বড় একটি অংশ পাকিস্তানিদের অনুসারী ছিল। আমরা তাদের নেতাদের ধরে আনি সেন্টারে। কিন্তু বেশি দিন রাখতে পারিনি। দুএকদিন পরেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করে পটুয়াখালী শহর দখলে নিয়ে নেয়। আমরা তখন কোনো রকমে নৌকা নিয়ে ইটবাড়িয়া ও লাউকাঠি হয়ে চলে আসি জলিসায়। সেখান থেকে লেবুখালি হয়ে ক্যাম্প করি পাদ্রি শিবপুরের একটি স্কুলে। খ্রিস্টান পাদ্রিদের বাস ছিল সেখানে। দায়িত্বে ছিলেন ব্রাদার জল্লাদ, ব্রাদার ওজে।''

তারা কি তখন সহযোগিতা করেছিলেন?

''হ্যাঁ, সংখ্যায় আমরা ছিলাম ২০০ জনের মতো। পাদ্রিরা খাবার ও চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন আমাদের। নদীপথে গেরিলা সেজে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর আক্রমণ করেই আমরা আবার ফিরে আসতাম পাদ্রি শিবপুরে। ট্রেনিং ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে এভাবেই আমরা যুদ্ধ করি কিছুদিন।''

পরে ট্রেনিং নিলেন কোথায়?

''শিবপুর থেকে আমরা কয়েকজন চলে আসি বরিশালে। খবর পাই সেখানে মেজর আবদুল জলিল মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করছিলেন। আমরাও লাইনে দাঁড়াই। তিনি জানতে চাইলেন পরিবারে আমরা কয় ভাই। আমরা দুই ভাই এবং আমি দুজনের মধ্যে ছোট শুনেই আমাকে নিয়ে নিলেন। অনেকে সেদিন বাদ পড়েছিল। পরিবারের বড় ও একমাত্র ছেলেদের কিছুতেই রিক্রুট করা হত না। ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টরে ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম ও ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর। জুনের শুরুতে আমরা চলে আসি মেহেরপুরে। মুজিবনগরে চলে আমাদের দু মাসের ট্রেনিং।''

কোথায় কোথায় অপারেশন করেন?

''ট্রেনিং শেষে আমাদের আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে। সেখানে গেরিলা অপারেশন করি পাদ্র্রি শিবপুর, বাকেরগঞ্জ, দগদগিয়া, শ্যামপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। আক্রমণ করে সরে পড়াই ছিল নিয়ম।কারণ ট্রেনিংয়ে শিখানো হয়েছিল, হিট অ্যান্ড রান।''

এক অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হন মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার। সে গুলিটি বের করা যায়নি। এখনও তা তাঁর শরীরে। কী ঘটেছিল সে দিনে? জানতে চাই আমরা। খানিকটা নিরব থেকে দেলোয়ার স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন চুয়াল্লিশ বছর আগের রক্তাক্ত সে দিন।

''নভেম্বরের শেষের দিকের কথা। বাউফল থানা থেকে পাকিস্তানি আর্মি ছোট ছোট লঞ্চে করে খালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ছিলাম দশ থেকে পনের জন। কালিশ্বরী নামক জায়গায় খালের একপাশে একটি ঝুপড়িতে পজিশন নিয়ে আছি। ফায়ার করতেই তারা বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে আমার ডান পায়ে। সেটি ঢুকে যায় উরুর ভেতরে। পা নাড়াতে পারছিলাম না। তাকিয়ে দেখি রক্তে পা ভিজে গেছে। পাশ থেকে এক সহযোদ্ধা এসে গামছা দিয়ে পা বেঁধে দেন। সব কিছুর মধ্যেই আমরা গুলির প্রত্যুত্তর দিচ্ছিলাম। তাই আমাদের সংখ্যায় বেশি ভেবে পাকিস্তানি সেনারা নদীপথে লঞ্চ নিয়ে পিছু হটে যায়।''

চিকিৎসা নিলেন কোথায়?

মুচকি হেসে এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধার উত্তর:

''দুএকদিন চিকিৎসা ছাড়াই সেখানেই থাকি। কিন্তু পায়ের যন্ত্রণা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে একটা ছোট ডিঙি নৌকায় আমাকে লঞ্চে তুলে নেয় সহযোদ্ধারা। বরিশাল সদর হাসাপাতালে চিকিৎসা চলে প্রায় একমাস। স্বাধীনতার পর ভর্তি হই পিজি হাসপাতালে। কিন্তু গুলিটা হাড়ের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তা আর বের করা সম্ভব হয়নি।''

পরিবারের সঙ্গে কি যোগাযোগ ছিল?

প্রশ্ন শুনে দেলোয়ারের বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। কষ্টগুলো জল হয়ে ভিজিয়ে দেয় তাঁর দুচোখ। আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন:

''বাবার প্রতি অনেক অভিমান ছিল। বাড়িতে ছিল আমার সৎ মা। সবাই জানত আমি মরে গেছি। যুদ্ধের সময় একরাতে গোপনে দেখা করতে যাই বাবার কাছে। আমাকে পেয়ে বাবার সে কী আনন্দ। সেদিন বাবা পাশে বসিয়ে আমাকে খাওয়ালেন। অন্য রকম আদর করলেন। থেকে যেতে বললেন। বিদায়ের সময় জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন।''

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা বললেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধরা কোন বেলায় কোথায় খাবেন জানতেন না। সাধারণ লোক খাবার দিয়ে সাহায্য করতেন। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী আর মুক্তিকামী জনতা। এ জনতার সহযোগিতা ছিল বলেই মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই অপারেশনগুলোতে জয়ী হতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আক্তার মুকুলের চরমপত্র শুনতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন দেলোয়াররা। আজও তাঁর মনে পড়ে 'বিছুয়া বাহিনীর কেইসকা মাইর' শিরোনামের চরমপত্রটির কথা।

কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। দেলোয়ারের মতে, সরকার বদল হলেই যদি তালিকা বদল হয় তবে কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করা সম্ভব হবে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় হয়েছে, কিন্তু তবু তালিকা নিয়ে বির্তক কমেনি। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার পর বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যখন প্রথম গঠন হয় তখনই সম্ভব ছিল সঠিক তালিকা তৈরি করা।

দেরিতে হলেও স্বাধীন এ দেশে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারদের বিচার হচ্ছে। দুই রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এটা ভেবেই আত্মতৃপ্ত হন এই যোদ্ধা। তবে তিনি মনে করেন, রাজাকারদের দল জামায়াত-শিবিরকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না। বন্ধ হবে না পেট্রোল বোমা ও মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতি।

এরপর মুখে দৃঢ়তা ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। তিনি বলেন:

''আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, বোনকে যারা তুলে দিয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে, তাদের ক্ষমা নেই। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তাদের ক্ষমা করে রাজনীতিতে এনেছিলেন। সে কারণেই রাজাকারদের গাড়িতে উড়েছে স্বাধীন দেশের পতাকা। ইতিহাস কলঙ্কিত করেছেন তিনি। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করত তখন। আমি মনে করি, রাজাকারদের যারা পুনর্বাসিত করেছে, তারাও রাজাকার।

বঙ্গবন্ধু সততার কথা বলতেন। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও সাহস মানুষকে আকৃষ্ট করতো। তিনি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। এখন হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। টাকা ছাড়া তো চাকরি হতে দেখি না। শুধু প্রধানমন্ত্রী সৎ হলেই হবে না। গোটা শাসক দলটির সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। অপরাধ করলে দলীয় লোকদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।''

দেশ অনেক এগিয়েছে। শিক্ষায়, কৃষিতে, চিকিৎসায় আমাদের সাফল্য এসেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাগুলো আমাদের জীবনযাপন ও সেবা সহজ করে তুলেছে। কেউ স্বীকার না করলেও সবাই কিন্তু টের পাচ্ছে যে, দেশটা বদলে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে পরবর্তী প্রজন্মকেই দেশের হাল ধরতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

''তোমরা দেশের ইতিহাস জেন। বাঁচিয়ে রেখ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মনে রাখবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই তোমার গৌরবের ইতিহাস।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন।

ট্রেনিং নেন: ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টরের মেজর মেহেদি আলী ইমাম, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর এর অধীনে মেহেরপুরের মুজিবনগরে দু মাস ট্রেনিং নেন।

যুদ্ধ করেছেন: ৯ নং সেক্টরে।

যুদ্ধাহত হন: ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকের কথা। বাউফলের কালিশ্বরী নামক জায়গায় ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলিটি হাড়ের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তা আর বের করা সম্ভব হয়নি। চুয়াল্লিশ বছর ধরে তিনি তা বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখন জোরে হাঁটতে পারেন না। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই গুলিটি মাংসের ভেতর কামড়ে ধরে। তখন যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতে থাকেন।

ছবি: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।