যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ২৪ ‘‘সেরা বুদ্ধিজীবীদের ওরা হত্যা করেছিল’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 13 Dec 2014, 02:43 AM
Updated : 13 Dec 2014, 02:43 AM

নাম তাঁর ছানাওয়ার উদ্দিন আহমেদ। গ্রামের সবাই ডাকে 'ছানু মিয়া' বলে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জেদি আর দুরন্ত। হান্নান, আকলু, ফুরুত মিয়া, হারুন, বিরেন, দেবনাথ, গিতেশসহ জনা পনের বন্ধু তার। লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল, গোল্লা গেইম, কাবাডি খেলা আর পুকুরে ঝাঁপাঝাপি করেই কাটান দিনগুলো। মাঝেমধ্যে নানা উসিলায় বাড়িছাড়া হন। রাত কাটান দূর গ্রামে, পুঁথিপাঠের আসরে। তাঁর কৈশোরের দুরন্ত জীবন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু জীবনের সে গতি একদিন পাল্টে গেল।

বন্ধুদের মধ্যে হান্নান ছিলেন সবচেয়ে দুষ্ট। একবার ক্লাসে পড়াতে আসেন নতুন ধর্ম শিক্ষক। নামকরা মাওলানা তিনি। ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছিলেন। পেছনে গিয়ে হান্নান মাওলানাকে ব্যঙ্গ করে নানা অঙ্গভঙ্গি করতে থাকেন। তা দেখে গোটা ক্লাসেই হাসির রোল ওঠে। অপমানিত হন মাওলানা। ক্ষিপ্ত হয়ে সকলকেই লাঠিপেটা করেন। লাঠির আঘাতে দাগ পড়ে কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও-বা সারা শরীরে। গোটা ক্লাসেই কান্নার রব ওঠে।

একজনের কারণে কেন সবাই মার খাবে? প্রতিবাদ করেন ছানু মিয়া। বেরিয়ে যান ক্লাস থেকে। প্রধান শিক্ষক হয়ে এ খবর চলে যায় তাঁর বাবা আলহাজ্ব কণা মিয়ার কানে। ছানু মিয়াদের পরিবারের বেশ নামডাক ছিল। তাই পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার অপরাধে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।

ছানু মিয়ার কিশোর মনে তখন ঝড় ওঠে। মাওলানার কাছে মাফ না চাওয়ায় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়। বাবার ভয়ে মাস খানিক পালিয়ে থাকেন এ বাড়ি ও বাড়ি। পরে দাদা কাবিল মোহাম্মদ তাঁকে ফিরিয়ে আনেন বাড়িতে। তবে ছানু মিয়া আর ক্লাসে ফিরলেন না। লেখাপড়ায় ইতি টানলেন ক্লাস টেনে পড়তেই।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার উদ্দিন আহমেদ ওরফে ছানু মিয়ার মুখে শুনছিলাম তাঁর কৈশোরের না-বলা কথাগুলো। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গাবদেব গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। সাত ভাই ও চার বোনের সংসারে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মুরাউরা প্রাইমারি স্কুলে। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর তিনি ভর্তি হন দিনারপুর হাই স্কুলে।

নিজে লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার প্রতি তিনি ছিলেন সচেতন। তাঁর ভাষায়:

''বড় ভাই জালাল আহমেদ তখন চলে গেছেন লন্ডনে। ছোটদের দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। চিন্তা ছিল ওদের কীভাবে ভালো লেখাপড়া করাব। একটা বাড়ি ভাড়া করে ওদের নিয়ে চলে আসি হবিগঞ্জ শহরে। ভর্তি করে দিই ভালো স্কুল ও কলেজে। ভাইবোন সবাই মাস্টার্স পাশ করেছে, এটা ভাবলেই তৃপ্ত হই।''

সে সময় দেশের অবস্থার কথা জানালেন তিনি। এদেশের আয়ের টাকা চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, পাকিস্তানিদের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন শেখ মুজিব। ছানাওয়ারদের এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন মানিক চৌধুরী। রেডিও থেকে ওরা নানা খবরাখবর জেনে যেতেন। সত্তরের নির্বাচনের পর তো ওরা ক্ষমতা দিল না, শুরু হল অসহযোগ। একাত্তরের ৭ মার্চ ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এই ভাষণই ছানোয়ারের জীবনটা ওলটপালট করে দিল।

কীভাবে?

তিনি বলেন:

''দিদারপুর হাই স্কুলের স্টাফরা ছিল আমার খুব ক্লোজ। কাজী আজিজুর রহমান নামে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একজন বিকম স্যার ছিলেন। ৮ মার্চ সকালে চায়ের দোকানে বসে আমরা গল্প করছি। আজিজুর বললেন, যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই। ওখানেই রেডিওতে শুনি ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে…। কথাটা মনে গাইথা যায়। তখনই নিয়ত করে ফেলি। দেশের জন্য প্রয়োজনে এক ভাই না হয় চইলা যামু। দেশটা তো বাঁচব।''

ছানাওয়ার উদ্দিন প্রথম যুদ্ধ করেন একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম দিকেই। একদিন খবর পান বাঙালি ইপিআর, আর্মি, পুলিশ, আনসার সদস্যরা হবিগঞ্জ কোর্টের সামনের মাঠে জড়ো হচ্ছেন। সেখানে মেজর সিআর দত্ত, রব সাহেব, মানিক চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। সংগ্রহ করা ১০০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে মাঠের মধ্যেই তাঁরা ছানাওয়ারদের একদিনের ট্রেনিং দেন। পরে চারটি ট্রাকে সবাই রওনা দেন প্রতিরোধ গড়তে। মৌলভীবাজারে আরও অনেকে যোগ দেন।

এভাবে সব মিলে হলেন দেড়শ মতো। এরপর দলটি সিলেটের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণে পজিশন নেন। কমান্ডে মেজর সি আর দত্ত। পাকিস্তানি সেনারা ছিল উত্তরে। শুরু হয় গোলাগুলি। এক সময় ওরা মাইল দেড়েক পেছনে গিয়ে হাদিপুরে অবস্থান নেয়। ছানোয়ারদের দলটি এর কারণ বুঝে উঠতে পারেননি। একদিন পরেই বিমান থেকে শেল পড়তে থাকলে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। অনেকেই মারা পড়েন তখন। জীবন নিয়ে ছানোয়ার পালিয়ে যান নিজ গ্রামে।

আপনাদের ওখানে আর্মি গেল কোন সময়টায়.. আমাদের প্রশ্ন… আর ছানোয়ারের উত্তর–

''নবীগঞ্জে পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিল ইসমাইল মোল্লা। প্রথম দিকে সে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে নানা খবর পৌঁছে দিত। পরে তার মাধ্যমেই গ্রামে আর্মি আসে। এখন সে পলাতক রয়েছে। এপ্রিলের ওই যুদ্ধের পর গ্রামে পালিয়ে গেলেও, ভারতে যাওয়ার খোঁজ-খবর নিতে থাকলাম। জুলাইয়ের মাঝামাঝির কথা। নুরুউদ্দিন, রশিদসহ এক রাতে আমরা দেশের টানে ঘর ছাড়ি। হাওড় পার হয়ে পায়ে হেঁটে ৩ দিনে পৌঁছাই বালাট বর্ডারে। সেখান থেকে গেলাম বড়চরা ট্রেনিং ক্যাম্পে। একুশ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখানো হয় গ্রেনেড থ্রো, স্টেনগান, এসএলআর ও হালকা মেশিনগান চালানো। ক্যাম্পে ইন্ডিয়ান আর্মিদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের মেজর মোতালেব। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ১৫৭০৫।''

ট্রেনিং শেষে প্রথম দিকে ওঁরা ভারতেই থাকতেন। ওঁদের ছিল পনের-বিশ জনের দল। দেশের ভেতরে ঢুকে অপারেশন করে আবার ফিরে যেতেন ভারতে। ওঁরা আসলে ছিলেন গেরিলা। পাকিস্তান আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে আক্রমণ করেই সরে পড়তেন তাই। কিন্তু অক্টোবরের শেষে ছানোয়াররা ভেতরে আসতে থাকেন। অংশ নেন সম্মুখ যুদ্ধে।

ছানোয়ারের মুখে শুনি বাকি বৃত্তান্ত:

''৪ নং সেক্টরের জালালপুর সাব সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদীর আন্ডারে ছিলাম আমি। আমরা অপারেশন করি মৌলভীবাজার, আখালকুর, বগার হাওয়র, নবীগঞ্জ থানা, চৌধুরী বাজার, শেরপুর, তেইল্লাপাড়া প্রভৃতি স্থানে। এমনই এক অপারেশনে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। ওই পায়ের দিকে তাকালে আজও সবকিছু জীবন্ত হয়ে উঠে ''

রক্তাক্ত দিনটির আদ্যোপান্ত শুনি তাঁর জবানিতে:

''আমরা দিনারপুর পাহাড়ে। ক্যাম্প করে থাকি আশি জনের মতো। রাজাকারদের খবর নিয়ে এল আশপাশের লোকেরা। চৌধুরী বাজার মাদ্রাসার নিচে বাঙ্কার করেছে তারা। রাত হলেই সেখানে ধরে নিয়ে আসত বাঙালি মেয়েদের।

আমরা প্রথমে রেইকি করি। এক রাতে সেখানে আক্রমণ চালাই। কয়েকজনকে ধরলেও বেশ কিছু রাজাকার পালিয়ে আশ্রয় নেয় নবীগঞ্জ থানায়।

আমরাও তখন প্রস্তুতি নিই থানা আক্রমণের। থানায় কিছু বাঙালি স্টাফ আর রাজাকার ছাড়া কেউ নেই, এমনটাই ছিল আমাদের ধারণা। সাদী ভাই বললেন, 'ওরা তো বাঙালি। ওদের মের না। সারেন্ডার করিয়ে অস্ত্রগুলো নিয়ে এস। অস্ত্র নিলেই দেখবে পাবলিক ওদের পিটিয়ে মারছে।'

আমরা গেলাম ত্রিশ জন। কমান্ডে আবদুর রশিদ। থানার একদিকে হবিগঞ্জ আর অন্যদিকে সিলেট যাওয়ার রাস্তা। দুই সড়কেই আমরা ১০জন করে মুক্তিযোদ্ধা রাখলাম। কমান্ডারসহ আমরা দশজন ভেতরে মুভ করি। থানার সামনে গিয়ে জমির আইলে পজিশন নিই।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত তখন ২টা। প্রথমে আমরাই ফায়ার ওপেন করি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। পাকিস্তানি এক সেনা ওদের কমান্ড করছে। পাকিস্তানি আর্মিরা যে থানায় পজিশন নিয়ে আছে এ খবর আমরা পাইনি।

পরিকল্পনা ছিল গুলির সিগনাল পেলেই সড়কের দল দুটি কাউন্টার অ্যাটাক করবে। কিন্তু তা হল না। পাকিস্তানি আর্মির অবস্থান টের পেয়ে ওরা ক্যাম্পে ফিরে গেল। আমরা কী করব ভাবছি। কানে এল পাকিস্তানি এক সেনা কমান্ড করছে চৌদ্দ নম্বর বাঙ্কার থেকে অ্যাটাক করার। আমরা ছিলাম ওই বাঙ্কারটির কাছাকাছি।

আমার পাশে ধ্রুব নামে এক ছেলে। ক্লাস এইটে পড়ত সে। বলল, 'দাদা, দাঁড়ান, আমি ওগো উঠাইতাছি।'

ওর হাতে ছিল এসএলআর। সেটি ফেলে দিয়ে সে দুটি গ্রেনেড কোমরে গুঁজে নেয়। বাঙ্কারে থ্রো করতে ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে যায়। আমরাও সাপোর্টিং ফায়ার করি। হঠাৎ গুলির তোড়ে সে ছিটকে এসে পড়ে আমার সামনে। 'মাগো' শব্দটাও শেষ করতে পারে নাই, বাবা, তার আগেই শেষ। গুলিটি লাগে তার মাথায়। চোখের সামনে তরতাজা ছেলেটা মারা গেল। তার মুখটা আজও ভুলতে পারি না।

আহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন ছানাওয়ার উদ্দিন আহমেদ:

একটা দুইটা গুলি করে আমরা পেছনে সরে পরার পরিকল্পনা করছি। সকাল হয়ে এসেছে। চারপাশটা ফকফকে। আমার সঙ্গে ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা। চা বাগানে শ্রমিকের কাজ করত সে। একটা উঁচু বাড়ির ওপাশে যেতে পারলেই আমরা সেইফ। তাই করলাম। বাড়ির ওপরে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি দূরে একটা বন্দুক তাক হয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি লাফ দিই।

ফলে গুলিটি আমার বুকে না লেগে বাঁ পায়ে লাগে। পা উঠাতে পারছিলাম না। রক্তে ভরে যাচ্ছে। সাহসটা ছিল বেশি। মাফলার দিয়া পাটা শক্ত করে বেঁধে দিলাম। কিন্তু তবুও রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। শরীরটাও দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। চা শ্রমিককে সরে পড়তাম বললাম। ও আমাকে ফেলে যাবেই না। বন্দুক তাক করে তাকে শুধু বললাম, 'না গেলে এই মুহূর্তে আমি তোকে গুলি করব।'

আমার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থেকে বন্দুক নিয়ে সে চলে গেল। আমার সঙ্গী হয়ে থাকল মাত্র দুটো গ্রেনেড।

দূর থেকে দেখলাম পাকিস্তানি সেনাদের আটজনের একটি দল এগিয়ে আসছে। বাড়ির সামনে তখন সাধারণ পাবলিক। গ্রেনেড থ্রো করলে তারাও মারা পড়বে। সিদ্ধান্ত বদলিয়ে গ্রেনেড দুইটা ধানের খড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম।

ওরা এসেই 'মাদার চোদ… বাইন চোদ' বলে আমায় লাথি মারতে থাকে। একটা লাশের সঙ্গে কিছুক্ষণ রেখে ভয় দেখিয়ে বলে, 'কিছুক্ষণ পর তোরও এই দশা হবে।' পরে ওরা আমাকে থানার মাঠে নিয়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সারা শরীরে ইচ্ছামতো টর্চার করতে থাকে। টর্চারের সময় শুধু তিনটা প্রশ্ন ছিল ওদের, 'তোর কমান্ডার কে? তোরা কতজন লোক? কোথায় তোর ক্যাম্প?'

৪ ডিসেম্বর রাতেই আমাদের পুরো কোম্পানি এসে থানা অ্যাটাক করে। তারা আমায় উদ্ধার করে রক্তাক্ত অবস্থায়। ওইদিনই মুক্ত হয় নবীগঞ্জ।''

পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের বিবরণ দিচ্ছেন ছানাওয়ার উদ্দিন আহমদ:

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কাহিনি শুনে। মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে ফিরেছেন। দেশের জন্য সব রকম ঝুঁকি নিয়েই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। আহত পা নিয়ে পাকসেনাদের অত্যাচার সইতে হয়েছে তাঁকে, নিদারুণ কষ্টের! কোনোমতে জিজ্ঞেস করি তাঁকে, কখন কীভাবে তাঁর আহত পায়ের চিকিৎসা শুরু হল সে কথা।

''বন্দি অবস্থাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা করেন জব্বার ডাক্তার। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ হবিগঞ্জ মুক্ত হলে ভর্তি হই হবিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে। পায়ে তখন ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ হত। নিজের শরীরের গন্ধ নিজেই সহ্য করতে পারতাম না। হবিগঞ্জ থেকে আমাকে পাঠানো হয় প্রথমে ভারতের কোয়াই হাসপাতালে। সেখান থেকে আসি আগরতলা হাসপাতালে। পায়ের অপারেশন সেখানেই হয়।''

যে দেশ চেয়েছিলেন তা কি পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার? তাঁর মনে হয়, নয় মাসে দেশ স্বাধীন হয়েছে এটা আল্লাহর রহমত। স্বাধীন দেশ তো মিলেছে। তবু অতৃপ্তিও আছে অনেক। ধনী-গরিবের বৈষম্যটা আকাশচুম্বী। স্বার্থপরতা এখন ভালো একটা যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো উনারা চাননি। তবে, ছানাওয়ার বিশ্বাস করেন, ধীরে ধীরে দেশ অনেক এগোবে।

ছানোয়ার উদ্দিন মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। সে সময় সব তথ্য ছিল দপ্তরগুলোতে। তবে যুদ্ধবিধস্ত দেশে তালিকার চেয়ে জরুরি ছিল মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। বঙ্গবন্ধু তাই করার চেষ্টা করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?

প্রশ্ন শুনেই খানিকটা উত্তেজিত হন মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার উদ্দিন। বুকে পুষে রাখা প্রতিবাদগুলো যেন বেরিয়ে এল। বললেন:

''তালিকা বাড়ার জন্য সর্বপ্রথম দায়ী থানা কমান্ডাররা। ওরা টাকা খাইয়া অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সুপারিশ করেছে। এরপর দায়ী সরকারের আমলারা। কল্যাণ ট্রাস্টের ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টটা ছিল চোরের ঘাঁটি। ডাকাত ছিল কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক এমডি আর মন্ত্রী ছিল চোর। তা না হলে কি বিদেশি বন্ধুদের ক্রেস্টে এমন জালিয়াতি করতে পারে!''

স্বাধীন দেশে রাজাকারদের উত্থান বিষয়ে কথা বলেন এই মুক্তিযোদ্ধা:

''যারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল, জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তাদের সম্মান দিয়া একেকজনকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত বানাল। দালাল আইন বাতিল করল। শাহ আজিজকে বানাইল প্রধানমন্ত্রী। এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। সে সময় একবার বঙ্গভবনে আমাদের সঙ্গে হাত মিলাতে এগিয়ে আসে শাহ আজিজ। আবদুল লতিফ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তখন খেপে যান। মুখের ওপর বলে দেন, 'যা ব্যাটা রাজাকার। তুই জিয়ার লগে গিয়া হাত মিলাগা।'

পরে সবাই প্রতিবাদ করে চলে আসি। জিয়াকে আমরা সম্মান করতাম। গদির লোভে মুক্তিযোদ্ধাদের সে সম্মান সে রাখতে পারেনি। যাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করলেন, স্বাধীনের পর তাদের সহযোগী রাজাকারের সঙ্গেই তিনি হাত মেলালেন। জাতিকে করলেন কলঙ্কিত। এরপরের কথা আর কী বলমু, বাবা? রাজাকারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়েছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। এই কষ্টের কথা কারে বলুম। রাজাকারদের সহযোগিতার দায় কম বেশি সব সরকারকেই নিতে হবে।''

দেরিতে হলেও যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার হচ্ছে। আপনার অনুভূতি…

চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার বলেন:

''এক একটা রায় শুনি আর বুকের ভেতরের বোঝাগুলো একেক করে নেমে যায়। অন্তত শান্তিতে আমরা মরতে পারুম। তাই এ সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এক নম্বর রাজাকার ছিল গোলাম আযম। তার রায়টা বাংলার মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আমাদের আশাটা পূর্ণ হয়নি।''

স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''ওরা তো এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি। আমাদের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এরা এখনও নিজেদের ফায়দা লুটছে। এদের কিছু হলেই পাকিস্তান বিবৃতি দেয়। তবুও জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে না। আমি মনে করি, জামায়াত নিষিদ্ধ না করলে সরকার ভুল করবে। '

স্বাধীন দেশে নানা উন্নয়ন দেখলে বুক ভরে যায় মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার উদ্দিনের। খারাপ লাগে যখন দেখেন রাজনীতিতে তোষামোদি, চামচারা কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। ঘুষখোর আর দুর্নীতিবাজ আমলারা অন্যকে ভালো হওয়ার উপদেশ দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। খুব কষ্ট পান তখন। রাজনীতিবিদ আর আমলারা ভালো না হলে দেশটা এগোবে না বলেই মনে করেন ছানাওয়ার।

তবু শত বাধা পেরিয়ে এদেশ একদিন অনেক উন্নত হবে, এমনটাই আশা যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধার। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত প্রজন্মের। তাই পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি অকপটে বললেন:

''দেশ চলে শিক্ষার ওপর। তোমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হইও। সৎ পথে চল। দেশের ভালো হয় এমন কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রেখ।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছানাওয়ার উদ্দিন আহমেদ।

ট্রেনিং নেন: ২১ দিনের ট্রেনিং নেন ভারতের বড়চরা ট্রেনিং ক্যাম্পে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং- ১৫৭০৫।

যুদ্ধ করেছেন: ৪ নং সেক্টরের জালালপুর সাব সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদীর আন্ডারে ছিলেন। অপারেশন করেন মৌলভীবাজার, আখালকুর, বগার হাওয়র, নবীগঞ্জ থানা, চৌধুরী বাজার, শেরপুর, তেইল্লাপাড়া প্রভৃতি স্থানে।

যুদ্ধাহত: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ভোরবেলা। নবীগঞ্জ থানা অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি এসে লাগে তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে। পরে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা শারীরিকভাবে টর্চার করে।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।