ইতিহাসের সন্ধানে না সংখ্যার সন্ধানে

Published : 4 Dec 2014, 04:19 AM
Updated : 4 Dec 2014, 04:19 AM

কিছুটা শংকা নিয়ে এই নিবন্ধ লিখতে বসেছি। বিষয়টি নিয়ে আগেও বহুবার লিখেছি, গালি-গালাজ পাবার চেয়ে বেশি আমার তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু এখন অবস্থা কিছুটা আলাদা। বিষয়টি উত্থাপনের কারণে ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং একদিন দণ্ডায়মান থাকার শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমার কপালে এটা ঘটবে না তেমন আশা নিয়ে এটা লিখতে বসেছি। আদালত অবমাননা করার কোনো ইচ্ছে তো আমার নেই-ই, বরং আমি চাই আদালত তার কাজ করে যাক, আমি আমার কাজ করে যাব, ইতিহাসের একজন গবেষক হিসেবে। আদালতের সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমি কেবল তথ্যের পূজারী।

বার্গম্যান ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কথা বলে আদালতের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন কিনা জানি না। কিন্তু যদি সংখ্যার বিষয়ে হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বার্গম্যান মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং যেহেতু এটা আদালতের এখতিয়ারভুক্ত, তাই আদালত অবমাননা ঘটেছে।

ইতিহাসের একজন গবেষকের অবস্থান থেকে কথাগুলো বলছি, আইনের বা আদালতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে নয়। আমার মতে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, মারা গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট গবেষণাভিত্তিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। যেহেতু এ ধরনের কোনো জরিপ বা গবেষণা করা হয়নি, সে কারণে এই সম্পর্কিত যে কোনো সংখ্যাভিত্তিক তথ্য সঠিক বলে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এটা আইনের বিষয় নয়, গবেষণার বিষয়।

আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা শুরু করি ১৯৭৮ সালে, কবি হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত 'স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র' প্রকল্পে। এই প্রকল্প পনের খণ্ড দলিল প্রকাশ করে, যা আজ আমাদের ১৯৭১এর ইতিহাস- সংক্রান্ত তথ্যের প্রধান ভাণ্ডার। এর নেতৃত্বে ছিলেন দেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদগণ, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সঠিকভাবে প্রমাণিত ইতিহাসের দলিল সংরক্ষণ করা।

পরবর্তীতে আমার সম্পাদনায় একটি ৪ খণ্ডের 'বাংলাদেশ ১৯৭১' নামে গবেষণাভিত্তিক প্রামাণ্য গ্রন্থ বের হয় ২০০৭ সালে। আমি বিবিসির জন্য ১৯৯৩-২০০০ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় পাঁচটি রেডিও ডকুমেন্টারি করি। একটি ভিডিও করি একাত্তর ও নারীদের ওপর 'তাহাদের যুদ্ধ' নামে। ১০ পর্বের একটি ডকুমেন্টারি করছিলাম ২০০০ সালে, একুশে টিভির জন্য, এই বিষয়েই। মালিকপক্ষের পছন্দ হয়নি বলে কোনোদিন দেখানো হয়নি। বর্তমানে তিনটি জেলায় 'গ্রামে একাত্তর' শিরোনামের একটি গবেষণা কাজ করছি বছর দেড়েক ধরে।

আমি মনে করি, যে কোনো ইতিহাসচর্চার কাজটি রাজনীতিমুক্ত রাখা উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আমি বাংলাদেশের ইতিহাস পড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গবেষণা জগতের মানুষ। কম-বেশি আমাদের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে চড়াই-উৎড়াই পার হতে হয়, তার সঙ্গে পরিচিত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ইতিহাসচর্চা ও রাজনীতিচর্চা এক করে ফেলি না, কোনো কারণও খুঁজে পাই না এটা করার। এর ফলে আমি খোলা চোখে ইতিহাস দেখার সুযোগ ও চর্চা কিছুটা হলেও রপ্ত করতে পেরেছি।

এখন আমার বয়স বাষট্টি। আর কতদিন কাজ করতে পারব জানি না; তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সত্য বলতে। আমাদের মতো যারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা করে, তাদের উপর সে দাবি আমার দেশের মানুষের আছে। আর ওই উপলব্ধি থেকেই আজ আমার এই লেখাটা তৈরি করা।

স্বাধীনতার পর থেকেই শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তথ্যটি জনশ্রুতিতে প্রবেশ করে। কোন সূত্রে বা কীসের ভিত্তিতে সংখ্যাটা সৃষ্টি হয়েছে এটা আমি জানি না। তবে এটা নির্ধারণের জন্য জরিপ বা গবেষণা চালানো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদি কারও জানা থাকে তাহলে সেটা উল্লিখিত হলে সবার উপকার হবে।

এ বিষয়ে একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে, স্বাধীনতার পর পর। কিন্তু এটি কী ধরনের জরিপ ছিল তা আমরা জানি না। এই জরিপের ফলাফল কোনোদিন প্রকাশ করা হয়নি। যদি হত, তাহলে আমরা সেই সব শহীদদের একটি তালিকা পেতাম, তাদের নাম-ঠিকানাসহ। আর সেটা হত আমাদের জাতীয় সম্পদ। কিন্তু আমরা সে রকম কোনো তালিকা হাতে পাইনি। অতএব, এ রকম তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হলেও তা সম্পন্ন করা হয়েছে, এমনটা জানা যায় না। পরবর্তীতেও এমন কোনো গবেষণা, জরিপ বা অন্য কোনো অনুসন্ধানী কাজকর্ম গ্রহণ করার কোনো উল্লেখও কোথাও পাইনি। অতএব, ইতিহাসচর্চার বা গবেষণার ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের পক্ষে বলা এক প্রকার অসম্ভব যে, এত জন মানুষ শহীদ হয়েছেন, এত জন নারী নির্যাতিত হয়েছেন ইত্যাদি।

সে ক্ষেত্রে 'সরকারি তথ্য' আছে বলে যদি কিছু দাবি করা হয়, তবে আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। গবেষণালব্ধ তথ্য এবং সরকারি নির্দেশনার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে সে কারণেই। আমরা গবেষকরা, যারা তথ্যচর্চায় নিবেদিত, বিপদে পড়ে যাব। কারণ তথ্যের ভিত্তি ছাড়া আর কোনো কিছুর ভিত্তিতে বলা 'ইতিহাসচর্চার ধর্মবিরোধী'। যেহেতু কোনো গবেষণার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না এই বিষয়ে– যারা ৩০ হাজার শহীদের কথা বলেন, যারা ৩ লাখের তথ্য তুলে ধরেন অথবা যারা বলেন সংখ্যাটি ৩০ লাখ– তাদের সবার প্রমাণের খাতিরে এই তথ্যের গ্রহণযোগ্য সূত্রের উল্লেখ প্রয়োজন।

এই সংখ্যার গুরুত্বটা কোন স্থানে এবং কেন, এটা কি এতদিনে আমাদের মধ্যে স্থায়ী হয়েছে? প্রমাণের ভিত্তিতে ইতিহাস নির্মিত হলে তা টলানো যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতির এমনই হাল যে, সরকার পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের তথ্য পরিবর্তিত হয়। এর ফলে ইতিহাসের 'সরকারিকরণ' ঘটেছে, যা একটি জাতীয় ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস পরিবর্তনের বিপদটা তাই সবসময় মাথার উপর ঝুলে থাকে।

বর্তমানে এই বিপদ অনেক বেশি। যেহেতু ইতিহাসচর্চা পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বা সরকারি আদেশের মাধ্যমে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাই ইতিহাসের তথ্য পরিবর্তন সহজ হয়ে গেছে, যা লক্ষ্য করা যায় সরকারবদলের সঙ্গে সঙ্গে। জনযুদ্ধের ইতিহাস প্রস্তুত হচ্ছে অফিস কক্ষে!

এই বিচ্ছিন্নতার বোঝা বহন করছে সাধারণ মানুষ। তাই সাধারণ মানুষ নিজেদের ইতিহাস নির্মাণ করছে আপন ভাবনার মাধ্যমে, যেখানে প্রধান উপাদান হচ্ছে তার কল্পনা, ভাবনা, আবেগ ও জনশ্রুতি। সাধারণ মানুষকে তার ইতিহাস রচনার জন্য কোনোভাবে কিছু বলা যায় না, যেহেতু নির্ভরযোগ্য জাতীয় ইতিহাস এদেশে রচিত হয়নি এখনও। তাই এই সংখ্যার মালিকানা সাধারণ মানুষের আবেগের, কিন্তু সেটা ইতিহাস রচনার সূত্র বা ভিত্তি হয় না।

বিপদটা কোন জায়গায়? ধরা যাক, ইতিহাসের পটপরিবর্তন হল এবং বিএনপি ও তারেক জিয়া ক্ষমতায় এলেন; সঙ্গে সঙ্গেই কোনো আইন বা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারা ও তিনি ঘোষণা করে দেবেন যে, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন জিয়াউর রহমান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভুল ছিল, জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি বাংলাদেশের জন্মবিরোধী ছিল না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই কথাগুলোর কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু যদি এই ঘোষণা দেওয়া হয় যে, এই সব তথ্য 'মীমাংসিত বিষয়'– তাহলে আমার, আপনার, জনগণের কিছু করার থাকবে কি? তখন যদি কোনো নতুন আদালত গঠিত হয়– যে কোনো কারণেই হোক সেখানে কেউ যদি বলে যে, জিয়াউর রহমান দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান নন– তাহলে আদালত বা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না কি? এর কারণ হল ইতিহাসের তথ্য বা চর্চা অস্বীকার করে বিষয়টিকে বিদ্যাপাড়া থেকে আমলাপাড়ায় নিয়ে যাওয়া।

তাই, ইতিহাস রক্ষা করার জন্য ইতিহাসের ঘটনা বা তথ্যের বিষয় বক্তব্য কেবল গবেষকদেরই দেওয়া উচিত, যার ভিত্তি হতে হবে তথ্য এবং যে তথ্য গ্রহণযোগ্য করার ভিত্তি হবে ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুন। তথ্য যাচাইয়ের জন্য ইতিহাসচর্চার একটি বিশেষ প্রক্রিয়া আছে, সেটা পালন করেই তথ্য গ্রহণ করা যায়। সেই প্রক্রিয়া থেকে চ্যুত হলে সবাই বিপদে পড়বে। অতএব, গ্রহণযোগ্য মানের গবেষণা না হলে 'তথ্য' জন্মায় না। বিপদটা হচ্ছে ওখানেই যে, মানুষ যাচাই করা ছাড়াই তথ্য ব্যবহার শুরু করে যেটা এক সময় অনুমান থেকে 'তথ্য'তে পরিণত হয়। যখন শত্রু-মিত্র উভয়েই নিজেদের ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীগত স্বার্থে এই সুযোগ গ্রহণ করে, তখন সবাই বিপদে পড়ে যায়।

কিছুদিন আগে 'সামাজিক শহীদ' এবং 'যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ', এই দুটি বিষয়ে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী কিছু বক্তব্য রাখেন টেলিভিশনে। তিনি বলেন যে, সরকার একটি কমিটি গঠন করেছেন গ্রাম পর্যায়সহ জাতীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের জন্য। এছাড়া রাজাকারদের একটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। জানা যায় যে, বীরাঙ্গনাদের একটি তালিকা করার কথাও সরকার ভাবছে। সে অনুষ্ঠানে আমি এভাবে মত দিয়েছিলাম যে, সবার আগে শহীদদের একটি তালিকা থাকা প্রয়োজন। তখন মন্ত্রী জানালেন যে, এটাও সরকারের চিন্তায় আছে। তখনই তিনি দু'ধরনের শহীদের কথা বললেন: (১) যারা যুদ্ধে শহীদ হন; (২) যারা যুদ্ধের কারণে শহীদ হন। অতএব, এই সংক্রান্ত কোনো তালিকা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

'সংখ্যা' আমাদের আবেগের পরিমাপ হিসেবেই রয়েছে। এই সংখ্যার মাধ্যমে আমরা আমাদের দুঃখ-কষ্টের নিরিখ করতে চাই, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তথ্য উপস্থিত করি না। এ বিষয়ে খুব কম গবেষণামূলক কাজ হয়েছে বলে সংখ্যাটি আমাদের মধ্যে বিকল্প তথ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু ইতিহাস গবেষকদের কাছে ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো সংখ্যা উপস্থিত করা সঠিক হবে না। কারণ আবেগের পরিসর ও তথ্যের পরিসর আলাদা।

আমাদের দেশে ইতিহাসচর্চা হয় না। কারণ আবেগের বাণে সব তথ্য ও বাস্তবতা ভেসে যায়। কিন্তু শত বাধা সত্ত্বেও সে কাজ আমাদের করতে হবে। যেভাবে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের আগামীকে রক্ষা করতে, ঠিক সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক ইতিহাস রক্ষা আমাদের দেশপ্রেমিক কর্তব্যের অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

আফসান চৌধুরী: লেখক, সাংবাদিক ও অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।