বঙ্গবন্ধু ও তাহের: ঔদার্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 14 August 2014, 04:00 PM
Updated : 14 August 2014, 04:00 PM

২৫ মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানের কোয়েটায় স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন মেজর আবু তাহের। সে সময় শত্রু দেশে তিনি অবরুদ্ধ। যে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের জন্য তিনি নিজ শরীরের একটি অঙ্গ দান করেছেন, সেই দেশে পাঁচ বছর পর অবরুদ্ধ অবস্থায় ঢাকা কারাগারের অভ্যন্তরে গোপন মার্শাল-ল ট্রাইব্যুনালে তাহের তাঁর জবানবন্দিতে স্মরণ করেন ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা। তিনি বলেন–

"The barbaric purpose of the Military Junta was not unknown to us who were in West Pakistan, when from General Headquarters of the Pakistan Army the message went out: 'Burn everything, kill everyone in sight." […] When I heard the announcement of General Yahya Khan over the radio on the evening of 26th March, I came to know what a catastrophe had fallen on my people. For the whole night I walked on the lonely roads of Quetta." [i]

পরদিন সন্ধ্যায় কোয়েটার অফিসার ক্লাবে একজন পাঞ্জাবি অফিসার উচ্চস্বরে মন্তব্য করল, "মুজিব ইজ এ ট্রেইটর"। পাশের টেবিলে বসা তাহেরকে শোনাবার জন্যই যেন এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ বিদ্রুপ। কিছু বুঝবার আগেই বিদ্যুৎগতিতে তাহের ঐ পাঞ্জাবি অফিসারের কলার ধরে তাকে দাঁড় করালেন। বললেন, এই মুহূর্তে তার কথা প্রত্যাহার না করলে তাকে তিনি হত্যা করবেন। তা যে বাগাড়ম্বর নয়, পাকিস্তানি অফিসারের তা জানা ছিল। তাহের এসএসজি'র অকুতোভয় কমান্ডো অফিসার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ব্র্যাগ এবং ফোর্ট বেনিং-এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত 'রেঞ্জার'। খালি হাতে মুহূর্তে শত্রুকে হত্যা করা তার জন্য কিছু নয়। নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ভয়ে কম্পমান পাকিস্তানি অফিসার তার উক্তি প্রত্যাহার করে নিল।

এ ঘটনার জন্য কোয়েটায় তাহেরকে আটক করা হয়। অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস-এর কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল বি এম মোস্তফার সঙ্গে তাহেরের ভালো সম্পর্ক থাকায় কিছুদিন পর সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। [ii] ধারণা করি মেজর জেনারেল মোস্তফা শুধুমাত্র সুসম্পর্কের কারণে অভিযোগ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করেননি। একদিকে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ঘটানো গণহত্যা এবং অন্যদিকে বাঙালি অফিসার-সিপাহীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা। এমন পরিস্থিতিতে তাহেরের মতো একজন উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারকে কোর্ট-মার্শাল করলে তার প্রতক্রিয়ায় কী ঘটত, সে সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের দুর্ভাবনা ছিল।

নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তাহের পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধে পা হারিয়ে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে তাহেরকে প্রথমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যানট জেনারেল ও দু'মাস পরে কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এর অল্পদিন পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লা সেনানিবাস সফরে আসেন। গার্ড অব অনারে নকল পা লাগানো ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল তাহের অভিবাদন জানালেন জাতির জনককে। ২ আগস্ট, ১৯৭২, কুমিল্লা সেনানিবাসের জন্য একটি বিশেষ দিন। সেনানিবাসে অবস্থিত শিশু অভ্যর্থনা কেন্দ্রের মাসিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ ও দেয়াল পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।অভ্যর্থনা কেন্দ্রের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে সেনানিবাস স্টেশন কমান্ডার তাহের বলেন–

"শিশুদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে না পারলে সমাজতন্ত্রের কোনো মূল্য নেই। এইটা মহান দায়িত্ব। এই দায়িত্বকে চাকরির চাইতে বড় মনে করতে হবে। শিশুদের গড়ে তোলা স্বাধীন দেশের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমাদের দেশে আমরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র কায়েম করতে পারব না যদি না আমরা শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সমবেতভাবে থাকলে আদর্শ নাগরিক হওয়া সম্ভব। আপনারা প্রমাণ করবেন যে আপনারা তা করতে পেরেছেন।" [iii]

মুক্তিযুদ্ধে মা-বাবা হারানো শিশু ও গরিব পরিবার থেকে আসা সর্বমোট ৫০০ শিশুর থাকা, খাওয়া ও পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এই কেন্দ্রে। তাদেরই একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে শুনিয়ে মুগ্ধ করে দেয়। [iv]

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধে এক পা হারানো এই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ভুলেননি। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা পদত্যাগপত্রে কর্নেল তাহের বলেন–

"প্রধানমন্ত্রী [*বঙ্গবন্ধু ] আন্তরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য যেন আমি বিদেশ যাই। [*সে সময় লন্ডনে চিকিৎসারত বঙ্গবন্ধু সেখানে তাহেরের উন্নত নকল পা লাগাবার জন্য এবং দেশে ফিরে তাহের যাতে বাম পায়ের সাহায্য ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারেন তেমন একটি অটোম্যাটিক গাড়ি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন] যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম তখন জানতে পারি যে মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতির সুযোগে দেশের ক্ষমতা গ্রহনের চেষ্টা করছে। (সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন) আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশ গমন স্থগিত রাখা উচিত।

ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো হলই না; উপরন্তু সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ড ত্যাগ করে ডি ডি পি [*ডিরেক্টর ডিফেন্স পারচেজ] হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করছি ষড়যন্ত্র এখনও চলছে এবং আরও অনেকে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এই ধরনের ক্ষমতা দখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে। এটাকে অবশ্যই রুখতে হবে।

যদি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে সেনাবাহিনীর যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং তেমন সেনাবাহিনীতে আমার কাজ করা সম্ভব হবে না। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আমি এটাকে অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই; যারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের বলব কী ধরনের বিপদ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব।

আপনার একান্ত বাধ্য,

লে. কর্নেল এম এ তাহের। […]" [v] (*লেখকের মন্তব্য)

পদত্যাগপত্র পেশের পর কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করে তার শঙ্কার কথা জানান। বাসায় ফিরে বলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের কিছু অংশ এখনও মনে আছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, "তুমি আমাদের ন্যাশনাল হিরো, তুমি সৎ। নতুন সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অনেক সাজ-সরঞ্জাম কিনতে হবে। তাই তোমার মতো একজন সৎ অফিসারকে ডি ডি পি পদে নিয়োগ দিয়েছি।" তাহের একমত হননি। তারপরও বঙ্গবন্ধু প্রথমে সি ট্রাক ইউনিট এবং পরে ড্রেজার সংস্থার পরিচালকের পদে তাহেরকে নিয়োগ দেন।

এর মধ্যে তাহের নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তবে তা অপ্রকাশ্য থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রাখেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তাহেরকে ডেকে পাঠান এবং বলেন যে তাহেরের সব যোগাযোগ সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা জ্ঞাত। সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে সেসব সাক্ষাতের কথা তিনি জানান। তাহের তা অস্বীকার করেননি। বলেছেন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি নানা জনের সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে কিছু বলেননি। বরং ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি কৃষক লীগের সংগঠক আমাদের অপর ভাই আবু সাইয়িদের মামলার নম্বর চান তিনি যাতে অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেওয়া যায়।

১৯৭৩ সালের ১৩ অক্টোবর কর্নেল তাহের দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি পত্র লিখেন। সে বছরের ৬ অক্টোবর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেই পত্রের প্রথম প্যারাগ্রাফে তাহের বলেন–

"Your desire to send a group of freedom fighters to fight shoulder to shoulder with our Arab brethren against Zionist aggressors has been greatly appreciated by the freedom fighters. I as a freedom fighter wish to volunteer myself for our brethren in faith at this hour of their trial." [vi]

জায়নবাদি আগ্রাসনের শিকার আরব ভাইদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে পাঠাতে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কথা জেনে তাহের এই ঐতিহাসিক পত্রটি পাঠিয়েছিলেন।

ঘটনা দ্রুত এগুতে থাকে। ১৯৭৫ সালের শুরুতে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এসেছে। দেশে কায়েম হয়েছে একদলীয় সরকার। বাকশালে যোগদানের হিড়িক পড়েছে। প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে শুরু করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না যার প্রধানরা বাকশালে যোগ দেননি। ব্যতিক্রম শুধু কর্নেল তাহের। তিনি যোগ দেননি। এজন্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে দোষারোপ করেননি। কোনো হয়রানির শিকারও হতে হয়নি তাঁকে।

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীরে বিডিআরএস বাংলোতে ছুটির দিনের এক সকালে নাশতার টেবিল। ফোন বেজে উঠল। আমি ধরে তাহের ভাইকে দিয়ে বললাম, বঙ্গবে থেকে ফোন এসেছে। নৌযান বানাতে এই কোম্পানির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাহের ভাই কথা শুরু করতেই বুঝে ফেললাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ফোন। আমি গভীরভাবে লজ্জিত। কথা শেষে স্নেহের সুরেই তাহের ভাই বললেন, "বঙ্গবন্ধু তাঁর ছেলে শেখ কামালের বিয়েতে দাওয়াত করেছেন, বুঝলে ইডিয়েট?"

বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই। শেখ কামাল আমার বয়সী। সাক্ষাত দেখা হয়নি কখনও। তবে ১৯৭২-এর এপ্রিল মাসে ভারত থেকে নকল পা লাগিয়ে যেদিন তাহের ভাই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন সেদিন ঢাকার পুরনো এয়ারপোর্টে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে অন্যান্যদের মধ্যে শেখ কামালও উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ কামাল ছিলেন নবীন অফিসার এবং জেনারেল ওসমানীর অন্যতম এডিসি। শেখ কামালের বিয়ে প্রসঙ্গে পরে আর একটু লিখব।

১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী ছেড়ে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করে লেখা তাহেরের পদত্যাগপত্রের গভীর শঙ্কার কথাগুলো নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে। খোন্দকার মোসতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে গেঁড়ে বসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি দেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৬ সালে কারাভ্যন্তরে গোপন প্রহসন বিচারের জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তাহের বলেন–

"On August 15 1975 Sheikh Mujib was killed by a group of officers and a section of the Army. […] This was shocking news to me. I thought it would create political instability and that in this situation we could even lose our independence. Meanwhile, several telephone calls came urging me to go to Bangladesh Betar. I thought I should go and see the situation. […] At 11:30 in the morning I left Bangladesh Betar with a feeling of deep concern. I sensed that some outside power was involved in the killing of the Father of the Nation. […] on August 16, I realized that Major Rashid and Major Farooque were using my name opportunistically to give their troops the impression that they were with me. On August 17, it became clear to me that the whole game was backed by the United States of America and Pakistan. I also understood that Khondokar Mushtaque was directly involved in the killing of Sheikh Mujib. This group it was also clear, had a pre-determined course set for them. From the 17th onwards I stopped going to Banga Bhavan." [vii]

তাহেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় নতুন সরকারের ক্যাবিনেটে যোগদান করতে। এমনকি তাহেরকে প্রস্তাব করা হয় তিনি যাতে সর্বহারা পার্টির কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দুটি প্রস্তাবই কর্নেল তাহের প্রত্যাখ্যান করেন। তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে সাধারণ নির্বাচনের জন্য তাহের মোশতাকের প্রতি কয়েকটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখেন। [viii] বলার অপেক্ষা রাখে না যে খুনিচক্রের কাছে তাহেরের একটি প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য হয়নি।

কর্নেল তাহের ও জাসদের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মোশতাকের আড়াই মাসের শাসনামলে জাসদের উপর নেমে আসে হত্যা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তার। ড্রেজার সংস্থায় কর্মরত তাহেরও খুনিচক্রের হয়রানি থেকে রক্ষা পান না। সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব আসাফউদ্দৌলা (সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত)। তিনি খোন্দকার মোশতাকের খুবই ঘনিষ্ঠ। আবার তার ভাই ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা। একদিন কর্নেল তাহেরকে টেলিফোন করে জনাব আসাফউদ্দৌলা কয়েকটি অভিযোগ শোনান। তার মধ্যে প্রধান অভিযোগ ছিল ড্রেজার সংস্থার প্রমোদতরীতে শেখ কামালের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন তাহের।

প্রতিটি অভিযোগ ছিল ডাহা মিথ্যা; তাহেরকে হয়রানি ও তাঁর উপর চাপ প্রয়োগের অপচেষ্টা। বঙ্গভবনে তাহেরকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় মোশতাকের সঙ্গে। মোশতাক বারবার বঙ্গবন্ধুকে 'মুজিব' বলে সম্বোধন করছিলেন। এই নরাধম বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে কী নতজানুই না ছিল! তাহেরের সহ্য হয়নি। হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে কঠিন কণ্ঠে তাহের বললেন, "বলুন বঙ্গবন্ধু"। তাহেরের উচ্চকণ্ঠ শুনে উদ্যত পিস্তল হাতে মেজর ডালিম কক্ষে প্রবেশ করে। কিন্তু তাহেরের কড়া ধমকে সে দ্রুতই কক্ষ ত্যাগ করে। চতুর মোশতাকও তাহেরের সঙ্গে কথা শেষ করেন এই বলে যে, অভিযোগ বিষয়ে তিনি ভুল তথ্য পেয়েছিলেন।

এমন বহুজন যারা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে তাঁর নাম জপ করেছেন শয়নে-স্বপনে, তারাই ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর খুনিদের কাছে নতজানু হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু উচ্চারণে ভীত হয়েছেন, বঙ্গভবনে ছুটে গেছেন মোশতাকের কৃপাভিক্ষা পেতে। আর কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম যিনি কোনো তোষামোদি করেননি; অটল থেকেছেন আপন অঙ্গীকারে, সেনাবাহিনী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতি-কৌশলের চরম বিরোধিতা করেছেন, তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেছেন জাতির জনককে। তাই খুনি মোশতাকের ক্ষমতার দুর্গ বঙ্গভবনে গিয়ে অকুতোভয়ে উচ্চারণ করতে পেরেছেন 'বঙ্গবন্ধু '।

মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে তাহেরের ঐতিহাসিক জবানবন্দির কিছু কথা আগে উল্লেখ করেছি। এ জবানবন্দি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে বোম্বে থেকে, 'Economic and Political Weekly' সাময়িকীতে। পরে লন্ডনের 'জেড প্রেস' থেকে বই আকারে তা প্রকাশিত হয়।

অল্প ক'দিন আগে গণকন্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন সাংবাদিক রায়হান ফেরদৌস মধু দুঃখ করে বললেন, তাহের ভাই তাঁর জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবেই সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু সে জবানবন্দির বাংলা তরজমাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক আফতাব আহমেদের পীড়াপীড়িতে জাতির পিতা (Father of the Nation) সম্বোধনটি তারা বাদ দিয়ে দেন।

রায়হান ফেরদৌস, আপনি কষ্ট পাবেন না। সত্য প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত 'Economic and Political Weekly' সাময়িকীর ১৩৫১ পৃষ্ঠা দেখুন। তাহের ঠিকই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা সম্বোধন করেছেন। কখন? যখন বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই, তাঁর দল ক্ষমতায়ও নেই। যখন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা উচ্চারণে ভীত-সন্ত্রস্ত, তখন এক পায়ের একজন বন্দি মানুষ কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম দ্বিধাহীন ও নিঃশঙ্ক চিত্তে উচ্চারণ করেন 'জাতির পিতা'।


তথ্যসূত্র:

[i] Lawrence Lifschultz, 'Abu Taher's Last Testament: Bangladesh: The Unfinished Revolution'

[August 1977] 12 Economic and Political Weekly 33/34 (Special Number)

p. 1347

[ii] দেখুন অ্যান্ডনোট ii

[iii] 'পাঁচ শত শিশুর আনন্দমুখর পরিবেশে শিশু অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সমাপ্ত'

আমোদ, আগস্ট ১০, ১৯৭২

[iv] দেখুন অ্যান্ডনোট iii

[v] জিয়াউল হক মুক্তা সম্পাদিত, শহীদ কর্নেল তাহের রচনা সংগ্রহ– ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে

(পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৬)

পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭

[vi] "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লেখা কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)-এর চিঠি

অক্টোবর ১৩, ১৯৭৩"

[vii] Lawrence Lifschultz, 'Abu Taher's Last Testament: Bangladesh: The Unfinished Revolution'

[August 1977] 12 Economic and Political Weekly 33/34 (Special Number)

p. 1350-1351

[viii] দেখুন অ্যান্ডনোট vii

পৃষ্ঠা ১৩৫১।