যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১৬ ‘‘শেখের বেটিই মুক্তিযোদ্ধাগো কষ্ট বুঝে’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 15 July 2014, 08:29 PM
Updated : 15 July 2014, 08:29 PM

সেভেন থেকে এইটে উঠমু, তহনই আব্বা মারা যায়। মা আর আমি একা। নানাবাড়ি পাঁচ কাহনিয়ায় চইলা আসলে আমার আর পড়াশোনা হয় না। বন্ধু মোশারফ, নয়ন মিয়া, দুলাল, হামিদ, চাঁনমিয়ার লগে বলটল খেলতাম। শখে মাঝে মাধ্যে মাছও মারতাম। এইভাবেই কাটত দিনগুলা। দুই বছর পর একদিন মা-ও মারা গেল। আমি তহন এতিম। এতিমগো পাশে কেউ থাকে না। সুযোগ পাইয়া সৎ চাচারাও জমি-জমা থেকে আমারে না-শরিক করে। আমার তহন দুঃখের আর সীমা নাই। কী করমু বুঝতে পারি না।

উনিশশ' ছেষট্টি সাল। নেত্রকোনা সরকারি কলেজের ক্যান্টিন ইজারা দেওয়া হইব। প্রিন্সিপাল সাহেব একদিন আমারে ডাইকা কইলেন, 'যা তুই ইডা কর, গরিব মানুষ, কইরা খা।' ৫ বছরের জন্য অল্পমূল্যে পাই ক্যান্টিনটা। তহন ভিপি ছিলেন ছাত্রলীগের মতিউর রহমান। খসরু ভাই, সাফায়েন আহম্মেদ খান আমারে খুব আদর করত।

১৯৬৯ সাল। ছাত্ররা আন্দোলন করছে। দেশের অবস্থা অন্যরকম। 'পিণ্ডি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা'। 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'। কলেজে সকাল-সন্ধ্যা একই স্লোগান। সবখানে মিছিল আর মিছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। শেখ মুজিব ভাষণ দিব। খবর পাইয়া ট্রেনে কইরা আসি ঢাকায়। সঙ্গে রহমান, সিরাজ, চাংখা (চাঁনমিয়া)।

নারায়গঞ্জে আমার এক মামা চাকরি করত। নাম আজিজুর রহমান। তার বাড়িতে সকালে নাস্তা খাইয়া সবাই চইলা আসি রেসকোর্স ময়দানে। মানুষ তখন জড় হচ্ছে মাত্র। সবাইর হাতে ফ্লাগ আর নিশান। গাছের মধ্যে পর্যন্ত লোক। শেখ মুজিব কইল, 'ভায়েরা আমার। ২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি কল করেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। … সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না…।' ভাষণ শুইনা আমগো রক্ত যাইগ্যা গেছিল। আজও শুনলে রক্ত গরম হইয়া যায়। অসুখে বুড়া হইছি। নাইলে এইসব কেয়ার করছি না। ভাষণ শেষে সন্ধ্যার ট্রেনে আমরা নেত্রকোনায় চইলা যাই।

২৫ মার্চে ঢাকায় আর্মি নামার খবর সব জায়গায় ছড়াইয়া পড়ে। সব মানুষ তহন ভাগতাছে। হিন্দুরা বাড়ি, সম্পদ সব ফালাইয়া পালায়। সংগ্রাম কমিটির লোকদের সঙ্গে আমরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করি, বেরিকেড দেই। পাকিস্তানি সেনারা নেত্রকোনায় ঢুকেই যুবকদের ধরে, বলে, 'পাকরাও শালা কো'। খালি হাতে আমরা ওগো লগে পারি না। কয়েকজনকে ওরা মাইরাও ফেলে। ঘাটি গারে আনসার ক্যাম্পে। আমি, শহিদ খান পাঠান ও আজিরউদ্দিন তহন দুর্গাপুর দিয়া চইলা যাই ভারতের বাগমারায়।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল। এ তিন বছর আমি মুজাহিদ ট্রেনিং নিছি। একটা ট্রেনিং হয় নেত্রকোণায়, একটা কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ মাঠে ও একটা ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে। ফায়ারিংয়ের সবকিছু ছিল আমার জানা। বাগমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়া ক্যাপ্টেন মুড়ালিকে মুজাহিদ সনদ দেখাতেই তিনি বলেন, 'এ তো পাক্কা ফৌজি থায়, ইসকো লে লো পেহেলা'।

আমাদের প্রথমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরায়। পরে তুরা থেকে ভুটান নামক স্থানে। দুইটা গ্রুপকে সেখানে ট্রেনিং করানো হয়। ভারতের ভুটানে ২১ দিন ট্রেনিং ও জঙ্গল প্যারোড করে তুরায় আইসা কসম প্যারড করছি ৭ দিন। আমার এফএফ নম্বর ছিল ৩৩৫।

১৯৭১ ও তার পূর্বেকার নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল কুদ্দুস মীরের জবানিতে। বাবা আবদুল সাত্তার মীর ও মা আমিন জানের একমাত্র ছেলে তিনি। বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাকোয়া গ্রামে। পড়াশুনা করেছেন ক্লাস এইট পর্যন্ত, দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় প্রশ্নের পিঠেই তিনি উত্তর দেন নিজের মতো করে।

কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেন?

মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুসের উত্তর, 'তুরা থেকে অস্ত্র দিয়া আমগো পুরা প্লাটুন নামিয়ে দেয় বর্ডারে। প্রথমে আমরা ছিলাম রজব কোম্পানিতে। কমান্ডার ছিলেন রজব আলী। বাগমারা দিয়া গোসগাঁও কসিন্দুু বাজারের পাশেই একটা গারো মোড়ল বাড়িতে আমরা ক্যাম্প করি। পরে ৩১ জন করে আমাদের ৪টি সেকশনে ভাগ করে দেওয়া হয়। ৪ নম্বর সেকশনের আমি ছিলাম কমান্ডার। আমাদের কমান্ড করতেন প্লাটুন কমান্ডার নির্মল দত্ত। ১১ নং সেক্টরের অধীনে জাগশু গ্রাম, নেতাই নদীর পাড়, করসিন্দু বাজার, গোসগাঁও, শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত আমরা অপারেশন করি। আমরা ছিলাম গেরিলা। স্টেনগানের সঙ্গে কোমরে থাকত ৪ টা করে গ্রেনেড। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ভয়ে মানুষ ধান কাটতে পারত না। খবর দিলে আমরা অ্যাম্বুস করে বসে থাকতাম। তারা ধান কেটে আনত। পরে আমাদের ক্যাম্পে কিছু চাল ও মুরগি পাঠিয়ে দিত। তাদের বাড়িতে খাওয়া আমাদের নিষেধ ছিল।

কেন?

খানিক নীরব থেকে তিনি বলেন– 'জাগশু গ্রামে এক ছেড়া আমগো খাওয়াইছিল বইলা ছেড়ার বাপটারে পাকিস্তানিরা মাইরা ফালাইছে।'

১৯৭১ সালে রাজাকারদের কার্যক্রম সম্পর্কে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন– 'জাগশু গ্রামে শহীদুল্লাহ ও তার ছেলে হামিদুল্লাহ বাপ-পুত দুইজনই রাজাকার আছিল। ওরা এক মুক্তিযোদ্ধাকে মাইরা পুকুর পাড়ে কবর দিছে। ওগো কোনো গৃহস্থ ছিল না। কিন্তু আমরা তাগো বাড়ি গিয়া দেখি ১৫-২০ টা গরু। ঘরভর্তি লুটের মাল। স্বর্ণ ছিল কয়েক কেজি। এলাকাবাসীকে খবর দিয়া যার যার মাল আমরা সবাইরে ফিরায়া দিই। পরে রাজাকার দুইডারে ধইরা আনি ক্যাম্পে। আমার বাল্যবন্ধু রহমান ও চাংখাও (চাঁনমিয়া) রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিছিল। অথচ একসঙ্গে আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গেছিলাম। চাঁনমিয়া পরে সাধারণ ক্ষমা পায়। এ কারণেই আমি ওগো লগে মিলি না। রাজাকারগো লগে হাত মিলাইতেও ঘেন্না লাগে।'

মুক্তিযুদ্ধের সময় এক সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন না। চলছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ষাটোর্ধ্ব এ মুক্তিযোদ্ধা দু'বার স্ট্রোক করেছেন। তাঁর শরীরের একপাশ বর্তমানে প্যারালাইজড। ফলে স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হওয়ার রক্তাক্ত সে দিনটি আজও তাঁর কাছে জীবন্ত। সে দিনকার আদ্যোপান্ত শুনি তাঁর জবানিতে।

'১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত তহন ১১ টা। নেতাই নদীর পাড়ে আমরা পুরা প্লাটুন। কমান্ডে নির্মল দত্ত। পাকিস্তানি সেনারা পূর্বধলা থেকে অ্যাডভান্স হইছিল। ওদের ঠেকানোর জন্যই নদীর তীরে আমরা পজিশন লই। আমাদের কাভারিংয়ের জন্য পজিশনে ছিল রজব কোম্পানি ও ১ নম্বর সেকশন। পিছনে ভারতীয় সেনারা। ওরা পূর্বধলা পার হয়েছে খবর পাইয়া আমরা ভারতীয় সেনাদের ম্যাসেজ পাঠাই। তারা টুআইস মটর ছাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা তহন ঘাবরে যায়। ধীরে ধীরে পিছু হটে। এ সুযোগে আমরা অ্যাডভান্স করি। একটা পাইপ দিয়া আমরা ক্যামোফ্লাস কইরা কামানের মতো বানায়া রাখতাম। আমাদের কয়েকটা স্টেনগান একসাথে করে ফায়ারিং করলেই মনে হত যেন কামান ছাড়ছে। তা দেখে ওরাও ঘাবড়ে যেত।

বৃষ্টির মতো গুলি চলছিল। আমি আইলে শুয়ে স্টেনগান চালাচ্ছি। পাশেই এলএমজি ম্যান হারুনুর রশিদ। আমার ডান দিকে এবাদত আলী। হঠাৎ একটা গ্রেনেড এসে পড়ে হারুনের সামনে। আমি তাকে পা দিয়া ধাক্কা দিতেই সে দূরে ছিটকে পড়ে। গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হলেও সে যাত্রায় সে বাইচা যায়। আইলে আমি একটু উঁচুতে ছিলাম। চু করে একটি গুলি এসে লাগে আমার বাম পায়ে। আমি পেছনে ছিটকে পড়ি। গুলিটি আমার হাঁটুর ওপর দিয়ে বিদ্ধ হয়। প্রথম কিছুই টের পাইনি। মনে হয়েছে সাপে কাটছে। পায়ে কোনো বোধ নাই। বাম পা টানতে পারছিলাম না। কী হল পায়ে? হাত দিতেই অনুভব করি পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছে। আমার শরীরের শক্তি ছিল বেশি। রক্ত গেলেও জ্ঞান হারাই নাই। সহযোদ্ধারা আমাকে পেছনে টেনে নেয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর জিপে করে পাঠিয়ে দেয় মোড়ল বাড়ি ক্যাম্পে। দুইদিন পর পাঠানো হয় তুরাতে। সেখান থেকে পুনা হাসপাতালে। সেখানেই অপারেশন করে গুলি বের করা হয়।'

দেশ স্বাধীনের খবরে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস বলেন– 'তহন আমরা পুনা হাসপাতালে। স্বাধীনতার আনন্দে কাঁদছিলাম। মনটা পড়েছিল দেশের মাটিতে। অনেক মানুষ ফুল নিয়া আমগো দেখতে আসে। তাজউদ্দিন আর ওসমানী সাহেবও এসেছিলেন। স্বাধীনের কয়দিন আগে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আসেন। আমাদের সাহস দিয়া তিনি সেদিন বললেন– 'ঘাবড়ানা মাত, ঠিক হায় জাগা, তোমারা দেশ তুম আজাদ কারেগা।' তার কথাই পরে সত্য হল।

স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস নিজের ক্যান্টিন ব্যবসায় ফিরে গেলেও ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে চাকুরি নেন চট্টগ্রাম আলমাস আর দিনার সিনেমা হলে। অবসরে যাওয়ার পরে বর্তমানে ভাতার ওপরই চলছে পরিবার।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে জিয়াউর রহমানের ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররাও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নেমেছে– এই ভেবে তহন আমগো মনোবল বাইরা গেছিল।'

কথা ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস অকপটে বলেন– 'আরও আগেই এদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। তাইলে আজ বৃদ্ধ হওয়ার অজুহাতে রাজাকাররা ফাঁসির সাজা থেকে মাফ পেত না। ওরা যখন স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালিদের হত্যা করছে তখন কি বৃদ্ধ বইলা কাউরে মাফ করেছিল? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এদের বিচার অনেক আগেই হত।'

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন– 'উনি বড় নেতা ছিলেন। মন ছিল আকাশের মতো। তাই ছোট ছোট অপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন। আমি মনে করি ক্ষমা না করে সবাইর বিচার করা উচিত ছিল। যদিও তিনি বড় বড় অপরাধীদের ক্ষমা করেননি। বরং তাদের বিচারের জন্য আইন করেছিলেন। কিন্তু বিচারের আগেই তো তার পরিবারসহ মাইরা ফেলা হল।'

পরের সরকারগুলো বিচার করল না কেন, আপনি কী মনে করেন?

তারপর বিচার করব কেডা? কেউ থাকলে তো করব। গদিতে বইসা জিয়াউর রহমান ওদের বেকটিরে রাজনীতিতে আনল। গোলাম আজমরে নাগরিকত্ব দিল। দালাল আইন বাতিল কইরা রাজাকারদের বিচার বন্ধ করল। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হইয়া একটা রাজাকাররে স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বানাইল। এ রচেয়ে অপমানের আর কী আছে! নয় মাসে দেশ স্বাধীন না হইয়া নব্বই বছরে হলে মানুষ বুঝত স্বাধীনতা কারে কয়। এ সব কথা মনের দুঃখ্যে কই বাবা!'

একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন– 'বিএনপির শাসনামলে মতিউর রহমান নিজামী শিল্পমন্ত্রী। আমরা কয়েকজন একটা কাজে গেছিলাম তার মন্ত্রণালয়ে। তিনি আমাদের রুমে ডাকলেন। ভাল-মন্দ খাওয়ানোর প্রস্তাব করলেন। ওইদিন আমি তাকে বলেছিলাম– 'রেজাকারের হাতের খানা আমরা খাই না'। আমার সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিবাদ করে চলে আসে।

মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস বলেন– 'অনেক পরে হলেও এদের বিচার হচ্ছে এটাই শান্তি। তবে তা কার্যকর করতে হবে দ্রুত। তা না হলে রাজাকাররা প্রায়ই চান্দে চইলা যাইব। দেখছেন না রাজাকার সাঈদীরে নাকি চাঁন্দে দেখা গেছিল? ও কি আল্লাহর ওলি যে তারে চাঁন্দে দেখা যাইব! আমরা চাই সব রাজাকারের বিচারের রায় ও তাদের শাস্তির বাস্তবায়ন দেখতে।'

কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। কষ্ট নিয়ে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন– 'উপজেলা কমান্ডাররা ৫০ হাজার, ১ লাখ টাকা নিয়া তালিকায় নাম তুলে দেয়। এটা তো বাবা ঠিক না। ভারতীয় তালিকায় তো মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা ছিলই। স্বাধীনের পর বরং রাজাকারের তালিকা বানানো দরকার ছিল। তাহলেই বের হতো কে কী। কিন্তু দুঃখ, রাজাকারদের তালিকাই হল না। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হল বিতর্কিত।'

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বলেন– ' না বাবা, ওই দেশ পাইছি না। আমরা চাইছিলাম মোটা ভাত, মোটা কাপড় আর দেশের শান্তি। গরিব-ধনীর ব্যবধান কম থাকব। সবার মধ্যে সহমর্মিতা থাকব। কিন্তু কই দেশে তো গরিব আরও গরিব, বড়লোক আরও বড়লোক হইছে। দুর্নীতি তো নিয়মে পরিণত হইছে।'

কী করলে দেশটা আরও উন্নত হবে?

তিনি বলেন– 'জামাত-শিবির রাইখা দেশ চলব না। তাইলে কয়েকদিন পর পরই ওরা রাস্তার ভিতর গাছ কাটব। বাড়িঘর জ্বালায়া দিব। রগ কাইটা ফেলব। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাখলে দেশ আগাইব না। সরকারের উচিত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা।'

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বলেন– '১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ আইলে মনে হয় আমগো নতুন করে জন্ম হইছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গ্যাস বাড়ছে, বিদুৎ উৎপাদন বাড়ছে, দেশ উন্নত হচ্ছে– এটা দেখলে ভালো লাগে।

কিন্তু এ সরকারের বিরুদ্ধেও তো দুর্নীতির অভিযোগ আছে…

উত্তরে তিনি বলেন, 'শেখ হাসিনা তো একা দেশ চালায় না। তাঁর দলের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হইব। তাইলেই তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। নিজের দলকেই শাসন করতে হইব সবচেয়ে বেশি। আমার বিশ্বাস শেখের বেটি এইটা করব।'

মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধিতে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এ মুক্তিযোদ্ধা। অতঃপর বলেন– 'ভাতা পাই ১৬ হাজার টাকা। হাসিনা যেটা দিসে তা দিয়াই পরিবার চলব। এহন শুধু আমাগো থাকার জায়গা দরকার। বাংলার মাটিতে শেখ মুজিব হত্যার বিচার কইরা হাসিনা দেখায়া দিসে এইডা বাপের বেটি। ওর তো জানের কোনো মায়া নাই। ও তো কয়ই। আমার জান আমি দেশ ও দশের জন্য উৎসর্গ করে দিলাম। আমি প্রধানমন্ত্রী না আমি আপনাদের বোন। আপনাদের মাঝেই আমি আমার বাবার মুখ দেখতে পাই। শেখের বেটিই মুক্তিযোদ্ধাগো কষ্ট বুঝে।'

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা, এমনটাই ধারণা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুসের। তাঁর ভাষায়, 'এরা তো অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা। আপনি যে কাজটা করছেন এটাও তো একই কাজ। যে পর্যন্ত রাজাকারদের ফাঁসির রায় কার্যকর না হবে সে পর্যন্ত সবাইকে সজাগ থাকতে হইব। তাদের প্রতি আমাদের দোয়া আছে। উপরে আল্লাহ নিচে আমরা আছি, তোমরা কাজ চালায়া যাও। স্বার্থের কারণে বিভক্ত হয়ো না। তাইলে ইতিহাসও তোমাদের ক্ষমা করব না।'

পরবর্তী প্রজন্মই পারবে দেশ এগিয়ে নিতে। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস মীর বলেন– 'তোমরা লেখাপড়া কইরা বড় মানুষ হও। সৎ পথে চল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাইখ। মনে রাইখ তোমাদের পূর্বপুরুষরা রক্ত দিয়ে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছে। তাই তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তোমাদেরই।'

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস মীর,।

ট্রেনিং করেছেন: ভারতের ভুটান নামক স্থানে ২১ দিন ও তুরাতে ৭ দিনের ট্রেনিং করেন। এফএফ নং- ৩৩৫।

যুদ্ধ করেছেন: ১১ নং সেক্টেরের অধীনে গেরিলা অপারেশন করেন নেত্রকোনার জাগশু গ্রাম, নেতাই নদীর পাড়, করসিন্দু বাজার, গোসগাঁও, শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত।

যুদ্ধাহত: ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত ১১টায়। নেত্রকোনার নেতাই নদীর তীরে এক সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন না। বর্তমানে চলছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।