যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১৫ ‘‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার পরিবর্তে ধ্বংস করা হয়েছে’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 30 June 2014, 05:46 PM
Updated : 30 June 2014, 05:46 PM

ষাটের দশকের কথা। গ্রামাঞ্চলে ফুটবল তখন খুবই জনপ্রিয় খেলা। নানা জায়গায় আয়োজন হত ফুটবল টুর্নামেন্টের। খেলা দেখতে আমরা প্রায়ই যেতাম বেল্স পার্কে। বরিশাল জিলা স্কুলে ক্লাস ওয়ারি আমাদের টিম ছিল। বিকেলে স্কুলের মাঠেই চলত ফুটবল খেলা। খেলা নিয়ে তখনও সে কী উত্তেজনা! সন্ধ্যায় ঘাম আর ধুলামাখা শরীর ভাসাতাম পরেশ সাগরের বুকে। মাঠের পাশেই ছিল এ দীঘি।

সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হত। অন্যথায় বাবার বকুনি। তবুও নিয়মের মাঝেই আমরা নিয়ম ভাঙতাম– লঞ্চঘাটে মুক্ত বাতাসে আড্ডা দেওয়া, মাসে একবার ইভনিং শোতে সিনেমা দেখা। আর মাঝেমধ্যেই কীর্তনখোলায় নৌকা ভাসিয়ে বাকেরগঞ্জের দিকে চলে যেতাম। নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া সবই চলত নৌকাতে। এসব আনন্দে টাকা লাগত। কিন্তু বাবার কাছে চাওয়ার সাহস ছিল না। মা-ই ছিলেন ভরসা। গোপনে মায়ের কাছ থেকে সুপারি নিয়ে বাজারে বিক্রি করলেই মিলত নগদ টাকা।

তখন ১৯৬৪। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হই বিএম কলেজে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যগুলো তখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে কাগজে নানা খবর বেরুত। আমরা পড়তাম দৈনিক আজাদ ও ইত্তেফাক পত্রিকা দুটি। ডিসি, এসপি ও সরকারের উচ্চপদে অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কলেজের প্রফেসর কিংবা কোনো অফিসের বড় বাবু ছাড়া শিক্ষিত বাঙালিদের গতি ছিল না। এ নিয়ে আমাদের মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে।

এইচএসসি শেষে ভর্তি হই অনার্সে, অর্থনীতিতে। বিএম কলেজ তখন বরিশালের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ছাত্র ইউনিয়নের গ্রুপ ছিল দুটি। মতিয়া গ্রুপ ও মেনন গ্রুপ। মতপার্থক্য থাকলেও আন্দোলনের সময় দুই গ্রুপই এক হয়ে যেত। বৈষম্যগুলো তুলে ধরে ছাত্রনেতারা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতেন। ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষকরাও দেশের নানা তথ্য জানাতেন।

এসব কারণে মনের ভেতর তখনই একটি চিন্তাই পাকাপোক্ত হয়ে যায়– 'অধিকার আদায়ে সেপারেট হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।' কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব, জানা ছিল না।
বাঙালি যে শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত– সে সময় এটা ভিন্নভাবে মানুষের মনে দাগ টেনে বলতে পারতেন শেখ মুজিব।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ছাড়া পাওয়ার পর শেখ মুজিব একবার এসেছিলেন বরিশালে। উঠেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে। গলাচিপার এক ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির পাশেই। নাম আবদুর রশিদ। এক দুপুরে তার বাড়িতে খেতে আসেন শেখ মুজিব। আমাদের কয়েকজনের ওপর দায়িত্ব ছিল খাওয়ানোর। সেদিনই প্রথম কাছ থেকে দেখি বঙ্গবন্ধুকে। ভরাট তাঁর কণ্ঠ। কেমন সুন্দর দেখতে। আমরা তার মুখপানে চেয়ে থাকি।

নাম ধরে ডাকতেন তিনি। মনে হত যেন কত দিনের চেনা। আমাকে বললেন, ''এই, তোমার নাম কী? কী পড়িস?''

উত্তর শুনে পিঠ চাপড়ে তিনি শুধু বললেন– ''ঠিকভাবে লেখাপড়া করিস'। বঙ্গবন্ধুর সে স্পর্শ আজও ভুলিনি।

১৯৭০ সাল। অনার্স পাশ করে মার্টাসে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতি বিভাগে। দেশ তখন উত্তপ্ত। ক্লাস শুরু না হওয়ায় আমি বরিশালেই ফিরে আসি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরও ক্ষমতা ছাড়ে না পাকিস্তানি শাসক দল। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আমরা তখন ব্যস্ত থাকি মিছিল-মিটিংয়ে।

আসে ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। আমার চাচা সৈয়দ আবদুর রাজ্জাকের বাড়িতে ছিল একটি রেডিও। গ্রামের সবাই জড় হয় সেখানে। বঙ্গবন্ধু বললেন– ''এরপরে যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। তোমাদের যার যা কিছু আছে….।''

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। বরিশালে আমির হোসেন আমু, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, জালাল সরদার প্রমুখের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায় এ কমিটি গঠিত হয়।

[সাক্ষাতকারের ভিডিও লিংক

২৬ মার্চ, ভোরবেলা। মাইকের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। ঢাকায় আর্মি নামা ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর মাইকিং করছিল সংগ্রাম কমিটির লোকেরা। গ্রেফতারের আগে ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। টিএন্ডটি এক্সচেঞ্জ অফিসের অপারেটর সেটি টাইপ করে বিলি করছেন। এ খবর পেয়ে আমিও ঘোষণাটি সংগ্রহ করি। কী হবে দেশে বুঝতে পারছিলাম না।

বরিশাল পুলিশ লাইন ছিল আমাদের বাড়ির কাছেই। আমির হোসেন আমু, মেজর জলিল, জালাল সরদারসহ অন্যান্যদের মাধ্যমে পুলিশ লাইনের অস্ত্র চলে আসে সাধারণের হাতে। উদ্যোগ নেওয়া হয় বেল্স পার্কে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ের। খবর পেয়ে আমিও নাম লেখাই। আমরা ছিলাম পাঁচশ জনের ওপরে। পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন আবু ভাই ছিলেন কমান্ডার।

আমাদের একমাসের গেরিলা ট্রেনিং করান আবদুল মান্নান নামের একজন হাবিলদার। সকালে গিয়েই ফোলিং করা। পিটি প্যারেড, দৌড়-ঝাঁপ, ডামি বন্দুক দিয়ে ফায়ারিং প্র্যাকটিস শেষে ছিল ব্রেক। সন্ধ্যার পর লেডিস পার্কের পাশে নদীর পাড়ে শিখানো হত গ্রেনেড চার্জ, নাইট অপারেশন প্রভৃতি।

বরিশালে পাকিস্তান আর্মি নামে ২৪ এপিল। ওইদিন হেলিকপ্টারে তারা নামে ভোলাহাট তালতলীতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারি অস্ত্রের মুখে টিকতে পারে না। তখন আমরা আশপাশের গ্রামে গা ঢাকা দিই। চলে আসি ফুপুর বাড়ি জাগুয়া রুপাতলীতে। পাকিস্তানিদের খোঁজখবর নেওয়া ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে নানা পরিকল্পনার মাঝেই কেটে যায় সময়।

একাত্তরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল মালেক। এক বিকেলে তার লালমাটিয়ার বাড়িতে বসে আলাপ হয় আমাদের। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার আলেকান্দা গ্রামে। সৈয়দ আবদুল আজিজ ও সফুরা খাতুনের বড় সন্তান তিনি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দক্ষিণ আলেকান্দা সিরাদিয়া মক্তবে। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন বরিশাল জিলা স্কুলে। এরপর বিএম কলেজ ও সর্বশেষে মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিতে।

১৯৭৩ সালে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন পটুয়াখালিতে এবং ২০০৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ''পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিত। তাদের পথ ও লোক চিনিয়ে দিতেন রাজকাররা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে তারা টর্চার করত। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন বরিশাল টু খুলনা স্টিমারের রানিং ক্লার্ক। নাম ছিল মালেক। পাকিস্তানি সেনাদের মুভমেন্ট তিনি গোপনে জানিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তার লাশ পাওয়া যায় বাড়ির পাশের খালে।''

কীভাবে আক্রমণ চালাতেন?

মুক্তিযোদ্ধা মালেকের উত্তর– ''৯ নং সেক্টরের সুইসাইড স্কোয়াডের কমান্ডার রেজা-ই-সাত্তার ফারুক ছিলেন আমাদের কমান্ডার। আমরা যুদ্ধ করি বরিশাল শহর ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে। দল বেঁধে শহরে এসে বোম থ্রো করেই সরে পড়তাম। নির্দেশ ছিল, হিট অ্যান্ড ব্যাক। এভাবেই গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করি নভেম্বর পর্যন্ত।''

বরিশালে রাজাকার বাহিনীতে কারা ছিলেন?

''ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ও মাদ্রাসার কিছু ছাত্র সে সময় রাজাকারের ট্রেনিং নেয়। ওরা বন্দুক নিয়ে টহল দিত। বরিশালে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আবদুর রহমান বিশ্বাস (সাবেক রাষ্ট্রপতি)। আমাদের গ্রামে আবদুর রশিদ নামে একজন চিহ্নিত রাজাকার ছিল। পরে সে পাগল হয়ে স্টিমার ঘাটে ছালা পড়ে ভিক্ষা করত।''

মুক্তিযোদ্ধা মালেক একাত্তরে এক অপারেশনে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি তাঁর হাঁটুর নিচ নিয়ে বিদ্ধ হয়ে হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। প্রথম দিকে তিনি পা ভাঁজ করতে পারতেন না। কয়েক বছর আগেও চামড়া ফেটে পুঁজ বের হত। ব্যথা ও ঘা হওয়ার ভয়ে এখনও প্রতি সকালে ক্ষতের জায়গায় মলম লাগাতে হয়। গুলিবিদ্ধ পাটি অন্য পা থেকে ছোট হয়ে গেছে।

রক্তাক্ত সে দিনটির আদ্যোপান্ত শুনি মুক্তিযোদ্ধা মালেকের মুখে। তার ভাষায়– ''বরিশাল ডিসি অফিসের ক্লার্ক আবদুল রহিম হাওলাদার ছিল আমার পরিচিত। তার কাছ থেকে আর্মিদের মুভমেন্ট জেনে রেজা-ই-সাত্তারকে জানাতাম। ডিসি একেএম সিদ্দিকুল্লাহ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে।

ডিসেম্বরের সাত তারিখ। সারাদেশে পাকিস্তানিরা টিকতে পারছিল না। আমরা খবর পাই স্টিমারে পাকিস্তানি সৈন্যরা বরিশাল ত্যাগ করবে। শহরের চারপাশে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দল। তাদের আসার আগেই বরিশাল শহর দখলে নিতে হবে।

৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সন্ধ্যার পর। ডিসি সাহেবের পাঠানো দুটি গাড়িতে রহিমের সঙ্গে আমিও যাই লাকুটিয়ায় রেজা-ই-সাত্তার ফারুকের ক্যাম্পে। দুটি গাড়িতে আমরা ১৪ জনের মতো। রহিমসহ একটি গাড়িতে আমি, আবুল কালাম আজাদ, ফেরদৌস, মাহবুব আলম। নির্দেশ ছিল ডিসি অফিস দখলে নেওয়ার। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দলগুলোও তখন শহরে ঢুকে পড়ে।

পরিকল্পনা ছিল একটি গাড়ি জিলা স্কুলের সামনে দিয়ে এবং অন্যটি পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে ডিসি অফিসে ও তার বাংলোতে পৌঁছবে। আমাদের গাড়িটি পুলিশ লাইনের পথ ধরে। গাড়িতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। হালিমা খাতুন স্কুলের পশ্চিম দিকের রাস্তায় ওঁত পেতে ছিল সাত-আটজন রাজাকার। পতাকা ওড়ানো গাড়ি দেখে তারা ভাবল মুক্তিবাহিনী ঢুকে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা বৃষ্টির মতো ফায়ার করতে থাকে। গাড়ি থেকে আমরাও প্রত্যুত্তর দিই। কিন্তু তার আগেই ড্রাইভারসহ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। গাড়িটি পড়ে যায় রাস্তার পাশের খালের মধ্যে।

পরে পশ্চিম দিক থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আমাদের উদ্ধার করে। ডিসি অফিসের রহিম গুলি খেয়ে স্পটেই মারা যায়। তার মুখটির দিকে বার বার চোখ আটকে যাচ্ছিল। আমি ডান পাটা নাড়াতে পারছিলাম না। ঝিরঝির করে রক্ত বেরুচ্ছিল। গুলিটি হাঁটুর এক ইঞ্চি নিচ দিয়ে হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে বটতলা মসজিদে শুইয়ে দেয়। এরপর আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি সদর হাসপাতালে। আমার ডান পাটি টানা দেওয়া। গুলিবিদ্ধ হলেও ওই রাতেই ত্রিশ গোডাইন ছাড়া বরিশাল মুক্ত হয়।''

চিকিৎসা নিলেন কোথায়?

মুক্তিযোদ্ধা মালেক বলেন– ''বরিশাল থেকে আমাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের ৩২ নং মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে। তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতাম। ওই অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে যেতাম। '৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চিকিৎসার জন্য অন্য যুদ্ধাহতদের সঙ্গে আমাকেও পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। ওখানকার হাসপাতালে আমাদের দেখতে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান ও সুইস মন্ত্রী জ জিগলার। সে সময়কার ছবিগুলো দেখলে আজও সব জীবন্ত হয়ে ওঠে।

যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কি পেয়েছেন?

খানিক নিরব থেকে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার উত্তর– ''ওই দেশ পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশ আজ অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতার পর পরই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার পরিবর্তে ধ্বংস করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ৭ মার্চে ভাষণ দিয়েছিলেন, সে জায়গাটিকেও সংরক্ষণ করা হয়নি। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে শিশুপার্ক। এখনও সারা দেশে অবহেলায় পড়ে আছে অনেক গণকবর। তাহলে স্বাধীনতার মান থাকল কি? আমরা তো চেয়েছিলাম সোনার বাংলায় মানুষ শান্তিতে থাকবে, শিক্ষিত হবে, দেশে থাকবে গণতন্ত্র।''

কথা ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল মালেক অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়– ''বঙ্গবন্ধু এদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এরপর যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ছিল নয়। ফলে বিচারের পরিবর্তে রাজাকাররা পুরষ্কৃত হয়েছে। অর্থে-বিত্তে ও ক্ষমতায় তারা নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছে। তেতাল্লিশ বছর পরে হলেও তাদের বিচার হচ্ছে। স্বাধীন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে– এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।''

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো ছোট ছোট অপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন?

''যুদ্ধপরবর্তী দেশের ওই প্রেক্ষাপটে এটি সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বড় বড় যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি।''

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা মালেক বলেন– ''উইদাউট অ্যানি ট্রায়াল সব হত্যাই বেআইনি। বঙ্গবন্ধু যদি অপরাধ করেই থাকেন, তাঁকে ট্রায়ালে এনে তাঁর অপরাধ কী তা বলা যেত। কিন্তু তা না করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার অর্থ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরতরে হত্যা করা।''

রাজাকারদের উত্থানে কারা দায়ী বলে মনে করেন?

'' '৭৫ থেকে '৯৬ পর্যন্ত সরকারগুলোর ওপরই এর দায় বর্তায়। দীর্ঘ এ সময়ে রাজাকাররা দেশ-বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ প্রভৃতি করেছে। স্বাধীন দেশের মাটিতে এরা নিজেদের শেকড় পোক্ত করেছে।''

স্বাধীন দেশে সামরিক সরকারের শাসনামল নিয়ে মালেক বলেন– ''সামরিক সরকার কোনো দেশের জন্যই ভালো নয়। দেশের উন্নয়ন তখন প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মুক্তচিন্তা ব্যাহত হয়। তবে একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকারেরও জবাবদিহিতা বাড়ানো উচিত।''

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিষয়ে। তিনি বলেন– ''স্বাধীনের পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিলিশিয়া ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অস্ত্র জমা দেয়। তখন ওই তালিকা সামনে রেখেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা যেত।''

তেতাল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা মালেক বলেন– ''সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কারণেই তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও কিছু অসাধু কর্মকর্তা।''

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আমরা কথা বলি মুক্তিযোদ্ধা মালেকের ছেলে সৈয়দ মাহাবুব হাসান মিদুলের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা বাবা প্রসঙ্গে তিনি শুধু বললেন– ''আমি গর্বিত, আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত গল্প পড়েছি। ছবি দেখেছি। এইসব গল্পের সঙ্গে যে আমার নিজের বাবাও যুক্ত এটা ভাবলেই ভালো লাগে।''

তিনি বলেন– ''মুক্তিযুদ্ধ তো একবারই হয়েছে, যদি আবার হত তাহলে আমরাও অংশ নিতাম। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করি, ধারণ করি।''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা জানতে চাই আমরা। উত্তরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মালেক বলেন– ''স্বাধীন রাষ্ট্র ও পতাকা পেয়েছি। দেশের জমি কমেছে, মানুষ বেড়ে, কিন্তু তবুও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন। মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বেড়েছে। এগুলো দেখলে সত্যি তৃপ্ত হই। ভালো লাগে।''

খারাপ লাগা জানতে চাইলে তিনি বললেন– ''আমরা লোভ থেকে বেরুতে পারিনি। বিদেশি বন্ধুদের ডেকে এনে সম্মাননা দিলাম। কত ভালো উদ্যোগ। কৃতজ্ঞ জাতি। কিন্তু ক্রেস্টের সোনাও চুরি হয়ে গেল। টাকার লোভে দেশের সম্মানের কথাও আমরা ভুলে গেছি। আগে লেখাপড়া করা লোক পেলে মানুষ আশ্বস্ত হত। ভাবত, এরা আর যাই করুক চুরি করবে না। এখন শিক্ষিত লোকেরই চোর হচ্ছে।''

সমস্যা পেছনে ফেলেই নতুন প্রজন্ম দেশকে একদিন অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুর মালেকের। তাই তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন– ''তোমরা লোভ পরিহার কর। কারণ এটা তোমাদের অন্য ভালো গুণগুলোকে নষ্ট করে দিবে। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসটাকে তোমরা জেনে নিও। সব সময় মনে রেখ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া, দেশ এগোবে না।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল মালেক।

ট্রেনিং নেন: এক মাসের ট্রেনিং নেন বরিশাল বেল্স পার্কে। পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন আবু ভাই ছিলেন কমান্ডার। ট্রেনিং করান আবদুল মান্নান নামের একজন হাবিলদার।

যুদ্ধ করেছেন: ৯ নং সেক্টরের সুইসাইড স্কোয়াডের কমান্ডার রেজা-ই-সাত্তার ফারুকের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন বরিশাল শহর ও আশপাশের এলাকায়।

যুদ্ধাহত: ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বরিশাল শহর অপারেশনে তিনি ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি তাঁর হাঁটুর নিচ নিয়ে বিদ্ধ হয়ে হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। প্রথম দিকে তিনি পা ভাঁজ করতে পারতেন না। কয়েক বছর আগেও চামড়া ফেটে পুঁজ বের হত। ব্যথা ও ঘা হওয়ার ভয়ে এখনও প্রতি সকালে ক্ষত জায়গায় মলম লাগাতে হয়। গুলিবিদ্ধ পাটি অন্য পা থেকে ছোট হয়ে গেছে।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।


সালেক খোকন:
লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।