যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১২ ‘‘শেখের মাইয়াই আমগো খেয়াল রাখে’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 13 May 2014, 04:08 PM
Updated : 13 May 2014, 04:08 PM

তাঁর নাম বাকি মোল্লা। বয়স আটষট্টির মতো। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে কেটে ফেলতে হয় তাঁর ডান পা। শরীরের ভারে বাঁ পা-ও এখন বেঁকে গিয়েছে। ফলে হাঁটতে পারেন না, শুধু শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন। জীবনের হিসেব তাঁর মিলে না। তাই বুকে পুষে রাখা কষ্ট এবং কান্না-হাসির মাঝে কেটে যাচ্ছে তাঁর দিনগুলি।

মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা সম্পর্কে তথ্যগুলো দেন আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমরা পা রাখি বাকি মোল্লার বাড়িতে।

মিরপুর চিড়িয়াখানার ঠিক পাশেই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। নামে কমপ্লেক্স হলেও এটি আসলে সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তি বিশেষ। এখানেই একটি খুপরি ঘরে আমরা খুঁজে পাই মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লাকে। টিনে ঘেরা ছোট্ট ঘর। একটি চৌকি, টেবিল ও একটি হুইলচেয়ার ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। দুজনকে বসতে দেওয়ার মতো আসবাব নেই এ মুক্তিযোদ্ধার ঘরে। যুবক বয়সী একজন পাশের ঘর থেকে নিয়ে এল একটি কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসেই আমরা চোখ রাখি বাকি মোল্লার চোখে।

পরিচয় দিতেই তিনি প্রশ্ন করেন, ''কেন আইছেন?''

''আপনার কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা আর দেশের কথা শুনতে।''

তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। পরক্ষণেই চোখ ভেজান বুকে পুষে রাখা কষ্টের স্মৃতিগুলো অনুভব করে।

স্বাধীনতার জন্য শুধু অঙ্গ নয়, এই যোদ্ধা হারিয়েছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকুও। দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতিদান তিনি চান না। কিন্তু স্বাধীন তালাভের পর অন্যদের সঙ্গে নিজের জীবনের হিসেবটুকুও তিনি মেলাতে পারেন না।

সেদিন ইন্টারভিউ নেওয়া হল না। তিনি শুধু বললেন– ''আমরা তো ভিখারির মতো বেঁচে আছি। কর্তব্য ছিল, করে দিছি। এখন যদি হাজারও মাথা ঠুকি, আপনি পারবেন না আমার একটা অঙ্গ ফিরায়া দিতে। পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছি বহুবার। শরীরের ভারে বাম পা-ও বেঁকে গেছে। বসতে পরি না। চলতে পারি না। এত কষ্ট লাগে আমার।''

এরপর সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। মুঠোফোনে বার কয়েক খবর নিই তাঁর। এক সকালে তিনি মনের ভেতর জমে থাকা যুদ্ধদিনের কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ফোন পেয়েই আমরা চলে আসি তাঁর বাড়ি।

মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার (পূর্বে ছিল চারঘাট থানা) হামিদকুড়া গ্রামে। বাবা আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা ও মা রমিজান বেওয়ার বড় ছেলে তিনি। ২ ভাই ও ১ বোনের সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। তিনি কৃষিকাজ করতেন।

বাকির বয়স যখন দশ, তখন হঠাৎ অসুখে মারা যান তাঁর বাবা। কিন্তু মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে থাকতে পারেননি তিনি। বাবার মুখের শেষ কথাগুলো তাই আজও তাঁর কানে বাজে। সে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না বাকি।

[বাকি মোল্লার সাক্ষাতকারের ভিডিও দেখুন–

তাঁর ভাষায়, ''চারঘাটে একটা সরকারি হাসপাতাল ছিল। আমারে বাবা কইল, 'আমার শরীর খুব খারাপ। বাবা তুমি সরকারি হাসপাতাল থাকি ওষুধ আনি দাও।' চারটা বোতলে গামছা বাঁধি দিলে আমি কোশ তিনেক রাস্তা হাঁটি গেছি। কিন্তু ওষুদ নিয়া আসতে আসতে আমার সন্ধ্যা লাগি গেছে। তখন কোথায় গিয়া উঠি? বেলা ডুবি গেলে আমি এক মামার বাড়িতে উঠলাম। ফজরের আযানের পর আবার বাড়ির দিকে রওনা দিই। আমাদের বাড়ি ছিল উত্তর পাড়ায়। রেললাইন যখন পার হইছি, তখনই আজহার নামে একটা ছেইলে ডাক দিয়ে কইল, 'তুই কই গেছিলি?' আমি কই, 'আব্বার লাইগা ওষুদ আনতে গেছিলাম।' 'ওষুদ কারে খাওয়াবি, তোর বাপ তো নাই, তোর বাপ রাতেই মারা গেছে।' কথাডা শুইনাই আমার সে কী কান্দন।''

বাবার মৃত্যুর পর বাকি মোল্লার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে, সে বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। বাকি বলেন–

''ছালবাল কালে আজের, আরামান, কোরবান, জিবা, মতিবারের সঙ্গে বল আর মার্বেল খেলতাম। বাপ যখন মরি গেল তখন তো আর খেলাধুলা নাই। আফসোস করি। বড় পোলা আমি, জমির লাঙল তো ধরতে হবি। কিন্তু তহন আমি তো ছোটমানুষ, লাঙল তো ধরতে পারি না। চিনি হাজি নামে এক লোক ছিলেন গ্রামে। আমার কষ্ট দেখে উনিই আমারে সাহায্য করতেন। বীজ ছিটায়ে দিতেন। জমিতে মই দিয়ে দিতেন। এভাবে চলতে চলতে আমি হাল দেওয়া শিখলাম। তহোন এক টাকা চাইর আনা ছিল এক সের চালের দাম। হাল দিয়া, মাইনসের জমিতে কামলা দিয়া আর ঘাস বাছি চাইলের টাকা জোগাড় করি আর ভাইবোন নিয়ে খাই।''

দেশের অবস্থা তখন কেমন ছিল?

বাকি বলেন–

''আমি তো নিজের জীবন নিয়াই ব্যস্ত। জমিতে কাজের পাশাপাশি তখন আমি বিস্কুটের ব্যবসা করি। সিরাজগঞ্জে ফেক্টরি থেকে বিস্কুট এনে গ্রামে পাইকারি বিক্রি করতাম। বাজারে গিয়া রেডিও শুনতাম। মানুষের মুখে শুনতাম, দেশ ভালো নাই। পাকিস্তানিরা আমাগো দেখতে পারে না।''

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাকি মোল্লা শোনেন রেডিওতে। আজও সে ভাষণ তাঁকে উদীপ্ত করে। তাঁর ভাষায়–

''শেখ মুজিব কইলেন, ভায়েরা আমার।… রক্তের দাগ শুকায় নাই।… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না… ।''

২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ২৬ মার্চের পর রাজশাহীর গোপালপুর সুগার মিলের সমানে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে পারে না।

মার্চের শেষে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে চারঘাট থানা আক্রমণ করে। অস্ত্র লুট করে তারা ওখানেই অবস্থান নেয়। পরিবার নিয়ে বাকি মোল্লা তখন ভিতরবাগ গ্রামে আশ্রয় নেন। সে সময় থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি বলেন–

''আমার বয়স তখন পঁচিশের মতো। গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রুটি বানায়া দিত। মজিবর চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা সে রুটির বস্তা বাঁধি মাথায় করি নিয়া গেছি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, চারঘাট দিয়ার বাজারে।''

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

বাকির উত্তর–

''সংসারে তখন আমার তিন ছেলে। বউ আবার অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের মায়া আর প্রবল পিছুটান। পুলিশ, আর্মি আর ইপিআরের বাঙালি সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার তাগাদা দিয়ে বলত, 'বাবা, তোমরা যদি আমাদের সাথে না আসো, তাইলে দেশ স্বাধীন করা যাবে না। আমাদের দেশ আমাদেরকেই স্বাধীন করতে হবে, তোমরা আসো।' আমরা প্রশ্ন করতাম, 'আমরা তো যুদ্ধের কিছুই বুঝি না।' 'ট্রেনিং কর। যখন অস্ত্র হাতে পাইবা, তখন শক্তি বাড়ব। বুঝন লাগব না।' তাদের কথায় পরিবারের মায়া ছেড়েই আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।''

ট্রেনিং নিলেন কোথায় ?

বাকি বলেন–

''তখন এপ্রিলের মাঝামাঝি। চারঘাট দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আমরা ভারতের সাগরপাড়া ক্যাম্পে উঠি। ট্রেনিংয়ের জন্য সেখান থেকে আমাদের পাঠানো হয় পাহাড়পুর ক্যাম্পে। ওখানে আমাদের একমাস রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া হয়। কমান্ডার ছিলেন ইপিআরের নায়েক সুবেদার কাশেম। ট্রেনিং শেষে দেশের মাটি ছুঁয়ে আমরা কসম করি, দেশকে শক্রমুক্ত করব, মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব, আমাদের অস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের হাতে দেব না। পরে ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর লালগোলা ডাক বাংলা ক্যাম্পের অধীনে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি।''

ট্রেনিং শেষে বাকি মোল্লা প্রথম অপারেশনেই গুলিবিদ্ধ হন। সেদিনের আদ্যোপান্ত শুনি মুক্তিযোদ্ধা বাকির জবানিতে–

''১৯৭১ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে গুলি খাই আমি। খবর ছিল ভিতরবাগ, মইরবাগ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি বহর যাবে নন্দনগাছির দিকে। আমরা মাত্র ২৫-৩০ জন। কমান্ডে নায়েক সুবেদার কাশেম। আমাদের কাছে ছিল মার্ক ও রাইফেল। রাতে আমরা পজিশন নিই আড়ানি ব্রিজের পাশে। ভোর হয়-হয়। পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছিল। আতঙ্ক তৈরি করে ওরা এইভাবেই পথ চলত।''

''ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই আমরা দুইপাশ থেকে আক্রমণ করি। শুরু হয় গোলাগুলি। গুলি ছুঁড়ে আমি দৌড়ে সামনে আগাইতে যাই। অমনি একটা গুলি আইসা লাগে আমার ডান পায়ের হাঁটুতে। আমি দুই লাফ গিয়া ছিটকে পড়ি। শরীরটা তখন দুইটা ঝাড়া দেয়। প্রথম বুঝতে পারি নাই। দেখি পিনপিন করে রক্ত বেরোচ্ছে। পাশেই ছিল সহযোদ্ধা মিল্লাত আলী। তার বুকেও এসে লাগে একটি গুলি। সে চিৎকার দেয়। অতঃপর তার শরীরটা ঝাঁকি দিয়েই নিথর হয়ে যায়। 'মা গো' চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি অন্যপাশে সুধাংশু বাবু। তাঁর মাথার পেছন দিয়ে গুলি লেগে চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সব ঘটছে চোখের সামনে!''

''অসহায়ের মতো পড়ে ছিলাম। মৃত্যুভয় তাড়া করছিল। সহযোদ্ধারা আমাকে টেনে পেছনে এক গ্রামের ভেতর নিয়ে যায়। পরে একটা দরজার পাল্লায় শুইয়ে আমাকে নেওয়া হয় আড়আলীর বাজারে। ওইখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সন্ধ্যায় সাগরপাড়া ক্যাম্পে এবং সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাসপাতালে। ওইখানেই অপারেশন করে আমার ডান পা হাঁটুর ওপর এক বিঘা থেকে কেটে ফেলা হয়। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম পা-ডা নাই। আমি তখন আসমান থেইকা জমিনে পড়লাম।''

এক পা হারালেও মুক্তিযোদ্ধা বাকি বেঁচে আছেন, এটাই ছিল তাঁর সান্ত্বনা। স্বাধীন দেশে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার করবেন। বাড়িতে রেখে আসা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কোলে দেখবেন ফুটফুটে নবজাতক। স্বাধীনতার পর এমন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে তিনি দ্বিতীয়বার রক্তাক্ত হন। তবে তা দেহে নয়, মনে। বাকি মোল্লার ভাষায়–

''আমি স্টেশনে নামি গেণ্ডারির মাঠ দিয়া বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এক হাজির পোলা মধু আমারে দূর থেকে দেখে ছুটে আসে, 'কী রে, ভাই বাকি?' জড়িয়ে ধরে বলে, 'আহা রে, তোর পরিবারডা মারা গেল। পেটের সন্তানডাও মরিছে। তুই দেখতে পারস নাই।' শুনেই আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার স্ত্রী কুলসুম বড় ভালো মানুষ ছিল। ব্যবসা করতাম। রাতে না ফেরা পর্যন্ত সে ভাত খেত না। স্বাধীনতার জন্য তারেও হারালাম! এখনও মনে হলে কষ্ট পাই। এত দুঃখ, এত কষ্ট। দুনিয়াডাই ফাঁকিবাজি।''

বাহাত্তর সালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু একবার দেখতে আসেন বাকিসহ অন্যান্য যুদ্ধাহতদের। সেদিন তিনি সবার হাতে তুলে দেন দুশো করে টাকা। পরে তিনিই তাদের প্রথম ৭৫ টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাকি মোল্লা এমএলএসএস পদে চাকরি পান ঢাকার জিপিওতে। তিনি বলেন–

''চাকুরির দুই বছর খুব কষ্ট করেছি। গাড়ি থেকে পড়ছি কয়েকবার। উঠতে লাগি, রিকশা থাকি পড়ছি তিনবার। মানুষের কত কথা যে সহ্য করছি। কাউকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতাম না। তারপরও চাকরিডা ধরে রাখছিলাম।''

কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা বলেন–

''ওসমানী সাহেব (আতাউল গনি ওসমানী) থাকা অবস্থাতেই এ তালিকা চুড়ান্ত করা যেত। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ তাদের হাতে বিতরণ না করে সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে বিলি করলে দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধা গজানো কঠিন হত।''

এখনও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে? উত্তরে তিনি দুঃখ করে বলেন–

''এখন তো বঙ্গবন্ধু নাই যে তাঁরে দোষ দিমু। ওসমানী সাহেবও নাই। কিছু স্বার্থপর মুক্তিযোদ্ধাই এর জন্য দায়ী। ২০০৪ সালে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখিয়েছে। দুধের সুন্দর পায়েসের মধ্যে যদি কয়েকটি মাছি পড়ে, তাইলে কি আপনি খাইতে পারবেন? সেই মাছিগুলা হইল তারা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা না, এডি হইল দুষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।''

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়–

''সাধারণ ক্ষমা মস্তবড় ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধু বড় নেতা ছিলেন। তাঁর মনে ছিল, কারে মারতে কমু, কারে মারুম, সবাই তো আমার ভাই। এই ক্ষমাতেই রাজাকারদের বড় একটি অংশ রেহাই পেয়ে যায়। পরে ওরাই জোট হয়ে বলেছে বঙ্গবন্ধুর গুস্টি রাখমু না।''

বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা বলতে গিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা অশ্রুসজল হন। তিনি বলেন–

''তিনি ছিলেন বাঙালিদের মনের মানুষ। অথচ স্বাধীন দেশে তাঁরেই সপরিবারে মাইরা ফেলা হইছে। তাঁর হত্যার বিচার করা যাবে না বলে আইন করা হইছিল। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হইতে পারে?''

রাজাকারদের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বাকি বলেন–

''বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো আরও আগেই এদের বিচার করতেন। পরে তো জিয়াউর রহমান ও তার দলের হাত ধরে এরা মন্ত্রী হয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা, বাজার করতে পারি না। এক মাসের বেতনে তখন ১৫ দিনও যায় না। অথচ রাজাকারেরা পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে চড়ছে। কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছা করত।''

মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য কমপ্লেক্স তৈরির বিষয়ে সরকারের কাছে দাবি রেখে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন–

''এদেশে শরণার্থী, বাস্তহারাদেরও জায়গা হয়, আমাদের জায়গা হয় না! আজ যদি দেশ স্বাধীন না হত, এত মন্ত্রী কোথা থেকে হত? আজ আমরা গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কমপ্লেক্স আজ হবে না কাল হবে, পরশু হবে না, তরশু হবে। কর্মকর্তারা নানা কথা বলে বুঝ দেয়। অনেকেই বলে পরিত্যক্ত বাড়ি নিতে। আমি কইছি শেখের মাইয়াই বাড়ি করে দিবে। তাঁর সময়েই আমাদের ভাতা বেড়েছে। নইলে পরিবার নিয়া রাস্তায় নামতে হইত। শেখের মাইয়াই আমগো খেয়াল রাখে। সে আশাতেই বসে আছি।''

কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন–

''মুক্তিযুদ্ধে যদি না যাইতাম তাইলে পঙ্গু হইতাম না, পঙ্গুদের কোনো দাম নাই, আপনারা লিখবেন। তারপরই কাজ শেষ। এরপর আর খোঁজও রাখবেন না। একটা অঙ্গ না থাকলে কী অবস্থা হয় সেটা আপনারা বুঝবেন না। আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কী দিবেন? তাইলে বাজেটের অজুহাত দেখিয়ে কেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কমপ্লেক্সের কাজ বন্ধ রাখা হয়?''

মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার প্রশ্নের উত্তরে আমরা শুধুই নিরব থাকি।

কী করলে দেশে আরও এগিয়ে যাবে?

এমন প্রশ্নে এ মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন–

''কী করলে ভালো হবে, এটা আপনারাই বোঝেন। আপনারা সাংবাদিক, লেখক বা যাই হোন না কেন বুঝে করেন, মন থেকে দায়িত্ব মনে করে করেন, দেশের চিন্তা করে করেন। কোনো দলীয় দৃষ্টিতে না। এ রকম প্রত্যেকে করলেই দেশ বদলে যাবে।''

তিনি আরও বলেন–

''হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। কিন্তু তিনি তো একা দেশ চালান না। তাঁর দলের লোকজন লাগে। সেই সাঙ্গপাঙ্গরা যদি চোর হয়, তাইলে দেশ আগাবে না। আমার বিশ্বাস, এই সরকার নিজে বস্তা বানানোর চিন্তা না কইরা দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে। দেশটারে সত্যি সত্যিই বদলাইয়া দিবে।''

নতুন প্রজন্ম সবকিছু বোঝে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনেকটাই উজ্জীবিত। তাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাকি মোল্লার আশা, তারাই দেশের সত্যিকারের কাণ্ডারী হবে। দেশকে ভালোবেসে নতুন প্রজন্মই সোনার বাংলা গড়বে।

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. বাকি মোল্লা।

ট্রেনিং নেন: ভারতের পাহাড়পুর ক্যাম্পে এক মাসের রাইফেল ট্রেনিং নেন। ওখানে তাঁর কমান্ডার ছিলেন ইপিআরের নায়েক সুবেদার কাশেম।

যুদ্ধ করেছেন: ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর লালগোলা ডাক বাংলা ক্যাম্পের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন।

যুদ্ধাহত: ১৯৭১ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীর বাসুদেবপুর অপারেশনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর এক বিঘা থেকে কেটে ফেলা হয়। শরীরের ভারে বাম পা-ও বর্তমানে বেঁকে গেছে।


ছবি ও ভিডিও:
সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।