গণজাগরণ মঞ্চ: টুকরো ভাবনা

শাহাদুজ্জামান
Published : 26 April 2014, 02:07 PM
Updated : 26 April 2014, 02:07 PM

'গণজাগরণ মঞ্চ' বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা নতুন পদ। পুরো বিষয়টা অভিনব এবং খানিকটা আচমকা। ফলে রাজনীতির মানচিত্রে তাদের জায়গাটা ঠিক কোথায় তার মীমাংসা খুব সহজ নয়। গত কদিন যাবত গণজাগরণ মঞ্চ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিতর্ক বিষয়ে আমার কিছু টুকরো ভাবনা হাজির করলাম এখানে।

১.

এটি বিশ্বাস করি যে, ২০১৩এর ফেব্রুয়ারিতে দেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক ক্রান্তিতে শাহবাগ চত্বর কেন্দ্র করে গণজাগরণ মঞ্চ যে ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল তা এখন এদেশের ইতিহাসের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। এ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ আমি 'শাহবাগ ২০১৩' বইটিতে উপস্থিত করেছি। লক্ষ করি, গত এক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি যে নাটকীয় পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে তার উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই গণজাগরণ মঞ্চের প্রভাব রয়েছে।

বলাবাহুল্য যে, এই মঞ্চ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে না হলেও এটি অরাজনৈতিক মঞ্চও ছিল না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটা অমীমাংসিত ঘোর রাজনৈতিক ইস্যু কেন্দ্র করেই দলমতনির্বিশেষে লক্ষাধিক মানুষ তাদের ক্ষোভ, হতাশা শাহবাগ চত্বরে এসে উন্মুক্ত করেছিলেন। শাহবাগ চত্বরের মূল স্পিরিট নিঃসন্দেহে ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো এই মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও, মঞ্চের মূল নিয়ন্ত্রণে ছিলেন দলীয় তকমাবিহীন কিছু অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। বলা যায়, বিশেষ রাজনৈতিক সাংগঠনিক পরিচয়হীনতাই ছিল এই মঞ্চের শক্তির প্রধান উৎস।

যে প্রাণের দাবিতে গত বছর শাহবাগসহ দেশের নানাপ্রান্তে বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছিলেন তা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের ম্যানিপুলেশনে হয়েছিল কিম্বা কোনো বিশেষ দল চাইলেই এই গণজোয়ার বন্ধ করে দিতে পারত এমন ভাবার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সে সঙ্গে এটিও লক্ষ্য করি যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত গণজোয়ার একটা পর্যায়ে নানা গোষ্ঠী, দল তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে।

বলা বাহুল্য, কোনো গণজোয়ারই অনির্দিষ্টকাল চলে না। ব্যক্তিজীবনের মতো জাতীয় জীবনেও একটা বিশেষ লগ্ন তৈরি হয়। সেই লগ্ন স্বল্পস্থায়ী হয় কিন্তু যা থাকে তা ওই লগ্নের স্পিরিট। যেমন রাতের তারারা থাকে দিনের আলোর গভীরে। তেমনি শাহবাগের গণজোয়ারও স্বাভাবিকভাবে স্তিমিত হয়েছে কিন্তু তার স্পিরিট দেশব্যাপী সুপ্ত আছে বলেই ধারণা করি।

২.

দেখা যাচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠার বছরপূর্তির পর একটা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, একটা বিশেষ মুহূর্তে, বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আর্থিক অনিয়মের এবং এই মঞ্চের মুখপাত্রের নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিকতার। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই স্মরণ রাখতে চাই যে, শাহবাগের এই গণজাগরণ বিশেষ কোনো নেতৃত্ব-নির্ভর, মঞ্চ-নির্ভর জাগরণ ছিল না, এটি ছিল একটি বিশেষ সর্বব্যাপী চেতনানির্ভর জাগরণ। চেতনার মতো বিমূর্ত বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক ধোঁয়াশার জন্ম দেওয়া হয়েছে।

আপাতত সে চেষ্টা না করে এটুকু বলা যায় যে, কোন সে চেতনায় বিপুল মানুষ শাহবাগসহ দেশের নানা চত্বরে হাজির হয়েছিলেন তা সেই হাজির মানুষরা ভালোই জানেন। রাজনীতিতে 'সাইলেন্ট মেজরিটি' বলে একটা কথা আছে। লক্ষণীয়, সেই 'নিরব সংখ্যাগরিষ্ঠ' মানুষ তাদের কণ্ঠস্বর শোনাবার জন্য প্রচলিত সংগঠনের বাইরের বিকল্প, নতুন একটা ভাষা, পরিসর খুঁজে পেয়েছিলেন শাহবাগ চত্বরে। ঘটনা-পরস্পরায় গণজাগরণ মঞ্চ সেই সাইলেন্ট মেজরিটির সর্বব্যাপী চেতনার একটা মূর্ত রূপে পরিণত হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মতিক্রমে একজনকে এই মঞ্চের মুখপাত্র নির্বাচন করা হয়েছিল।

এখন এই মঞ্চের কর্তৃত্ব ইত্যাদি নিয়ে যারা বিভিন্ন অভিযোগের প্রদর্শনী করছেন তাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, এ কাজ করতে গিয়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ কোনো কর্তৃত্বের আশায় নয়– নেহাত আবেগ, অনুভূতি, প্রেরণার জায়গা থেকে ওই চত্বরে উপস্থিত হয়েছিলের তারা যেন প্রতারিত বোধ না করেন।

৩.

গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর এই মঞ্চ গঠনের সূচনালগ্ন থেকেই ছিল। তবে এবারের অভিযোগের অভিনবত্ব হচ্ছে অভিযোগগুলো এসেছে মঞ্চের সহযোগীদের ভেতর থেকেই। মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিকতার কথা তোলা হয়েছে। ডা. ইমরান রাজনীতির চত্বরে কোনো পরিচিত মুখ নন। দূর অতীতে কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তার সংযুক্ততা থাকলেও, মূলত একজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট সংগঠক পরিচয়েই তিনি গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন।

খানিকটা ঘটনাচক্রে এই মুখপাত্র হবার সুবাদে ডা. ইমরানের উপর অভূতপূর্ব দ্রুততায় দেশব্যাপী মানুষের দৃষ্টি পড়েছে। মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে ডা. ইমরান অগণতান্ত্রিক ছিলেন কিনা তা নিয়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের ভেতর পরষ্পরবিরোধী মত আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে একজন সাধারণ পর্যবেক্ষক হিসেবে এটুকু বলা যায়, সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে ডা. ইমরানের মতো রাজনীতির মঞ্চে অপরিচিত একজন মানুষ মঞ্চের মূল প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন এবং ঘন ঘন মুখপাত্র বদলের মাধ্যমে সেই প্রতীক পরিবর্তন হয়নি বলেই, মঞ্চের গ্রহণযোগ্যতা এতটা ব্যাপক হয়েছিল, মানুষের আস্থা তৈরি হয়েছিল।

সে সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে যে, মুখপাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে গত বছর ডা. ইমরানকে যুদ্ধাপরাধী শক্তির হত্যা, খুনের ভয়াবহ মহোৎসবের অন্যতম একজন টার্গেটে পরিণত করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তিনি সেই বিপদজনক সময়ে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এখন একটা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ সময়ে এসে তার ভূমিকা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন, তারা তার সেই ঘোর সংকটকালীন সময়ের ভূমিকার জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি।

৪.

অভিযোগ উঠেছে, গণজাগরণ মঞ্চ চাঁদাবাজি করেছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই তার দায় নিতে হবে। তবে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে আরও প্রবল নানা অভিযোগ আগেও উঠেছে আমরা দেখেছি। নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগে গণজাগরণের কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা গণজাগরণের মুখপাত্র মঞ্চ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন এমন সংবাদও পরিবেশন করেছে।

গণজাগরণের বিরোধী পক্ষের সেই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি– এবার তাদের পক্ষের লোকজনের অভিযোগ প্রমাণ হয় কিনা সেটা দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান থেকে এটুকু বুঝতে পারি যে, মানুষের ভালোবাসার দান আর চাঁদাবাজি এক ব্যাপার নয়। আর ওই রকম একটা উত্তাল গণকর্মসূচির ভেতর কোনো রকম পূর্ব সাংগঠনিক এবং দাপ্তরিক কাঠামো ছাড়া একটা স্বতঃষ্ফুর্ত মঞ্চের পক্ষে খুব স্থির মস্তিস্কে সুচারু কোনো অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ রাখাও সহজ ছিল না। তবে অনুদানের টাকা হলেও তার একটা হিসাব রাখার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল গণজাগরণ মঞ্চের। নিজেদের জবাবদিহির আওতায় রাখবার ব্যাপারে সতর্ক থাকলে ভালো হত।

৫.

নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ২০১৪ সালে একটা নতুন প্রেক্ষাপটে এসে পৌঁছেছে। নির্বাচন-পূর্ববর্তী গণজাগরণ মঞ্চ আর নির্বাচন-পরবর্তী গণজাগরণ মঞ্চের তাৎপর্য পাল্টেছে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গণজাগরণ মঞ্চের ভূমিকা কী হবে সেটা নির্ধারণ জরুরি ছিল মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। তারা কি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করা আধা-রাজনৈতিক একটা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে, নাকি একটা সংগঠিত যথার্থ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে এই দূরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা দরকার ছিল।

তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বোঝা যাচ্ছিল তারা দ্বিতীয় পথই ধরবার চেষ্টা করছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের মূল বিষয়টির সমান্তরালে তারা সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার অঞ্চলে পদযাত্রার মাধ্যমে, পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করবার ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে, সম্প্রতি জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অনুদানের বিরোধিতার মাধ্যমে তাদের একটা স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তুলে ধরবার চেষ্টা করেছে।

সর্বোপরি, আমরা দেখতে পেলাম গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল গঠনেরও ইঙ্গিত দিলেন। ঠিক এ রকম একটা পর্যায়ে গণজাগরণ মঞ্চ বিতর্কিত হয়ে ওঠা কাকতালীয় ব্যাপার নয়।

৬.

গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে বিতর্ক তুলেছেন মূলত প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রনেতাবৃন্দ। লক্ষ্য করবার যে, মঞ্চে সংশ্লিষ্ট ছিল বহুদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন; পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ছিল নানা অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা যারা ঠিক প্রচলিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী নন। ঘটনাপরম্পরায় সংগঠনবিহীন অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা ছিলেন মঞ্চের কেন্দ্রে; আর পুরনো ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছিলেন প্রান্তে।

ইতোপূর্বে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা আন্দোলন করেছেন মাঠে-ময়দানে; আর অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা ছিলেন নেপথ্যে, অনেকটা বাঙ্কারে থেকে যুদ্ধ করার মতো। বাঙ্কারের যোদ্ধারা, যারা মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করছেন তাদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছেন। বাঙ্কারের সুবিধা হচ্ছে, এখানে বসে যুদ্ধ করলে অনেকটা নিরাপদে করা যায়, কারণ যোদ্ধাকে সবাই ঠিক চিনতে পারেন না। যোদ্ধা যখন বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করতে শুরু করে তখন তার পরিচয় জনসমক্ষে নিশ্চিত হয়। তবে তাতে তার গুলি খাওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে।

গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে অনেক অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট তাদের বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। এতে তারা যেমন পরিচিত হয়ে উঠেছেন তেমনি তাদেরকে আক্রমণ করাও হয়েছে সহজ। গণমাধ্যমের সুবাদে গত এক বছরে ডা. ইমরানসহ তার সহযোগী আরও কিছু ব্লগার যেভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত হয়েছেন– তার পাশাপাশি দেশব্যাপী বিশাল ছাত্র সংগঠনের দীর্ঘদিন আন্দোলন করা সব প্রধান তরুণ নেতারা অনেকটা ম্লান হয়ে গেছেন।

একটি অসংগঠিত মঞ্চের হঠাৎ নেতার সঙ্গে এই মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু পুরনো সংগঠনের পুরনো নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তারপরও একটা পারষ্পরিক বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে তারা এতদিন চলেছেন। কিন্তু সেই বোঝাপড়ায় ধস নেমেছে বলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলত সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন এবং কিছু বাম ছাত্র সংগঠনের নেতা, যারা অধিকাংশ সরকারের বৃহত্তর জোটে আছেন তারাই গণজাগরণের ব্যাপারে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।

বলাবাহুল্য, একটা দলীয় কাঠামো এবং দায়বদ্ধতার ভেতর ছাত্র সংগঠনগুলোকে চলতে হয়। ঠিক সে ধরনের দলীয় কোনো দায়বদ্ধতা গণজাগরণ মঞ্চের নেই। গত বছর একটা গণজোয়ারের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন তাদের নিজস্ব এজেন্ডা সাময়িক স্থগিত রেখে মঞ্চের অধীনে একটা বৃহত্তর এজেন্ডায় সামিল হয়েছিল। কিন্তু এ বছরের নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মঞ্চের নির্দলীয় এজেন্ডা এবং ছাত্র সংগঠনের দলীয় এজেন্ডাকে এক কাতারে রাখা জটিল।

দেখা যাচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র এমন দাবি এবং বক্তব্য নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন যা অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন পরিস্থিতিতে সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ায় ধস নামাটা বোধগম্য। এমন একটা পরিস্থিতিতেই সংগঠিত ছাত্রনেতৃবৃন্দ যারা এতদিন মঞ্চের প্রান্তে ছিলেন তারা মঞ্চের ইমেজ নির্মাণের পেছনে তাদের দখলদারিত্বের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং এই মঞ্চের কেন্দ্রে থাকা মুখপাত্র– তাদেরই সৃষ্টি একটি চরিত্র– যে ফ্রাঙ্কেনষ্টাইনের মতো তাদের অবাধ্য হয়ে উঠেছে, এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

এই বিতর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবশ্য এতদিন গণমাধ্যমের উপেক্ষার শিকার ছাত্রনেতৃবৃন্দকে আমরা গণমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে আসতে দেখতে পেয়েছি।

৭.

তবে এ-ও স্মরণ রাখা দরকার যে, মূলত কিছু ছাত্রনেতা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও বিরোধিতাটা শুধু ছাত্রনেতাদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের ভেতরেও রয়েছে নানা বিরোধ। গণজাগরণের বিরুদ্ধ পক্ষের অনেক সাইবার অ্যাকটিভিস্ট তাদের ভেতর সক্রিয় আছেন দীর্ঘদিন ধরেই। সে সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষের শক্তির ভেতরও রয়েছে পরষ্পরের প্রতি বৈরিতা, সন্দেহ।

অনলাইন জগতের খোঁজ-খবর যারা রাখেন তারা অবগত আছেন সে সাইবার জগতে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর পারষ্পরিক তীব্র, তীক্ষ্ণ বিরোধিতার রেওয়াজ বেশ চালু। ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বয়স খুব বেশি নয়। মানবজাতির জন্যই এটি এক নতুন ধরনের যোগাযোগের অভিজ্ঞতা। ফলে সাইবার পরিসরে যথার্থ আচরণবিধি নিয়ে এখনও নানা বিতর্ক রয়ে গেছে। সাইবার স্পেসের অসাধারণ, মেধাবী ব্যবহার হলেও পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য দেশের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফেসবুক ইত্যাদিতে প্রবলভাবে সক্রিয়দের অনেকের ভেতর এক ধরনের 'নার্সিসিজম' কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সাইবার পরিসরে আত্মপ্রেম, আত্মপ্রচার, ঔদ্ধত্য এবং মনোযোগ আর্কষণের দুর্মর আকাঙ্ক্ষার একটা প্রতিযোগিতা দেখা যায়।

আমাদের দেশে সাইবার স্পেস ব্যবহার আরও নিয়ন্ত্রণহীন, রয়েছে মডারেশনের অভাব। ফলে সাইবার পরিসরের পারস্পরিক বিরোধিতা অনেক ক্ষেত্রেই এক নগ্ন অনলাইন ঝগড়ায় পর্যবেসিত হয়। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো সাইবার পরিসরের সক্রিয় মানুষেরা জাতীয় পরিসরে পরিচিত হয়ে উঠেছেন, পরিচিত হয়েছেন তাদের মেধা, দক্ষতার জোরেই– কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন রীতিমতো সেলিব্রিটি।

তবে তাতে যে তাদের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিলিয়ে গেছে তা হয়তো নয়। গণজোয়ারের তোড়ে সাইবার যোদ্ধাদের পারস্পরিক বৈরিতার রাশ টানা ছিল দীর্ঘদিন। এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে সাইবার পরিসরের পারস্পরিক দ্বন্দ্বও যদি অচিরে অন্তরাল থেকে প্রকাশ্য হয়ে ওঠে তাহলে সেটাও খুব অবাক করা কোনো ব্যাপার হবে না।

দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের স্তর এবার উপনীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই বিভিন্ন শক্তির পারষ্পরিক অগ্নিপরীক্ষার স্তরে। তবে এটুকু জানি যে, একটা সমাজের পরিবর্তন কখনও সরল পথে ঘটে না, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তাকে এগোতে হয়। ফলে এই ক্রান্তিকে একটা জনগোষ্ঠীর বিকাশের অনিবার্য একটা ধাপ হিসেবেই দেখতে চাই।

৮.

গণজাগরণ মঞ্চ ঘিরে সাময়িক যত বিতর্কই উঠুক না কেন, এ ঘটনা স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করি। সে সঙ্গে স্মরণ করি, শাহবাগের গণজাগরণের মাধ্যমে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে তারুণ্যদীপ্ত একটা নতুন রাজনীতির প্রত্যাশাও প্রতিফলিত হয়েছিল। আমাদের বহু চেনা ডান এবং বামদলগুলোর বাইরে শাহবাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটা নতুন তরুণ রাজনৈতিক শক্তির সম্ভাবনা সেখানে সুপ্ত ছিল।

বলাবাহুল্য, সেখানে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি হয়ে যে তরুণরা উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের পক্ষে পুরনো সংগঠনিক কাঠামোর ভেতর থেকে নতুন ও সৃষ্টিশীল রাজনীতির জন্ম দেওয়া দুরুহ। আমরা দীর্ঘদিন যে নতুন রাজনৈতিক সংষ্কৃতির কথা বলছি, তার সূত্রপাত গণজাগরণ মঞ্চের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া এখনও অসংগঠিত দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে ঘটতে পারে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক সংগঠনের অভিজ্ঞতাহীনতা এইসব তরুণ-তরুণীর দুর্বলতার দিক, কিন্তু সেটাই আবার তাদের বড় শক্তির জায়গাও হয়ে উঠতে পারে।

প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ঝোলাতে যেমন অর্জন আছে তেমনি আছে বহু গ্লানিও। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঝোলা এখনও তুলনামুলকভাবে খালি। তারা তাদের সেই খালি ঝোলায় অর্জনের পাল্লা ভারি করতে পারেন। কিন্তু সেজন্য তাদের আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক পরিকল্পনা নিয়ে গণমানুষের আরও কাছাকাছি যেতে হবে, তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। যে জন্য প্রয়োজন সীমাহীন সততা, আত্মত্যাগ। পেশিশক্তি, অর্থশক্তি নয়, সাইলেন্ট মেজরিটির আস্থাই কেবল হতে পারে তাদের শক্তির উৎস।

সে ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ চত্বরের কাঠামোর বাইরে আসতে হবে। তাদের তখন নিঃসন্দেহে মোকাবেলা করতে হবে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী সব দলের সঙ্গে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে।

লক্ষণীয়, গণজাগরণ মঞ্চের যে প্রধান দাবি, সেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াটি বহু আপোস, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারই সূচনা করেছে এবং আন্দোলনের সময় যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের ভয়ংকর আক্রমণের হাত থেকে গণজাগরণ মঞ্চকে নিরাপত্তা দিয়েছে তারাই। এই মুহূর্তে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িত হলে তা ওত পেতে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে চাঙা হবার সুযোগ করে দেবে বলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন।

আবার গণজাগরণ মঞ্চের যে দাবি তা বর্তমান সরকারি কাঠামোর ভেতর অর্জন সম্ভব কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের। ফলে এই জটিল প্রেক্ষাপটে গণজাগরণ মঞ্চকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তা দাবি করবে সতর্ক পদক্ষেপের। মঞ্চের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তরুণ প্রজন্ম একটা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে কিনা তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারে।

৯.

আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্বব্যাপী সংগঠনবিহীন গণজাগরণের সাম্প্রতিক উদাহরণ তাহরির স্কোয়ার, হাবিব বারগুইবা স্কোয়ার, পার্ল স্কোয়ার, টাকসিম স্কোয়ারের পথ ধরেই শাহবাগ ষ্কোয়ার ঘটলেও এর কোনোটির সূত্রপাত এবং পরিণতি এক নয়। প্রতিটি গণজাগরণকে তাদের নিজম্ব প্রেক্ষাপটে তার অর্জন ও ব্যর্থতার বিবেচনা করতে হবে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের একটা ছবি হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো শাহবাগ চত্বরে ফুটে উঠেছিল। ছবিটি আবছা, যেমন থাকে ফিল্মের নেগেটিভে। নানা প্রক্রিয়ায় সেই অস্পষ্ট ছবি স্পষ্ট করে তুলতে হয়।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন 'একটি পৃথিবী নষ্ট হয়েছে আমাদের আগে/ আরেকটি পৃথিবী তৈরি হতে লাগে, সকালের আকাশের মতো বয়স।' এখন যাদের সকালের আকাশের মতো বয়স– নানা মেরুকরণের মাধ্যমে ত্যাগী, নিষ্কলুষ একদল তারুণ-তরুণীই শাহবাগে জেগে ওঠা আগামী বাংলাদশের ছবিটা ষ্পষ্ট করবেন বলে বিশ্বাস করি।