নববর্ষ দেশে বিদেশে, আনন্দ ও উৎসবের শুভদিন

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 14 April 2014, 00:56 AM
Updated : 14 April 2014, 00:56 AM

শুভ হোক নববর্ষ ১৪২১ সাল। শুভ নববর্ষের প্রথম প্রহর থেকে বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় আনন্দ উৎসবের মহা-আয়োজন। পরষ্পরের মঙ্গল কামনায় শুরু হয় বার্তা-বিনিময়। বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটদেরকে করে আশীর্বাদ।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির মহাবিপ্লবের মহাসুযোগে নববর্ষের প্রথম প্রহরে প্রায় প্রত্যেকটি মোবাইল ফোন দারুণভাবে সরব হয়ে উঠে, প্রতি ঘরে ঘরে। চলে শুভেচ্ছা বিনিময়, যাতে আছে নানান বৈচিত্র্য, ভাষাপ্রয়োগে নতুনত্ব, লেখার মাধুর্য, আবেগ ও অনুভূতির ব্যাপকতা। ভালোবাসার পাত্র হলে নববর্ষে কথা ও লেখার গতিপ্রকৃতি হয় বৈচিত্র্যময়, রোমাঞ্চে একেবারে ভরপুর, প্রিয়তমার ছবি ভাসে হৃদয়-মন্দিরে। নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের মহাউৎসব, আনন্দঘন জীবনের মহালগ্ন। সকলের শুভদিন, শুভক্ষণ।

মোগল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন, ১৫৮৬ সালের ১৬ মার্চ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু হয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের শুভদিনকে পয়লা বৈশাখ ধরে বিবেচনা করে বাংলা সনের গণনা করা হয়। মজার কথা হচ্ছে, বৈশাখের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় গ্রামে গ্রামে মেলার আয়োজন। গৃহিণী ও নববধূদের কেনাকাটার ধুম, এক মেলা থেকে অন্য মেলায় ঘোরাফেরা– সে কী মহাআনন্দ– কত কথা বলে জনে জনে, কানে কানে।

নববর্ষের সঙ্গে বাংলার গ্রামীণ শিল্প ও সংস্কৃতির প্রদর্শনী হচ্ছে বড় প্রাপ্তি। তবে এসব মেলা ঘিরে বাংলার জনপদে শুরু হয় মহামিলনের এক অপূর্ব সুযোগ। নববর্ষ বাংলার অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের অংশ, ঐতিহাসিক মিলনমেলার মহাযজ্ঞ।

ষাটের দশকে আইয়ুব খান-মেনায়েম খান বাংলার এ সংস্কৃতি ধ্বংস করার লক্ষ্যে যখন নিজেরাই রবীন্দ্র সঙ্গীত লেখার ভাবনায় বিভোর, তখনই রমনার বটমূলে শুরু হয় 'ছায়ানট' আয়োজিত "এসো হে বৈশাখ"-এর মহাগণসঙ্গীত, যা পরোক্ষভাবে ছিল বাঙালি জাতিসত্তার পুনরুত্থান এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রথম বার্তা, স্বাধিকারের সূত্রপাত।

বাংলার নববর্ষ বাংলাদেশিদের রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন দিগন্ত করেছে উন্মোচন; স্বাধীনতার চেতনায় এবং অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশ বিনির্মাণে দিয়েছে নতুন ভাবনা। তাই নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়, এ হচ্ছে বাংলার গণজাগরণের এক মহালগ্ন। পয়লা বৈশাখ আমাদের ইতিহাস, মহামিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ।

বাংলাদেশের অনুরূপ, নববর্ষ পৃথিবীর সকল দেশেই বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়, দেশীয় সংস্কৃতি, জনগণের অনুভূতি, আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সকলের প্রত্যাশা থাকে, নতুন বছরে অতীতের সকল গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে শুরু হোক চলার পথ, সৌভাগ্যের রাজটীকা শোভিত হোক ললাটে, বিষাদ ও বিড়ম্বনার হোক অবসান। বাংলাদেশেও আমরা বৈশাখের প্রথম দিন (এপ্রিল ১৪/১৫) কে নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করি, নানান অনুষ্ঠান, সঙ্গীত, নাচগান ও মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে। অবশ্য চৈত্র সংক্রান্তিতে ভূত ও অপদেবতা তাড়ানোর সংস্কৃতি আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে।

বাংলাদেশে যখন নববর্ষ উৎযাপিত হয়, প্রায় একই সময় ভারতের কয়েকটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ছাড়াও মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ক্যাম্বোডিয়া, নেপাল, থাইল্যাল্ডে উৎযাপিত হয় নববর্ষ। চাকমাদের বিষুর দিনটি থাকে নাচে-গানে ভরপুর। নববর্ষে বাঙালির হালখাতা, শুভমহরত, অকাতরে মিষ্টি বিতরণ এবং আকারে-ইঙ্গিতে শুভবিবাহের প্রস্তাব, কন্যাদেখা, হবু বরের প্রতি সুন্দরী কন্যার আড়চোখে দেখা, ঠোটের কোণে মিষ্টি হাসি– কোনোটাই বাদ যায় না নববর্ষের প্রথম দিনে।

মিয়ানমার, থাইল্যাণ্ড এবং গণচীনের মানুষ নববর্ষে একে অন্যের গায়ে পানি ছুঁড়ে মারে। এভাবে পানিতে ভিজে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আত্মশুদ্ধির অভিযান। চীনে জনগণ নববর্ষে ড্রাগন ও সিংহের প্রতীক নিয়ে নাচ-গান করে। ড্রাগন হচ্ছে দীর্ঘায়ু ও সম্পদের প্রতীক, সিংহ হচ্ছে বীরত্বের। চীন বা থাইল্যাণ্ডে জানুয়ারির প্রথম দিনকে নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে বিবেচনা করে না, তাদের বছর শুরু হয় আমাদের বৈশাখের কাছাকাছি সময়ে।

তবে নববর্ষ নিয়ে নানান সংস্কার প্রচলিত আছে পৃথিবীর দেশে দেশে। ইংল্যাণ্ডের অধিবাসীরা মনে করে বছরের প্রথম দিনে যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে তার যদি লাল চুল হয় এবং সে যদি অসুন্দর মহিলা হয়, তবে বছরটি হবে অবশ্যই দুর্ভাগ্যের। কালো চুলের অধিকারী, রুটি, টাকা অথবা হাতে লবণ নিয়ে আসা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম দেখা হলে বুঝতে হবে বছরটি হবে আনন্দঘন, বেদনার হবে অবসান।

ইংল্যাণ্ডের ছেলেমেয়েরা নববর্ষে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিবেশিদের বাড়িতে গান গাইতে গাইতে যাবে। প্রতিবেশিরা তাদের হাতে দিবে আপেল, মুখে দিবে মিষ্টি, পকেটে ভরে দিবে পাউণ্ডের চকচকে মুদ্রা। মজার ব্যাপার হল, অনেক মেয়ে সকালের প্রথম প্রহরে ডিমের সাদা অংশ ছেড়ে দিবে পানিতে, সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে বলে। লণ্ডনবাসীরা ট্রাফালগার স্কয়ারে অথবা পিকাডেলি সার্কাসে জড়ো হয়ে বিগবেনের ঘণ্টাধ্বনি শুনে, স্বাগত জানায় নববর্ষকে, প্রার্থনা করে গ্রেট ব্রিটেনের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। তবে সেটা বৈশাখ নয়, ইংরেজি নববর্ষ।

জাপানিরাও জানুয়ারির প্রথম দিনকেই নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করে। সকল দোকানপাট, কলকারখানা ও অফিস বন্ধ রাখে এবং পরিবারের সকল লোকদের নিয়ে প্রচুর খানাপিনার মাঝে দিনটিকে করে আনন্দঘন। এ উদযাপনের মধ্যে আছে লোকসংস্কৃতির আমেজ। ওরা খড়কুটো দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের সামনে ঝুলিয়ে দেয়, ভূত-প্রেত ও শয়তানদের এ গৃহে প্রবেশ বন্ধ হবে বলে।

নববর্ষকে জাপানিরা বলে 'উষাগাটসু'। সিণ্টো ধর্মের অনুসারীরা বছরের প্রথম দিনে প্রার্থনা করে সুখ ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশায়। নতুন বছরের ঘণ্টা বাজলে অনেক জাপানি শুধু শুধু হাসতে শুরু করে, মনে করে বছরটি হবে হাসিখুশি ও আনন্দময়।

কোরিয়ার জনগণ নতুন বছরকে বলে 'সোল-নাল'। নতুন বছরে ঘরের সামনে খড়ের সেচনী, ঝাঁঝরি বা চালনি ঝুলিয়ে দিবে ওরা। নতুন কাপড় পরে ছোটরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করবে, তারা আশীর্বাদ করবেন। সবাই মিলে 'টুক্কুক' নামক সুপ খাবে, চাউলের পিঠা দিয়ে। তাদের বিশ্বাস, সুপ খেলে বয়স বাড়ে। অনেকেই বয়সের হিসেব করে নববর্ষ থেকে, জন্মতারিখ ধরে নয়।

আমেরিকাতে আতশবাজি ও নাচ-গানের মাঝে নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে নববর্ষকে স্বাগত জানায় উৎফুল্ল জনতা। গাড়িতে হর্ন বাজায়, বন্দরে জাহাজের সাইরেন বাজে মহাসমুদ্রে নাবিকদের যাত্রা হবে বলে। দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে মধ্যরাতে নববর্ষের প্রথম প্রহরে বাড়ির জানালা দিয়ে ঘরের নোংরা পানি বাইরে ছুঁড়ে মারে, যেন গত বছরের সকল অশুভ শক্তি বহিষ্কৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ''ক্ষমা কর আজিকার মতো, পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।''

পর্তুগিজেরা বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বারোটি আঙুর খাবে। তাদের আশা, আগামী বারো মাস যেন খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে সৌভাগ্যের সঙ্গে গান গেয়ে কাটাতে পারে। বলিভিয়াতে বাড়ির আঙিনায় কাঠের পুতুল সাজিয়ে ঝুলিয়ে রাখে, যেন বছরটি ভালোভাবে কাটে।

নতুন বছর ১৪২১ হোক শান্তি, প্রগতি ও সম্প্রীতির বছর, এ হচ্ছে বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রত্যাশা। গত বছর অনেক বিড়ম্বনার মাঝে কেটেছে। "জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক" এই অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে নতুনের বিজয় কেতন উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে দেখা দিবে সমগ্র জনগণের জীবনে। সমৃদ্ধির ক্ষেত্র হবে প্রসারিত, নতুন প্রজন্ম পাবে শান্তির শুভ বার্তা, সমগ্র জাতি ও গোষ্ঠী হবে ঐক্যবদ্ধ, লক্ষ্য হবে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা।

নববর্ষের প্রথম প্রহরে এই হচ্ছে আমাদের সকলের প্রত্যাশা। নতুন নতুন কর্মকাণ্ডে গণমানুষের জীবন হোক রোমাঞ্চময়। আনন্দে কাটুক জীবন; সুখ ও সমৃদ্ধি হোক চিরসাথী; হিংসা ও প্রতিহিংসার হোক অবসান।

শুভ নববর্ষ, শুভ হোক যাত্রাপথ।

ধীরাজ কুমার নাথ: প্রাক্তন সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।