দুর্নীতি যখন মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ক্রেস্টে

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 13 April 2014, 06:42 AM
Updated : 13 April 2014, 06:42 AM

মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিদেশি ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা জানানোর যে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার, তা নিয়ে বিএনপি নেত্রী ছাড়া কেউ বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে মনে হয় না। তার মন্তব্য হালকাভাবে নেওয়া যায় না অবশ্য। কমবেশি দেশের অর্ধেক মানুষ রয়েছে তার পক্ষে। খালেদা জিয়ার উল্টোপাল্টা মন্তব্য বা ভূমিকার জন্য তার জনসমর্থন কমছে বলেও মনে হয় না।

একাত্তরে বন্ধুর ভূমিকার অবতীর্ণ বিদেশিদের সম্মাননা জানানোর সময় দেওয়া ক্রেস্টে সোনা-রূপার বদলে ভেজাল দেওয়ার ঘটনায় কিন্তু সরকারের সমালোচনা হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার জনসমর্থনও কমতে পারে। ক্রেস্টগুলো খোদ সরকার বানায়নি, প্রশাসনও নয়। তবে কাদের দিয়ে বানানো হবে, সেটি স্থির করেছেন তারাই আর ক্রেস্ট বুঝে নিয়ে বিলও পরিশোধ করেছেন।

সব ক্রেস্ট নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি; তবে এর সিংহভাগ নিয়ে উঠেছে। যে প্রতিষ্ঠান এগুলো সরবরাহ করেছে– দেখা গেল, তারা স্বীকৃত উপায়ে কাজ পাননি এবং অভিযোগের গ্রহণযোগ্য জবাবও দিতে পারছেন না।

একটি বাংলা দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার অবশ্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। জনপ্রশাসনের যারা ওই ক্রেস্ট সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের ক'জনকে সাসপেন্ড করে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, এমন একটি বিষয়েও যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা হবে না।

জাতীয় সংসদে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনিক তদন্তে এ ক্ষেত্রে সত্য উদ্ঘাটন হবে কিনা। প্রস্তাব করা হয়েছে, ক্রেস্ট জালিয়াতি নিয়ে সংসদীয় তদন্তের ব্যবস্থা হোক। সরকার চাইলে প্রশাসনিক তদন্তেও সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। আর না চাইলে সংসদীয় তদন্তেও সেটি হবে না। সরকারের হাত এত লম্বা যে, চাইলে সব তদন্তই তারা প্রভাবিত বা বিপথে পরিচালনা করতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য দেওয়া সম্মাননার ক্রেস্টে কী ধরনের দু'নম্বরি হয়েছে, তার বিবরণ আশা করি পাঠকরা এর মধ্যে পেয়ে গেছেন। সরকারি সংস্থায় সম্পাদিত পরীক্ষাতেই ধরা পড়েছে এটি। বড় আয়োজন করে যাঁদের ওইসব ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকে প্রয়াত। কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা এমন খবর পেলে আহত হবেন বৈকি। অপমানিতও বোধ করতে পারেন। সহজ যোগাযোগের এ যুগে তাঁদের অন্তত একাংশে এ খবর গিয়ে পৌঁছবে, এটি ধরে নিয়েই আলোচনা করা ভালো।

পদক বা ক্রেস্টে সোনা-রূপা কম দিয়ে দুর্নীতির ঘটনা দেশে নতুন নয়। এ প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশিদের সম্মাননা জানানোর প্রক্রিয়ায় তেমনটি ঘটবে না, এটি ধরে নিয়ে বসে থাকার সুযোগ কি ছিল? নাকি সরকার এ বিষয়ে কিছুই ভাবেনি? একদম উদাসীন ছিল? আর এ সুযোগেই যা করার করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও আমলারা?

ক্রয়-প্রক্রিয়ায় থাকা আমলাদের সহায়তা ছাড়া এমনতরো দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, এর দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা নিয়ে সংঘটিত দুর্নীতি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে জাতির মর্যাদা সরাসরি জড়িত।

এক কলামিস্ট এর মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, এ জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা লাভকারীর তালিকা বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছিল? এমন প্রশ্ন এ নিবন্ধে তোলা হচ্ছে না। তবে এটা বলতেই হবে, বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলে তার সঙ্গে আরও অনেকে ওই প্রশ্ন তুলবেন।

অনেক বেশি ব্যক্তি ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। একজনকেও যদি এটি দেওয়া হয় আর তাঁকে দেওয়া ক্রেস্টে জালিয়াতি ঘটে, সেটিও নিন্দনীয়, ক্ষমার অযোগ্য। যে পর্যায়ের লোকই এতে জড়িত থাকুক, তাকে শাস্তি দিতে হবে। ব্যবসায়ী ও আমলার সঙ্গে কোনো রাজনীতিক জড়িত থাকলে তাকে বাঁচানো যাবে না।

নইলে কিন্তু ওই কথাই উঠবে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে খোদ সরকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে বা সেটিকে অন্তত প্রশ্রয় দিচ্ছে। বলা হবে, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশিদের সম্মাননা জানানোটা আসলে উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ছিল এটি ঘিরে দুর্নীতি করা। বলা হবে, এসব করতেও সরকারের লোকদের বাধছে না।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম. মুজিবুল হক (সম্প্রতি প্রয়াত) এ লেখককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এদেশে দুর্নীতি সব সময়ই ছিল। কিন্তু এখন দুর্নীতি মানে 'আঁটিশুদ্ধ খেয়ে ফেলা'। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আম খাচ্ছ খাও; কিন্তু আঁটিটা রেখ। ভবিষ্যতের লোকজন তাহলে ওটা থেকে আম খেতে পারবে।

তার উক্তি স্মরণ করা হল এটা বলতে যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও দুর্নীতি হলে আর কিছু থাকে না আমাদের। আর কিছু নিয়ে বড় কথা বলা সাজে না। নামতে নামতে নামার আর জায়গা থাকে না।

ক্রেস্ট তৈরিতে যে ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে, তাকে নির্লজ্জ চুরি না বলে আর কিছু বলার উপায় নেই। যারা এটি করেছিল, দুঃসাহসজনিত কারণেই হয়তো-বা ধরে নিয়েছিল– কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না বা ধরা পড়বে না। ভালো যে, সেটি ঘটেনি। আবার মনে হচ্ছে, ধরা না পড়লেই ভালো ছিল। চুরি-চামারি করতে করতে আমরা যে এত নিচে নেমে গেছি, সেটি না জেনে স্বস্তিতে থাকতে পারতাম!

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা ন্যূনতম ধারণ করেন, তাদের কেউ এখন এ নিয়ে স্বস্তিবোধ করবেন না। দুর্ভাগা এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি গোষ্ঠী রয়েছে। তারা মোটেও দুর্বল নয়। মুক্তিযুদ্ধে সম্মাননা জানানোর ক্রেস্ট নিয়ে ভয়ানক জালিয়াতির ঘটনায় তারা কিন্তু খুব আনন্দ পাবে। দাঁত দেখিয়ে হাসলেও হাসতে পারে।

এর মধ্যে 'গণজাগরণ মঞ্চ' সংশ্লিষ্টরা নিজেরা যেভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তাতেও এরা আনন্দ পাচ্ছে। একটি বিশেষ সময়ে যারা নিছক প্রাণের আবেগে ওখানে গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন, তারা কেমন বোধ করছেন এখন? দুর্ভাগ্য যে, কোনো কিছুকেই আমরা বিতর্কমুক্ত রাখতে পারছি না। দায়িত্ববোধ জাগ্রত রাখা আর সতর্ক হয়ে পথ চলার বিষয়েও বড় উদাসীন আমরা!

সরকারের কি উচিত ছিল না এ সর্বগ্রাসী দুর্নীতির দেশে শত শত মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ক্রেস্ট বানানো ও তা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে একশভাগেরও বেশি সতর্ক থাকা? দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তারা পেন্ডিং এ কাজ করলেন। সেজন্য তো আমরা তাদের প্রশংসাই করেছি। কিন্তু এখন দাবি করছি নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি। সংবিধানে বাধা আছে বলে 'লাঞ্ছনাকর শাস্তি' তো আর দেওয়া যাবে না। আইনানুগ শাস্তির দাবিই জানাচ্ছি।

ভালো যে, সরকারের ভেতর থেকে কেউ বলেননি– এটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের চক্রান্ত! চুক্তিমতো সোনা-রূপা না দিয়ে ক্রেস্ট বানিয়ে সরকারকে যারা গছিয়ে দিয়েছে, দেশের প্রচলিত বিভাজনে তারা হয়তো 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি'রই অন্তর্ভুক্ত। যেসব আমলা এতে জড়িত, 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' লোক বলেই হয়তো তারা ওখানে পোস্টিং পেয়েছিলেন।
পক্ষ-বিপক্ষের এমন বিভাজনে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি আড়াল হয়ে যায়। আড়াল হয়ে যায় অপশাসন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ করলে দুর্নীতিটা সুনীতি হয়ে যাবে কেন? অপশাসনও হয়ে উঠবে কেন সুশাসন? এর বিপরীতটি বলা হতে থাকলে 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি' নিয়েই কিন্তু প্রশ্ন উঠবে। বলা হবে, এরা মুক্তিযুদ্ধ ভাঙিয়ে খাচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে অনেক বড় কথা বলি আমরা। সেসবের ভিড়ে মূল কথাটা হারিয়ে যেতেও দেখা যায়। কথাটা হল, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়া হবে আর এতে সুশাসন থাকবে বলেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। রাষ্ট্রের কেনাকাটায় দুর্নীতি বাসা বেঁধে থাকলে বুঝতে হবে, সুশাসনের ন্যূনতম শর্তও এখানে পূরণ হচ্ছে না। আর মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ক্রেস্ট নিয়ে ভয়ানক চুরি হলে?

ভালো খবর যে, প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন সম্পন্ন করেছি আমরা। প্রধানমন্ত্রী আস্থার সঙ্গে বলেছেন, আরও বড় ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজক হতে আমরা প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে তার মনোযোগ আকর্ষণ করে শুধু বলি, টি-টুয়েন্টির একাধিক ম্যাচ চলাকালে রাজধানীর বাইরে দুটি স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটে কী বিপত্তি ঘটেছিল, তার স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া কিন্তু প্রয়োজন।

উপর্যুপরি এসব ঘটনায় ম্যাচ বিঘ্নিত হয়েছে। ওই সময়ে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের মনোযোগ ছিল বাংলাদেশের দিকে। প্রভাবশালী বিদেশি মিডিয়ায় এ নিয়ে খবরও প্রচারিত হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে উঠেছে গাফিলতি ও দুর্নীতির অভিযোগ। ম্যাচ নির্বিঘ্ন রাখতে খোদ আইসিসিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এ ক্ষেত্রে।

ঘটনাটি উল্লেখ করা হল এ জন্য যে, এর সঙ্গেও জাতির মর্যাদা জড়িত। যে কোনো ক্ষেত্রে বাম হাত ঢুকিয়ে দিতে যারা ওঁৎ পেতে থাকে, তাদের মাথায় কিন্তু কোনো কিছুর প্রতি কোনো রকম শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। একাত্তরের শহীদদেরও তারা হয়তো ভাবে নির্বোধ! বোধহয় মনে করে, তারা অকাতরে জীবন দিয়ে সব কিছু থেকে এদের কাঁচা পয়সা বানানোর সুযোগ সৃষ্টি করে গেছেন!

কোনো দেশ বা সমাজই একশভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয়। সেটি লক্ষ্য বলে স্থির করাটা নাকি শুষ্ক আদর্শবাদ। কিন্তু আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ক্রেস্ট বানানো নিয়েও দুর্নীতিতে নেমেছি। ওয়ান-ইলেভেনের পর খুব আলোচনা হয়েছিল 'মাইন্ডলেস করাপশন' নিয়ে। রাষ্ট্র ও সমাজের ভেতর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অর্থবহ প্রতিরোধ না থাকলে, উল্টো একে প্রশ্রয় দেওয়া হলে, ওটা এক সময় 'মাইন্ডলেস' হতে নাকি বাধ্য। এটা তখন মুক্তিযুদ্ধ বা জাতীয় মর্যাদারও ধার ধারে না।

শুধু কথায় নয়, কাজেকর্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলে সরকারের উচিত হবে ক্রেস্ট জালিয়াতির বিষয়টায় 'জিরো টলারেন্স' দেখানো। কী ঘটেছিল, তা পরিষ্কার করে সবাইকে জানানো। মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের কাছেও হয়তো আমাদের দৈন্যের কথাটা স্বীকার করতে হবে। নজিরবিহীন এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার খবরটুকু দেওয়া গেলে অবশ্য তাঁরা আমাদের মার্জনা করবেন।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।