যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ১০ ‘‘মৃত্যুর পর সম্মানের দরকার নেই’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 30 March 2014, 04:51 PM
Updated : 30 March 2014, 04:51 PM

১৯৬৩ সাল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে আমরা রেজাল্টের অপেক্ষায়। আব্বা তখন বুক-বাইন্ডার। চাকরি করতেন ঢাকার বাংলাবাজারে। থাকতেন নোয়াববাড়িতে। আমি ওইসময় বেড়াতে আসি আব্বার কাছে। সঙ্গে ছিলেন দূরসম্পর্কের এক ভাই, তালুকদার মঞ্জনু।

ঢাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন পরিচিত একজনের মুখে শুনি আর্মিতে লোক নেওয়ার সংবাদটি। ''কাল আর্মিতে লোক ভর্তি করব, যাবি তোরা''?

আমরা রাজি হতেই জানিয়ে দেন ঠিকানাটি। ওইদিন সকালেই আমি আর মঞ্জনু রওনা দিই পলাশী ব্যারাকের দিকে। ওখানেই লাইন দিচ্ছিল সবাই। আমরাসহ লাইনে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। এক সুবেদার দেখে দেখে বাছাই করছিলেন। আমাকে না নিয়ে তিনি আগে পিছে অন্যদের নিয়ে নিচ্ছেন। তাদের নজরে পড়তে আমি আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এবারও আমাকে না নিয়ে অন্যদের নেওয়া হল। আমি আগের মতোই আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

তখন সুবেদার বললেন– ''কেন বার বার সামনে আসছ? তুমি বাচ্চা ছেলে, তোমাকে নেওয়া যাবে না''।

আমার খুব রাগ হল। আমি বললাম– ''আপনিও তো আমারই সমান। খাওয়া-দাওয়া করেছেন বলে একটু মোটা হইছেন। কিন্তু আপনার হাইট তো আমার মতোই''।

আমার কথা শুনে তিনি হেসে দিলেন। দূরে বসে ঘটনাটি দেখছিলেন রিক্রুটিং অফিসার। আমাকে ডেকে তিনি বাড়ির ঠিকানা জেনে প্রশ্ন করলেন– ''আর্মিতে কেন ভর্তি হতে চাও''?

উত্তরে বললাম– ''স্যার, মেট্রিক পরীক্ষা দিছি, রেজাল্ট হয় নাই। ওয়েস্ট পাকিস্তান দেখার খুব শখ''।

আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি অর্ডার দিতেই আমার বুকে পড়ল সিল। যোগ দিলাম সিপাহী পদে। আমার আর্মি নম্বর ৬৫৭৮১০৩। প্রথমে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে, পরে ঢাকার সিগন্যালে এবং সবশেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের জিলংয়ে। সেখানে নিই ছয় মাসের আর্মি ট্রেনিং।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় পঁয়ষট্টিতে। ট্রেনিং শেষে তখনই আমাদের কসম খাওয়ানো হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিয়ালকোটে। ভারতীয় আর্মির বিরুদ্ধে ওখানেই আমরা যুদ্ধ করি। পাকিস্তান সোনবাহিনীতে থাকলেও বাঙালিদের তারা উল্টো চোখে দেখত। ব্যারাকের ভেতর বৈষম্য ছিল অনেক। অফিসার পদে অধিকাংশ ছিল ওদের লোক।

সত্তরের নির্বাচনের পর ছুটিতে বাড়ি আসি। দেশের অবস্থা তখন অন্যরকম। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছুটি শেষ। তবুও আব্বা আমাকে যেতে দিলেন না। বললেন– ''দেশের কন্ডিশন খারাপ। তোমার আর যাওয়া লাগবে না''।

আমি আব্বার কথা ফেলতে পারলাম না। বারবার চিঠি আসে, আমাকে বলা হয় রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমি ঢাকাতেই থেকে যাই আব্বার কাছে।

৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন রের্সকোস ময়দানে। খবর পেয়ে ওইদিন সকালের দিকেই চলে আসি সেখানে। পাবলিক লাইব্রেরির পাশ দিয়ে ঢুকে দেখি তিলপরিমাণ জায়গা নেই। তবুও বাঁশের লাঠি হাতে একের পর এক মিছিল আসছিল। সবার মুখে একই কথা, শেখ সাহেব আজ কী বলবেন! তিনি ভাষণ শুরু করতেই সমস্বরে সবাই স্লোগান তুলল।

শেখ সাহেব বললেন– ''সরকারি কর্মচারিদের বলি– আমি যা বলি তা মানতে হবে….। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে….।''

ভাষণ শুনেই মনে হয়েছে দেশটা বুঝি স্বাধীন হয়ে গেল। ওইদিনই বুঝেছিলাম এবার দেশে একটা কিছু হবে।

পাঠক, এতক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খানের মুখে। তাঁর পিতার নাম গোলাম রহমান খান এবং মাতা ছবিলা খাতুন। বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে জাহাঙ্গীর ছিলেন সবার বড়। বাপ-চাচারা সবাই ছিলেন চাকরিজীবী।

মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি তেবাড়িয়া সলিমাবাদ ইসলামী হাই স্কুলে। তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন ওই স্কুল থেকেই। আজও তাঁর মনে পড়ে বাল্যবন্ধু সুরুজ মিয়া, আবদুল কাইয়ুম, সানোয়ার হোসেন, কাসায়েফের কথা। ওই সময়কার একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা শুনি তাঁর জবানিতে–

''এখনকার মতো তখন এত ক্লাব ছিল না। আমাদের ফুটবল ক্লাবটির নাম ছিল তেবাড়িয়া সলিমাবাদ স্পোর্টিং ক্লাব। তখন জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। একদিন বন্ধুরা বলে, আজকে যে গোলে হারাতে পারবে, তাদের খাওয়াতে হবে। কী খাবি তোরা? আলু-ভাত দিলেও খাব, ডাইল-ভাতও খাব। সবাই আমরা রাজি হলাম। আমি যে দলে ছিলাম সে দল সেদিন হারল। তাই সন্ধ্যায় সবাই মিল্লা বাজার করি। পাশেই যমুনা নদী। বড় যমুনার একটা শাখা। নৌকা ভাড়া করে আমরা নদীতে ঘুরলাম। খিচুড়ি আর মাংস রান্না হলো নৌকাতেই। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গিয়ে নদীতে পড়ে যায় সানোয়ার। শীতের রাত্রে তার সারা শরীর ভিজে হয় চুপচুপা। এ নিয়ে আমাদের সে কী হাসাহাসি!''

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামার ঘটনা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ''২৪ মার্চ সারাদিনই নানা গুঞ্জন চলছিল। রাত ১২টার পর গুলির শব্দ পাই। সকালে দেখলাম যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে। আমরা ঢাকায় থাকি ৪ দিন। তারপর পায়ে হেঁটে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নবাবগঞ্জ হয়ে মানিকগঞ্জের ভেতর দিয়ে চলে আসি নাগরপুরে।''

মুক্তিযুদ্ধে কবে গেলেন?

প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, ''এপ্রিলের ২৮ তারিখ হিলি বর্ডার দিয়ে আমরা ওপারে যাই। আমার সঙ্গে ছিল পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। ইপিআর কাদেরের কথা এখনও মনে পড়ে। ভারতে বিএসএফ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। পাকিস্তানি আর্মির পে-বই দেখালে তারা আমাকে বাড়তি কদর করে। তাদের মুখে একবার খবর পেলাম, কলকাতা পার্ক সার্কাসে এসেছেন অসমানী সাহেব। তার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি ২৪ জন ট্রেইনড সৈন্যের তালিকায় আমার নাম তুলে দেন। আমরা তখন ইন্ডিয়ান আর্মির পোশাক পরে তাদের সঙ্গে নানা কাজ করতাম।

আর্মিতে আমি ছিলাম ড্রাইভার। আমাদের কাজ ওদের ড্রাইভারদের সেকেন্ড সিটে বসে থাকা। ওরাই চালাবে। দরকার হলে আমরা কাজ করব। পরের দিন আমরা ইছাপুর অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে গৌহাটি, তারপর শিলচর এবং শেষে আসি ধর্মনগরে। সেখানে গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ট্রেনে ফিরে আসি। এভাবেই চলছিল সময়টা।

একবার শিলচর ক্যান্টেমেন্টে এসে দেখি, আমাদের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেব ছিলেন সেটার দায়িত্বে। আমাদের দেখে তিনি খুশি হলেন। ভারতীয় মেজরের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন আমাদের ২৪ জনের লিস্ট। এরপর থেকে মাস-শেষে আমরা তিনশ টাকা বেতন নিতাম তার কাছ থেকে। ২ নং সেক্টরে আমরা সরাসরি ছিলাম তার সঙ্গে।''

মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের ডান হাতের কনুইয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর তলপেটে। সেদিনের সেই ঘটনাটির কথা শুনি তাঁর ভাষায়–

''আমি তখনও ইন্ডিয়ান ট্রুপসের সঙ্গে। পরিকল্পনা হয় আমাদের এফএফ ও ইন্ডিয়ান রেজিমেন্ট একসঙ্গে মুভ করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট দখলে নেওয়ার। ইন্ডিয়ান আর্মি পাঁচশর মতো; আর এফএফ তারও বেশি।

২৮ নভেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম মেঘালয়ে। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মেঘালয়ে পাহাড়ের এক জায়গায় নামে ইন্ডিয়ান ট্রুপস। ঢালের রাস্তা বেয়ে গাড়ি নিয়ে নামে তারা। একটি গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি। পাকিস্তানি সেনারা ছিল কংস নদীর পশ্চিম পাড়ে। আমরা পূর্বপাড়ে পাহাড়ের ঢালু দিয়ে নেমে আসছি। ওপার থেকে হঠাৎ আমাদের লক্ষ করে গুলি চালানো হয়।

গুলির শব্দ হতেই আমি ব্রেক কষি। আগুনের মতো ফায়ার আসছিল। সবাই তখন গাড়ি থেকে নেমে যায়। সিগন্যালের ওরা ওয়ারলেসের সাহায্যে যোগাযোগ করে। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে কথা বলছিলাম পাশের দুই ইন্ডিয়ান সিপাহীর সঙ্গে। ব্রাশের গুলি প্রথম এসে লাগে আমার ডান হাতের কনুইয়ে। স্টেনগান হাতে নিচে পড়ে যেতেই আরও কয়েকটি গুলি লাগে তলপেটে।

আমি প্রথমে তেমন কিছু টের পাইনি। মনে হল, কেউ যেন আমার হাতে জোরে বাড়ি দিয়েছে। রক্ত পড়ছিল ঝরঝর করে। পাশে ছিল এক ইন্ডিয়ান জেসিও। সে একটা শার্ট দিয়ে আমার হাতটা পেঁচিয়ে দেয়। পেটে যে গুলি লেগেছে তখনও বুঝিনি। আমার সাথের দুজনও গুলিবিদ্ধ হয়। সারা শরীর হিম হয়ে আসছিল। আমাদের তুলে নিতে হেলিকপ্টার কল করা হয়। কিন্তু তার আগেই আমি জ্ঞান হারাই। ১ মাস ৮ দিন জ্ঞান ছিল না। যখন চোখ মেলি তখন আমি ব্যারাকপুর মেডিকেল হাসপাতালে।''

ডান হাতের জখম দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর জানান হাত নিয়ে তাঁর কষ্টের কথাগুলো–

''২০০০ সাল পর্যন্ত হাতে অপারেশন হয়েছে ২৬ বার। ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে ২৬ জনকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানে আমার হাতে স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাতটা ঝুলেছিল কোনো রকমে। মাঝে মাঝেই ব্যথা হয়ে ফুলে যেত। তখন সারারাত বসে বসে কাঁদতাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। কোনো এক সেমিনারে এসেছিলেন তিনি। সেদিনকার ছবি দেখলে আজও সবকিছু মনে পড়ে যায়।''

[নিচের লিংকে রয়েছে ইউটিউবে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর খানের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের ভিডিও:

মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে বলেন–

''দেশের জন্য রক্ত দিছি সেটা আর বলতে চাই না। বিয়াল্লিশ বছরে তো একটা লোক আসল না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার খোঁজ নিতে। আজ তুমি আসলা। আমি তো ছেলেমেয়েরে বলেই দিছি, মরলে যেন কেউ বাসায় না আসে। মরণের পরে মুক্তিযোদ্ধার ওই সম্মান আমার দরকার নাই।''

কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর বলেন–

''এরশাদ সাহেবের সময় প্রথম তালিকা তৈরি হয়। ওই সময়ই উচিত ছিল তালিকা চূড়ান্ত করা।''

তালিকা কেন বাড়ে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন–

''বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সবাই চায় তার দলের মুক্তিযোদ্ধা একটু বেশি হোক। রাজনৈতিক কারণে এ তালিকা বাড়ে। আগে শুনছি ইন্ডিয়ান তালিকা মোতাবেক পঙ্গুসহ মুক্তিযোদ্ধা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো। এখন তো শুনি ৩ লাখের ওপর ভাতা নেয়। বাকিগুলা তাইলে কোথা থেকে আসল? একসময় ৫শ টাকা দিলেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। তবে এর জন্য আমরাই দায়ী। কোনো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফাই না করলে মুক্তিযোদ্ধা বাড়ে কীভাবে? এই তালিকা তাই সিল করে দেওয়া উচিত। তালিকা বাড়লেই কলঙ্ক বাড়বে।''

যেমন দেশ চেয়েছিলেন তা কি পেয়েছেন? এমন প্রশ্নে আনমনা হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর। অতঃপর বলেন–

''ওই দেশ আমরা পাই নাই, বাবা। ভেবেছিলাম দেশটা সোনার বাংলা হবে। শেখ মুজিবকে ওসমানী সাহেব বলেছিলেন, স্যার, মুক্তিযুদ্ধে এতগুলা লোক মরল। ওয়ার ফিল্ডের নিয়ম মেনে আরও কিছু লোককে মারতে চাই। শুনে শেখ সাহেব বলেছিলেন, কারে মারুম, এটা আমার ডান হাত, ওটা আমার বাম হাত। এটা চোর, ওটা ভালো মানুষ। এটা ফেরেশতা তো ওইটা শয়তান। সবই তো আমার। ফলে স্বাধীন দেশে রাজাকার, চোর, বদমাশ সবাই থেকে যায়। পরে বঙ্গবন্ধুকেই ওরা মেরে ফেলল। সোনার বাংলা পরিণত হয় শশ্মানে।''

বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন–

''বিচার তো আরও আগেই হওয়া দরকার ছিল। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শুরুও করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পর দালাল আইন বাতিল হল। জিয়া সাহেব যুদ্ধাপরাধী অনেককেই বিদেশে পাঠালেন, প্রধানমন্ত্রী বানালেন শাহ আজিজকে। পরে তার দলের হাত ধরে রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হন রাজাকার। জিয়াউর রহমান এদের রাজীতিতে এনেছিলেন। এখন এরা তার দলের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছে।''

স্বাধীন দেশে খারাপ-লাগার কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন–

''এখন ইলেকশন করেই সবাই জনগণের কথা ভুলে যায়। যে রাজা হয় তার পকেটেই টাকা যায়। কেউ ইলেকশনে খরচ করল ৩ কোটি টাকা। ক্ষমতায় গিয়ে সে টাকা না তুলে জনগণের কাজ করে না। দুই পয়সারও দেশপ্রেম দেখি না তাদের মধ্যে। যে যায় ক্ষমতায় সেই চুরি করে। এ সব দেখলে খুব খারাপ লাগে।''

কথা উঠে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা নিয়ে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের প্রতি দোয়া করে তিনি বলেন–

''এই গণজাগরণ না হলে এদের বিচার করা যেত না। কাদের মোল্লার ফাঁসিও হত না। তাই যে যাই বলুক, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন আজ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতির কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের মুখে–

''নিজস্ব রাষ্ট্র আর ফ্লাগ পাইছি। খাইয়া থাহি না থাহি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বিদেশি মিশনে আমাদের সৈনিকরা দেশের মুখ উজ্জল করতাছে। গার্মেন্টস সেক্টরের মা-বোনরা দেশের অর্থনীতি বদলাই দিতাছে। এর চেয়ে বেশি ভালোলাগার আর কী হইতে পারে!''

মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনিদের সঙ্গেই আজ মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেনের বন্ধুত্ব। তিনি বলেন–

''তাদের বলেছি ভালোভাবে লেখাপড়া করতে। বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নয়, বরং ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে।''

নানাকে ঘিরে নাতনি ফরিয়া, ফারহা, আদৃতা ও হৃদিতা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। জাহাঙ্গীর তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। কোলে ওঠে ছোট হৃদিতা নানার হাতের জখম দেখে। মলিন মুখে তাতে হাত বুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নানাকে সে প্রশ্ন করে– ''তোমার এখানে কে গুলি করল, নানু? পাকিস্তানিরা? ওদের আমি ধরব, কেন ওরা আমার নানুকে গুলি করল''।

অবুঝ নাতনির কথা শুনে বুক ভরে যায় মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের।


সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর খান।

তিনি ছিলেন: সেনাবাহিনীর একজন সিপাহী, আর্মি নম্বর ৬৫৭৮১০৩।

যুদ্ধ করেছেন: ২ নং সেক্টরে।

যুদ্ধাহত: ২৮ নভেম্বর ১৯৭১, রাতে। হালুয়াঘাট অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর তলপেটে। ২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁর হাতের অপারেশন হয়েছে ২৬ বার। ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে তাঁকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানেই হাতে স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাতটা ঝুলেছিল কোনো রকমে। এখনও মাঝে মাঝে ব্যথা হয়ে ফুলে যায়।

ছবি: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।