চেতনা: মুক্তিযুদ্ধ থেকে শাহবাগ: প্রথম পর্ব

ওমর শেহাব
Published : 5 April 2014, 03:07 PM
Updated : 5 April 2014, 03:07 PM

২০১৩ সাল ক্যালেন্ডার থেকে চলে গেলেও আমি এখনও ২০১৪ সালে ঢুকতে পারিনি। একটু অবসর পেলেই শাহবাগ আন্দোলনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। শুধু মনে পড়ে তাই নয়, একেকবার সেই আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ আমার মাথায় একেক অর্থ নিয়ে ধরা দেয়। আন্দোলনের প্রথম ধাপটি আমরা পার হয়েছি কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধের শাস্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। এখন দ্বিতীয় ধাপটি আরও ব্যাপক ও জটিল।

বিচারপ্রক্রিয়া চালু রাখার পাশাপাশি এখন প্রাতিষ্ঠানিক যুদ্ধাপরাধের ও বিদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশি অপরাধীদের বিচারের খরচ তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে আদায়ের আইনি ও কারিগরি দিকটিও রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ইতিহাসে নতুন ও অনন্য ঘটনা। কাজেই আমাদের কাজটি ঠিকভাবে করার উপর নির্ভর করবে অন্যান্য দেশ এই অভিজ্ঞতা কী করে কাজে লাগাবে। তারা এখন আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাঝে মধ্যে গালে হাত দিয়ে ভাবি, শাহবাগ বলতে আমি কী বুঝি। কোন জিনিসটি আমার মধ্যে শাহবাগের আগে ছিল না, এখন আছে। কোন জিনিসটি শাহবাগ আমার ভিতর থেকে মুছে দিয়েছে। আমাদের পূর্বপুরষেরা যেমন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, আমরা (বিশেষ করে আমার প্রজন্ম) তেমনি বড় হচ্ছি শাহবাগের মধ্য দিয়ে। শাহবাগের যেসব অর্জন আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে দিয়ে যাব সেগুলোই আমার কাছে শাহবাগের চেতনা। এগুলো সেই জিনিস যা শাহবাগ আন্দোলন না হলে আমি বুঝতে পারতাম না কিংবা অনেক সময় লেগে যেত বোঝার জন্য। শাহবাগের চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাঝে কি কোনো যোগাযোগ আছে?

প্রশ্নটি আদৌ ঠিক কিনা আমি জানি না। হয়তো ২০১৪ সালেই আমরা সব বুঝতে পারব না। কিন্তু নিজের ভিতরে সবসময়ই একটি প্রশ্ন খুঁতখুঁত করে; তা হল, আমি নিজে শাহবাগ থেকে কী নিয়েছি? কাজেই এই প্রবন্ধ একেবারেই নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। অন্য কেউ হয়তো এই লেখা অন্যভাবে লিখত, আমি নিজেই হয়তো ২০১৫ সালে লিখব অন্যরকম। আপাতত ২০১৪ সালেই থাকি!

এই লেখার দুটি পর্ব। প্রথম পর্ব হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি যা বুঝি তার একান্ত ব্যক্তিগত পাঠ। এটি হল মূলত শিবের গীত। ধান ভানব পরের পর্বে যেখানে আমি শাহবাগের চেতনা বলতে কী অনুভব করি সেটি বলব। তারপর দেখব তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যোগাযোগ কতটুকু। মনে মনে তার একটি তালিকা এখনই আমি তৈরি করেছি, কিন্তু ভাবলাম পাঠকদের একটু অপেক্ষা করিয়ে রাখলে ক্ষতি কী!

আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী– এই প্রশ্নের উত্তর আমার জন্য এক নিঃশ্বাসে দিয়ে দেওয়া খুব সহজ। আমি আশির দশকের একদম শুরুতে জন্মেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যারা বেড়ে উঠেছেন তারা সবসময়ই নিজেদের প্রশ্ন করেছেন কেন যুদ্ধ হয়েছিল, কেন তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কী হল, কী হওয়ার কথা ছিল, কেন হল না।

কিন্তু আমাদের জন্য চেতনার ব্যাপারটি একদম রেডি করা ছিল পাঠ্যবইয়ে– জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র। এসব আমাদের পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়েছে। পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করার সময় (এখন শুনেছি মুখস্ত আগের চেয়ে কম করতে হয়) অত মাথা ঘামাইনি, কিন্তু অবসরে যখন চিন্তা করেছি তখন এগুলোর অর্থ কিছুটা বুঝার চেষ্টা করেছি। আমার প্রজন্মের সবাই এগুলো নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে। দিনশেষে সবকিছুই সবাই নিজের মতো করে বুঝে নেয়, অনুভব করে নেয় আর তার ভিত্তিতে জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে, এই চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানে, তাহলে আমি এগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দাবি করছি কেন। ভালো প্রশ্ন! উত্তরটি একদম সহজ। ১৯৭২ সালের সংবিধানটি হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা কী বলা আছে চলুন একটু দেখে নিই। মনে রাখতে হবে এটি কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধানও ছিল।

— ''মুজিবনগর, বাংলাদেশ

তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১

যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং

যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং

যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং

যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছায় এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং

যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি-বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং

যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং

বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং

যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং

যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে; এবং

যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;

সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং

এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং

রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমাপ্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং

তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং

বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।

বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।

স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী

বাংলাদেশ গণপরিষদের ক্ষমতা দ্বারা এবং ক্ষমতাবলে যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।''–

কারা এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছিলেন? তাঁরা কাদের প্রতিনিধি ছিলেন? তাঁদের কি আদৌ এটি করার অধিকার ছিল? দেখা যাচ্ছে এঁরা হলেন সেই লোক যাদের এই দেশের মানুষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। দেশের মানুষের হয়েই তাঁদের এই দেশটি চালানোর কথা ছিল।

আমরা তাহলে প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছি। চার মূলনীতি সরাসরি বলা না থাকলেও কি ঘোষণাপত্রে চেতনার কিছু ছিল? "… সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার …" এই কথাগুলো থেকে বোঝা যায় চেতনার একটি ব্যাপার অবশ্যই ছিল। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল।

এই অভাবটা আমরা টের পেতে শুরু করেছিলাম সেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই। তিল তিল করে বেড়ে উঠে এটি এক সময় আমাদের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল আমাদের মায়ের ভাষার উপর আরবি হরফ আর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে সেই ষাটের দশকে রেহমান সোবহান লিখেছিলেন "টু ইকোনমিস অব ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট পাকিস্তান"– এটি ছয় দফাকে দিয়েছিল তাত্ত্বিক ভিত্তি। তারপর ছাত্র আন্দোলনের এগার দফা আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম যে, ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক পরিচয় একটি কৃত্রিম ধারণা।

আমরা যে এটি ঠেকে ঠেকে শিখে ফেলেছি সেটি গোটা দুনিয়া টের পায় যখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুটি বাদে বাকি সব আসন পেয়ে যায়। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সব বাঙালিই ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছিল। এর বাইরেও গুটিকয়েক বাঙালি ছিল যারা অন্য দল করত।

যেমন ধরুন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও এখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযম। গোলাম আযম ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দল, জাতীয় আওয়ামী দল, জমিয়তে উলামা-এ-ইসলাম ও পাকিস্তান জাতীয় লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে গো-হারা হেরেছিল।

আরেক যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ছিল তার নির্বাচনী প্রচারণার একজন সক্রিয় কর্মী (কাদের মোল্লার মামলার শুনানির প্রশ্নোত্তর পর্বে এই তথ্যগুলো বের হয়ে এসেছে)। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক বাঙালি যে জনগণের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করত না সেটি নির্বাচনের ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। এখানে আরও একটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে, বাঙালিরা কিন্তু কখনও-ই নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের চর্চা থেকে বিরত ছিল না।

বিভিন্ন মহলে (অবশ্যই ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে বেশি বেশি করে) সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা উঠলেও মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনও-ই নিজ থেকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে প্রকাশ্যে আগ্রহী ছিলেন না। প্রচুর মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ছাত্রনেতৃত্বের উপর তাদের সেই প্রভাব অব্যাহত ছিল (ইতিহাসের এই অধ্যায় থেকে খালেদা জিয়া গত বছর শিক্ষা নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও চেয়েছিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে, শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে কিন্তু তার জন্য তিনি নিরীহ মানুষের গায়ে পেট্রোল বোমা মেরে আন্দোলন করেননি)।

গণতন্ত্র আর অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র, এই দুটি ব্যাপার কবে থেকে বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠল, সেটি তাহলে আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি। কিন্তু জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা কবে থেকে এল?

আমি কাদের মোল্লার মামলার শুনানির প্রশ্নোত্তর পর্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামার সাক্ষ্য থেকে জানতে পেরেছি, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে মিরপুরের আসন থেকে যিনি নির্বাচন করে গোলাম আযমকে হারিয়ে ছিলেন [৪], তিনি নিজেই ছিলেন একজন উর্দুভাষী। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী থেকে কেউ নির্বাচন করে জিতলে তার উর্দুভাষী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি– ঠিক যেমন চট্টগ্রাম থেকে কেউ নির্বাচন করলে তার চট্টগ্রামের স্থানীয় লোক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ– এটি সহজ বীজগণিত।

এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটি হল, তখন পর্যন্ত এই আন্দোলনকে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবেই ধরা হচ্ছিল। জ্ঞানের স্বল্পতা আর আলসেমির কারণে আমি জানি না সমতলের আদিবাসীরা (যেমন ধরুন গারো, হাজং) এনারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মূলধারার আন্দোলনে তখনও কতটুকু একাত্ম হয়েছিলেন। বাঙালির আত্ননিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের ইতিহাস আর সমতলের আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের ইতিহাস খুব সম্ভবত দুটি পৃথক ধারা।

সমতলের আদিবাসীদের বিখ্যাত টংক আন্দোলনের নেতা কমরেড মণি সিংহ কিন্তু কারাগার থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন [২]। একই ব্যাপার ঘটেছিল পাহাড়ের আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও। তাদের জননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচনে জিতেছিলেন [৩]।

এর অর্থ হল, মূলধারার আন্দোলনে তারা একই ছাদের নিচে থেকে থাকলে (আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে যদি না-ও হয়, সত্তরের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনগুলোতে তাদের মধ্যে কিছু না কিছু যোগাযোগ ছিল), বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরেও আন্দোলনের কিছু ব্যাপ্তি থাকার কথা। সেই মানুষগুলো ১৯৭০ এর নির্বাচন পর্যন্তও ছিলেন ভিন্ন রাজনৈতিক ধারায় এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে সবাই একধারায় মিশে গেলেন।

যেভাবে আমি 'মিশে যাওয়ার' কথা বলে দিলাম আদতে সেটি মোটেই সে রকম সহজ ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের যুদ্ধের সময় একই সমতলে আনতে যে উদারতা আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়, সেটি দুপক্ষ থেকে দেখানো হয়েছিল বলেই সেদিন তা সম্ভব হয়েছিল। আমার খুব ইচ্ছা একটি বই কেউ একজন লিখবেন শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের সময়কার রাজনৈতিক ডিলব্রেকিংগুলো নিয়ে। হয়তো কেউ ইতোমধ্যে লিখেছেন, কিন্তু আমি জানি না। যদি সে রকম বই কখনও পাই তাহলে আমি নিশ্চিত, আমাদের জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের আরও কিছু নতুন গুণের কথা জানব।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সালে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন আর শুধুমাত্র বাঙালিদের (নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কথা বলছি) আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল তখন এই ভূখণ্ডের সবার মুক্তিসংগ্রাম। জাতীয়তার এই ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে উঠে আসেনি, কিন্তু এখানে জনপ্রতিনিধিরা সবসময় 'বাংলাদেশের জনগণ' কথাটি ব্যবহার করেছেন। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ একটি সর্বদলীয় ব্যাপার ছিল, কাজেই সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বাইরেও একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপার ছিল।

কাজেই আমরা যদি এখানে 'বাঙালি' শব্দটি ব্যবহার করি তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, এখানে তার একটি নতুন অর্থ দাঁড় করাতে হবে। সেই অর্থটি কী? বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটি আছে তাতে বসবাসকারী সকল ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় হল সেই নতুন অর্থ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যদি 'বাংলাদেশের জনগণ' কথাটি ব্যবহার না করে 'বাঙালি' ব্যবহার করা হত এবং তারপরও যদি সমতল ও পাহাড়ের ভিন্নভাষী আদিবাসীরা সেই যুদ্ধে যোগ দিতেন, তার মানে হল 'বাঙালি' কথাটি তখন আর নৃতাত্ত্বিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে না, এর রাজনৈতিক অর্থও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘোষণাপত্রে সেটি ছিল না।

এখানে একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। একটি জনগোষ্ঠীকে কী নামে ডাকা হবে সেটি কারা ঠিক করবে? সেটি ঠিক করবে শুধুমাত্র, শুধুমাত্র, শুধুমাত্র সেই জনগোষ্ঠী। আমরা যেমন অন্য ভাষার কিছু রাজনীতিবিদদের পরামর্শে আমাদের মায়ের ভাষা আরবি হরফে লেখা শুরু করতে রাজি হইনি; তেমনি অন্য একটি জনগোষ্ঠীকে কী নামে ডাকা হবে সেটি তারা ঠিক করবে, আমরা নই। গত সরকারের সময় 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' কথাটি প্রচলিত করে পাহাড়ের আদিবাসীদের মন যেভাবে ছোট করে দেওয়া হয়েছে তার জন্য আমাদের কেউ কোনোদিন ক্ষমা করবে না।

আনুষ্ঠানিকভাবে 'জাতীয়তাবাদ' কথাটি আমি পাচ্ছি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদে সৈয়দ নজরুল ইসলামের শোক প্রস্তাবে [১]। এখানে কিছুটা তুলে দিচ্ছি–

"মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনার অনুমতি নিয়ে পরিষদে আমি একটা প্রস্তাব গ্রহণের জন্য পেশ করছি:

ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙালিরা, সাবেক ইপিআর ও পুলিশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ সশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিবনগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল তার সঙ্গে এই গণপরিষদ একাত্মতা প্রকাশ করছে।
স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এই পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এ ক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্ত প্রতীক ও আদর্শ, তথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।"

এই প্রস্তাব কিন্তু ধুম করে পাশ হয়ে যায়নি। গণপরিষদ সদস্য নূরজাহান মুরশেদ, আসহাব-উল হক, সাজেদা চৌধুরী, মহম্মদ আতাউল গণী ওসমানী, মো. ময়েজউদ্দিন এনারা এই প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সেগুলোর সুরাহা করা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ নিয়ে কেউ সেদিন প্রশ্ন তুলেননি। তবে সেদিন বঙ্গবন্ধুর একটি কথা আমি আগের বা পরের কথা ছাড়াই প্রথমে উল্লেখ করতে চাই।

"রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মচারিরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে।"

প্রিয় পাঠক, আপনার কী মনে হচ্ছে? এখানে 'বাঙালি' বলতে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র বাংলাভাষীদের কথা বলেছেন? সেদিনের পুরো কার্যবিবরণী পড়লে কিন্তু তা আর মনে হবে না। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বলা কথা থেকে আরও কিছু তুলে দিই।

"বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।

এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যাঁরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তাঁদের জন্য এই পরিষদ তাঁদের আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে এবং এই পরিষদকে তাঁদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে।

জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ত্রিশ লক্ষ ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসাবে নিশ্চয়ই তাঁদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখব। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়।

রক্ত দিয়েছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এ দেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে এ দেশের জনগণ, রক্ত দিয়েছে সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে ভূতপূর্ব ইপিআর, রক্ত দিয়েছে আনসাররা, মোজাহেদরা। রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মচারিরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খানসেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশুসেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।

তাছাড়া এই দেশের জানা-অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যারা আমাদের এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।

… আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে।

স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যাঁরা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন, গণতন্ত্রকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাঁদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পেছনে কারা ছিলেন।

আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সে জন্য তাঁদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আর যেসব দল আমাকে সমর্থন করেছে তাঁদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।

আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হল সংবিধান তৈরি করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসব। শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়; দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে।"

বঙ্গবন্ধু যখন 'বাঙালি' কথাটি বলেছিলেন তখন যে নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরে একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও তাঁর মাথায় কাজ করেছিল, এটি আমাকে একটি ফেসবুকীয় আলাপচারিতায় প্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক অমি রহমান পিয়াল। গণপরিষদের ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিলের কার্যবিবরণীতে আমি সেটির কিছু ছায়া খুঁজে পেয়েছি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে আমাদের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানটিতে আমাদের এই চার মূলনীতিকে রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই সংবিধান কিন্তু প্রণয়ন করা হয়েছিল জনপ্রতিনিধিদের একটি সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে, ২০৯ দিন ধরে। এর মধ্যে গণপরিষদ সদস্যের বাইরেও যে কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল যার শেষ সময় ছিল ১৯৭২ সালের ৮ মে [৫]। শুধু তাই নয়, যেদিন সংসদে এই সংবিধান উত্থাপন করা হয় তারপরও টানা সাতদিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে এটি প্রকাশ করা হয়েছে যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে তাদের প্রতিনিধিরা কী করছে। সরকারি দল, বিরোধী দল সব দিক থেকেই প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তাদের কাজ ছিল দেশের মানুষের ইচ্ছাটুকু যেন সংবিধানে প্রতিফলিত হয় সেই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা। এর বাইরে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কারিগরি দিকটি দেখেছেন।

সব মিলিয়ে এই সংবিধানটি সম্ভাব্য সকল পরীক্ষার ধাপ পার হয়েই এই রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যখন সংসদে খসড়া দাখিল করে তখন সেটি নিয়ে ১৯ অক্টোবর জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আমি বিশেষভাবে আগ্রহী আওয়ামী লীগের বাইরে সেই সময়কার বিরোধী দলীয় সদস্য বা স্বতন্ত্র সদস্যমদের বক্তব্য জানতে [৫]।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন–

"…বাংলার মানুষ মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে অফুরন্ত আশার প্রতীক এই সংবিধান পেতে যাচ্ছে এবং এই সংবিধানের মাধ্যমে তারা কতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করছে, সেটা এখানে আলোচনা হওয়া দরকার। তাছাড়া কিছু লোক এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যাতে সংবিধান পাস হতে না পারে, সংবিধান যাতে বানচাল হয়ে যায়, মানুষের আইন যাতে এদেশে টিকতে না পারে, সত্যিকার আইনের শাসন যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে।

… কোনো ষড়যন্ত্রে যাতে এই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে না যায়, আমি সে জন্য সজাগ আছি।

…সংবিধান মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে পাস হওয়ার আগে যাতে এদেশের মানুষ আলোচনা করতে পারে, তার জন্য পরিষদের নেতার কাছে আবেদন করছি।"

স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন–

"আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বারা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি আমরা উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোনো অর্থ হয় না। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এ কথা ছিল না, ১৯৬২ সালের সংবিধানেও এ কথা ছিল না।

…যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যাঁরা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে গিয়েছেন।

…আমরা এ সংবিধানকে সুন্দর করে গড়ে তুলি, যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে এই দাবি রেখে যেতে পারি যে, আমরা সুন্দর একটি সংবিধান রচনা করেছি।"

এই চার মূলনীতি কিন্তু কোনো দলের জনপ্রতিনিধির কাছ থেকেই আপত্তির সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু সংবিধানের অন্য একটি জায়গায় একটি মূলনীতি 'জাতীয়তাবাদ'-এর ব্যাখ্যাটি তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছ থেকে। সেদিন ছিল ৩১ অক্টোবর [৬]। এ দিন থেকে সংবিধানের দফাওয়ারী পাঠ শুরু হয়েছিল [৫]। বাংলাদেশের অধিবাসীরা 'বাঙালি' হিসেবে পরিচিত হবেন এই ধারাটিতে ছিল তাঁর আপত্তি (৬ ও ৯ নং ধারা )।

স্পষ্টতই 'বাঙালি' শব্দটির অর্থ বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছে এক ছিল না। প্রথমজন ভেবেছিলেন এর মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় ঠিকঠাক প্রকাশ পায়, কিন্তু দ্বিতীয়জন তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন না। এটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ একই দলের মধ্যেই যেখানে সব ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারেন না, সেখানে দুই দলের দুই সদস্য কোনো বিষয়ে একমত না হতেই পারেন।

এর প্রথাগত উপায় আছে। ক্রমাগত আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের নিজেদের মধ্যে সেই বোঝার দূরত্ব কাটিয়ে উঠে একমত হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের জাতীয় সংসদ তো সে কারণেই তৈরি করা হয়েছে। প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যাদের পাঠাব তারা অধিবেশনের পর অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে যোগাযোগের দূরত্বগুলো যতদূর সম্ভব কাটিয়ে একমত হবেন। সেই অধিবেশনের খরচও করের মাধ্যমে আমরাই দিই।

এই দ্বিমত কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে শত্রুতে পরিণত করেনি। ১৯৭৩ সালেও মানবেন্দ্র নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন [৭]। তারপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন। এমনকি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগ দেন তিনি। এর অর্থ হল, প্রথম মূলনীতি 'জাতীয়তাবাদ' কথাটির অর্থ নিয়ে তাঁর আপত্তি থাকলেও খুব সম্ভবত সেটি নিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ কিংবা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সেই আলোচনা যদি পূর্ণতা পেত তাহলে হয়তো আমরা জাতীয়তাবাদের একটি সংশোধিত রূপ বা অর্থ পেতাম। কিছু একটা নিশ্চয়ই হত যেটি আমাদের আর ভিন্নভাষী আদিবাসীদের রাজনৈতিক পরিচয়কে সমানভাবে ধারণ করতে পারত। কিন্তু তার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হল। একসময় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ক্ষমতায় আরোহণ করলেন জিয়াউর রহমান এবং তিনি জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়াই সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের উপর কাঁচি চালিয়ে দিলেন।

আজকে বেঁচে থাকলে মামলায় হাজিরা দিতে দিতে তার জান শেষ হয়ে যেত (বর্তমান সরকার সব কাজ ঠিকঠাকমতো করলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও একই পরিণতি হওয়ার কথা। এখনও যে সেটি হচ্ছে না তার জন্য আগামী প্রজন্ম আমাদেরকে সবসময় লজ্জা দিয়ে যাবে)।

সামরিক শাসক (টেকনিক্যালি চিন্তা করলে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক যার কোনো ম্যান্ডেট ছিল না) জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে ফরমান জারি করে বলে দেন, বাংলাদেশের জনগণ 'বাংলাদেশি' বলে পরিচিত হবেন। আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মধ্যকার মতদ্বৈধতা যখন দূর হত, এ রকমই কিছু একটা পরিবর্তন সংসদে আসত। তাহলে জিয়াউর রহমানের কাজের সমস্যাটি কোথায়?

সমস্যাটি হল জাতীয়তার এই নতুন বোধটি মানুষের মধ্যে সঞ্চার করতে পারার ব্যর্থতা। জিয়াউর রহমান জনপ্রতিনিধি ছিলেন না, ক্ষমতালিপ্সু একজন জেনারেল ছিলেন যিনি প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে জানার পরেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে কয়েক বছর পর পর নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের মুখোমুখি হতে হত। তাই জনগণের প্রতি দুজনের দায়বদ্ধতা ছিল। এই মিথস্ক্রিয়াতে তাঁরা অন্যান্য সব এজেন্ডার পাশাপাশি জাতীয়তাবোধের নতুন ধারণার তাগিদটুকু জনগণের চিন্তায় ঢুকিয়ে দিতে পারতেন। একসময় মানুষই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দিত তাদের নতুন ধারণার প্রয়োজন আছে কিনা এবং থাকলে সেটি কী।

জিয়াউর রহমান প্রায় ঠিক কাজটি করে ফেললেও এর মধ্যে গণতন্ত্রের ফাঁকিটুকু রয়ে গিয়েছিল। এই পরিবর্তনটি জনগণ যেহেতু তাকে করতে বলেনি, এর বাস্তবায়নে এসে যোগাযোগের দূরত্বটি ঠিকই প্রকাশ পেয়ে গেল। কীভাবে পেল? আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাহাড় ও সমতলের ভিন্নভাষী আদিবাসীদের গণ্য করে কিনা এই সমস্যা ছিল। এখন জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' হয়ে গেল আসলে গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদ।

বেশিরভাগ বাংলাদেশি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের আগে যতটুকু বাংলাদেশি ছিলেন ততটুকু রয়ে গেলেন। কেবল কিছু 'সুযোগসন্ধানী বাংলাদেশি' প্রশাসনের মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও বন দখল শুরু করল। এতদিন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছে তাও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান যখন অন্যান্য জায়গা থেকে সেটলার এনে পাহাড়িদের উপর চাপিয়ে দিলেন এবং নৃতাত্ত্বিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেন, তখন তারা সশস্ত্র সংগ্রামে চলে গেলেন।

২০১০ সালে আদালত রায় দিয়েছেন জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যাটি সংসদ অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিরা ঠিক করবেন, তবে সেখানে বাংলাদেশির পরিচয়, অর্থাৎ একটি সার্বিক রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। কীভাবে মাথায় রাখা হবে সেটি জনপ্রতিনিধিরা তাদের ভোটারদের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে ঠিক করবেন [৮]। অর্থাৎ আমরা আবার বঙ্গবন্ধু ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই অসমাপ্ত বিতর্কে ফেরত গেছি। আশা করি এবার সেটি ঠিকমতো শেষ হবে।

শেষ প্রশ্ন হল ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটি কী করে এল। আমার কাছে সব সময়ই মজা লাগে এটি চিন্তা করে যে বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা একসময় পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য কাজ করেছিলে,ন কিন্তু এত অল্প সময়ে কী করে ম্যাজিকের মতো বুঝে গেলেন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র একটি অযৌক্তিক চিন্তা। শুধুমাত্র একটি ধর্মের ভিত্তিতে কখনও-ই ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কারণ দিনশেষে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ধর্ম চালায় না, ধর্মপালনকারীরা চালায়।

এই ধর্মপালনকারীরা কখনও-ই সব বিষয়ে একমত হতে পারবেন না। এটি থিওরিটিক্যালিই অসম্ভব। কাজেই কোনো একটি বিশ্বাসের প্রধান ধারার অনুসারীদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে উৎসাহী তারা যদি সবার জন্য নিজের বিশ্বাসের ভিত্তিতে নৈতিক ও আইনি মানদণ্ড তৈরি করে দেন তাহলে দেশের বারোটা বাজতে বেশিদিন লাগে না। এর দুটি ভালো উদাহরণ হল পাকিস্তান ও ইজরায়েল। প্রশ্ন হল, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা কী করে এটি বুঝতে পারলেন?

আনুষ্ঠানিকভাবে তো আমরা জানি, আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ধর্মনিরপেক্ষ দল আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছিল। এরপর তাদের জনসমর্থন বেড়েছে বৈ কমেনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আমরা সবাই জানি। সে সময় নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্মচ্যুতি ঘটবে, জামায়াতের এ রকম প্রচারণায় কাজ হয়নি। দেশের মানুষ ঠিকই রায় দিয়েছিল, রাষ্ট্রপরিচালনা আর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা এই দুটি মেশানো ঠিক নয়।

কিন্তু এর মূল সুরটি ধরা পড়ে এই নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনের ছোটখাট ঘটনায়, যেখান থেকে বুঝা যায় একজন ধর্মনিরপেক্ষ ধার্মিক ব্যক্তি কী করে নিজের বিশ্বাস আগের মতো রেখে একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ২৫৮ পৃষ্ঠাকে থেকে একটি অনুচ্ছেদ তুলে দিচ্ছি। এটি ছিল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জেতার পর তাঁর আত্মোপলব্ধি–

"এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে 'ইসলাম ও মুসলমানের নামে' স্লোগান দিয়ে ধোকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না, এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।

মুসলিম লীগ নেতারা এসব বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু প্রোগ্রাম জনগণের সামনে পেশ না করে বলে চলেছে– 'পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে, মুসলিম লীগ পাকিস্তান কায়েম করেছে, তাই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মাতা, পাকিস্তান অর্থ মুসলিম লীগ ইত্যাদি, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য নেতারা রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দুদের দালাল, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা এক করতে চায়'– এ রকম নানা ধরনের স্লোগান দিতে আরম্ভ করেছিল।

জনগণ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জানত যে তিনি পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে জানত, তিনি এদেশের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মওলানা ভাসানীও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আর আমরা যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি তাও জনগণের জানা ছিল, তাই ধোঁকায় কাজ হল না।"

এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের জাতির পিতার ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠশালার পাঠ নেওয়ার দিনগুলোর কথা। যে মানুষটি একসময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের স্বার্থেই পাকিস্তান সৃষ্টি প্রয়োজন– কী করে তিনি কয়েক দশকের মধ্যে একটি নতুন দেশ প্রতিষ্ঠা করলেন যার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা– সেটি একটি চমৎকার গল্প। এই আঙ্গিক থেকে যদি বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি ছোট্ট গল্প আমাদের পাঠ্যবইয়ে দেওয়া যায় তাহলে এক লহমায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব একটি কাজ হয়ে যাবে।

এই হল আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একান্ত ব্যক্তিগত পাঠ। খুবই কষ্টের ব্যাপার হয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এই চেতনার সঙ্গে যখন বিশ্বাসঘাতকতা করেন। কীভাবে করেন? ব্যাপারটিকে বিএনপি একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সেই উদাহরণগুলো দিতে গেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সার্ভারে আর কোনো লেখা রাখা যাবে না। কেবল বিএনপির ওয়েবসাইট থেকে তাদের মতাদর্শের স্ক্রিনশটটি দিয়ে দিই। নিচের দিকে দলের মতাদর্শগুলো পড়ে দেখুন। যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বিএনপি সদস্য লজ্জা পেয়ে যাবেন এবং গত বছর গোটা বার মাসে দলটির যত বড় বড় রাজনৈতিক ভুল তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

তার চেয়ে আমরা আওয়ামী লীগের কিছু উদাহরণ দিই। তাহলে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাকটি বুঝা যাবে। যদিও নির্বাচনের মাঠে দুই বড় দলকেই সমান মাঠে খেলতে হয়– মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী দলটির প্রতি– এমনকি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রত্যাশাও তুলনামূলকভাবে একটু বেশি থাকে। ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে প্রাক-নির্বাচন চুক্তি হয়েছিল যেখানে ব্লাসফেমি আইনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লঙ্ঘন।

কী রকম লঙ্ঘন? এটি হল ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। একইভাবে যখন কালো টাকা সাদা করার বিধান বাজেটে রাখা হয় সেটিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লঙ্ঘন। কেমন করে হল? এটি 'সামাজিক ন্যায়বিচার' কথাটির সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। এমপিরা যখন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের উপর মাতবরি করেন স্থানীয় বাজেট ও উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে, সেটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লঙ্ঘন। কারণ, এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাস নষ্ট হয়।

আর জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে সবচেয়ে হতাশাজনক একটি ব্যাপার ঘটেছে গত সরকারের সময় 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' কথাটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। জিয়াউর রহমান পাহাড়ে রক্ত ঝরিয়ে দেশের যে ক্ষতি করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে এই মানুষগুলোকে কী পরিচয়ে চিহ্নিত করা হবে সেটি বাইরে থেকে আমরা অপমানজনক ভাষায় ঠিক করে দেওয়ায়। আমাদের এই কাজ করার কোনো নৈতিক বা আইনি অধিকার ছিল না, এখনও নেই। আশা করব আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিবে; আর বিএনপি সেগুলো অন্তত বোঝার চেষ্টা শুরু করবে।

আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হল 'কেন বাংলাদেশ চাই' এই প্রশ্নের উত্তর। আর 'কেমন বাংলাদেশ চাই' এই প্রশ্নের উত্তর হল শাহবাগের চেতনা। সেই কথা বলব আগামী লেখায়।

[পরের পর্বে সমাপ্য]

তথ্যসূত্র:

[১] বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব, শুভ কিবরিয়া, সাপ্তাহিক

[২] ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, নেত্রকোণার আলো

[৩] মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা চির অম্লান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, দীপায়ন খীসা, ইউকে বেঙ্গলী

[৪] শহিদুল হক মামার সাক্ষাৎকার, সুব্রত শুভ, মুক্তমনা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৩,

[৫] বাংলাদেশ গণপরিষদ ॥ সংবিধানের আঁতুড়ঘর, আবুল খায়ের,

[৬] মানবেন্দ্র লারমার 'পরিচয়-রাজনীতি', পাভেল পার্থ, দৈনিক সমকাল, ১০ই নভেম্বর, ২০১৩,

[৭] এম এন লারমা : আদিবাসীদের এক অবিসংবাদিত নেতা, শক্তিপদ ত্রিপুরা, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ই নভেম্বর ২০১০,

[৮] Military takeover never again, Julfikar Ali Manik and Ashutosh Sarkar, The Daily Star, July 29, 2010,

ওমর শেহাব: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচ-ডি অধ্যয়নরত, সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।