ইউক্রেন: পশ্চিমা রাজনীতির দাবার ঘুঁটি

শওগাত আলী সাগর
Published : 5 March 2014, 01:22 PM
Updated : 5 March 2014, 01:22 PM

ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়ার সৈন্যসামন্তের প্রস্তুতি দেখেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ''পশ্চিমা শক্তি প্রস্তুত। ইউক্রেনে যে কোনো ধরনের 'সামরিক আগ্রাসনের' দায়ে রাশিয়াকে একঘরে করে দেওয়ার জন্য পশ্চিমারা সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেবে।'' কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি, তার মিত্রদের তৎপরতা কোনো কিছুই রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনকে দমাতে পারেনি। ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমাদের হুমকির মধ্যে রাশিয়ার এই অপারেশনটি হয়েছে রক্তপাতহীন এবং নিতান্তই ছোটখাটো সামরিক অভ্যুত্থানের মতো। কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসের খোঁজখবর যারা রাখেন তারা শঙ্কিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, এই ধরনের ছোটখাটো সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বিশ্ব অনেক বড় বড় সামরিক যুদ্ধের পথে হেঁটে গেছে।

ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সেনাসদস্যদের অবস্থানের খবর পড়তে পড়তে অনেকেরই ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরে ফিরে যাবার কথা। স্থানীয় আফগানিদের ছদ্মাবরণে মাত্র এক হাজার রুশ সৈন্য সেদিন ঢুকে পড়ছিল আফগানিস্তানের কাবুলে। একেবারে বিনা বাধায় তারা সরকারি ভবন এবং প্রধান সামরিক ঘাঁটির দখল নিয়ে ফেলেছিলেন। কোথাও কোনো প্রতিরোধ ছিল না। বরং ছিল সমর্থন আর সহযোগিতার হাত।

ক্রিমিয়ার দৃশ্যটাও কার্যত একই রকমের ছিল। দূরে বসে মার্কিন-কানাডা আর পশ্চিমা শক্তির হুঁশিয়ারি, সতর্কতা থাকলেও ক্রিমিয়ার চিত্রটা ছিল সাড়ে তিন দশক আগের কাবুলের মতো। তাই পশ্চিমের অনেক মিডিয়া ক্রিমিয়ায় রুশ সেনাদের প্রবেশের সঙ্গে ১৯৭৯ সালের কাবুলের ঘটনার তুলনা করছেন।

কাবুলে মাত্র সপ্তাহ তিনেকের ব্যবধানেই রুশ সেনার সংখ্যা স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেটিই পরিণত হয়েছে রক্তাক্ত সামরিক 'জবরদখলে'। একযুগ পরে রুশ সেনারা যখন কাবুল ছেড়ে যায়, ততদিনে উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনেক ঝড় বইয়ে গেছে। সেই ঝড় উপমহাদেশের রাজনীতির চরিত্রটাই অনেক পাল্টে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক এবং সামরিক সহায়তায় আফগানিস্তানে গড়ে ওঠে সশস্ত্র ইসলামি জেহাদি গোষ্ঠী।

রাশিয়া যখন আফগানিস্তান ছেড়ে যায়, ১৫ হাজার সেনাসদস্য হারানোর স্মৃতি তাদের হয়তো তাড়া করেছিল। কিন্তু রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট লড়াইয়ে ইসলামি চরমপন্থীদের নব্বই হাজারেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছে বলে জানা যায়। এক যুগের সামরিক লড়াইয়ে আফগানিস্তানের সাধারণ নিরীহ নাগরিকদের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা তো আছেই।

রুশ সেনাদের ইউক্রেনের ক্রিমিয়া সেনা ঘাঁটি ঘিরে ফেলার ধরনটা অনেকটাই ১৯৭৯ সালের কাবুল অপারেশনের মতোই। রাশিয়ার সেনারা যখন ইউক্রেনে সামরিক অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে, পশ্চিমের পত্রিকাগুলোর খবর আর মতামতের পাতায় তখন 'আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ কি আসন্ন' বলে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজের স্ক্রলে 'নতুন স্নায়ুযুদ্ধ' বলে খবরও প্রচার করছে।

তবে কানাডার রক্ষণশীল পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জনাথন কে এর তীব্র বিরোধিতা করছেন। তিনি এ পত্রিকায় তার নিয়মিত কলামে বলছেন, ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের যা হচ্ছে তাকে কোনোভাবেই 'স্নায়ুযুদ্ধ' বলা যাবে না। তার ভাষ্য, স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, সেটি আর কখনও-ই ফিরে আসবে না। বর্তমান পরিস্থিতিকে 'স্নায়ুযুদ্ধের' ঐতিহাসিক সমীকরণের সঙ্গে তুলনা করা হলে তা বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্তই করবে কেবল। জনাথনের পরিষ্কার বক্তব্য, যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তার আর কখনও-ই পুনর্জন্ম হবে না; অন্তত ইউক্রেনের আঞ্চলিক স্বার্থ বিষয়ক দ্বন্দ্ব-বিবাদ থেকে তো নয়ই।

তার ব্যাখ্যা– স্নায়ুযুদ্ধ ছিল একটা আদর্শের দ্বন্দ্ব– পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ আর সরকারি প্রোপাগাণ্ডার লড়াই। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের নতুন পুঁজিবাদী রাশিয়ার কোনো আদর্শ নেই; তার আদর্শ একটাই; সেটা হচ্ছে বিরোধিতা করা– পশ্চিমের বিরোধিতা, ন্যাটোর বিরোধিতা, সমলিঙ্গের বিয়ের বিরোধিতা। মোট কথা, পশ্চিমের উল্টোপথে হাঁটাই এখন রাশিয়ার একমাত্র আদর্শ।

জনাথন বলছেন, ইউক্রেনে যা ঘটে গেছে, সেটি আসলে একটি অভ্যুত্থান বা ক্যূ। পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেনের রাস্তায় বিক্ষোভ আর আন্দোলনের পথ ধরে ঘটে যাওয়া যে অভ্যুত্থান নিয়ে উচ্ছসিত ছিলেন, এটিও তার মতোই একটি অভ্যুত্থান। পশ্চিমা মিডিয়ার 'রোমান্টিক অভ্যুত্থানের' উচ্ছাসে অবশ্যই ধাক্কা দিয়েছে পুতিনের নতুন এই 'অভ্যুত্থান'।

রাশিয়া কেন প্রতিবেশি একটি রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে গেল? সেটা কি কেবলই রাশিয়ার আগ্রাসী চরিত্রের কারণে (যেমনটি বলছেন জন কেরি ও তার পশ্চিমা মিত্ররা)? ইনস্টিটিউট ফর পলিটিক্যাল স্টাডিস ইন মস্কোর পরিচালক ও ক্রেমলিনের উপদেষ্টা সারগেই মারকভ এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্লুমবার্গ নিউজকে তিনি বলেছেন, পশ্চিমারা আসলে মস্কোর বাড়ির পাশে রাশিয়াবিরোধী একটি শক্তি গড়ে তুলছিল। 'দেখি না কী হয়' নীতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে চাননি পুতিন। তিনি ভবিষ্যতে বড় শত্রুর সঙ্গে বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে এই মূহুর্তের ছোটো যুদ্ধটাই বেছে নিয়েছেন। এই লড়াইটা তাকে একটা সময় করতেই হত।

আর ব্রেন্ট স্ক্রোক্রফ সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি উইদ দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের পরিচালক ব্যারি পাভেল বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ায় মার্কিন নীতি এবং শক্তির দুর্বলতা সম্ভবত পুতিনকে কাজটা করতে উৎসাহ জুগিয়েছে। 'আমি যা খুশি তাই করতে পারি' এমন একটা ভাবনায় তাকে উৎসাহী করেছে। পুতিন হয়তো ভেবেছেন, আমি যা কিছুই করি না কেন, পশ্চিমারা চিৎকার চেঁচামেচি করবে কিন্তু বাস্তবে আমার কোনো ক্ষতি তারা করতে পারবে না।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের পরিণতিতে কী ঘটবে? পরাশক্তিগুলো কি নতুন করে বিবাদে জড়িয়ে পড়বে? গত সোমবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার কঠোর গলায় বলেছেন, ইউক্রেনের ঘটনা বিশ্বশান্তিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি এ-ও বলেছেন, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে রাশিয়া নিজেদের একলা করে ফেলার ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে।

বলে রাখা ভালো, ইউক্রেনের ঘটনায় আমেরিকার চেয়েও কানাডা বেশ উচ্চকণ্ঠ। 'রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ করা হচ্ছে'– এমন একটা ঘোষণা দিয়েই ফেলেছিলেন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেয়ার্ড। প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার তাকে ইউক্রেন পাঠিয়ে দিয়েছেন সশরীরে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে জি-৮ দেশগুলো রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের পাল্টা সামরিক হস্তক্ষেপের চিন্তা যে করছে না এটি অত্যন্ত পরিষ্কার। অর্থনৈতিক অবরোধ এবং জি-৮ গ্রুপ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়ার চিন্তা নিয়েই তারা এগুচ্ছে। কিন্তু সেখানেও মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পরপরই জি-৮ দেশগুলোর অন্যতম সদস্য জার্মানি জন কেরির বক্তব্যকে জার্মানি সমর্থন করে না বলে প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাঙ্ক ওয়েল্টার এএফপিকে বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের কথাবার্তা বলার একমাত্র ফোরাম হচ্ছে জি-৮। রাশিয়ানদের সঙ্গে যোগসূত্রের এই সুযোগটা হাতছাড়া করা পশ্চিমাদের ঠিক হবে না। জার্মানির এই বক্তব্য গুরুত্বসহকারে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।

কানাডার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জি-৮ গ্রুপ থেকে কাউকে বহিষ্কারের জন্য সকল সদস্যের ঐকমত্য হতে হয়। জার্মানি যখন বিরোধিতা করেছে, তখন অন্তত বহিষ্কারের ঘটনা ঘটছে না। অন্টারিওভিত্তিক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল গভরনেন্স ইনোভেটিভের পরিচালক ফ্যান হ্যামপন গ্লোব অ্যান্ড মেইলকে বলেছেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোর এই ফোরাম গড়ে উঠেছে কোনো ধরনের লিখিত নিয়মাবলী, কমিটি, উপকমিটি ছাড়াই। এর সদস্য হওয়া না-হওয়া নিয়ে কোনো লিখিত বিধি-বিধান নেই।

তবে একটা নীতি এই ফোরাম অনুসরণ করে; তা হল আলোচনার টেবিলে ওঠানো কোনো ইস্যুর ব্যাপারে সদস্য কোনো একটি দেশও যদি আপত্তি বা অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে সেই ইস্যু নিয়ে ফোরামটি আর অগ্রসর হয় না। ফ্যান হ্যামফেন বলছেন, জার্মানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য, বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জার্মানিকে রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়।

তাহলে কী ঘটবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে? রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো সামরিক অভিযান যে হচ্ছে না সেটি প্রায় নিশ্চিত। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উলিয়াম হ্যাগ নিশ্চিত করেছেন যে, তারা সামরিক কোনো অভিযানের বিষয় মাথায় নেননি। কানাডা এমনকি ন্যাটোও সামরিক অভিযানের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপে। কিন্তু সেটি কতটা সফল হবে?

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টারকেই উদ্ধৃত করি– বার্লিন দেয়ালের পতনের পর গত পঁচিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে ইউরোপ। সেই সময়কার বিরোধটা ছিল পূর্ব আর পশ্চিমের। আর এখন ইউরোপই বিভক্তির মুখে। তিনি বলেন, পশ্চিম থেকে যত সতর্কতা হুমকি দেওয়া হোক না কেন, রাশিয়া তার কাজ কিন্তু বন্ধ করছে না। বরং রাশিয়ার কণ্ঠস্বর উচ্চ থেকে উচ্চতর হচ্ছে।

পশ্চিমা দেশগুলো তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার গুটি হিসেবে ইউক্রেনকে ব্যবহার করেছে দীর্ঘদিন। সেই ইউক্রেন ইস্যুতেই পশ্চিমা রাজনীতির ক্ষমতা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তাতে কে জিতবে তা দেখার জন্য আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

শওগাত আলী সাগর: দৈনিক প্রথম আলো'র সাবেক বিজনেস এডিটর ও টরন্টো থেকে প্রকাশিত নতুনদেশ ডটকমের প্রধান সম্পাদক।