দিল্লি-ওয়াশিংটনের উদ্বেগে আমরাও উদ্বিগ্ন

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 13 Nov 2013, 08:48 AM
Updated : 13 Nov 2013, 08:48 AM

বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বশেষ গ্রেফতার অভিযান বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে সম্পূর্ণ অচলাবস্থার দিকেই ঠেলে দিল বলা যায়। বিএনপি আন্দোলনে যে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করেছে তারই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার এই দমননীতির আশ্রয় নিয়েছে।

গত শুক্রবার রাতে বিএনপির তিনজন সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। পরের দিন আদালত তাদের জামিন নাকচ করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট রোববার সকাল থেকে ৭২ ঘন্টার হরতাল ঘোষণা করার পরই এই গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। বিরোধী দলীয় আরও নেতা গ্রেফতার হতে পারেন। এদিকে খালেদা জিয়ার বাসভবন ও তার গুলশানস্থ অফিসও পুলিশ-র‌্যাব ঘেরাও করে রেখেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে নির্বাচনের আগমুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করা হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ সরকার ও বিরোধী দল আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে চূড়ান্ত শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে।

১৯৯১ সাল থেকে যে গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হয়েছে, নির্বাচনী মৌসুম এলেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে এ ধরনের শক্তিপরীক্ষা রাজনৈতিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শক্তিপরীক্ষায় বরাবরই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, নিরীহ নারী-শিশুসহ অনেকেই নিহত ও আহত হয়েছে, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এর আগের দুই সপ্তাহে ৩০ ঘন্টা করে দুবার হরতাল হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল যে হার্ডলাইনে গিয়েছে, তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ছাড়া উন্নতির আশা করা বাতুলতা। কেননা লড়াইটা হচ্ছে নির্বাচনের আগেই জয় নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কৌশলে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাই যত রক্তক্ষয়ীই হোক, লড়াইয়ে হারতে চান না।

অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শীর্ষনেত্রীর টেলিফোনে তিক্ত ও তীক্ষ বাক্যবিনিময়ে হতাশার মধ্যেও যে ক্ষীণ আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল– ব্যক্তি-অহংবোধের কারণে তা নিভে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া কে কাকে আগে টেলিফোন করবেন এই স্নায়ুযুদ্ধের কারণে প্রত্যাশিত সংলাপের পরিবর্তে সংঘাতের পথই বেছে নিয়েছেন।

জনগণকে ধোঁকায় ফেলেছেন তাঁরা, বলেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ করেননি। দরজা উন্মুক্ত রেখে একজন সারা দেশ ঘুরে (সরকারি প্রটোকল নিয়ে) নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, আরেকজন মাঠে আন্দোলন অব্যহত রেখেছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, আমি আহ্বানের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু শেখ হাসিনা দাওয়াত বহাল আছে বললেও দিনক্ষণ জানিয়ে তাকে ডাকছেন না।

যদি ধরেও নিই, এবার টেলিফোন করার পালা খালেদা জিয়ার, তাহলেও সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কি তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারেন? কারণ তিনি যখন দাওয়াত দিয়েছেন, তখন খালেদা জিয়া তাঁর অতিথি এবং তিনি হোস্ট। বিশেষত এখন যখন বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং পুলিশ তাদের ধাওয়া করছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়টা আরও বেশি।

সম্প্রতি তিনি গণভবনে দলের নেতাদের এক বৈঠকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, আমি আর কত অপমানিত হব! এর থেকে মনে হয় তিনি আর উদ্যোগী হয়ে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন বা যোগাযোগ করবেন না। খালেদা জিয়াও সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেই বসে থাকবেন।

প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীই মনস্তত্বগতভাবে জেদী, এটা তারা অতীতেও প্রমাণ করেছেন। রক্তপাত, মানুষের দুর্ভোগ, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি– কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করতে পারে না। বর্তমানের ও অতীতের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলির জন্য এককভাবে বিরোধী দলকে দায়ী করা হবে অযৌক্তিক। কারণ সরকার যখন আলোচনার পথ পরিহার করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে নির্যাতন-নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিরোধী দল রাস্তায় আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। নিপীড়ন যত বাড়তে থাকে, আন্দোলনও ততই তীব্র হয়ে ওঠে– কখনও সহিংস হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আজকের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূত্রপাত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণের মধ্য দিয়ে। যদিও আদালতের রায়ের দোহাই দেওয়া হয়, তা সত্য নয়। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসংবিধানিক বলা হলেও 'Doctrine of necessity'-র কথা উল্লেখ করে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ রাখা হয়েছিল।

পঞ্চদশ সংশোধনী তৈরির জন্য যে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেই সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদীয় কমিটির যে সর্বশেষ বৈঠক হয়, তখন তিনি আচমকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের অনুকরণে অন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করার নির্দেশ দেন।

এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, তখনই সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা পঞ্চদশ সংশোধনীর ব্যাপারে নানা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করে এর পেছনে সুপ্ত ইচ্ছার সন্ধান করেন। সেদিনের সেই সন্দেহ-সংশয় যে অমূলক ছিল না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানই তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, তা নেহাতই দায়সারা গোছের।

তাতে বিএনপিকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হলেও সুনির্দিষ্টভাবে রূপরেখার কোনো কিছু উল্লেখ না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি এবং তার মন্ত্রীরা ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা এখন সুস্পষ্টভাবেই বলছেন, বিএনপি না এলেও তাদের বাদ দিয়েই সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচন করা হবে। জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরীক এরশাদের জাতীয় পার্টি সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনে না হলে তারাও নির্বাচনে যাবে না বলে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে।

তাহলে কাদের নিয়ে এই সর্বদলীয় সরকার হবে? অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে সে নির্বাচন কীভাবে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? ওই নির্বাচন হবে বস্তুত আওয়ামী লীগের একদলীয় নির্বাচন এবং ওই সুপ্ত ইচ্ছাটি সংসদে তড়িঘড়ি করে পাশ করা পঞ্চম সংশোধনীর পেছনে কাজ করেছে। হরতাল স্থগিত বা প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়া যদি প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ২৮ অক্টোবর আলোচনায় যেতেন, তাহলে সুপ্ত ইচ্ছাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হোঁচট খেত। এক বৈঠকে ফলপ্রসূ কিছু অর্জিত না হলেও পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিত।

দ্বিতীয়ত, তাতে সংকট সমাধানে খালেদা জিয়ার আন্তরিকতা প্রকাশ পেত এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে তাঁর ওপর জনগণের আস্থাও বাড়ত। অপরদিকে, আরও চাপ সৃষ্টি হত শেখ হাসিনার স্নায়ুর ওপর। আলোচনার দরজা খোলা বলে তিনি সহজে দায় এড়িয়ে যেতে পারতেন না।

দুই নেত্রীর রাষ্ট্রনায়কসূলভ আচরণের অনুপস্থিতিতে শনির নজর পড়েছে উঠতি বাংলাদেশের ওপর। স্বাধীনতার পর আমাদের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে দুই শক্তিধর দেশ ভারত ও আমেরিকার এমন মাথাব্যথা ও অস্থিরতা আর কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। সম্প্রতি হোয়াইট হাউজের এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান।

ওবামা তাঁর উদ্বেগের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে মার্কিন প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিল্লির সঙ্গে আলোচনা জোরদার করার নির্দেশ দেন। মনমোহন সিং-এর উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে ''in paticular violence and growing radicalisation in the country which he argued poses threat to India and the region.''

বাংলাদেশের সংকটের বিষয়টি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন ও মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইসের মধ্যে আলোচনা হয়। দুই দেশের মধ্যে এই কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবেই ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা তড়িঘড়ি করে সম্প্রতি দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন। ভারতের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্কিন কর্মকর্তারা দিল্লিকে জানিয়েছে তারা খালেদা জিয়ার বিএনপির সঙ্গেই কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই রিপোর্ট থেকে মনে হয়, পক্ষান্তরে দিল্লি কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করতেই অধিক আগ্রহী।

যাহোক, আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে মতবিরোধের কারণ যদি এটাই হয়ে থাকে, তাহলেও কি একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া সাংবিধানিক উপায়ে কোনো সমাধান সম্ভব? বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি যখন ভারত ও আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তাদের মতবিরোধটা বেশ বড় ধরনের।

দুই দেশের মধ্যে এই টানাপড়েনের কারণে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার দীর্ঘদিন ধরে নিরবতা পালন করে আসছিলেন। গত সোমবার এক বিবৃতির মাধ্যমে হাইকমিশন মুখ খুলেছে। অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের কূটনীতিকরাও সর্বক্ষণ তৎপর। চীনের রাষ্ট্রদূতও বেইজিং থেকে ফিরে এক বিবৃতিতে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মণি কলম্বোতে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যাওয়ার পথে দিল্লি গিয়েছেন। এ মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে এখন রশি টানাটানি চলছে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে, আর দুই নেত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত 'প্রক্সি ওয়ারে' জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ দেশে নেই, চলে গেছে বিদেশে।

বিএনপি নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭২ ঘন্টার হরতাল বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮৪ ঘন্টা। প্রতিদিন সংঘাতে প্রাণ যাচ্ছে, যানবাহনে অগ্রিসংযোগে পুড়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে শিশু-নারী-পুরুষ, চলছে ভাঙচুর, ধরপাকড়, পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটা। সরকার ও বিরোধী দল কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না, দোষারোপ করছে পরস্পরকে। আলোচনা চায় না বলে বিরোধী দল হরতাল করছে, কিন্তু সরকার জেল-জুলুমের আশ্রয় নিয়ে কোন অনুকূল পরিবেশ তৈরির কাজ করছে?

বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ অফিসে আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলোও একই কায়দায় তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য, একটা নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি করা, নির্বাচনের জন্য সাজ-সাজ রব তোলা। একদিকে বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার ও গ্রেফতারের হুমকির মুখে রেখে খালেদা জিয়াকে বিপর্যস্ত করা, অন্যদিকে নির্বাচনের সাজ-সাজ রব তুলে তার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা।

একই সঙ্গে চলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা, রোববার ইমাম সম্মেলনে শেখ হাসিনার ঘোষণা: 'প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, আমি শান্তি চাই'। জবাবে বিএনপি বলেছে, তিনি ইস্তফা দিলেই শান্তি আসবে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি চাইলেই তো পদত্যাগ করতে পারেন না, এর একটা প্রক্রিয়া আছে।

তার বক্তব্য সর্বৈব যুক্তিসঙ্গত। শেখ হাসিনা সাময়িক আবেগবশত এ কথা বলেছেন, না ভোটারদের কাছে আবেদন সৃষ্টির জন্য বলেছেন, তা নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। কারণ রাজনৈতিক প্রগলভতায় অভ্যস্ত আমাদের রাজনীতিবিদরা। তারপরও বলতে হবে, তিনি একটি সমাধানের পথ দেখিয়েছেন, শান্তির বিনিময়ে হয়তো তাকে সেই কঠিন সিদ্ধান্তটিই নিতে হতে পারে।

১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনের আগে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেননি, উপলব্ধি করেছিলেন নির্বাচনের পরে। শেখ হাসিনা কি একই ভুল করবেন? এই পরিস্থিতি তার জন্য উভয় সংকট। তাঁর ক্ষমতাসীন দল যে একদলীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা দেশকে আরও গভীর সংকটে ফেলবে– রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে।

ফলে যে শক্তিপরীক্ষা হবে, তাতে কথিত উগ্রপন্থী শক্তির বিকাশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী তার অস্তিত্ব-সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। এই সুযোগে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হেফাজতে ইসলামও সুংগঠিতভাবে মাঠে নামবে। শেখ হাসিনা যে 'সন্ত্রাস' দমনের জন্য গর্ব করেন এবং ভারতের নিরাপত্তা-উদ্বেগ প্রশমিত করে তার আস্থা অর্জন করেছেন, একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তিনিই আবার সেই 'সন্ত্রাস' প্রমোট করে যাবেন।

এই 'সন্ত্রাসের' প্রতি ইঙ্গিত করেই মনমোহন সিং 'growing radicalisation'-এর কথা বলেছেন। সুতরাং ভারতীয় রাজনীতিবিদরা– তা কংগ্রেস বা বিজেপি যেই হোক– আরব বসন্তের হওয়ায় তাদের পূর্ব সীমান্তে (ভারতের রাজনীতিবিদদের ভাষায়) 'আরেকটি পাকিস্তানের' জন্ম হোক, তা মেনে নেবেন না। শেখ হাসিনা যদি শেষ পর্যন্ত একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন, তবে তা কেবল গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করবে না, দেশকেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেব।

সকল আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও বাস্তবতা হচ্ছে যে, দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই কেবল দেশকে এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে। হরতাল ও ধরপাকড় যেমন কোনো সমঝোতার সহায়ক নয়, তেমনি একদলীয় নির্বাচনও নয়।

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকাই মূখ্য। তিনি আবেগবশত পরোক্ষভাবে পদত্যাগের কথা বললেও তা কেবল সম্ভব দুই নেত্রীর সমঝোতার পর। যত বিলম্ব হবে, এই সমঝোতার পথ তত কন্টকাকীর্ণ হবে। আমাদের ভাগ্য নিয়ে বহিঃশক্তি রশি টানাটানি করুক, এটা আমাদের জনগণ চায় না। কোন্ দলকে কোন্ দেশের পছন্দ-অপছন্দ, তা বাংলাদেশের জনগণের দেখার বিষয় নয়; জনগণ যে দলকে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট দেবে, সেই সরকারকেই মেনে নিতে হবে অন্য সকল দেশকে।

কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য আমাদের নেতা-নেত্রীরা যেভাবে বিদেশি শক্তির আশির্বাদের আশায় ঘরে ঘরে ধর্না দিচ্ছেন, তা বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ডেকে আনারই সামিল। এই সুযোগ গ্রহণ করেই শক্তিধর দেশগুলো আমাদের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস পাচ্ছে। কূটনীতিকদের তৎপরতা দেখে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক: সংকট সমাধানে দুই নেত্রী কি শক্তিধর দেশগুলোর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন?

মার্কিন কংগ্রেসের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান শ্যাবেট গত সপ্তাহে দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার পর নাকি মন্তব্য করেছেন, তাঁরা সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি না করে আবারও কারাবাসের পরিস্থিতিই তৈরি করছেন।


আমানুল্লাহ কবীর:
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।