চার বছরে দেশটিতে বাঘের আক্রমণে প্রাণ গেছে ৪০ জনের। অনেক বাঘকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বণ্যপ্রাণী বিভাগ। বাধ্য হয়ে তারা এখন অন্য দেশকে বাঘ উপহার দেওয়ার কথাও ভাবছে।
Published : 17 Jan 2025, 10:24 PM
মাত্র এক দশকে বাঘের সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে নেপাল বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রশংসিত হলেও এই সাফল্য এখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির কাছে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“এত ছোট একটা দেশে সাড়ে তিনশোর বেশি বাঘ। এত বাঘ রাখতে এবং সেগুলো মানুষ খেয়েই যাবে, এমনটা হতে দিতে পারছি না আমরা,” গত মাসে কপ২৯ এর ফলাফল পর্যালোচনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এমনটাই বলেছিলেন।
হিমালয় কন্যা খ্যাত দেশটিতে কেবল ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যেই বাঘের আক্রমণে প্রায় ৪০ জনের প্রাণ গেছে এবং ১৫ জন আহত হয়েছে বলে নেপালের সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, হতাহতের সংখ্যা সরকারের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
“আমাদের জন্য দেড়শ বাঘই যথেষ্ট,” গত ডিসেম্বরে এমন মন্তব্যই করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ওলি। অতিরিক্ত বাঘ নেপাল অন্য দেশকে উপহার দিতে পারে সেসময় তার কথায় এমন ইঙ্গিতও ছিল।
কী পরিমাণ বাঘকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বলা যাবে?
এক কথায় এর উত্তর নেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় শিকারের প্রাপ্যতা কেমন তার ওপর বাঘের সংখ্যা বেশি না কম তা বিবেচিত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, একটি বাঘের আশপাশে যদি হরিণ, বন্য মহিষ বা এন্টিলোপের মতো শিকারযোগ্য অন্তত ৫০০ প্রাণী থাকে, বলেছেন বাঘ বিশারদ উল্লাস কারান্থ।
তার মতো বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, বাঘের সংখ্যা সীমিত করা নিয়ে ওলির উদ্বেগ অহেতুক। উল্টো সরকারে উচিত সংরক্ষিত এলাকা আরও বিস্তৃত করা যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিকার ও বাঘ থাকতে পারে।
শিকারের খোঁজে বন্যপ্রাণীরা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে চলে গেলে বাঘের হাতে মানুষের আক্রমণের সংখ্যাও বাড়বে, এ কারণেই সংরক্ষিত এলাকার সীমানায় এত হামলার ঘটনা ঘটছে।
নেপালে সংরক্ষিত এলাকা বা ন্যাশনাল পার্ক ও মানুষের বসতির মাঝে ‘বাফার জোন’ এলাকাও আছে। বন্যপ্রাণী দেখতে এই বাফার জোনে মানুষের নিয়মিত ভিড় দেখা যায়। কিন্তু স্থানীয়দের অনেকে এসব এলাকায় গবাদিপশু চরায়, পশুখাদ্য ও কাঠ সংগ্রহ করে।
আলাদা আলাদা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার বা অভয়ারণ্যগুলোকে যেসব ফরেস্ট করিডোর সংযুক্ত রাখে সেগুলোতেও বাঘের আক্রমণের ঘটনা শোনা যায়। এ করিডোরগুলোর ভেতর দিয়ে বেশকিছু রাস্তাও চলে গেছে; স্থানীয়রা এমনকী এসব করিডোরকেও খাদ্য সংগ্রহের জায়গা মনে করে, যা একইসঙ্গে তাদের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে।
নেপালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের যে মডেল এক সময় সফল বলে বিবেচিত হত, তাতে যে ফাটল ধরেছে মানুষের মৃত্যু বৃদ্ধিতে তারই ইঙ্গিত মিলছে, বলেছেন প্রাণিবিজ্ঞানী করণ শাহ।
“আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার দিকেই মনে হয় এখন নেপালের নজর, এদিকে ন্যাশনাল পার্ক ও সংরক্ষিত এলাকাগুলোর আশপাশে থাকা লোকজনের ওপর কী প্রভাব সেদিকে তারা খেয়ালই করছে না,” বলেছেন তিনি।
বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেবল ‘পরিবেশগত বা বৈজ্ঞানিক বিষয়’ নয়, সামাজিক বিষয়ও; এ কারণেই বাঘের হাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে হবে, তাহলে স্থানীয় লোকজনও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ চেষ্টায় অংশ নিতে পারবে এবং এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যাবে না। কেবল মানুষ হত্যাই নয়, বাঘের হাতে গবাদিপশুর মৃত্যুও স্থানীয়দের ক্ষেপিয়ে তুলছে।
“আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনও গ্রামাঞ্চলে বাস করে, তারা বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল এবং বন সংরক্ষণে সহযোগিতাও করে। কিন্তু এই মানুষগুলো এখন বাঘের হাতে হতাহত হচ্ছে। বন সংরক্ষণবাদী হিসাবে আমরা বন্যপ্রাণীর বিরুদ্ধে যেতে পারিনা, তবে এর অর্থ এই নয় যে মানুষ এবং সমাজের উপর এর প্রভাবকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি,” বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন ফেডারেশন অব কমিউনিটি ফরেস্ট্রি ইউজার্স নেপালের সভাপতি ঠাকুর ভান্ডারি।
সাফল্য এখন পরিণত আতঙ্কে
এক শতাব্দী আগেও এশিয়ায় প্রায় এক লাখ বাঘের বিচরণ ছিল, কিন্তু নির্বিচারে বন উজাড় ও চোরা শিকারের ফলে শিকারি এ প্রাণীটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।
এখন নেপাল, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়াসহ ১৩টি দেশের বনগুলোতে কেবল ৫ হাজার ৬০০টি বাঘ অবশিষ্ট আছে।
এই দেশগুলো ২০২২ সালের মধ্যে তাদের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এদের মধ্যে নেপালই প্রথম লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। চোরা শিকার শূন্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ এবং ১৯৯২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বনাঞ্চল দ্বিগুণ করা দেশটির কাজ সহজ করে দিয়েছে।
তবে এখন বাঘের আক্রমণে ক্রমবর্ধমান নিহতের সংখ্যা সেই কৃতিত্ব মিইয়ে দিচ্ছে।
যে কারণে প্রধানমন্ত্রী ওলির মতো অনেকেই মনে করেন, নেপালে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তা মানুষের জীবনের বিনিময়ে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বের করাও বেশ কঠিন।
বিভিন্ন পার্ক কর্তৃপক্ষ ও বন্যপ্রাণী বিভাগ বাঘ সামলাতে হিমশিম খাওয়ার কথা স্বীকারও করছে; যেসব বাঘ মানুষের ওপর আক্রমণ করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে আটকের কাজও চলছে।
চিড়িয়াখানা এবং উদ্ধার কেন্দ্রগুলোতে এ ধরনের বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে জানিয়ে ২০২৩ সালেই নেপালের বন্যপ্রাণী বিভাগ সমস্যা মোকাবেলায় বিস্তৃত প্রটোকল তৈরির তাগাদা দিয়েছিল।
শেষ উপায় হিসেবে ওলি নেপালের বাঘ বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন।
“মানুষ বাজপাখি ও ময়ূরকে পোষ্য রাখতে পছন্দ করে, তাহলে বাঘ কেন নয়? বাঘ তাদের মর্যাদাও বাড়িয়ে দেবে,” বলেছেন তিনি।
তবে সবার মত তার মতো নয়।
জীববিজ্ঞানী কারান্থের প্রস্তাব হচ্ছে, যে বাঘগুলো একাধিক মানুষ হত্যা করেছে সেগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব মেরে ফেলতে হবে।
আবার অনেকে বলছেন, বাঘের তো দোষ নেই। মানুষই বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে অনুপ্রবেশ করে, সেখানে চাষাবাদ বা অবকাঠামো নির্মাণ করে, বাঘের শিকার কমিয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
এ নিয়ে বিবিসি একজন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কখা বলতে গেলে তিনি জানান, ওলি বাঘের সংখ্যা কমাতে চাইছেন কারণ বন পরিষ্কার করে তিনি নতুন নতুন স্থাপনা বানাতে চান।
“জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে তিনি এমনটা বলছেন না,” ভাষ্য তার।
শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতি কোনদিকে কতদূর গড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ছোট দেশটি যে মানুষ আর বাঘের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে, তা মেনে নিতেই হচ্ছে। যে সাফল্য কয়দিন আগেও তাদের গলার মালা হয়ে ছিল, তাই যেন এখন কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।