বিতর্কলেখার ভাষা :: মুখের ভাষা

admin
Published : 22 Feb 2010, 02:40 AM
Updated : 22 Feb 2010, 02:40 AM

অনলাইন বৈঠকে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শুধু বাংলা ভাষায় লেখা প্রতিক্রিয়াই গ্রহণ করা হবে। যারা ইউনিকোডে অভ্যস্ত নন তারা মন্তব্যের ফাঁকা ঘর-এ বিজয় পদ্ধতিতে লিখে পেস্ট করবেন। অথবা arts@bdnews24.com-এ ই-মেইলের মারফতে লেখা পাঠাবেন। কাগজে লিখে স্ক্যান করে লেখা পাঠানো যাবে।

এখানে মন্তব্যগুলি নিচ থেকে উপরের দিকে সাজানো হয়েছে। অর্থাৎ নতুন প্রতিক্রিয়া উপরে থাকবে।


ছবি. কমলকুমার মজুমদার

‍‍অনলাইন বৈঠক ১ শুরু হয়েছে ২৬/১০/২০০৭ তারিখে। এর বিষয়:

লেখার ভাষা বা সাহিত্যের ভাষায় মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষার মিশ্রণ রচনার শিল্পগুণ নষ্ট করে।

এ পর্যন্ত লিখেছেন:

১. শোহেইল মতাহির চৌধুরী
২. ফকির ইলিয়াস
৩. সাঈদ জুবেরী
৪. নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (১)
৫. অবনি অনার্য
৬. চয়ন খায়রুল হাবিব
৭. আইরিন সুলতানা
৮. আদনান সৈয়দ
৯. আদনান সৈয়দ
১০. তাহমিদাল
১১. জগলুল হায়দার
১২. সারওয়ার রেজা
১৩. ফারিহান মাহমুদ
১৪. সারওয়ার চৌধুরী

●●●

১৪. সারওয়ার চৌধুরী

বেশি না, পঞ্চাশ বছর আগের মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় বিস্তর ব্যবধান পাওয়া যাবে পৃথিবীর যে-কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষায়। শব্দ প্রয়োগে, উচ্চারণে, অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণে বানানো শব্দ, সরাসরি অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার ইত্যাদি কারণে 'শিক্ষিত' বা 'অশিক্ষিত' মানুষের মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় পরিবর্তনটা আসে।

পঞ্চাশ বছর আগের আরবী ফারসি ইংরেজী উর্দূ হিন্দি মুখের ভাষা ও লেখার ভাষা আর এখনকার মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় রদবদলের ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো। ব্যাকরণের মানটাকে মেনেই এই বদলটা আসছে লেখার ভাষাতে। মুখের ভাষায় ব্যাকরণের আইন সকল সময় না-মানা সত্ত্বেও বোধ-সংবেদ-অনুভূতি বিনিময় হয়ে আসছে। অভিজ্ঞতায় পাইলাম কিছু ভাষার মধ্যে পরস্পর খুব সখ্য; ভারতের কেরালা রাজ্যের 'মালায়ালাম' ভাষার সাথে তামিলনাড়ু রাজ্যের 'তামিল' ও শ্রীলংকার 'তামিল' ভাষার লেখার অক্ষরে পার্থক্য আছে কিন্তু শব্দার্থে যথেষ্ট মিল। মালায়ালীরা তামিল বোঝে, তামিলরা মালায়ালী বোঝে। আবার ওই তামিল ও মালায়ালাম ভাষার সাথে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের 'কানাড়ি' ভাষারও মিল আছে। কানাড়িভাষী মালায়ালাম ও তামিল বোঝে। উচ্চারণে হেরফের আছে। ওদিকে সংস্কৃত হ'তে অদলবদল হ'য়ে আগত অনেক শব্দ হিন্দিতে, তামিলে, মালায়ালামে, কানাড়িতে, এবং বাংলাতে আছে। শুধু উচ্চারণে ও লেখায় ব্যবধান বিদ্যমান। ইউরোপেও লাগোয়া দেশগুলোর পরস্পরের ভাষার সাথে মিল আছে। অস্ট্রীয়রা জার্মান ভাষা বোঝে ইত্যাদি।

আবার দেখুন, পঞ্চাশ বছর আগের সিলেটের, চট্টগ্রামের, কুমিল্লার, নোয়াখালি ইত্যাদি জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষা আর বর্তমানের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে ব্যবধান পাওয়া যাবে 'শিক্ষিত' 'অশিক্ষিত' নির্বিশেষে। কেউ বলতে পারেন আগের চাইতে এখন পরিশীল আঞ্চলিক ভাষাগুলো। আর লেখক-কবিরা তো শব্দ তৈরি করতেই আছেন। প্রবাসীদের মুখে মুখে ভাষার ভেতরে নতুন নতুন শব্দ ঢুকে যাচ্ছে। সিলেটে ও চট্টগ্রামে দেখেছি আরব প্রবাসী পরিবারগুলোতে 'ইয়াল্লা খালাস' খুব ব্যবহার হয়। এবং তা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। 'ইয়াল্লা খালাস' মানে 'ঠিক আছে, হয়েছে বা থাক'।

আর মুখের ভাষা পুরোটা সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করি? সাহিত্যের ভাষার শৈল্পিকতার একটা মান তো থাকা দরকার। ভাষা বিজ্ঞানীরা নাকি বলেন প্রতি ১৮ কিলোমিটার অন্তর মানুষের মুখের ভাষার ব্যবধান তৈরি হয়। আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্যের কারণেই একটা সার্বজনীন সাহিত্য ভাষা থাকা দরকার। তবে হ্যাঁ, যেই লেখক সহজবোধ্য করে লিখতে পারেন, সেটা তার বিশেষ গুণ। কিন্তু কথা আছে, কিছু শিল্পসমৃদ্ধ লেখা, প্রায় সব ভাষাতেই, খুব সহজে বোধ-সংবেদ-ভাব ধরা পড়ে না। উত্তরাধুনিক শিল্প আলোচকেরা বলছেন, ভাষার শব্দগুলো বহুবিধ অর্থবোধক। পাঠকভেদে কিংবা একই পাঠকের বার বার পঠন থে'কে ভিন্ন অর্থ আসতেই পারে শব্দের, বাক্যের।

নভেম্বর ৪, ২০০৯
sarwarch@gmail.com

১৩. ফারিহান মাহমুদ

সবার আগে তাহলে 'মান ভাষা'র একটা প্রমিতকৃত সংজ্ঞার দরকার। মানভাষা কীসের ভিত্তিতে 'মানিত' হবে? সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নাকি লঘিষ্ঠতার ভিত্তিতে? নাকি, গরীব আর ধনীদের ব্যবহারের ভিত্তিতে? নাকি অঞ্চল ভিত্তিতে? নাকি অন্য কিছু?

আমাদের পুরান ঢাকা ও নতুন (অভিজাত) ঢাকার জন্য কি আলাদা আলাদা মান ভাষা হবে? নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কুষ্টিয়া—প্রতি অঞ্চলের জন্য কি আলাদা আলাদা মান ভাষা থাকবে?

তাহলে মান ভাষার জন্য প্রমিতকৃত আরেকটা প্রমিত শব্দকোষেরও দরকার, যেরূপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছিল ১৯৩৬-এর দিকে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৮-৬৪-এর দিকে শুরু করে ২০০০ সালে চূড়ান্ত করে। ধরুন, মান ভাষার জন্য এরূপ একটা শব্দকোষ গ্রন্থিত হলো, তাতেই কি সমগ্র বাংলাদেশ সেই মানভাষার শব্দাবলি প্রয়োগ করবে, বা প্রয়োগে বাধ্য থাকবে? বর্তমান প্রমিত শব্দগুলো কি সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ সমভাবে ব্যবহার করেন? আমার জানা মতে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির জন্য আঞ্চলিক ভাষার অভিধান আছে। এরূপ প্রতি অঞ্চলের জন্য যদি আলাদা আলাদা শব্দকোষ গঠন করা যায়, তখন সবগুলো শব্দকোষ মিলিয়ে আরেকটা প্রমিত শব্দকোষ তৈরি করতে হবে; অর্থাৎ আরেকজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র প্রয়োজন পড়বে, আর সেই প্রমিতকৃত শব্দভাণ্ডারের জন্য আমাদেরকে আরো ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

আমার আত্মীয়স্বজনের এক অংশ ঢাকাইয়া কুট্টি, আরেক অংশ অন্যান্য ঢাকায়। কুট্টিদের ভাষা সবসময়ই আমাদের বিনোদন দিয়ে আসছে। ওদের অনেক শব্দ আবার বুঝিও না, তবু বিশেষ এক পিকিউলিয়ারিটির কারণে সেই ভাষা খুব মজা করে শুনতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করে বলতাম এটাকে 'মেথরের ভাষা।' পদ্মার তীর ঘেঁষে যে বিস্তৃত চরাঞ্চল, ওদের মুখের ভাষা পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত ভাষা। আমরা অনেকাংশেই তাদের দ্বারা প্রভাবিত। ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাষাও এরূপ শ্রুতিমধুর ও মার্জিত।

প্রথম বাক্যেই 'আমাগো' শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে—বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর কথ্যরূপ হলো—আমাগো, আমাদের, মোগো, আমগো; এর বাইরেও আরো থাকা সম্ভব। এখন প্রমিত করবো কোন্‌টাকে? 'মোগো' বা 'আমগো' শব্দরা কী দোষ করলো? আর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর 'আমাদের' শব্দটা তো প্রায় ১১০০ বছরের পুরনো ও সর্বজনগৃহীত একটি শব্দ, এটাকে ফেলে দিচ্ছেন বা ঠেলে দিচ্ছেন কেন?

সাহিত্যে বিভিন্ন ক্যারেক্টারের মুখে তার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের নজির খুব পুরনোও নয়। কিন্তু ঐ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের প্রাকট্যের কারণে অনেক ভালো মানের বইও পাঠক পড়তে পারেন নি।

আপনি কোন্‌ ভাষায় লিখবেন তা আপনাকে চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়, তাহলে আপনার বাক্‌ (লিখবার) স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। যেটাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সেটাতেই লিখুন। কাল-মহাকালই নির্ণয় করবে—আপনি টিকে আছেন, নাকি হারিয়ে গেছেন; আর এভাবেই ভাষার বিবর্তন ঘটতে থাকবে, শতাব্দী থেকে শতাব্দী।

১২. সারওয়ার রেজা

"তথাকথিত মান ভাষার মান-সম্মান লইয়া ইদানিং আমাগো অনেকের চিন্তাই রিভাইজ হইতেছে দেইখা ভালোই লাগতেছে। এইটা অনিবার্য। প্রতিক্রিয়াশীলরা কয়দিন হইল চিল্লা-ফাল্লা করতে পারব কিন্তু ঠেকানোর উপায় নাই। পয়লা পয়লা খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে সব সইয়া যাইব! আরে ভাই এইটাই হিস্টোরিক্যাল ডিটারমিনিজম। আমি নিজেও ছড়ায় যথাসম্ভব এই ভাষায় মানে আমার প্রকৃত ভাষায় লেখার চেষ্টা করতেছি। কারণ আমাগো মান ভাষায় অবশ্যই আমাগো মান-ইজ্জতের প্রতিফলন থাকতে হইবই।"
– জগলুল হায়দার

এই 'আমাগো মান ভাষা' টি নির্ধারণ করছে কে? রাজধানী ঢাকার আজিজ মার্কেট বলয়ের নব্য বুদ্ধিজীবীরাই তো! যে যুক্তিতে নদীয়া-শান্তিপুরকেন্দ্রিক মানভাষাকে ম্লেচ্ছ বলার তাগিদ এঁরা অনুভব করছেন, সেই একই যুক্তিতেই তাঁদের নির্ধারিত 'আমাগো মান ইজ্জতের প্রতিফলন'যুক্ত ভাষাটিও ব‌্যক্তিগত চর্চা হতে পারে, বাংলাদেশের মানভাষা নয়। ঢাকার মিশ্র/অবিমিশ্র ভাষার বাইরে পুরো বাংলাদেশের কথ্যরীতি পড়ে আছে ভাই। কোন বিচারে আপনারা আপনাদের এই 'মান-ইজ্জত'কে সবার ওপর চাপিয়ে দেন? দিনাজপুরের শহর অঞ্চলের মানুষ যে ভাষায় কথা বলছে, গ্রামের লোকগুলো সে ভাষায় বলছে না, নাটোর, পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল বা চাটগাঁর লোকেদের (শিক্ষিত বা অন্ত্যজ, যাদের বিবেচনায় আপনারা স্বস্তি বোধ করেন) ভাষা অন্যরকম, ক্রিয়াপদের ব্যবহার, রসপ্রয়োগ, pun… ইত্যাদি যে প্রসঙ্গগুলো উঠেছে—সবই স্বতন্ত্র। তাদের ওপর আপনার পছন্দের মানভাষা চাপিয়ে দেয়া বা দেয়ার প্রক্রিয়া জারি হবে কেন? কেন-ই বা আপনারটাই 'আস্তে আস্তে সব সইয়া' যেতে হবে?! মিডিয়াটা আপনার দখলে বলে (সেটা দৈবযোগ বা যে যোগ্যতাতেই হোক না কেন)? ফারুকী, রাইসুরা জনপ্রিয় বা প্রভাবশালী হয়ে গিয়েছেন বলে? ফারুকী এবং তার ভাই বেরাদরদের জনপ্রিয়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে 'করসস্', 'খাইসি', 'হইতেসে', 'খাইতেছে', 'হেগো লগে', 'আমাগো' ইত্যাদির যে সংক্রমণ নিজে দেখেছি তা কোনোভাবেই আপনাদের 'হিস্টোরিক্যাল ডিটারমিনিজম' হতে পারে না, কৃত্রিমভাবে আরোপিত একধরনের হেজিমনি ছাড়া।

লেখক, শিল্পী তাঁর শিল্প স্বাধীনতার অজুহাত/প্রিভিলেজ থেকে যেভাবে খুশি লিখুন, অন্যের জন্য মানভাষা নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজেদের কুয়োর ঘেরাটোপকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করবেন না দয়া করে। প্রতিক্রিয়াশীলতার সংজ্ঞা আপনারা রিভাইজ করছেন প্রতিক্রিয়াশীলতার চাদরে নিজেদের আগে ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে।
(প্রতিক্রিয়া, অক্টোবর ১৫, ২০০৯; এবাদুর-ইনারিতু সংলাপিকা)

১১. জগলুল হায়দার

তথাকথিত মান ভাষার মান-সম্মান লইয়া ইদানিং আমাগো অনেকের চিন্তাই রিভাইজ হইতেছে দেইখা ভালোই লাগতেছে। এইটা অনিবার্য। প্রতিক্রিয়াশীলরা কয়দিন হইল চিল্লা-ফাল্লা করতে পারব কিন্তু ঠেকানোর উপায় নাই। পয়লা পয়লা খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে সব সইয়া যাইব! আরে ভাই এইটাই হিস্টোরিক্যাল ডিটারমিনিজম। আমি নিজেও ছড়ায় যথাসম্ভব এই ভাষায় মানে আমার প্রকৃত ভাষায় লেখার চেষ্টা করতেছি। কারণ আমাগো মান ভাষায় অবশ্যই আমাগো মান-ইজ্জতের প্রতিফলন থাকতে হইবই।

(প্রতিক্রিয়া, অক্টোবর ১২, ২০০৯; এবাদুর-ইনারিতু সংলাপিকা)
jaglul_82@yahoo.com

১০. তাহমিদাল

যাঁরা ভাষায় হস্তক্ষেপের দলে, তাঁরা এই যুক্তি দেন যে: ভাষার কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নাই। ভাষারে বদলাতে দেওয়া হোক। সেই বদলটা ব্যক্তি/গোষ্ঠির নামে/ওয়াস্তে যদি সম্পন্ন হয় — তাইলে ক্ষতি নাই। কারণ ভাষার কর্তা মানুষ। মানুষের ব্যবহারের মধ্য দিয়াই ভাষা প্রাণ ধরে, চেহারা বদলায়। হয়তো একজন-দুজন মানুষ না, বহুমানুষ মিলে ভাষারে ধারণ করে; কিন্তু সেই বহুমানুষের আবার বহুরকমের ভাব। সেই বহুরকম আছে বলেই ভাষা বদলায় মানুষের কর্মের মধ্যস্থতায়।

ভাষা যে বদলায় — এটা হস্তক্ষেপবিরোধীরাও অনেকে কবুল করেন। কিন্তু তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, ভাষা বদলাবে নিজে নিজে। সেখানে কোনো বান্দার জারিজুরি খাটবে না। অর্থাৎ ভাষা এক সাবর্ভৌম খোদা।

আরেক দল বলেন, মানুষ ভাষাকে বদলাবে বটে, তবে সেখানে কোনো একটা লোক/দল/মহলের চালাকি খাটার সম্ভাবনা নাই। ভাষা বদলাবে সকলে মিলে, দিনে দিনে, একটু একটু করে।

এখন এই দ্বিতীয় পক্ষের কথাগুলাকে আমরা এই এই ভাবে দেখতে পারি:

১) নিরপেক্ষ, বুদ্ধিজীবীসুলভ বর্ণনা: অর্থাৎ ভাষার চালচলন সম্পর্কে বাইরে বসে গবেষণা ও ভবিষ্যদ্বাণী।

তাঁরা স্বয়ংচালিত ভাষার চলন নিয়ে বাইরে বসে শুমার করছেন। যদি তা-ই হয়, তাইলে ব্রাত্য রাইসু বা এবাদুর রহমান বা অন্য কাউকে গালি পাড়ার কোনো যুক্তি থাকে না। কারণ বিশেষ মানুষ যদি ভাষার কর্তা না হয়, তাইলে বিশেষ মানুষকে দোষী করাও অর্থহীন, সবই খোদ-ভাষারই লীলাখেলা।

সেক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বও অসার।

২) রাজনৈতিক মতবাদ: অর্থাৎ ভাষাকে একজন কীভাবে চান, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে শত্রুমিত্র নির্ধারণ ও রাজনৈতিক চর্চা।

এক্ষেত্রে অভিযোগটা এরকম হইতে পারে যে: একটা বিশেষ গোষ্ঠি বাংলা ভাষাকে অ-বাংলা ভাষা বানানোর তাগিদে আরবি-ফারসি শব্দ বাংলার সীমান্তে পুশ-ইন করে দিতেছে।

অথবা, মান বাংলা ভাষার সংহতি নষ্ট করার আশায় বিশেষ মহল বহুরকম আঞ্চলিক ভাষার যাচ্ছেতাই ব্যবহারের মধ্যে দিয়া ভাষায় নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত।

৩) পাহারাদারি: অনেকটা রাজনৈতিক জায়গা থেকেই, অনেকে নিজেদের হয়তো ভাষারক্ষাকর্তা বলে সাব্যস্ত করেছেন। এঁরা হয় উপরে বলা বিশেষ মহলকে তফাত রাখতে চান, অথবা:

* কিছু অবুঝ পোলাপান আপন বালখিল্যতাবশত ভাষার গায়ে আঁকিবুকি টেনে ভাষাকে বরবাদ করে দিচ্ছে

এই ভয় থেকে তাঁরা শিশুদের নাগালের বাইরে ভাষাকে সুরক্ষিত করে রাখতে চান।

কিন্তু সুরক্ষিত করা যায় কীপ্রকারে? ভাষাকে কি যা-কিছু-লেখা-হয়ে-গেছে তারই মধ্যে মুড়ে রাখলে ভাষা রক্ষা হবে? নাকি যেভাবে-এতোদিন-লেখা-হয়েছে সেই একই কায়দা দিয়ে ক্রমাগত পুনরুৎপাদনের মধ্যেই ভাষার রক্ষাসূত্র নিহিত আছে?

মন্তব্যের মধ্যে মন্তব্য:

* যদি প্রশ্নটাকে রাজনৈতিক বলেই সাব্যস্ত করা হয়, সেক্ষেত্রে পক্ষে বিপক্ষে কে কে আছেন, তার হিসাব নেওয়া দরকার।

* এই কথাটা মনে রাখলে হয়তো ভাল হয় যে: ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে এই তর্কটা বা এই তর্কগুলাও একটা কিছু ছাপ ফেলে যাইতেই আসে। ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বিশাল প্রক্রিয়াটারে বিশেষ অভিমুখ দেওয়ার সম্ভাবনারে মেনে নিয়াই এই তর্কগুলাকে যখন বারবার আন্দোলিত করা হয়, তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপন্থীদের 'স-তর্ক' হওয়ার দরকার পড়ে। ডাক পড়ে। আর একই ভাবে এই তর্কগুলায় যে যা বলতেছেন তার সামগ্রিক ফল যে ভাষায় ফলবে না — এই ভ্রমও মাথা থেকে দূর করেই বোধহয় হুঁশিয়ার হয়ে সবাই তর্ক করতে আসেন। তা যদি না-ই হইত, তাইলে তর্কেরই বা কী দরকার, আর কে কী বললেন তাতেই বা কী আসতো-যাইত?

অক্টোবর ১৯, ২০০৮
wowwow_85@yahoo.com

::

৯. আদনান সৈয়দ


আড্ডায় হাসান ফেরদৌস, জ্যোতির্ময় দত্ত, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

মুখের ভাষাই কি লেখার ভাষা? এই রকম একটা তর্ককে ঘিরেই জম্পেস এক লেখক আড্ডা মুখরিত হয়ে উঠেছিল জ্যাকসন হাইটস-এর পিএস ৬৯ এ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, নিউইয়র্ক আয়োজিত একটি বই মেলায়। এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং লেখক জ্যোতির্ময় দত্ত। অনুষ্ঠানটির মডারেটর ছিলেন লেখক এবং কলমিস্ট হাসান ফেরদৌস। মুখের ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষায় কি সাহিত্য রচনা করা সম্ভব? বাংলা ভাষা কি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাতে টিকে থাকতে পারবে কিংবা বাংলা শব্দের সাথে হিন্দি, আরবি ইত্যাদি বিদেশি শব্দ জুড়ে দিয়ে একদল লেখক বাংলা সাহিত্যের যে বারোটা বাজাচ্ছেন তারই বা কী হবে — এই বিষয়গুলোর উপর জোর দিয়েই সেদিনের লেখক আড্ডাটা উপস্থিত সবাইকে বেশ চাঙ্গা করে রেখেছিল।

হাসান ফেরদৌস: আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ তথা মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা কি সম্ভব? তাছাড়া ইদানিং বাংলা ভাষার পিণ্ডি চটকানোর জন্য একদল লেখক সাহিত্যে প্রমিত ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তে আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দেওয়ার একটা রীতি শুরু করে দিয়েছেন তারই বা যৌক্তিকতা কতটুকু? এ বিষয়ে আপনাদের মতটা জানতে চাই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে সাহিত্যের শৈল্পিক গুণাবলী হারানোর কোনো রকম সম্ভাবনাই নেই। বরং উল্টো বিভিন্নরকম এবং বহুমুখী আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে নিঃসন্দেহে সাহিত্যের একটা শক্তিশালী শাখা বের হবে। তবে কখনো কখনো প্রমিত ভাষার ব্যবহার সাহিত্যে খুবই জরুরি হয়ে উঠতে পারে, সেদিকটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আঞ্চলিক শব্দ নিয়ে যারা ভীত তাদের ভয়ের কিছুই নাই। ভবিষ্যতেই একমাত্র এর উত্তর পাওয়া যাবে।

জ্যোতির্ময় দত্ত: না, আমি মনে করি সাহিত্যের ভাষা প্রমিত হওয়া খ্বুই জরুরি। শুধুমাত্র আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দিলেই চলবে না পাশাপাশি শব্দের যুৎসই ব্যবহার, সাহিত্যের রস এবং এর শৈল্পিক বিন্যাসের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। সাহিত্যের ভাষায় আঞ্চলিকতা জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এ ধরনের প্রচেষ্টা ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে সাহিত্য খুব বেশি একটা এগোতে পারে না।

হাসান ফেরদৌস: আমাদের বাংলা ভাষার সাথে প্রচুর বিদেশি শব্দ অর্থাৎ আরবি শব্দ জুড়ে দিতেও এক গোপন ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকতে একদল সকাল বিকাল কাজ করে যাচ্ছে। যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ সেই বাংলা ভাষার উপর এ ধরনের ষড়যন্ত্র আপনারা কী চোখে দেখছেন?

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: আমি এই ধরনের তথাকথিত 'ষড়যন্ত্রে'র কথা বিশ্বাস করি না। ধরা যাক এবারের ঈদ সংখ্যায় দশটা উপন্যাস ছাপা হয়েছে, দুশোটা গল্প এসেছে, পাঁচশত কবিতা ছাপা হয়েছে। এর কোনো একটা মাধ্যমে কি এই বাংলা-আরবি মিশ্রণ অথবা ভাষার বিকৃতি বা এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে? মোটেই না। তার মানে হল বাংলা ভাষা তার প্রমিত মান নিয়েই এগোবে এবং বেঁচে থাকবে। আমরা শুধু শুধুই এ বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাংলার সাথে আরবী অথবা অন্যান্য অনেক বিদেশি ভাষার মিশ্রণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ভাষার পরিবর্তন হয় এবং হতেই পারে। ইংরেজি ভাষার সাথেও পৃথিবীর বহু ভাষার অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে। বাংলার সাথে যদি কোনো বিদেশি ভাষার মিশ্রণ ঘটে তাহলে সেটাতে খারাপ কিছু আমি দেখি না। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়। কিন্তু ভাষা হারিয়ে যায় না।

জ্যোতির্ময় দত্ত: আমরা ছেলেবেলায় যে ভাষায় কথা বলেছি এখন সে ভাষা অনেক অংশেই বদলে গেছে। আমার কাছে কলকাতার ভাষা এখন আর নিজের ভাষা বলে মনে হয় না। ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষার চেহারার এরকম পরিবর্তন মোটেই কোনো ভালো কথা নয়।

হাসান ফেরদৌস: বাংলা ভাষা কি ভবিষ্যতে তাহলে বাংলাতে টিকে থাকবে বলে আপনারা মনে করেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অবশ্যই। আমি তো বাংলাদেশে দেখি না যে আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে কথা বলছে। তবে বাংলার উপর হিন্দি অথবা ইংরেজির একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব যে পড়ছে না তা নয়। তবে সেজন্য বাংলা ভাষা বিলীন হয়ে যাবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ভাষার প্রায়োগিক একটা পরিবর্তন হতে পারে তাই বলে একটা ভাষা কখনো শেষ হয়ে যেতে পারে না।

জ্যোতির্ময় দত্ত: ছেলেবেলায় আমাদের মজার একটা খেলা ছিল। কেউ যদি কথা বলতে যেয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করত তাহলে তাকে নির্ঘাত জরিমানা করে তার কাছ থেকে এক টাকা নেওয়া হত। এভাবে আমি মীনাক্ষীর (জ্যোতির্ময় দত্তের স্ত্রী, বুদ্ধদেব বসুর কন্যা) কাছ থেকে প্রচুর টাকা পেয়েছি। ইদানিং আর সে রকমটা দেখা যায় না। একটা ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার সংমিশ্রণে একটা খিচুড়ী ভাষা হোক তা আমি কখনোই চাইব না। যে কোনো ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার মিশ্রণ হবেই তবে সেক্ষেত্রে ভাষার সৌন্দর্যটা কতটুকু থাকলো সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

(সংক্ষিপ্ত)

অক্টোবর ১৬, ২০০৮
adnansyed1@gmail.com

::

৮. আদনান সৈয়দ

মুখের ভাষা কি সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব? প্রশ্নটি রেখেছিলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাসী কবি শহীদ কাদরীকে। শহীদ কাদরী শুনে প্রথমে তার মুখটা বিকৃত করলেন, তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ নিজস্ব ঢংয়ে এর উত্তর দিলেন। 'কও কি মিয়া, ঘরে বউ-এর সাথে যেই ভাষায় কথা কই ওই একই ভাষায় উত্তর আধুনিক কবিতার উপর প্রবন্ধ লিখতে কও নাকি?' নিউ ইয়র্কের বাঙালি পাড়ায় হাঁটলে রাস্তার এদিক থেকে ওদিক থেকে বিভিন্ন রকম বাঙালি খিস্তি কান গরম করে ফেলে।
'ঐ হালা সাল্লু, বিকালে আলাউদ্দিনে আহিস, আড্ডা দিমু নে।'/'দোস্ত প্যাচাল অনেক অইছে, এহন ল জাইগা।'/'আবার জিগায়?' ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমেরিকানরাও খিস্তি ছাড়তে বেশ ভালোবাসেন। নিত্যদিনের পরিপাটি ভাষার পাশাপাশি এদের শিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রেণী সবাই দেখি বলছে, 'হোয়াটস আপ, সান?/হোয়াটস আপ ডিওড?/চিলিং এরাউন্ড/হোয়াট দা হেক ইস দেট/ইয়ো ব্রো/ইত্যাদি। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডায়, হাটে, মাঠে, বাসে, ট্রেইনে, ড্রয়িং রুমে সব জায়গায় আমরা এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করছি এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কথা হল আমরা নিত্য যে ভাষায় কথা বলছি সেই ভাষাটি কি টিভি, রেডিও সংবাদপত্র অথবা সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব?

২০০৭-এর বসন্তে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক নিউইয়র্কের কুইন্স লাইব্রেরীতে তাঁকে দেওয়া একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষা নিয়ে এই তর্ককে ঘিরেই উপস্থিত দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে মুখের ভাষায় সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব কিনা? আনিসুল হক তার উত্তরে প্রমথ চোধুরীর লেখার কয়েক ছত্র পড়ে শুনিয়ে বললেন যে, 'মুখের ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত।' কিন্ত যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে তা হল প্রমথ চৌধুরী যখন বলেছিলেন যে মুখের ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিৎ সেই সময় মানুষের মুখের ভাষাটি কেমন ছিল? 'আমি গিয়েছিলুম', 'আমি গিয়েছিলাম' অথবা 'আমি গেছিলাম' এই ক্রিয়া পদের ব্যবহার কি আঞ্চলিকতার ফসল নয়? বলতে চাচ্ছি একেক অঞ্চলের লোকের ভাষা একেক রকম তাহলে সাহিত্যের সার্বজনীন ভাষা কোনটা হবে? এ ব্যাপারে আনিসুল হক পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের জেলে কুবেরের ভাষার দিকে আমাদের নজর টানেন। চরিত্রের প্রয়োজনে এবং গ্রহণযোগ্যতার দাবিতে ভাষায় আঞ্চলিকতা আসবে এ তো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এখন কুবের যদি বলে, 'না, শরীরটা খুব একটা ভালো ঠেকছে না হে, পদ্মায় আজ ইলিশ ধরতে যাবো না' তখন এই চরিত্রের গ্রহণযোগ্যতা পাঠকের কাছে কতটুকু হবে তা নিশ্চয় অনুমেয়। কিন্তু এখানে লেখক যিনি উত্তমপুরুষ তিনি যখন সাহিত্যে তাঁর লেখায় ঘটনার বর্ণনা করবেন তখন সে বর্ণনা কোন ভাষায় হবে? লেখক যে ভাষায় কথা বলেন অর্থাৎ ঢাকা, রংপুর, নোয়াখালী, সিলেট, বরিশাল ইত্যাদির নাকি সে ভাষাটি হবে প্রমিত বাংলায়?

এবার টিভি, রেডিও অথবা সংবাদপত্রের কথা ধরা যাক। ইদানিং অনেকেই খুব জোর দাবি করছেন যে মুখের ভাষায় পত্রিকার সম্পাদকীয় অথবা টিভির টক শো হলে অসুবিধা কোথায়? জানি আমার মত অনেকেই এ ধরনের প্রস্তাব শুনে তাঁদের ভ্রু কুচকাবেন। হয়ত বলবেন, "মুখের ভাষায় সংবাদপত্রপাঠ অথবা আঞ্চলিক ভাষায় কোনো সম্পাদকীয় লেখার কথা কি ভাবা যায়?" এখন আবহাওয়া রিপোর্টার যদি বলেন যে, "ঘুর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হইছে। বাড়ি-ঘর, গাছপালা সব ভাইঙ্গা ফালাইছে" তখন এই ভাষার মান আমাদের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে কি? ফেকরাটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। যেহেতু মিডিয়া কখনও কোনো অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে না সেখানে সার্বজনীন ভাবে গ্রহণযোগ্য প্রমিত ভাষার ব্যবহারই কাম্য নয় কি?

আমেরিকার বিভিন্ন টিভি চ্যনেলে টক'শো গুলো প্রায়ই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অনেক কৌতুক-বিদ্রূপ করতে পছন্দ করে। এখানকার সাউদার্ন অ্যাকসেন্ট নিয়ে মানুষ এখনও ঠাট্টা-মশকরা করে। কিন্তু বিদগ্ধ কোনো আলোচনায়, নিউইয়র্ক টাইমস অথবা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর কোনো প্রবন্ধে, কোনো গবেষণার থিসিসে আমেরিকানরা মুখের ভাষায় সে কম্মটি করে ফেলবেন তা রীতিমত অকল্পনীয়। মুখের ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষা আমাদের থাকবেই এবং শুধুমাত্র চরিত্রের প্রয়োজনে মুখের ভাষা যদি সাহিত্যে স্থান পায় তাতে আপত্তির কিছুই নেই। সাহিত্যে চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে আর এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু কোনো ঘটনার বর্ণনায় লেখক যখন পাঠককে তার শিল্পিত জগতের দিকে টেনে নিয়ে যাবেন তখন সেখানে অযাচিত ভাবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এবং শিল্পসম্মত তা অবশ্যই ভাববার বিষয়।

জানুয়ারি ১৪, ২০০৮
adnansyed1@gmail.com

::

৭. আইরিন সুলতানা

সব লেখকের রচনাশৈলী এক নয়। তেমনি সব পাঠকও সমানভাবে একটি লেখানীর স্বাদ নিতে সক্ষম নয়। এটা হতে পারে পাঠকের নিজস্ব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, কিম্বা রসবোধের ভিন্নতা।

সাহিত্য কখনই কোনো একটি বিশেষ শ্রেণীকেই প্রকাশ করে না। শ্রেণীগত পার্থক্যে ভাষার ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। ঘটনার বাস্তবিক বর্ণনায় তাতে অবধারিত ভাবেই কথ্যভাষার প্রকাশ আসবে। সেটাতে সাহিত্যকে এক ভিন্ন মাত্রাতেই অলঙ্কৃত করা হয়। যা পাঠক দ্বারাই সমাদৃত হবে। অভিধানগত ভাষার অধিক ব্যবহার ক্ষেত্রবিশেষে, পাঠক বুঝে, হয়তো বা গুরুচণ্ডালী হিসেবে আদৃত হতে পারে।

যুগের পরিবর্তনে ভাষার ব্যবহার পাল্টাচ্ছে। রবীন্দ্র-নজরুল আজো তেমনি সমাদৃত হলেও বর্তমান সাহিত্যিকদের কাছ থেকে ভাষার সেই রকম ব্যবহারের দাবি কিন্তু উঠছে না পাঠকদের কাছ থেকে। কিম্বা লেখকরাই বা কতটুকু আগ্রহী? স্বভাবতই সবাই নিজের স্বাক্ষর রাখতে চান যুপোযোগীতায়।

স্বাভাবিক/কাল্পনিক জীবনের কাহিনীগুলো যখন সাহিত্যরূপে প্রকাশ পায় তখন হয়ত তাতে কিছু এদিক-সেদিক হয় — লেখনীভেদে, বলা ভাল লেখকভেদে। সূক্ষ কিছু রীতি মেনে একটি সাহিত্য রচিত হয় ঠিকই কিন্তু তাই বলে সাহিত্যকে পুরোদস্তর নিয়মের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলাটা হবে একেবারেই অনুচিত। তাহলে ওটা অন্তঃসারশূন্য গবেষণা রির্পোট হয়ে যাবে বড়জোর।

পরিশেষে, এরকম উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। প্রযুক্তির এই সময়োপযোগী ব্যবহার বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক সাহিত্যসভায় নবরূপে উচ্চারিত করবে।

অক্টোবর ২৯, ২০০৭

::

৬. চয়ন খায়রুল হাবিব

ক. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ… আঞ্চলিক, কথ্য, শুদ্ধ, অশুদ্ধ তর্কের উর্ধ্বে মিথে পরিণত হয়।

খ. রবীন্দ্রনাথ কি কোলকাতার ভাষায় লিখতেন? সন্দেহাতীতভাবে না। অন্যান্য কোলকাতাবাসীর মত ঠাকুরবাড়ির লোকদেরও দন্ত্য স, তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ উচ্চারণে সমস্যা ছিল। কবিগুরুকেও নিজের সাহিত্য ভাষাকে কথ্যভাষার অকথ্য উচ্চারণ রীতি থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি মান তৈরি করতে হয়েছিল। মাইকেলও কোলকাতার ভাষায় না লিখে মিশনারি বাংলায় মহাকাব্য লিখতে ব্রতী হন। তবে রবীন্দ্রভাষাই মানভাষা হিশেবে চালু হয়ে যায়।

গ. মুজতবা আলী সিলেটের ভাষায় বা জীবনানন্দ বরিশালের ভাষায় লিখলে ওদের সাহিত্যের কী পরিণতি হতো বলা মুশকিল।

ঘ. ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় ঢাকা ও কোলকাতার কজন কবির সাথে পরিচয় হয়েছিল। বেশ ফাটাফাটি হাসাহাসির ভেতর কোলকাতার কবিদের নিজেদের কবিতার স, শ, ষ-গুলো উচ্চারণ করতে বললে তিনজনই ফেল মারলেন।

ঙ. মারুফ রায়হান সম্পাদিত এক পত্রিকায় গোলাম মুরশিদ আক্ষেপ করছেন যে কোলকাতা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ও ঢাকা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলার দূরত্ব তৈরি হলে আমরা ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হব। যে কেন্দ্রিকতা কখনো তৈরি হয়নি তাকে নিয়ে নস্টালজিয়া অর্থহীন। আরেকটি নতুন কেন্দ্রিকতা হবে ওয়েব-কেন্দ্রিকতা।

চ. কিশোরগঞ্জ থেকে আসা নীরদ চৌধুরী থেকে আবিদ আজাদ, আলতাফ হোসেন, কাজল শাহনেওয়াজের ভাষায় যে বিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে মজার লেখা হতে পারে।

লন্ডন, অক্টোবর ২৭, ২০০৭
choygypsy@yahoo.com

::

৫. অবনি অনার্য

লেখার ভাষা এবং সাহিত্যের ভাষাকে 'বা' দিয়ে আলাদা করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, সে বিতর্কে আমি যেতে চাই না। সাহিত্যের ভাষা নিয়ে যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পের 'শিল্পগুণ' বিচারের 'সাধারণ' কোনো মাপকাঠি যেহেতু নাই, থাকা সন্তবও নয়, কেননা শিল্পের বস্তগত পরিমাপ সম্ভব নয় (ধরে নেয়া যায়, 'সাধারণ' মাপকাঠি না থাকলেও, 'অসাধারণ' মাপকাঠি নিশ্চয়ই আছে), এবং শিল্প যেহেতু চূড়ান্ত বিচারে পারসেপশন-এর (এটাকেই 'অসাধারণ মাপকাঠি' ধরে নেয়া যায়) বিষয়, অতএব শিল্পের টার্গেট অডিয়েন্স/রিডার/ভিউয়ার-এর সঙ্গে যোগাযোগ-মাধ্যম-কৌশল-মাত্রার সম্পর্ক নিবিড়। বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার্য একটা 'মানভাষা'র চল আছে, সেটা থাকা দোষের কিছু না। কিন্তু, সেটা অমান্য করাও দোষের কিছু না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে সেটা জরুরি (পতিতালয়ের একজন দেহজীবীর মুখে আমরা নিশ্চই 'হে আগন্তুক, তোমার গাত্র হইতে বমন-উদ্রেককারী দুর্গন্ধ নির্গত হইতেছে, স্নানকার্য সম্পাদন-পূর্বক আমাতে গমণ কর' এই বাক্য প্রত্যাশা করি না।) শুধু তা-ই নয়, সাহিত্যে মুখের ভাষার কুশলী ব্যবহার সাহিত্যকে শিল্পোত্তীর্ণ করে। সাহিত্যে কথ্য/মুখের ভাষার ব্যবহার নিয়ে নাক-সিঁটকানোর একটা প্রবণতা আছে, এ-প্রবণতা আসলে বিশুদ্ধবাদী/কুমারীবাদী। কিন্তু ভাষা নিত্য-পরিবর্তনশীল, গতিশীল — এখানেও ভাঙা-গড়ার খেলা চলে।

পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের বাধা হিসাবে কথ্যভাষাকে দেখ হয়। একই ভাবে এই ইংরেজি/ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি ভাষার বিপরীতে বাংলা ও অন্যান্য অ-আন্তর্জাতিক ভাষায় সাহিত্য রচনাও পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা। তাহলে কি বাংলাসহ অন্যান্য অ-আন্তর্জাতিক ভাষায় সাহিত্য রচনা করা উচিত নয়!

তারপরেও, পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, অতএব শিল্পস্রষ্টা নিজেই আসলে ঠিক করবেন তাঁর টার্গেট অডিয়েন্স/রিডার কারা, এবং একমাত্র তিনিই ঠিক করবেন তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির ভাষিক মাধ্যম।

কিন্তু শিল্পমান নির্ধারণ করবেন কে? সাধারণ পাঠক না অ-সাধারণ পাঠক (পুরস্কারের স্পন্সর এবং কর্পোরেট শিল্প-সাহিত্যসেবী বিচারকগণ)? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে।

ঢাকা, অক্টোবর ২৭, ২০০৭
aunarjo@gmail.com

::

৪. নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (১)

বৈঠকের বিষয়টি আমার কাছে জুইতের মনে হইলো না।

লেখার ভাষা বা সাহিত্যের ভাষায় = লেখার ভাষা যদি হয় ব্যবসায়িক পত্রযোগাযোগ কিংবা চাকুরির আবেদনপত্র তাইলে সেইটার শিল্পগুণ অক্ষুন্ন রাখা না রাখা কোনো গুরুত্বগূর্ণ বিষয় না, বিষয় হইলো উদ্দেশ্যে সাধন।

কিন্তু এখানে একটি 'বা' লাগিয়ে দেয়া হইলো, যাতে করে মনে হইলো যে সাহিত্য রচনার বিষয় হিসাবেই লেখার ভাষার কথা ইঙ্গিত করা হইছে। তাইলে এইটা ধইরা নিয়াই পরের ধাপে যাই।

শিল্পগুণ নষ্ট করে বা করে না, তার আগে বিচারের বিষয় হইলো সেই শিল্পগুণ মাপনের ইউনিট কী? আমার জানামতে তেমন কোনো ইউনিট বাইর হয় নাই।

গুহাযুগে যে ছবি আকাঁ হইছে পাথরের দেয়ালে তার চাইতে ভালো কইরা মানুষ বা গরুছাগল আঁকতে পারবে আইজকার প্রাইমারি পড়ুয়া ছোট বাচ্চাটাও। কিন্তু গুহাযুগের সেই ছবিরে আমরা শিল্প হিসাবেই গণ্য করি। এর গুণাগুণ চারুকলার ডিগ্রী দিয়া মাপা হয় না।

শিল্পের প্রকাশ শিল্পীর ইচ্ছাধীন। আমার ইচ্ছা হইলো আমার লেখাটি প্রকাশ হউক, আমি হুমায়ূন আহমেদের মতো সহজ ভাষায় লেখলাম, আবার আরেকজনের প্রকশভঙ্গি আরেক ধরনের, সে লেখলো পিঞ্জরে বসিয়া শূক। কেউ কারো গুণাগুণ নষ্ট করে না।

শিল্পগুণ নিয়া আলোচনার আগে তাই শিল্পের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ কইরা দিলে ভালো হইতো। যাউক, আমার কথা হইলো গিয়া, কেউ যদি উপভোগ্য ভঙ্গিতে গালাগালি লিখে, তাইলে আমি তারেও শিল্প কইতে পিছপা হইবো না। সেই শিল্প বিচারে সে কোন ভাষায় লিখলো, সেইটা কোনো বিষয় না।

অক্টোবর ২৬, ২০০৭

::

৩. সাঈদ জুবেরী

"লেখার ভাষা বা সাহিত্যের ভাষায় মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষার মিশ্রণ রচনার শিল্পগুণ নষ্ট করে।"

লেখার ভাষা কি সাহিত্যের ভাষা?

মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষার মিশ্রণ রচনার শিল্পগুণ নষ্ট করে কি করে না তা সম্ভবত লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তি, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং প্রকাশ দক্ষতা, লেখার বিষয় নির্বাচন, নির্বাচিত বিষয়ের সম্ভাব্য পাঠকগোষ্ঠির ভাষিক অভ্যাসের উপর অনেকটা নির্ভর করে । যখনই কোনো রচনার শিল্পগুণ নিয়ে ভাবি তখন পাঠক হিসেবে আমার অভ্যাস, দার্শনিক বিশ্বাস ও রাজনৈতিক অবস্থান একে প্রভাবিত করে বলে মনে করি । এসব বিষয়াদির পাঠক-ভেদে রকমফের ঘটে । এ রকমফেরের মাত্রা নির্ভর করে স্থান-কালের মাঝে নিহিত দূরত্বের উপর । তাছাড়া মৌখিক ভাষার প্রশ্নটি একই নাকি বিভিন্ন ভাষার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে তাও বিবেচনায় রাখা জরুরী। এক্ষেত্রে ভিন্ন ভাষার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলে সৃজনশীল সাহিত্যের অনুবাদ সম্ভব বলে বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে । কোনো অনুদিত সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন স্থানিকতায় এর বিষয়বস্তুর অনুরূপ মিশ্রত ভাষা পাওয়া সম্ভব কি না ভাবতে হবে । মৌখিক বা মিশ্রিত ভাষা বলতে আমরা কোন সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড স্থির করতে পারি কি না, এমন ভাষা ব্যবহার ব্যক্তির ভাষিক স্বভাবকে খর্ব করে কি না এরূপ বিষয়াদি বানের জলের মত ভাবনায় চলে আসে। সবচেয়ে বড় সংশয় হলো আদর্শ বা মান ভাষা বলে কিছু আছে কি না। মান ভাষা ব্যবহারের ভিতর দিয়ে কোনো সাহিত্যকর্ম যোগাযোগের সবর্জনীন স্তরে উন্নীত হয় কি না সে বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে সীদ্ধান্ত গ্রহণও একটা মীথ, অথচ প্রস্তাবটি সেদিকেই প্ররোচিত করে। আবার মৌখিক ভাষা বা মিশ্রিত ভাষা কোনো অঞ্চলের সাথে যতটা অন্তরঙ্গ এবং ভিন্ন অঞ্চলের কাছে ততটাই দূরত্ব সৃষ্টিকারী। এ ধরনের ভাষা বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চোরাটানে ভোগে ও সকল স্থানের পাঠকের সাথে যোগাযোগ যে একটি মানবিক আকাঙ্ক্ষা তার প্রতি একটা অগোচর অবহেলা বজায় রাখে মনে হয় ।

তো, কোনো লেখা যেহেতু লেখককেই (এ ক্ষেত্রে একবচন বিবেচনা করছি, যদিও একটি সাহিত্যকর্মের লেখক বহুজন এমন কি সমাজবাসীও হতে পারে) লিখতে হয়, লেখক তার চেতনা দিয়েই তার বিষয়, স্থান ও পাঠক বিবেচনায় রেখে ভাষা নির্ধারণ করুক এবং সে অনুযায়ী ভাষাভঙ্গি পরিবর্তনের স্বাধীনতা বজায় রাখুক। এতেই রচনার শিল্পগুণ নূন্যতম বজায় থাকার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। আমার এ লেখাটি পড়ার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে বিচরণশীল বাংলাভাষী পাঠকদের একটি অংশের ভাষারূপ আমার লেখার অনুরূপ ভেবেছি এবং সে ভাষায় লেখার চেষ্টা করলাম। কোনো লেখাই আজ আর স্ববিরোধীতা মুক্ত বলে মনে হয় না। তাই এ লেখারও অনন্ত বিরোধিতা সম্ভব।

অক্টোবর ২৬, ২০০৭
matshala@yahoo.com

::

২. ফকির ইলিয়াস

শিল্পগুণ নষ্ট করে, তা আমি বলি না। তবে কথ্য কিংবা আঞ্চলিক ভাষা পাঠক যদি না বোঝেন তবে অসুবিধা হতে পারে। সাহিত্য আপামর মানুষের জন্য। কিন্তু শব্দার্থ না বুঝলে আনন্দ, উপভোগ কোথায়? বিভিন্ন সাহিত্যে কথ্য ভাষার প্রয়োগ আমরা দেখি। আমার কাছে মনে হয় মূল ভাষার পাঠক-পাঠিকা বেশি।

অক্টোবর ২৬, ২০০৭

::

১. শোহেইল মতাহির চৌধুরী

বৈঠকের বিষয়টা আরো সুনির্দিষ্ট করা উচিত ছিল। প্রথমেই বলা ভালো 'বা' দিয়ে লেখা ও সাহিত্যকে আলাদা করে দেখিয়ে ঠিক পার্থক্য বোঝানো যায় না।

সাহিত্যে নানা স্তরের, স্থানের, সময়ের জীবন আসে। তাতে সেই সময়ের মানুষের কথা সংলাপ হিসেবে আসে। সুতরাং সাহিত্যে মুখের কথা থাকবেই, সংলাপ হিসেবে। তা ছাড়া সাহিত্যিক যদি উত্তম পুরুষে রচনা করেন এবং মূল চরিত্রের কথ্যভাষাতেই তিনি বলতে চান তবে পুরো রচনাতেই আমরা কথ্যভাষা দেখবো।

মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষার সংজ্ঞাও দেয়া উচিত এ আলোচনার আগে।

কথ্য ভাষা মানে কি আঞ্চলিক ভাষা? আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে কি জাত-পাতের বিষয় আছে? রাজধানীর আঞ্চলিক ভাষা হলে কি অন্য অঞ্চলের মানুষও সেই ভাষা বুঝতে ও বলতে পারবে?

একটি দেশে কয়টি ভাষা থাকতে পারে? যদি একের বেশি কথ্য ভাষা থাকে তবে জাতীয় মিডিয়াগুলো কোন কথ্য ভাষা ব্যবহার করবে?

কোন ধরনের ভাষা সবার বোধগম্য হবে ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা একটা সমাজ বা দেশের নেতৃত্বে থাকা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নিজেই ঠিক করে নেয়। ভাষা সেইভাবেই বিকশিত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশেও ভাষা একইভাবে এগুচ্ছে। এর উপর জোরজবরদস্তির চেষ্টা কখনো সফল হয়নি, হবেও না।

মুখের ভাষা বলতে আমি বুঝি একরকম অনানুষ্ঠানিক ভাষা। প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা ভাষার যে সহজ রূপ ব্যবহার করি। এটা আলাদা কোনো ভাষা নয়, আঞ্চলিক কোনো ভাষা নয়। তবে লেখালেখির সময় মানুষ যেহেতু তার মুখের অভিব্যক্তি, দেহের ভাষা ব্যবহার করার সুযোগ পায় না, সেহেতু লেখার ভাষায় নানা প্রকাশের নানা ফস্কা গেরোকে শক্ত করতে গিয়ে একটু খটমটে হয়ে যায়। মুখের ভাষায় থাকে সহজ পরিভাষা, অপ্রচলিত শব্দ কম থাকে, বাক্য থাকে ছোট এবং মুখের ভাষার মোট শব্দসংখ্যাও খুব কম । চার থেকে পাঁচশ শব্দ জানা থাকলে একজন লোক মুখে তার মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে।

লিখিত ভাষার ক্ষেত্রে মানুষ পুরো অভিধান তো ব্যবহার করেই প্রতিদিন আরো নতুন নতুন শব্দ আমদানি করতে চায় তার প্রকাশকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্য।

মন্তব্য দীর্ঘ হযে যাচ্ছে। সবশেষে বলতে চাই, আরো অনেকের মতো আমিও মানি, লেখালেখির ভাষা সবসময়ই মানুষের মুখের ভাষার বর্ণনাভঙ্গিকে ধরতে চায়। কারণ সব লেখালেখির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সাথে যোগাযোগ। যে লেখা মানুষের মুখের ভাষার যত বেশি কাছাকাছি সে লেখা তত বেশি অগ্রসর।

(তবে এখানে ভাষা বলতে আঞ্চলিক ভাষা, স্ল্যাং, বা বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভাষা (এলাকা, পেশা, বিত্ত ইত্যাদি কারণ আলাদা আলাদা গোষ্ঠী) বুঝাচ্ছি না। বুঝাচ্ছি লেখক নিজের লেখাকে মুখে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে সহজ অনানুষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করেন।

অক্টোবর ২৬, ২০০৭
shohailmc@aol.com

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: