জাতীয় বাজেট ও উচ্চাভিলাষের অর্থনীতি

আকবর আলি খান
Published : 4 June 2013, 06:32 PM
Updated : 4 June 2013, 06:32 PM

বাজেট সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে বা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে সরকার অত্যন্ত উচ্চভিলাষী একটি বাজেট পেশ করবে। এ উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে যুক্তি হল এ যে, ষষ্ঠ পঞ্চপার্ষিক পরিকল্পনায় যে প্রক্ষাপন করা হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করা।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যে প্রক্ষাপন তার সঙ্গে বাস্তবের বিরাট তফাত রয়েছে। ফলে এ পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাজেট পেশ করা হলে তা কখনও-ই বাস্তবায়িত হবে না। আমাদের আশঙ্কা যে, সরকার যে পরিমাণ সম্পদ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেটা সম্ভবত সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। তার কারণ কয়েকটি।

প্রথম কারণ হল, বর্তমান অর্থবছরে যে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি সেটি সন্তোষজনক নয়। এখানে একটি ঘাটতি থাকার বিরাট আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হল যে, সরকারের হিসেবমতো আমরা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি। মোট জাতীয় উৎপাদনের ওপর রাজস্ব নির্ভর করে। সুতরাং যদি জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণ আশানুরুপ না হয় তাহলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দেবে। তৃতীয় কারণটি হল যে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ সংকট আমাদের রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। আগামী অর্থবছরের প্রথম ছ'মাস পর্যন্ত এ অস্থিরতা থাকবে বলে মনে হয়।

এ প্রেক্ষিতে এবং এর সঙ্গে আগামী অর্থবছরের যে প্রবৃদ্ধি সেটিও অর্জিত হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এর সঙ্গে যেটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যে হিসেব করা হয়েছে তাতে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা নতুন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেটা আদায় হবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে। এ ছয় হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হলে বর্তমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে যেটি রাজনৈতিকভাবে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যথায় নতুন কর আরোপ করতে হবে। আমার মনে হয় না যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার এ ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে।

সুতরাং ছয় হাজার কোটি টাকাও আসবে না। প্রবৃদ্ধির জন্যও ঘাটতি হবে। বর্তমান বছরের ঘাটতিও থাকছে। বৈদেশিক সম্পদের সরকার যে হিসেব করছে তাতেও যেমন জটিলতা দেখা যাচ্ছে তাতে এটা কতটুকু পাওয়া যাবে বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমরা সম্পদের ঘাটতির আশঙ্কা করছি।

সম্পদের ঘাটতি দেখা দিলে অর্থনীতিতে দুটো খারাপ প্রভাব পড়বে। একটি হচ্ছে, সরকার ঘাটতি বাজেট করবে। সেক্ষেত্রে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে চালানোর চেষ্টা করবে। এর কুফল তিনটি। প্রথম কুফল হল, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, সুদের হার বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত বেসরকারি বিনিয়োগের হার কমে যাবে। বেসরকারি বিনিয়োগের হার গত অর্থবছরে এমনিতেই মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখন এ হার আরও কমে গেলে আগামী অর্থবছরে অর্থনৈতিক খাতে জটিলতা বাড়তে পারে।

বড় বাজেট করলে সম্পদের অভাব দেখা দেবে। তখন দেখা যাবে যে প্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থখরচ না করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে খরচ বেশি হচ্ছে। সুতরাং ঋণ করে অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থখরচ করা হলে সেটা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে আমার মনে হয় না।

গত অর্থবছরের বাজেটের মূল্যায়ন করলে বলব, সরকার নিজেই বলছেন যে সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা-সীমাবদ্ধতা ছিল। অবকাঠামোর যে ঘাটতি সেটা সরকার পুরোপুরি মেটাতে পারেনি। প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল সরকার। ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটা প্রায় ৬.০৩ শতাংশ। কেউ কেউ বলছেন যে, এটা ৬ শতাংশের কমও হতে পারে। আশেপাশের অনেক দেশের তুলনায় এ লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি। ভারতে এ হার ৫ শতাংশের মতো। কিন্তু সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেটি তো অর্জিত হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণের ব্যাপারে বলব, আমরা অতি উচ্চাভিলাষী টার্গেট নির্ধারণ করে থাকতে পারি অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের টার্গেট পূরণে বাধা দিচ্ছে।

বর্তমানে রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এটা বাড়ছে অন্য কারণে। আমাদের আমদানি কমে গেছে, বিশেষত মূলধনী দ্রব্য ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করতে চাই তাহলে কিন্তু আমাদের আরও অনেক বেশি রিজার্ভ লাগবে।

এছাড়া ইতোমধ্যে আমরা অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সভরেন গ্যারান্টি দিয়ে সমরাস্ত্র ক্রয় করছি। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়তে যাচ্ছে। সবই আমাদের করা দরকার। তবে এখানে প্রায়োধিকার দিয়ে কোনটি আগে আর কোনটি পরে করব তা ঠিক করা দরকার ছিল। সবকিছু একসঙ্গে করতে গেলে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে।

রিজার্ভ বাড়া অর্থনীতির জন্য খুব ইতিবাচক কিছু হবে না এটা আরও এ কারণে যে, সরকার ইতোমধ্যে অনেক বেশি ঋণ গ্রহণ করে ফেলেছে যাতে আগামী অর্থবছরেই অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ পড়তে পারে।

আরেকটি বিষয় হল, রপ্তানি যে খুব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব হবে তা-ও মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে পোশাক শিল্পে যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে তাতে আমরা খুব একটা আশান্বিত নই। পোশাক শিল্পে রপ্তানির পরিমাণ না কমলেও বাড়বে না এটা ঠিক। কিন্তু এ ঘটনাগুলোর ফলে রপ্তানিবৃদ্ধির হার কমে যাবে। আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হলে রপ্তানি-প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

সেটা করতে হলে প্রথম কথা হল, সময় লাগবে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে দেখাতে হবে যে, সমস্ত আইনকানুন ঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। তা না হলে বাইরের বাজারে আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

রেমিট্যান্স কতটুকু বাড়ানো যাবে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হতে হতে এমন একটি অবস্থায় এসেছে যে মোট উৎপাদন বেড়ে গেছে। মোট উৎপাদন বেড়ে গেলে বড় ভিত্তির ওপর বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়ে। নির্মাণ খাতে কতগুলো সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে এ খাতে বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহের সমস্যা দূর করতে না পারলে প্রবৃদ্ধিও অনিশ্চিত থাকবে।

বিদ্যুত সম্পর্কে আমার কয়েকটি বক্তব্য রয়েছে। প্রথমত, লোডশেডিং কিছু কমলেও যেভাবে আমরা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছি তাতে কয়েকটি মারাত্মক প্রতিকূলতা রয়েছে। একটি হল, আমরা এখনও রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের ওপর নির্ভরশীল। এর ওপর দীর্ঘসময় ধরে নির্ভরশীল হওয়ায় আমাদের বিদ্যুতের খরচ বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, গত চার বছরে আমরা কিন্তু খুব কম বড় বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে পেরেছি। একদিকে আমরা নতুন কেন্দ্র বাড়াচ্ছি না, অন্যদিকে আমরা বর্তমানে যেগুলো আছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গ্যাসের অভাবে চালানো যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, বর্তমানে দেশে তীব্র জ্বালানি সংকট বিরাজ করছে। আমরা যদি গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে না পারি এবং কয়লার ব্যবহার শুরু করতে না পারি তাহলে জ্বালানি সংকটের ফলে বিদ্যুতের সংকট আরও বাড়বে।

আমরা কিন্তু গত চার বছরে কয়লা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আমাদের কয়লা ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, পরিবেশের জন্য সেটি যাতে সহনীয় হয় তা দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ অবশ্যই করতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের যে পরিস্থিতি তাতে বিদেশ থেকে জ্বালানি কিনে অর্থনীতিকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে সেটি একটি প্রশ্ন বটে। ওদিকে গ্যাস খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে সরবরাহ বাড়বে না্

সরকারের মাথায় অবশ্যই আগামী নির্বাচন। তাই এর বাইরে অন্য কিানো কিছু বিবেচনায় নেওয়া একটি রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অসম্ভব। আমরা মনে করি, বাজেট অবশ্যই এমন হতে হবে যেটি বাস্তব, যেটি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হল, উচ্চাভিলাষী চিন্তা থেকেই বাজেট তৈরি করা হলে তা অর্থনীতির জন্য সমস্যা তৈরি করবে।

ড. আকবর আলী খান : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।