ক্রিকেটে জুয়া যেন চাঁদের গায়ে কলঙ্ক

ফখরুজ্জামান চৌধুরী
Published : 2 June 2013, 09:25 AM
Updated : 2 June 2013, 09:25 AM

খুব ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসার আকর্ষণে এমন অনেক কাজ করেছি যা মনে হয় করা উচিত হয়নি। তবু কোনো খেদ নেই। কারণ আবিবেচনাপ্রসূত কিছু যদি করে থাকি, তা করেছি এমন এক খেলার জন্য যা নিখাদ 'ভদ্রলোকের খেলা'। যার নাম ক্রিকেট।

ইংরেজ-আবিষ্কৃত অলস-অবকাশে জীবন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার তাগিদে ইংরেজ লর্ড-ব্যারনরা এ খেলার প্রবর্তন করেন এবং কালক্রমে যার সদর দফতরটির নামকরণও হয় লর্ডস। ইংরেজরা ক্রিকেটে এমনই আচ্ছন্ন যে, কোনো কাজ মনঃপূত না হলে তারা বলেন, 'দিস ইজ নট ক্রিকেট'! যদিও বাংলা অভিধানে ইংরেজি এ শব্দের (ক্রিকেট) প্রতিশব্দ হল একশ্রেণির পোকা- 'গুবরে পোকা'।

একদা যা ছিল বিনোদনের মাধ্যম আজ তা বিশাল বাণিজ্যের ক্ষেত্র। রীতিমতো বৈশ্বিক বাণিজ্য। রক্ষণশীল, নাকউঁচু জাত হিসেবে ইংরেজদের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। তারা চেয়েছিল তাদের উদ্ভাবিত খেলাটি সীমিত থাক তাদের গোত্র, বর্ণের মানুষদের মধ্যে।

তাই তারা তাদের আয়ত্তাধীন সাম্রাজ্যের শ্বেতবর্ণ কলোনিতে ক্রিকেটের প্রথম বিস্তার অনুমোদন করে। ক্রিকেট খেলা প্রচলিত হল অস্ট্রেলিয়ায়- ইংরেজদের অন্যতম সেরা কলোনি যেটি। অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেটের প্রসার ঘটল আরও পরে, এর আগে এল বর্ণবাদে জর্জরিত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়।

দক্ষিণ আফ্রিকা তার দলে জায়গা দিল শুধু শ্বেতবর্ণের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের। একদা কুখ্যাত বর্ণবাদী নীতি 'অ্যাপার্থেইড-এর যাঁতাকলে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হতে থাকল বছরের পর বছর। এর অবসানে নেলসন ম্যান্ডেলার অহিংসনীতির কথা আজ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়।

বর্ণবাদী নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বহুকাল নিষিদ্ধ থাকার পর গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মূলধারার ক্রিকেটে পুনর্বাসিত হল। এ সব এখন ইতিহাসের বিষয়। যেমন ইতিহাস বর্তমান বিশ্বক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল', পূর্বে ছিল 'ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স'- আইসিসি'র সংক্ষিপ্ত নাম যদিও এখনকার মতোই।

ওয়েস্ট ইন্টিজের ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্তি এবং অচিরেই পরাশক্তি হয়ে ওঠা ভালো চোখে দেখেননি শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেট খেলোয়াড় আর তাদের নিয়ামক সংস্থাসমূহ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ভেতরেও বর্ণবাদ ছিল উচ্চকণ্ঠ। ক্যাপ্টেন করা হত শ্বেতাঙ্গদের, দলে যোগ্য কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় থাকা সত্বেও। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগ গেছে। দুর্ধর্ষ এমন সব খেলোয়াড়কে একই সময় দলভুক্ত হতে দেখা গেছে যা আজকের দিনের ক্রিকেটদর্শকরা কল্পনাও করতে পারেন না।

মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা প্রতিনিয়ত স্লেজিং আর বুলশিটিং-এর শিকার হতেন। সঙ্গে যুক্ত হত ভুল আম্পায়ারিং যা অবধারিতভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যেত।

একটি ঘটনার উল্লেখ এখানে না করে পারছি না। ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন সম্পর্কিত এক কোর্সে অংশগ্রহণকালে ইনস্টিটিউট কর্তৃকপক্ষের সৌজন্যে র‌্যান্ডউইকে বিখ্যাত সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড দেখার সুযোগ হয়েছিল।

সময়টা ছিল শীতকাল, আর ক্রিকেটের জন্য অমৌসুম। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের কিউরেটর কেন মাজ আমাকে যখন মাঠের ভেতর নিয়ে গেলেন, চোখে পানি এসে গেল। এ কী দশা কুলীন এসসিজি'র! মাঠের মাঝখানটায় পিচটুকু বাঁচিয়ে বাকি পুরো অংশ যেন ধানক্ষেত!

কেন মাজ বললেন, 'অফ সিজন, তাই রাগবি খেলার আয়োজন করা হয়। শীতের বৃষ্টি আর খেলোয়াড়দের দাপাদাপিতে এ দশা।' বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ধারাভাষ্যকারদের বক্স দেখা শেষে যখন প্লেয়ারস লাউঞ্জে এলাম, বিশ্মিত হলাম বিশাল প্রবেশ দরজাটি ভাঙা দেখে।

আরও অবাক হলাম কেন মাজের সহাস্য মুখে তার কারণ জেনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড অন্যায্যভাবে আউট হয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে প্যাভিলিয়নের কাঠের দরজায় লাথি মেরে পাল্লা নেড়ে দিয়েছিলেন। এসসিজি কর্তৃপক্ষ স্মারক হিসেবে ভাঙা দরজা রাখলেও আসলে তা বর্ণবাদের স্মারক হয়েই আছে।

এরপর এল ক্রিকেট খেলায় 'কালোটাকার' কৃষ্ণ অধ্যায়। প্রথম দুর্নীতির শিকার মাঠে-বাইরে নিপাট ভদ্রলোক দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যানসি ক্রোনিয়ে। উপমহাদেশে সাজা পেলেন ভারতের অধিনায়ক মার্জিত রুচির আজহারউদ্দীন আর পাকিস্তানের সেলিম মালিক। পরে বিমান দুর্ঘটনায় ক্রোনিয়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে ক্রিকেটজগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই হ্যানসকে পুরোপুরি অপরাধী ভাবতে ইতস্তত করতেন।

ক্রিকেটে ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের সর্বশেষ ঘটনায় ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফররত পাকিস্তান দলের পুরো ভিত্তি নড়ে যায়। অধুনালুপ্ত ট্যাবলয়েড নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর আড়িপাতা রিপোর্টিং-এর শিকার হয়ে ক্রিকেট থেকে শুধু নির্বাসিত হলেন না অধিনায়ক সালমান বাট, ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আসিফ এবং আমির- ওরা জেল খাটলেন, জরিমানাও গুণলেন।

ক্রিকেটের এ কেলেঙ্কারি আমিরের মতো একটি সম্ভাবনাময় তরুণের ক্যারিয়ারে যবনিকা টেনে দিল। ১৯ বছর বয়সী এ ফাস্ট বোলারের অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল। অনেক বছর পর বল সুইংয়ে এমন যাদুকরি কাজ দেখা গেল। কিন্তু বাজিকরের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল পিচে সুইং বলের আলো ছড়াতে আসা তরুণ বোলার।

ক্রিকেট-অ্যাস্টাবলিস্টমেন্ট আয়োজিত সনাতন ক্রিকেট ম্যাচে যখন জুয়াড়িরা পেছন থেকে জাল বিস্তার করতে পারে কড়া নজরদারি সত্বেও, তখন রঙিন ঝলমলে সংক্ষিপ্ত ভার্সনের রাত্রিকালীন টি-২০ ম্যাচে কী অবস্থা হতে পারে তা ভেবে শঙ্কিত হয়ে আমরা লিখেছিলাম, 'ভারতে যখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলার আসর বসে, বুঝতে বাকি থাকে না কেলেঙ্কারি দুয়ারে সমাগত'। হলও তাই। এখন কতিপয় খেলোয়াড় আর আয়োজক তদন্তকারীর স্ক্যানারের নিচে।

আইপিএলের অনুকরণে যখন বাংলাদেশে বিপিএল চালু হল, আমরা ঢোক গিললাম। প্রথম আসর, এখন পর্যন্ত একমাত্র আসর। বসল, শেষও হল। আমরা শঙ্কা জানিয়ে লিখলাম, 'বিপিএল আনাড়িপনার আসর' (বিডিনিউজ ২৪.কম, মার্চ ২, ২০১২)। জুয়া আর অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠা ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। মেয়াদি বোমাটি ফুটল। কতিপয় হাল ও অতীতের খেলোয়াড়ের নামে বাতাসে ভেসে এল ম্যাচ ফিক্সিং-এর অভিযোগ।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অর্জন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু সততার সৌরভটি ছিল। বর্তমান সংকটে আমাদের প্রার্থনা- যেন অভিযোগগুলো ভুল প্রমাণিত হয়- যেন প্রকৃত দোষীই শাস্তি পায়- নিরাপরাধ কারও গায়ে সামান্য টোকাও না লাগে।

আর ক্রিকেট ফিরে পাক তার আগের বৈভব ও উজ্জ্বল্য।

ফখরুজ্জামান চৌধুরী : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।