শ্রম আইন : যতটা না শ্রমিকের তার চেয়ে বেশি মালিকের

মনজুরুল আহসান খান
Published : 1 June 2013, 06:28 AM
Updated : 1 June 2013, 06:28 AM

২৪ এপ্রিল সাভারে ৬টি গার্মেন্ট কারখানাসহ রানা প্লাজার ভবন ধসে ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিশেষত ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের অবস্থা, নিরাপত্তা, জীবনমান ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

একজন শ্রমিকের কর্মস্থলের নিরাপত্তা, চাকরির নিরাপত্তা, মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যাপার, মজুরি, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ইত্যাদি দেশের শ্রম আইনের সঙ্গে জড়িত।
শুধুমাত্র গার্মেন্ট সেক্টরেই একের পর এক ভবনধস, আগুন, পদপিষ্ট হয়ে হাজারো শ্রমিকের মৃত্যু বাংলাদেশের মালিকপক্ষ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের দুঃশাসন, ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা, আইনলঙ্ঘনের তোঘলোকী সংস্কৃতি রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতাকেই দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

গার্মেন্ট শিল্পে দুর্ঘটনা, অরাজক পরিস্থিতি এবং শ্রমিক-অসন্তোষ বারবার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, আইএলও সনদ ও উপযুক্ত শ্রম আইনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। দেশে এবং বিশেষত বিদেশে প্রবল জনমত, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন এবং ক্রেতাদের চাপের মুখে সরকার ঘোষণা করছে যে সম্প্রতি শ্রমিকদের পক্ষে শ্রম আইনের কিছু সংশোধন করা হচ্ছে। ২২ এপ্রিল এবং ১৩ মে মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর দুই দফায় ঘোষণা করা হয় যে সরকার শ্রম আইন ২০০৬-এর কতিপয় সংশোধনীর ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মন্ত্রীসভার বৈঠকের মুখপাত্র কয়েকটি সংশোধনী সম্পর্কে সাধারণভাবে উল্লেখ করেন। গ্রুপ বীমা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্লিনিক, গ্র্যাচুয়িটি, ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সরাসরি মজুরি প্রদান, মুনাফার অংশ ও কল্যাণ তহবিল, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইউনিয়ন এবং এনজিও-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সংশোধনীসহ বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধনী) আইন ২০১৩ প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকার তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে কোনো শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আগে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করেনি। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সংশোধনীর মাধ্যমে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য মালিকপক্ষের পূর্ব অনুমতির বিধান বাতিল করা হয়েছে। দেশে-বিদেশে পত্র-পত্রিকায় এ খবর বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।

গার্মেন্ট সেক্টরে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন সরকার ও সংস্থার পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাজরীন এবং রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন মহল থেকে এ চাপ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্ট মালিকরা ওইসব দেশের চাপ উপেক্ষা করতে পারে না। মনে হয় বিদেশি 'বন্ধু'দের খুশি করার জন্যই সরকার ওই ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে।

রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টের একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য কর্মস্থলের নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা, শ্রম আইনসহ বিভিন্ন আইন বাস্তবায়নে ব্যর্থতার সমালোচনা করা হলেও 'মালিকদের পূর্ব অনুমতি ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার' দিয়ে শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগে 'স্বাগত' জানানো হয়।

বস্তুত ২০০৬ সালের শ্রম আইনে গার্মেন্টে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার স্বীকৃত আছে। ১৯৬৯, ১৯৬৫ বা ১৯২৬ সনেও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ছিল। কাজেই শ্রম (সংশোধনী) আইন ২০১৩-এর মাধ্যমে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নতুন করে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

শ্রম আইন ২০০৬ এ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার জন্য মালিকদের পূর্ব অনুমতি নেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। ১৭৮ (৩) ধারায় বলা আছে যে শ্রমিক ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশনের জন্য যে দরখাস্ত শ্রম পরিচালকের কাছে দেওয়া হবে 'উহার একটি কপি (ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের তালিকাসহ) সংশ্লিষ্ট মালিককে তাহার অবগতির জন্য অবিলম্বে প্রেরণ করিবেন।'

ধারাটি বাতিল করে সংশোধনীতে '…….. আবেদনকারীর খরচে উহার একটি কপি কর্মকর্তাদের তালিকাসহ গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করিবেন' এ মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। যারা তৃণমূলে ট্রেড ইউনিয়ন করেন তারা জানেন শ্রমিকদের সাধারণ সভা করার সময় তো বটেই, তার আগেই যারা ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেন তাদের সম্পর্কে মালিকপক্ষ জেনে ফেলেন। মালিককে কপি দেওয়ার অর্থ তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো মাত্র।

এখন যে গণবিজ্ঞপ্তির কথা বলা হয়েছে তাতেও মালিকপক্ষ এটা জানতে পারবে। বিধানটি করা হয়েছিল, কারণ রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আবেদনকারী ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মালিকদের কোনো ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মালিকপক্ষ যাতে এ কথা বলতে না পারে যে কারা ইউনিয়নের কর্মকর্তা তা তারা জানতেন না বা মালিকের পদক্ষেপকে অবৈধ প্রতিপন্ন করার জন্যই সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের ইউনিয়নের কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করা হয়েছে।

২০০৬ সনের আইনের ১৮৬ (১) এবং (২) ধারা অনুসারে রেজিষ্ট্রেশনের জন্য দরখাস্ত 'অনিষ্পন্ন থাকাকালে শ্রম পরিচালকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া উক্ত ইউনিয়নের কোনো কর্মকর্তার অসুবিধা হয় এইরূপভাবে তাহার দরখাস্ত পূর্ব চাকরির শর্তাবলীর কোনো পরিবর্তন করিবে না।' এছাড়াও ২৬ ধারাতে যা কিছু থাকুক না কেন 'উক্ত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য এরূপ কোনো শ্রমিকের চাকরি উক্ত ধারার অধীনে অবসান করিতে পারিবে না।'

মূল সমস্যা হচ্ছে গার্মেন্ট সেক্টরে বাস্তবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ, সরকার, শ্রম দফতর ও প্রশাসনের একটা যোগসাজস আছে। মালিক এবং সরকারপক্ষ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার-সংক্রান্ত কোনো আইন মানতে রাজি নয়। কারখানায় ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার খবর পাওয়ামাত্র শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়, গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়, মিথ্যা মামলা দায়ের বা গ্রেফতার করা হয়, এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় অথবা গুম করে দেওয়া হয়।

এরকম হাজারো ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলেছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আইনে আছে, বাস্তবে নেই। কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই।

এরপরও গার্মেন্টে যেসব ইউনিয়ন রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে দেখা যাবে সেগুলোর একটি বড় অংশই মালিকের পকেট বা দালাল ইউনিয়ন অথবা সরকারি দলের ইউনিয়ন। শুধু গার্মেন্ট সেক্টরে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকার, মালিকপক্ষ বা বিদেশি শক্তির সঙ্গে 'লাইন' না করে বা তাদের মদদ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দেশে আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় শাসনের প্রাধান্য এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

গ্রুপবীমা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি কিছু অস্পষ্ট বিষয় ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীর বেশিরভাগই শ্রমিকস্বার্থবিরোধী। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে যেসব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করা হয়েছিল তা মানা হয়নি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। মালিকপক্ষের প্ররোচনায় শ্রমিকস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন সংশোধনী আনা হয়েছে।

১(৪) ধারা বাতিল করে ক্ষেতমজুর বা কৃষিশ্রমিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক, গৃহকর্মীদের শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়নি। এ সম্পর্কে অতীতে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছাড়াও কতিপয় বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ও ছিল।

বাংলাদেশে এবং বহির্বিশ্বে শ্রমিকদের আইন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য 'আউটসোর্সিং' এখন একটি বড় কৌশল। ৪(১১) ধারায় সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে সঙ্গে একটি রাইডার ক্লজ জুড়ে দিয়ে সংশোধনীটি মূল্যহীন করে ফেলা হয়েছে।

ধারা ১৮০(খ) তে উল্লেখ আছে ' যে প্রতিষ্ঠানেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা হইয়াছে, সে প্রতিষ্ঠানে তিনি শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত বা কর্মরত না থাকেন।' তাহা হইলে তিনি '….. ইউনিয়নের কর্মকর্তা ও সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না………।'

বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় কোনো শ্রমিক চাকরিচ্যুত হলে তিনি ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা থাকতে পারবেন না। মালিকপক্ষ সাধারণত কেউ ইউনিয়নের নেতা হয়েছে জানতে পারলেই চাকরিচ্যুত করে। তখন সে আর ইউনিয়নের নেতা বা সদস্য থাকতে পারে না। তার মানে তখন ইউনিয়নে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে। এরপর তাকেও যখন চাকরিচ্যুত করা হবে, তখন আবারও তার শূন্য পদে আর একজনকে নির্বাচিত করতে হবে।

এভাবে মালিকরা কাউকেই কর্মকর্তা বা সদস্য হতে দেবে না, ইউনিয়নও গঠন করা যাবে না। বাস্তবে প্রতিদিনই এমনই ঘটনা ঘটে চলেছে। এ কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের দেশে (অন্যান্য দেশেও) আইন ছিল যে কর্মকর্তাদের একটি অংশ কর্মরত শ্রমিক নয় এমনও হতে পারে। শ্রমিকের সংখ্যা বেশি এমন ট্রেড ইউনিয়ন চালাতে হলে সবসময়ই নেতার প্রয়োজন হয়।

ট্রেড ইউনিয়ন কোনো মুখস্থ সংগঠন নয়। আইএলও সনদ দেশীয় শ্রম আইন, শ্রমনীতি এবং আধুনিক বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়নের সামনে যে কর্তব্য হাজির করেছে তার জন্য দক্ষতা, শ্রম মেধা ও পেশাদারিত্ব প্রয়োজন। এছাড়া প্রাক্তন শ্রমিকদের কর্মকর্তা ও সদস্য হওয়ার সুযোগ ও অতীতের মতো ফিরিয়ে আনাটা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন।

শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা না থাকলে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও প্রয়োগ করা যায় না। কিন্তু এবারের সংশোধনীতে ধারা ৪ এ অসদাচরণের তালিকার মধ্যে 'প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃখল বা দাঙ্গা হাঙ্গামামূলক আচরণ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অন্যের কাজে বাধাপ্রদান ও শৃংখলাহানিকর কোনো কর্ম' অন্তর্ভুক্ত করার ফলে মালিককে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সীমাহীন সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মালিকরা অন্যদের দোষ শ্রমিকের ঘাড়ে চাপিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পাবে।

এছাড়া এ ধারায় চাকরিচ্যুত হলে বিধান অনুসারে শ্রমিকরা গ্র্যাচুইটি পাবে না। একজন শ্রমিক ১০ বা ২০ বছর মালিকের সন্তুষ্টি বিধান করে কাজ করলে প্রতিবছরের জন্য সে সার্ভিস বেনিফিট প্রাপ্য হয়। এটা তার শ্রমেরই অর্জন। ১০ বা ২০ বছর পর শ্রমিকের কোনো কাজে মালিক অসন্তুষ্ট হলে তাকে সে অপরাধের জন্য চাকরিচ্যুত করবে। কিন্তু একই সঙ্গে সন্তুষ্টি বিধান করে এত বছর ধরে সে যে কাজ করেছে, তার বেনিফিট থেকে তাকে বঞ্চিত করবে, এটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

এমনিতে বিদ্যমান শ্রম আইনে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার অনেক বেশি ক্ষমতা মালিককে দেওয়া হয়েছে এসব থেকে বরং শ্রমিককে আরও বেশি আত্মরক্ষার সুযোগ দেওয়া উচিত।

২৭(৩)(খ) ধারাতেও শ্রমিকদের বেনিফিট থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। মালিক শ্রমিককে মুখে চাকরিচ্যুত করে এবং নিরাপত্তারক্ষী এবং গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে শ্রমিককে কারখানায় ঢুকতে না দিয়ে কাগজপত্রে অনুপস্থিতি দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করে। পাকিস্তান আমল থেকে এমনই চলেছে। এখন গার্মেন্টে এটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধারা ২৩২(৩) শ্রমিকদের মুনাফার অংশ প্রদানের ক্ষেত্রে গার্মেন্ট মালিকদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকদের অতিমুনাফার লোভ এবং শ্রমিকদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও দুর্দশা নিয়ে দেশে এবং বিশ্বজুড়ে যে তোলপাড় হচ্ছে তার মধ্যে এ ধরনের সংশোধনী সত্যি বিস্ময়ের ব্যাপার।

নরমপন্থী বলে পরিচিত অনেক সংস্থা এবং সংগঠনের নেতারা তাই অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছেন যে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ প্রভৃতি মালিক সংগঠনের 'ফরমায়েসেই' এবারের সংশোধনী করা হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ক্ষমতার ব্যাপারে অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকে বলেই তার অধিকার সুরক্ষার জন্য শ্রম আইন করা হয়। কিন্তু মনে হয় এখন একে 'মালিক আইনে' পরিণত করা হচ্ছে।

কল্যাণ তহবিল ইত্যাদি নামে যা করা হচ্ছে, তা এখনও অস্পষ্ট। '৮০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি সংস্থার নির্দেশে আমাদের দেশে 'কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস'-এর নামে প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে যে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল, তখন শুধু শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি এবং সার্ভিস বেনিফিট থেকেই অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাই নয়, শ্রমিকদের কোটি কোটি টাকার প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা এবং বেনিফিটের টাকা আত্মসাৎ করা হয়। দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা আমানত খেয়ানতকারীদের কথা ভুলে যায়নি।

শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিকদের যা কিছু সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার আছে তা যেমন সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন, তেমনি শ্রমিকরা যাতে তাদের সুবিধা ও অধিকার আদায় করে নিতে পারে সে জন্য তাদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। শ্রমিক আইনে যে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আছে তা বাস্তবায়নের জন্যও প্রয়োজন শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন। বুর্জোয়া আপোসকামী দুর্নীতিপরায়ণ ও সুবিধাবাদী নেতৃত্ব সে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। তারা বরং আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল করবে।

সুকঠিন লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ১৮৮৬ সনের আমেরিকার শিকাগো শহরসহ সারা দেশের শ্রমিকের সংগ্রামসহ বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শ্রমিকদের অধিকারসমূহ ক্রমান্বয়ে অর্জিত হয়েছে।

আজকে তাই মালিকদের সুবিবেচনা এবং সরকারের সদিচ্ছার উপর ভরসা করে নয়, শ্রমিকদের আত্মশক্তিতে বলিয়ান ও সংগঠিত হয়ে বিপ্লবী ধারায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জানে বিপ্লবী ধারায় সুস্থ গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হবে। সে কারণেই তারা বহুদিন ধরে দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকেও দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্তায়িত করেছে। আমাদের দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেশের রাজনীতিকেও তারা দুর্বৃত্তায়িত করেছে।

একদিকে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়নের উপর বাইরে থেকে ভেতর থেকে আঘাত হানা হয়েছে, আর একদিকে সুবিধাবাদী দালাল নেতৃত্ব ও সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এনজিও ও কিছু আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন ও তাদের দেশীয় শাখাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

বিশ্বপুঁজি যেমন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, দেশি ধান ও কৃষিসহ সবকিছুকে কোণঠাসা করছে ঠিক তেমনি করে আজ দেশীয় রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়নকেও কোণঠাসা ও নিয়ন্ত্রণ করার চক্রান্ত চলছে।

লক্ষ্য করার বিষয় রানা প্লাজার ঘটনার পর বিশ্বপরিসরে তৎপর ইন্ডাষ্ট্রি অল গ্লোবাল ইউনিয়ন, ইউএনআই গ্লোবাল ইউনিয়ন, ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম, ক্লিন ক্লোথ্স ক্যাম্পেইন একজোট হয়ে গার্মেন্ট ক্রেতা (বায়ার), রিটেইলার ব্র্যান্ড কোম্পানি এনজিও এবং বাংলাদেশের কিছু গার্মেন্ট মালিক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ইতোমধ্যে 'আগুন ও দালান নিরাপত্তা সংক্রান্ত' ঐকমত্যে বা অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছে এবং এর জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ইতোমধ্যে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো শ্রমিক বা মালিক সমিতির সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। গোটা ব্যাপারটাই বিদেশি সংগঠন (রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট)-এর উদ্যোগে করা হয়েছে। অবশ্য 'ইন্ডাষ্ট্রি অল' এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার আছে বলে শোনা যায়। তবে সেটি বিদেশি সংস্থারই শাখা।

আমাদের দেশে কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন আছে, ইনস্পেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ আছে, ফায়ার সার্ভিস আছে, রাজউক, পৌর কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং স্থানীয় সরকার আছে। কারখানা কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুরূপ কর্তৃপক্ষ আছে। বাংলাদেশে সে সব রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অকার্যকর করে ফেলা হচ্ছে।

বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কল্যাণের নাম করে নিরাপত্তা বিষয়ক কাজটির উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন ও সংগঠনগুলো ঘোষণা করেছে তারা 'বাংলাদেশের শিল্পে ঐতিহাসিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে'। 'বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শোষিত কিছু শ্রমিকের জীবন ও কর্মক্ষেত্রে উন্নয়ন' সাধন করবে।' অ্যাকর্ডে এ কল্যাণের কথা বলা হলেও এদের আরও কী এজেন্ডা আছে তা স্পষ্ট নয়। তবে এ কথা বলা যায় যে, এসবের মধ্যে দিয়ে গ্লোবাল শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য, হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হবে।

আমাদের দেশে গার্মেন্ট সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়নের উপর বাস্তবে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও কয়েকটি এনজিও ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে তৎপর। সরকার একবার 'সাহস করে' সেসব এনজিও'র রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করলেও আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তারা আবারও রেজিষ্ট্রেশন নিয়েছে। কিছু ট্রেড ইউনিয়ন আছে যারা গ্লোবাল ট্রেড ইউনিয়ন, বিদেশি রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার অর্থানুকূল্যে চলে। এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রম আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৭৬ ধারাতে (গগ) আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক সহযোগিতাসহ সব ধরনের সহযোগিতার বিধান রাখা হয়েছে। এসব থেকে বোঝা কঠিন নয় বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে ঘটনাবলী কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে।

এ ধরনের জটিল বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বাত্মক ধারার মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিক শিল্প ও দেশের স্বার্থ রক্ষা করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক ও সুস্থধারায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণিকেই।

মনজুরুল আহসান খান : উপদেষ্টা, সিপিবি।