তামাকসেবন : নীল বেদনার উপাখ্যান

তাইফুর রহমান
Published : 30 May 2013, 08:30 PM
Updated : 30 May 2013, 08:30 PM

৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে: "তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ হোক"। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর পর এ প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং সবচেয়ে আগে অনুস্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অন্যতম।

তাই এফসিটিসির আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা বাংলাদেশের জন্য ছিল একটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশ সে দায়বদ্ধতা পূরণের চেষ্টা করে ২০০৫ সালে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। কিন্তু 'ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫'-এ অনেকগুলো দুর্বলতা থাকায় আইনটি তামাক নিয়ন্ত্রণে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সে কারণে তামাকবিরোধীরা আইনটি সংশোধনের দাবি করে আসছিলেন এবং সরকার সে দাবি মানতে বাধ্য হন। যদিও সংশোধনীটি তামাকবিরোধীদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতি পারেনি, তথাপি এটিকে তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে গণ্য করা যায়।

প্রতি বছর পৃথিবীতে ৬০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে তামাকের কারণে এবং বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মৃত্যুর এ সংখ্যা ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ৮০ লাখে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে ধূমপানজনিত প্রধান আটটি রোগে প্রতি বছর প্রায় ৫৭ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। তদুপরি ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন তামাকজনিত রোগে। প্রতি বছর যে ১২ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে ভোগেন তাদের চিকিৎসাব্যয় বিপুল।

এ সংখ্যাগুলো ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণায় পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরে এদেশে তামাকসেবনের হার যেভাবে বেড়েছে তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় যে মৃত্যু, অসুস্থতা ও পঙ্গুত্বের উপরোক্ত সংখ্যাগুলো বর্তমানে আরও অনেক বড়। বাংলাদেশে তামাকসেবনের হার বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ কোনো না কোনো তামাকসেবন করেন- ধোঁয়াযুক্ত কিংবা ধোঁয়াবিহীন।

পরোক্ষ ধূমপানের হারও বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ; ৬৩ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। এসব তথ্য বাংলাদেশে তামাকের বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণ দেয়। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ এ খাত থেকে অর্জিত আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

এফসিটিসি সত্যিকার অর্থে একটি বৈশ্বিক চুক্তিকে পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৮৬ দেশ অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে এ চুক্তির সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলো দেশ ইতোমধ্যে এফসিটিসির আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক এ চুক্তি তামাকের চাহিদা কমানোর দিকে অনেক জোর দিয়েছে এবং সরবারাহ কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেছে। অনুস্বাক্ষরের সদস্য দেশগুলো এ চুক্তি এবং এর গাইডলাইনগুলো অনুসরণ করে তামাক নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেটাই নিয়ম।

এফসিটির আর্টিকেল ১৩ অনুসারে সদস্য দেশগুলো তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করবে। আর্টিকেল ১৩-তে স্পষ্ট বলা হয়েছে: "প্রত্যেকটি সদস্য দেশ তার নিজ দেশের সংবিধান বা সাংবিধানিক মূলনীতির আলোকে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপণ, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করবে।" এরপর বলা হয়েছে সদস্য দেশগুলো ন্যূনতম কোন কোন পদক্ষেপ এ উদ্দেশ্যে গ্রহণ করবে। আর্টিকেল ১৩-র গাইডলাইনে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোর বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশে গৃহীত এ সংক্রান্ত নীতি-পদক্ষেপের ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে তামাকের প্রচারণা করছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, "মানুষের মৃত্যু ঘটায় এমন একটি পণ্যকে বিক্রি করার জন্য অসাধারণ বিপনন দক্ষতার প্রয়োজন। তামাক উৎপাদকারীরা পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ বিপননকারীদের মধ্যে অন্যতম এবং তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধের যে প্রয়াস গ্রহণ করা হচ্ছে তামাকের ব্যবহার কমানোর জন্য, তা পাশ কাটানোর জন্য তারা ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ। যেহেতু অনেক দেশ এখনও তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা কেবল আংশিকভাবে নিষিদ্ধ করতে পেরেছে, তামাক কোম্পানিগুলো অত্যন্ত সৃজনশীল উপায়ে সে নিষেধাজ্ঞার দুর্বলতাগুলো ব্যবহার করে তাদের পণ্যের প্রসার ঘটিয়ে যাচ্ছে।''

বাংলাদেশে ২০০৫ সালের আইনে তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হলেও সেটি ছিল আংশিক নিষেধাজ্ঞা যার মধ্যে অনেকগুলো ফাঁক-ফোকর ছিল। তামাক কোম্পানিগুলো অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে সেসব ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করেছে। তাদের একটি বড় কৌশল ছিল তামাকপণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রে বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা। আগের আইনটিতে যেহেতু সীমিত আকারে তামাকপণ্যের প্রচারণার সুযোগ ছিল, সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানিগুলো প্রত্যেকটি দোকানকে তামাকের বিজ্ঞাপনের একেটি বড় মাধ্যমে পরিণত করেছে। তাছাড়া গণমাধ্যমে তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হওয়ায় তারা বিভিন্ন উপায়ে পরোক্ষ বিজ্ঞাপন ও প্রাচারণা চালাতে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের অন্যমত টার্গেট অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণীরা।

তামাক কোম্পানিগুলোর আরেকটি পরিচিত কৌশল হচ্ছে 'ব্র্যান্ড স্টেচিং', অর্থাৎ তামাকপণ্যের নামে অন্যান্য পণ্যের নামকরণ, যেমন টি-শার্ট, টুপি, চাবির রিং, মোবাইল ফোনের মোড়ক, জ্যাকেট, দিয়াশলাই ইত্যাদি। এছাড়া কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে।

পৃষ্ঠপোষকতাও তামাকের প্রচারণার একটি অন্যতম উপায়। বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা পুরস্কার প্রদান বাংলাদেশে তামাক কোম্পানিগুলোর পরিচিতি কৌশল। তাছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের নামপ্রচারের আরেকটি বড় সুযোগ পেয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন 'সামাজিক দায়বদ্ধতা' কর্মসূচির বড় বড় বিজ্ঞাপন দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় ছাপা হতে দেখা গেছে।

এসব সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, সৌরবিদ্যুত, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামাক কোম্পানিগুলো যত টাকা সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে খরচ করে তার চেয়ে ঢের বেশি খরচ করে তা প্রচারের জন্য।

তামাক কোম্পানিগুলোর এসব কূটকৌশল রোধ করার জন্য 'ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৩'-তে বেশ কিছু শক্ত পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংশোধিত আইনে তামাকের বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের যে কোনো ধরনের প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তামাক কোম্পানি কর্তৃক সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির প্রচারণার উপর শক্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে তামাক কোম্পানিগুলো জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলেও তা প্রচারে কোম্পানির নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না।

এছাড়া সিনেমা, টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা গণমাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আঠারো বছরের কমবয়সী ছেলেমেদের কাছে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় এবং তাদের তামাকজাত দ্রব্যের বিপনন বা বিতরণকাজে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার উভয় পাশে বা মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগে শতকরা ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে তামাক ব্যবহারের ক্ষতিসম্পর্কিত সচিত্র সতর্কবাণী ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটায় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ব্র্যান্ড এলিমেন্ট (যেমন লাইট, মাইল্ড, লো-টার, এক্সট্রা, আল্ট্রা- এসব শব্দ) ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তবে কেবল আইন প্রণয়নই নয়, তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় একটি শক্তিশালী আইনও অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকতে পারে। যে কোনো আইন ততটাই শক্তিশালী যতটা এর প্রয়োগ হয়। তাই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

তাইফুর রহমান : ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সমাজকর্মী।