ছাত্ররাজনীতি: বাগানের সাপ

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
Published : 20 July 2010, 03:36 PM
Updated : 20 July 2010, 03:36 PM

কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে দেশের এই আবাসিক বিদ্যালয়টির প্রতি যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা ঠিক যেকোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার ফলে গড়ে ওঠা সম্পর্কের মতো নয়। গত শতকের সত্তুর দশকের শুরুতেই যাত্রা আরম্ভ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ওই একই দশকের শেষার্ধ্বে প্রভাষক হিসেবে আমিও যোগ দিই এবং টানা ছ বছর ক্যাম্পাসেই বাস করি। সে সময় ছেলেদের দুটো এবং মেয়েদের একটা আবাসিক হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো সাকুল্যে এক হাজার কি বারশো। ছাত্রদের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান কম থাকায় তাদের সঙ্গে যুবক শিক্ষকদের সম্পর্কও ছিলো বন্ধুর মতই।

রাজনৈতিক সহিংসতা যে একেবারে ছিলো না তা নয়, এখনকার এই ভয়াবহ মাত্রা সে যুগে মোটামুটি অকল্পনীয়ই ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্ররা কবিতা আবৃত্তি, লেখালেখি, গানবাজনা, নাট্যোৎসব, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নানা কাজে দারুণ উদ্দীপনার সঙ্গে অংশ নিত। ক্লাশের ভেতরে বাইরে ওদের নিয়ে আমারও কাটতো বেশিরভাগ সময়। একে তো জাহাঙ্গীরনগরের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গাছপালা, মানুষে-কাটা এবং প্রাকৃতিক জলাশয়, পাখ-পাখালি আর উঁচু নিচু রাঙামাটির পথ–সর্বোপরি পছন্দের পেশা, মনে হতো যেন আনন্দলোকেই বাস করছি, যেন আশীষের পথেই চলেছি। একাশিয়া তরু ঢাকা দীর্ঘ পথে বসন্তের জ্যোৎস্না ঢালা রাতে এক কবি আর প্রয়াত নাট্যকারের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে আলাপ করতে করতে বেড়ানোর যে দৃশ্য আজো চোখের মণিকোঠায় অনপনেয় রঙে আঁকা আছে তা বার বার এলোমেলো হয়ে যায় যখন সংবাদপত্রের কাঁধে চড়ে কফিনের মতো ভেসে আসে জাহাঙ্গীরনগরের দু একটা দুঃসংবাদ। এরপর বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে নব্বইয়ের শুরুতে যখন ফের জাহাঙ্গীরনগরে এসে যোগ দিই ততদিনে আমার সেই স্বপ্নলোক অনেকাংশেই বিলীন হয়েছে। ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ, সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজনীতির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে প্রচন্ড রকম এবং এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ছাত্র এবং তাদের জ্ঞানদাতা শিক্ষকদের মধ্যে। এক সময় তো এমন হলো, শিক্ষকরাজনীতি ওই সম্পর্ককে এমন তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে গেল যে বিক্ষুব্ধ ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক প্রহৃত হওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটলো।

অন্যদিকে, জাতীয় পর্যায়ে স্বৈরাচারের পতনের আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু ছাত্রদের ওপরই ছিলো বেশি নির্ভরশীল, সেজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন ছাত্রদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনি ছাত্রনেতৃত্বও এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে থাকে পুরোমাত্রায়। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় একটি হলের ওয়ার্ডেন এবং পরে প্রভোস্ট নিযুক্ত হওয়ায় ছাত্র রাজনীতি এবং এর ভেতরের কদর্য রূপ দেখার আমার সুযোগ ঘটে। ইতিমধ্যে ছাত্র শিবিরের তান্ডবে ছাত্রদলের একটি ছেলেও খুন হয়েছে এবং সেজন্য সাধারণ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের কিছুটা পিছিয়ে থাকা স্থানীয় জনগোষ্ঠিতে আস্তানা গেড়ে শিবির মাঝে মাঝেই গেরিলা কায়দায় এসে ছাত্রাবাসে আক্রমণও করতে শুরু করেছে এবং এতেও লাঠিসোটা চাপাতির সঙ্গে সীমিত আকারে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এখন, একজন তরুণের হাতে যখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ওঠে তখন তার আচরণ এবং সামগ্রিক অবয়বই যায় পাল্টে। মুখগহ্বরের নোলা তখন কাজ করে ট্রিগারের মতো এবং মুখ থেকে দমকে দমকে সেই ট্রিগার ঠেলে দেয় কথার কার্তুজ। এই তরুণের চোখে তখন সবাই শত্রু কিংবা সামনে হাঁটু গেড়ে বসা শত্রুপক্ষেরই কোনো কৃপাপ্রার্থী। কার সাধ্য তখন তাকে সামলায়? রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্রেই এইসব অস্ত্রের মোটামুটি একটা নিয়মিত চালান অব্যাহত থাকতো ছাত্রাবাসের দলীয় ক্যাডারদের মধ্যে।

তবে হ্যাঁ, অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় আরেকটি যে উপসর্গ এ সময় ছাত্ররাজনীতিকে উন্মুক্ত মচ্ছবে রূপান্তরিত করে তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের বখরা থেকে পাওয়া অর্থ। শুধু যে ঠিকাদারের কাছেই মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় হতো তা নয়, রাতের বেলা আরিচা রোডে ট্রাক থামিয়ে অর্থ উপার্জন (যা ডাকাতি ছাড়া আর কিছু নয়) কিংবা পথচারীদের সর্বস্ব ছিনতাই করা ইত্যাদি কাজও নিয়মিত চলতো বলে শোনা গেছে।

এজন্য মাঝে মাঝে আমার শখের পেশার প্রতিই জন্মাতো প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা। কাদের পড়াই আমরা? দিনের বেলা যে ছেলেটি কিংবা ছাত্র রাজনীতির পান্ডা বা কর্মীটি পেছনের বেঞ্চে বসে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে সে-ই কি রাতের বেলা আরেক মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে ঢাকা-আরিচা সড়কে ট্রাকে ডাকাতি করে? এইসব সত্য এবং কখনো কখনো হয়তো গুজবের টানাপোড়েনে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে যখন প্রভোস্টের দায়িত্ব ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে, তখন একটি ঘটনায় ছাত্র রাজনীতির উঠতি নেতৃত্বের একটি কদর্য চেহারা খুব কাছে থেকে দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়।

একদিন সকাল বেলা অফিসে গিয়ে শুনি যে একজন স্কুটার ড্রাইভার কোনো এক ছাত্রনেতার টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করায় তাকে মারধর করে হলের গেস্টরুমে আটকে রাখা হয়েছে। যা বলা হলো তা এরকম: আগের রাতে ঢাকা থেকে দুজন ছাত্র স্কুটার ভাড়া করে প্রায় কুড়ি মাইল দূরের এই ক্যাম্পাসে আসে। ওরা ভাড়া দেওয়ার জন্যে টাকা বার করতেই নাকি স্কুটার ড্রাইভার চাকু দেখিয়ে ওদের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই অপরাধে তাকে বেশ উত্তম মধ্যম দিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অতিথি কক্ষে গিয়ে দেখি লুঙ্গিপরা লোকটা মেঝেতে বসে আছে সামনে একটা বন রুটি আর কলা। বড় বড় লাল চোখে সে আমার দিকে তাকায়, কোনো কথা বলে না, আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা অভিযোগ কোনোটাই সে করে না। সে সময় খবর পেয়ে তার বোরখাপরা স্ত্রী এবং চার বছরের আধা ন্যাংটো একটা ছেলেও এসে হাজির। ছেলেটার নাক দিয়ে যথারীতি জিনিসপত্র ঝরছে। ওদের কান্নাকাটি পেছনে ফেলে যখন অফিসে গিয়ে বসি তখনো আমার বদ্ধ ধারণা যে ঘটনাটা সত্যি এবং স্কুটার ড্রাইভারটা দোষী। আসলে ছিনতাই এর চেষ্টা হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু কুশীলবদের ভূমিকা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। ড্রাইভারকে ভাড়া না দিয়েই ছাত্র দুজন হলে ঢুকতে চাইলে সে আপত্তি জানায় এবং তাতেই ঘটে বিপত্তি। একটি সাজানো নাটক তৈরি করে তাকে মারপিট করে আটকে রাখা হয়। কোত্থেকে একটা চাকুও জোগাড় হয়ে যায় এবং সেই চাকু দেখিয়েই নাকি স্কুটার চালক ছাত্রনেতাদের টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলো। এমন দাবিও করা হয় ছাত্রনেতৃত্বের পক্ষ থেকে।

ইতিমধ্যে নাটক দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। আমরা প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন, হাউস টিউটর, এমনকি স্বয়ং উপাচার্য ও প্রক্টরও লোকটিকে ছাত্রনেতাদের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারি না। ওদের এক কথা স্কুটার মালিককে আসতে হবে। এরপর শোনা যায় মালিকের কাছে ইতিমধ্যেই হাজার চল্লিশেক টাকা "ক্ষতিপূরণ" চাওয়া হয়েছে। মালিকও কম ঘুঘু নয়, টাকা দেওয়া দূরের কথা, সে ওদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবং দুদিন পর তখনকার ছাত্রদলের সভাপতি এসে হাজির হয়ে ধমক দিলে ওরা বিনা বাক্য ব্যয়ে ড্রাইভারকে মুক্তি দেয়। আমরা ওদের এতো বছরের এতগুলো শিক্ষাগুরু দুদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও কিছু করতে পারি না, অথচ ওদের রাজনৈতিক গুরুর জন্য কাজটা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। এতে প্রমাণিত হয় যে বইপত্রের শিক্ষা কিংবা শিক্ষক নয়, রাজনীতির যে খুঁটির সঙ্গে ওরা বাঁধা সেই খুঁটিই খুব শক্ত এবং ওরা তড়পায় ওই খুঁটির জোরেই।

আসলে ক্ষমতা যতই ক্ষণস্থায়ী এবং হাস্যকর হোক, ক্ষমতাধারীর মনে তা খুব তীব্র উত্তেজক প্রভাব ফেলে। এই উত্তেজনার বশে তরুণ মন ধরাকে সরা জ্ঞান করে, তার সামনে তখন থাকে দু ধরনের মানুষ এক, শত্রু যাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে; দুই, কৃপাপ্রার্থী পরাজিত শত্রু। এই একই উত্তেজনা আবার কামবর্দ্ধকও বটে। ক্ষমতার উত্তেজনার সঙ্গে যৌন উত্তেজনারও একটি নিবিড় সম্পর্ক মনস্তাত্বিকরা খুঁজে পান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতৃত্বে এই ব্যাপারটিও নব্বইয়ের দশকে বেশ সাড়া জাগিয়ে তা দেশের সীমানা পার হয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও নাড়া দিয়েছিলো। সে সময় এক ছাত্রনেতা ঘটা করে তার শততম ধর্ষন ক্রিয়া উদযাপন করেছিলো।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গোলাগুলি, হল দখল, চারতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলা, সবুজ ঘাসের বিছানায় অচেতন হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে শুয়ে থাকার ঘটনা ঘটলো তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, ছাত্ররাজনীতির একটা ধারাবাহিক উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকার কর্কটরোগাক্রান্ত এবং সবার স্বার্থেই একে উৎপাটন করতে হবে। ছাত্ররা যত খুশি রাজনীতি করুক কিন্তু সেটা তারা করবে দেশের সচেতন শিক্ষিত সমাজের অংশ হিসেবে, ছাত্র হিসেবে নয়, নয় কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হিসেবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন খুঁটিতে বাঁধা দড়িটাকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু সরাবেটা কে? বর্তমান সরকার যেহেতু মৌখিকভাবে তাদের অসংগঠনকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেছে এবং সংসদেও তাদের বিপুল সংখ্যাধিক্য। এই সুযোগে একটা আইন করে কি লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায় না? লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিকল্প হিসেবে যে রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চালু হতে পারে তা হলো বিষয় কিংবা কর্মকান্ডভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের রাজনীতি। এই সব সংগঠন হবে বহুলাংশে স্বায়ত্বশাসিত, এদের প্রত্যেকের জন্য থাকবে প্রয়োজন মাফিক অর্থ বরাদ্দ; এদের পরিচালনা কমিটি হবে নির্বাচনের মাধ্যমে কিংবা সর্ব সম্মতি ক্রমে, এবং প্রত্যেক সংগঠনের পরামর্শক হিসেবে থাকবেন একজন শিক্ষক। এই সব সংগঠন হতে পারে বিচিত্র বিষয়ক, যেমন সমাজসেবা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পর্যালোচনা, কম্পিউটার, বিজ্ঞান, নাটক, সিনেমা, আলোকচিত্র ইত্যাদি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং ছাত্রদের বিষয়ে পরামর্শদানের কিংবা হলের ব্যবস্থাপনায় সীমিত আকারে অংশগ্রহণের জন্যও সংগঠন থাকতে পারে। পড়াশোনাকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে লেখাপড়ার বাইরে ছাত্রদের এইসব কার্যক্রমে নিয়োজিত রাখলে তারা মোটামুটি দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে ছাত্রত্ব শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারবে। আমার এক স্বনামধন্য শিক্ষক বলতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হারে গোলাগুলি, মারপিট হয় তাতে একজন ছাত্র কোনো রকমে বেঁচে জীবন নিয়ে পার হতে পারলেও সেশন জটের কারণে যৌবন নিয়ে বেরুতে পারে না। খুঁটির রাজনীতি যদি উৎপাটন করা যায় তাহলে সে তার জীবন যৌবন জয় নিয়েই বেরুতে পারবে কারণ তখন ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, ফেরেববাজী ইত্যাদির রাজনীতি উৎপাঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। ছাত্রত্বের সঙ্গে এই "বাজী" প্রত্যয় নিতান্তই বেমানান। একমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও শুভ বুদ্ধির জয় হলে এবং শিক্ষক নেতৃত্বেও তা সঞ্চারিত হলে ছাত্র সমাজ এই নষ্ট প্রত্যয় থেকে মুক্ত হতে পারে।