টিকফা বা জিএসপি নয়, বৈষম্য দূর করাই হোক দাবি

আনু মুহাম্মদ
Published : 26 May 2013, 03:57 PM
Updated : 26 May 2013, 03:57 PM

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি হারাতে পারে এ ভীতি চারদিকে। ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আসলেই জিএসপি সুবিধা দেয় এবং শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ গার্মেন্টস পণ্য ইউরোপে যায়। সে জন্য তাদের হুমকির সত্যিই অর্থ আছে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির অর্থ কী? বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প তো সেখানে কোনো জিএসপি সুবিধা পায় না। বরং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানারকম বৈষম্যের শিকার। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেখানে আন্তর্জাতিক বিধিমালা আছে, ফোরাম আছে, সেখানে কেন 'টিকফা' নামের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এতটা অস্থির? এ লেখায় গার্মেন্টস শিল্পের আন্তর্জাতিক দিক, দেশের বাইরে তার মুনাফার ভাগীদার এবং যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডার পর্যালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের করণীয় চিহ্নিত করতে চাই।

তাজরীনের পর রানা

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস বিশেষত এখানকার শ্রমিকদের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ ও সে সূত্রে আলোচনা-সমালোচনা অনেক বৃদ্ধি পায়। তারপরও এ ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় বিশ্বের ইতিহাসে গার্মেন্টস কারখানার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় যে বাংলাদেশেই ঘটবে, এটা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কেননা সবারই ধারণা ছিল যে, তাজরীনের পর সরকার, বিজিএমইএ, মালিক, বায়ার ও ব্রান্ড- সবার মধ্যেই সতর্কতা তৈরি হবে।

সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বিশ্ব কাঁপিয়ে, সারাদেশ কাঁদিয়ে রানা প্লাজায় মিলল ১ হাজার ১২৯ শ্রমিকের লাশ, যাদের অধিকাংশ নারী। এখনও শত শত নিখোঁজ। আহত হাজারের বেশি। তার মধ্যে বহু আছেন যারা অঙ্গ হারিয়ে প্রায় অচল। নিহতদের পরিবার ও জখম যারা বেঁচে থাকলেন তাদের জীবন নিষ্ঠুরতার এক নতুন পর্বে প্রবেশ করল। এ রকম মৃত্যুই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবনের মূল আঘাত নয়। জীবনটা নিষ্ঠুর বলেই মৃত্যু এরকম ভয়ঙ্কর হয়।

এখন দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, সভা- সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও জোরদার হয়েছে 'বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা' প্রত্যাহারের হুমকি, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকফা (ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ। বর্তমান সময় এ বিষয়ে সারাদেশে প্রচলিত ও প্রচারিত উদ্বেগের সারকথা হল, 'যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার গার্মেন্টসের বিশাল বাজার হারাবে। এ বাজার রক্ষা করতে অতএব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব দ্রুত টিকফা চুক্তি সম্পাদন করা উচিত।'

প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস হল, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ দেয়, খাদ্য দেয়, নানারকম সুবিধা দেয়, নইলে বাংলাদেশ ডুবে মরত; তাই তার কথা অমান্য করা যাবে না। কিন্তু এসবের মধ্যে সত্যতা কতটুকু?

জিএসপি দাবি কতটা সত্য

মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যবিষয়ক অফিসের ওয়েবসাইটে তাদের জিএসপি সুবিধা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: 'সুবিধাভোগী ১২৭ দেশ থেকে আমদানি করা প্রায় ৫০০০ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য এ জিএসপি। এর অন্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি করা পণ্যে মার্কিন সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করে মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। … জিএসপির অধীনে যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে তার মধ্যে আছে: বহুরকম রসায়ন দ্রব্য, খনিজদ্রব্য, বিল্ডিং স্টোন, জুয়েলারি, বহুরকমের কার্পেট এবং কিছু কৃষি ও মৎস্যজাত দ্রব্য। জিএসপি শুল্কমুক্ত সুবিধাবহির্ভূত পণ্যগুলো হচ্ছে: বেশিরভাগ বস্ত্র ও পোশাক সামগ্রী, বেশিরভাগ জুতা, হাতব্যাগ ও ব্যাগ সামগ্রী।'

সে কারণে মার্কিন নীতির অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য তাদের জিএসপি সুবিধার বাইরে। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্কহার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানির শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ গেছে, সে হিসেবে এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ-অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে এ অঙ্ক তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে প্রতিবছর! কিন্তু সে যুক্তরাষ্ট্রই আবার মুক্তবাজারনীতি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে!

জিএসপি সুবিধা দেওয়া না-দেওয়া মার্কিন বিনিয়োগ ও পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। যেসব ক্ষেত্রে দেশে বিনিয়োগকারী আছে এবং তারা কংগ্রেস পর্যন্ত প্রভাব খাটাতে পারে সেগুলোতে অন্য কোনো দেশের পণ্য প্রবেশে শুল্ক বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। যেমন, গার্মেন্টস, জুতা ইত্যাদি। একে অন্যভাবে তাদের ভাষাতেই বলা যায়, সংরক্ষণবাদী নীতি বা প্রতিযোগিতায় অক্ষম শিল্পকে রক্ষা করার অদক্ষ নীতি।

'ওয়াশিংটন কনশেনসাস' অনুযায়ী আমাদের দেশেও অর্থনীতির নানা সংস্কার হয়েছে, অর্থশাস্ত্রীয় চিন্তার মধ্যে নিউ লিবারেল ধারার আধিপত্য তৈরি হয়েছে। সেখানে আমাদের বারবার বলা হয়েছে, কোনো শিল্প যদি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে তাহলে সেটা অদক্ষ, শুল্ক দিয়ে তাকে রক্ষা করার নীতি খুবই অপচয়মূলক। কাজটি কি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই করছে না?

অর্থাৎ প্রচারণা বা বিশ্বাস যাই থাকুক, তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে কোনো বিশেষ সুবিধা পায় না, বরং অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে সেখানকার বাজারে প্রবেশ করতে হয়। নেপালের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। কেননা নেপালও জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত

বাংলাদেশ যেভাবে বৈষম্যমূলক নীতির শিকার

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশিরভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, শ্রমঘন পণ্য যেগুলো গরীব দেশ থেকে আসে তার অনেকগুলোর ওপর মার্কিনি শুল্কহার অস্বাভাবিক রকম বেশি, গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনও কখনও ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আমদানি শুল্ক শতকরা ১১ থেকে ৪৮ ভাগ।

বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনামূলক চিত্র আইএমএফ-এর একটি হিসেব থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখানে দেখানো হয়েছে যে, বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করতে গিয়ে ফ্রান্সের শুল্ক দিতে হয়েছে ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার, সে একই বছরে এর ১২ ভাগের একভাগ অর্থাৎ ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে সমপরিমাণ শুল্ক দিতে হয়েছে

অর্থাৎ ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে শুল্ক দিতে হচ্ছে কমপক্ষে ১২ গুণ বেশি। এটাই কি বিশেষ সুবিধা! এ 'সুবিধা' রক্ষার জন্য তাদের পাতা জাল আরও বেশি করে গলায় জড়াতে হবে, নাকি এ বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে?

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে, টিকফা চুক্তির মধ্যেও এটি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এটা বলার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর আরোপিত উচ্চহারে শুল্ক কমিয়ে তাদের গড় শুল্কহারেরও সমান করে, তাতে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে তা দিয়ে ৪০ লাখ শ্রমিকের মজুরি তিনমাস অতিরিক্ত শোধ করেও নিরাপত্তাজনিত সকল ব্যয় বহন সম্ভব হবে।

গার্মেন্টস শিল্পের মুনাফার ভাগীদার কারা

পুঁজির বিশ্বায়নে বড় বড় শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থা, অর্থকরী খাতের ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা হুমকির মুখে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণির বড় অংশ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী মানুষ। বেআইনি অভিবাসীদের নূন্যতম মজুরি ও কর্মঘণ্টার কোনো ঠিক নেই। কোম্পানি সস্তা মজুরি ও উচ্চ মুনাফার লোভে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এর ফলে দেশে তাদের বেকারত্ব বাড়ছে, কমছে কাজের স্থায়ীত্ব বা নিরাপত্তা। দেশে আবার একই কারণে শ্রমিকদের হাল খারাপ।

প্রকৃতপক্ষে শিল্পায়িত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে দুর্বল। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের অনুপাত শতকরা ১০ ভাগেরও কম। সারা দুনিয়ায় দখল, গণহত্যা, সন্ত্রাস চালাতে যুক্তরাষ্ট্র বছরে এখন প্রায় ৯শ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। কিন্তু সে দেশের সাড়ে ৪ কোটি মানুষ চিকিৎসা সুবিধার বাইরে। লাখ লাখ লোক বেকার, আরও বহু লাখ নূন্যতম মজুরির অনেক নিচে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই বিশ্বজোড়া যে মুনাফার জাল বাংলাদেশের শ্রমিকের জীবন লাশে পরিণত করে, তা নানাভাবে মার্কিন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেও বিপন্ন করে।

সুতরাং সমস্যা বা সংকট এ দেশ বনাম সে দেশ নয়। সুবিধাভোগী যেরকম আন্তর্জাতিক- নিপীড়ন বা বৈষ্যম্যের শিকার মানুষেরও বাস বিশ্বজুড়েই। মার্কিন শ্রমিক সংস্থা (এএফএল-সিআইও) তাদের শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে আমদানি কমাতে চেষ্টা করছে। আর তার সুযোগ নিয়ে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের হাত মুচড়ে আদায় করতে চেষ্টা করছে টিকফা নামের আরেক ফাঁস, বঙ্গোপসাগরসহ অবশিষ্ট সকল ক্ষেত্রে তাদের যথেচ্ছাচারের সুবিধা।

যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনলে গার্মেন্টস বাজার হারানোর ভয় বহুদিন ধরেই ছড়ানো। আসলে বাংলাদেশের গার্মেন্টসে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও সরকারের বিপুল পরিমাণ লাভ খেয়াল করলে এটা পরিষ্কার হবে যে, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই কখনও বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে সরে যাবে না।

কারণ তাতে মার্কিন বহু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিশাল মুনাফার একটা বড় উৎস, সরকারের শুল্কের একটি ভালো উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। মার্কিন সরকার বা কোনো লবি তাই ইচ্ছা করলেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস আমদানি বন্ধ করতে সক্ষম হবে না। একইকারণে ইউরোপও নয়। গার্মেন্টস বিক্রিমূল্যের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগের যারা ভাগীদার তারা এটা বন্ধ করবে, এটা ভাবার কারণ নেই।

মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন 'ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস'-এর গবেষণা থেকে হিসেব করে দেখিয়েছে, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয় তার শতকরা ৬০ ভাগই পায় সেদেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্র্যান্ড বিক্রেতারা, উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি ৪০ ভাগের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহনখরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভূক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, শতকরা ১ ভাগেরও কম

এ বৈশ্বিক বাণিজ্যে মুনাফার হার খুবই উঁচু। তারপরও দেশের মালিকদের জন্য আছে রাষ্ট্র থেকে নানা আর্থিক সুবিধা, আছে মুনাফাবৃদ্ধির আইনি-বেআইনি পথ (প্রথম আলো, ১৮ মে ২০১৩)। বিদেশি পক্ষের জন্য আছে নানা আনুকূল্য। তবুও ক্ষুধার শেষ নেই। আরও মুনাফার জন্য দেশের মালিক, বিদেশের ক্রেতা–বিক্রেতা সংস্থা সবাই নিরন্তর চেষ্টায় থাকে। তাদের অর্থ ও ক্ষমতা দুই-ই আছে। দেশের মধ্যে এ মুনাফায় ভাগীদার হয় বড় দল, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশসহ অনেকেই। বিদেশিদের জন্য আছে উচ্চহারে মুনাফা অর্জনের জন্য বাজার ও হাত মোচড়ানোর নানা কৌশল।

দেশি বিদেশি সকলের 'খাইয়ের' পুরো চাপ পড়ে শ্রমিকদের ওপর। শুধু যে মজুরি নিম্নতম সীমায় চলে যায় তা-ই নয়, প্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কারণে জীবনের দামও তুচ্ছ হয়ে যায়। রানা প্লাজার মতো বাংলাদেশের আপাত জৌলুস এরকম চাপা দিয়ে রাখে লাখ লাখ শ্রমিকের বিবর্ণ ও পিষ্ট জীবন। বিশ্বজোড়া ছড়ানো মুনাফার জালেই তারা আটকে আছে। জিএসপি ভীতি আর টিকফা নিয়ে নানা তৎপরতা সে জাল আরও কঠিন করতে উদ্যত।

বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আলাদা চুক্তি কেন

বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের উন্নতি হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে এ উন্নতির অর্থ কী? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতি কি যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তন করবে? মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে মাগুড়ছড়ার গ্যাসসম্পদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা কি শোধ করার ব্যবস্থা করবে? সব সামরিক-বেসামরিক চুক্তি কি জনগণের কাছে প্রকাশ করবে?

না, এগুলোর বিষযে কোনো কথা নেই। কোনো সরকারের মুখে কথাটা কেন আসে না যে, 'আমাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে না। আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরোধী বৈষম্যমূলক সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যব্যবস্থা বাতিল কর।'

আরও প্রশ্ন হল, বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যেখানে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান 'বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা' (ডব্লিওটিও) আছে সেখানে এ বিশ্বব্যবস্থারই সর্দার যুক্তরাষ্ট্র কেন আলাদা চুক্তি করতে চায়? কারণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন দেশ জোটবদ্ধভাবে কাজ করে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের কোনো সরকারই ন্যায্য প্রশ্নে এমন কোনো শক্ত অবস্থান কখনও নেয়নি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট স্বার্থরক্ষায় সমর্থন দিতে বাংলাদেশের কোনো সরকার কখনও কার্পণ্য করেনি। তবে টিকফা কেন? কারণ শক্তহাতে সবদিক থেকে কোনো দেশকে ধরতে এ চুক্তি ভালো একটি অস্ত্র।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশে মেধা-স্বত্বাধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে কিছুদিন ছাড় পেয়েছে। ঔষধ শিল্প তারই সুবিধাভোগী, কম্পিউটর এবং আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক এ যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন টিকফা স্বাক্ষর হলে এ চুক্তি যেহেতু অন্যসব আইনবিধির উর্ধ্বে, সুতরাং আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত ছাড় গুড়িয়ে দিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসতে পারবে।

এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধ শিল্প এবং আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও বহুবিধ বিপদের আশঙ্কা। বাংলাদেশ জানে না, কত কত বীজ ফসল গাছ ফল ফুল মেধাস্বত্ব জালে কোন কোন কোম্পানির মালিকানায় চলে গেছে। টিকফা সে জাল বিস্তারেই আসছে।

বাংলাদেশের শ্রম নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে সেটা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে জনগণের স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করলে সরকারকে এক্ষেত্রে যা যা করতে হবে তা হল: প্রথমত, গার্মেন্টস শিল্পের খুনি ও দুর্বত্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ; নিহত, আহত ও নিখোঁজদের পরিবারকে যথাযথ সম্মানজনক ক্ষতিপূরণদান; এবং জাতীয় নূন্যতম মজুরি ও নিরাপত্তাসহ গার্মেন্টস শিল্পের সামগ্রিক সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর নয়, জিএসপির জন্য আবদারও নয়; বরং গার্মেন্টস শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতি দূর করার দাবি উত্থাপন ও তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রচার ও আলোচনা। তৃতীয়ত, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়া-আফ্রিকায় বাজার সম্প্রসারণ।

আনু মুহাম্মদ : শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব।