ব্রিটেন থেকে যুদ্ধাপরাধী হস্তান্তর ও কিছু বাধা

Published : 25 May 2013, 10:27 AM
Updated : 25 May 2013, 10:27 AM

বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে পুরো ব্রিটেনে সভা, সমাবেশ, মিছিল চলছিল গত প্রায় দু বছর ধরে। দেশে কোনো সংকট তৈরি হলেই ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা জেগে ওঠেন। এ দৃশ্য নতুন নয়। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তার ব্যথা অনুভব করেন এখানে বসবাসরত বাঙালিরা। আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন।

প্রবাসে রুটি-রুজির শত ব্যস্ততার মাঝেও এমন একটা দিন যায় না যেদিন দু'চারটা সভা-সমাবেশ হয় না। অন্য শহরগুলোর তুলনায় লন্ডনে বসবাসরত বাঙালিরা বেশি মুখর এসব বিষয়ে। লন্ডনে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে শতাধিক। সব ক'টি সংগঠনই সক্রিয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বেশি সরব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি তো রয়েছেই- সে সঙ্গে রয়েছে সাঈদী মুক্তি পরিষদসহ বিভিন্ন ইসলামি দলের খোলসে মূলত জামায়াতে ইসলামী।

সম্প্রতি লন্ডনে স্বাধীনতার সপক্ষে যেসব সংগঠন বা ব্যক্তি কাজ করেন তারা উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। সবারই জানা আছে, একাত্তরে আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কদিন আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যার নীলনকশা যারা করেছেন তাদের একজন যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন, বাঙালি-অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে থাকেন। ইতোমধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার অপরাধে তাকে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

যে দিন ট্রাইব্যুনাল এ নির্দেশ দিল সেদিন লন্ডনের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। তাতে পুরো খবরের সঙ্গে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের একটি বিবৃতি ছিল। সেখানে তিনি বলেছেন, তার মক্কেল চৌধুরী মঈনুদ্দিন সম্পুর্ণ নির্দোষ এবং যে আদালত তাকে গ্রেফতারের রায় দিয়েছে সে আদালত বিতর্কিত। আইনজীবী হিসেবে তিনি এ মন্তব্য করলেও এটা হচ্ছে অনেকটা জামায়াতে ইসলামীর সবসময়ের আওড়ানো বক্তব্যের মতোই একটি বিষয়।

অন্যদিকে এরপর থেকে স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন আরও উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। তারা চান আদালতের আদেশ অনুযায়ী যেন চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক গীতা সায়গল। তিনি বিদেশে পালিয়ে থাকা তিন যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আবু সাঈদ ও লুৎফুর রহমানকে নিয়ে ১৯৯৫ সালে চ্যানেল ফোরের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন 'ওয়ার ক্রাইম ফাইলস' নামে। প্রামাণ্য চিত্রটিতে এ তিনজনের অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা যেভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে বিভিন্ন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে, একই কায়দায় চৌধুরী মঈনুদ্দিনও লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাকে কমিউনিটিতে এখন অনেকেই ধর্মীয় গুরু হিসেবে মানে। তার এ পরিচয় বহু পুরনো। তাকে লন্ডনে এ সুযোগ দিয়েছেন আমাদের কমিউনিটির কতিপয় ব্যক্তি।

এখন কথা হচ্ছে আদালত ২১ মে'র মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হল কিনা সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল। তাই প্রশ্ন জাগে তাকে কি আদৌ গ্রেফতার করা সম্ভব? গ্রেফতার করলে প্রশ্ন উঠবে তাকে দেশে নেওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের মধ্যে কোনো রকম বোঝাপড়া আছে কিনা আমার জানা নেই।

তবে লন্ডনে বাংলাদেশের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড. সাইদুর রহমান খান আমাকে বলেছিলেন তিনি চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে দেশে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলেছেন এবং এ বিষয়ে ব্রিটেনের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। যদি তা ঠিক হয়ে থাকে ভালো। তবে আমরা যেটুকু বুঝতে পারি তাতে চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে দেশে ফেরত নেওয়া কঠিন হবে। আদৌ নেওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যেতে পারে। ব্রিটেনে আলোচিত কয়েকটি মামলার মধ্যে জর্ডানের চরমপন্থী ধর্মীয় নেতা আবু কাতাদার মামলাটি অন্যতম। জর্ডান সরকার কাতাদাকে ফেরত নিতে চায়। ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে-ও কাতাদাকে জর্ডানে ফেরত পাঠাতে চান।

কিন্তু বাধ সেধেছে খোদ ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত। এ আদালত বলছে কাতাদাকে দেশে ফেরত পাঠালে তার ওপর নির্যাতন চালানো হবে। এমনকি তার ফাঁসিও হতে পারে। ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থায় ফাঁসির বিধান নেই। তাই কাতাদাকে জর্ডানে ফেরত পাঠানো যাবে না। তাই বারবার কাতাদাকে জর্ডানে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন থেরেসা মে তথা ব্রিটিশ সরকার।

কয়েকদিন আগে মামালাটি উচ্চ আদালতে নিতে আবেদন করেছিলেন থেরেসা। কিন্তু আদালত তার আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে থেরেসা জর্ডান সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন। তাতে বলা হয়েছে যে, কাতাদাকে জর্ডানে যথোপযুক্ত বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে, তবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না।

মামলাটি নিয়ে প্রধামন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বিরক্ত। তিনি সরাসরি বক্তব্যে বলেছেন কাতাদাকে যে কোনো মূল্যে জর্ডানে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু তিনিও সফল হননি। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রতি বছর হাউস অব কমন্সে একটি বক্তৃতা দেন। ৭ মে রানি আগামীতে সরকার কী কী কাজ করবে তার সারসংক্ষেপ নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাতে তিনি অপরাধী ইমিগ্রান্টদের ব্রিটেন থেকে তাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। বললেন, কোনো বিদেশি অপরাধীকে ব্রিটেনে থাকতে দেওয়া হবে না।

রানির বক্তব্যের পর হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে আরও সক্রিয় হলেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে চলমান অভিযান আরও জোরালো করা হবে। ব্রিটেন থেকে বের করে দেওয়া হবে বিদেশি সন্ত্রাসীদের। থেরেসার এ বক্তব্যের পর আবু কাতাদা বললেন, তিনি স্বেচ্ছায় জর্ডানে ফেরত যাবেন, যদি ব্রিটেন যে চুক্তি করেছে তা বাস্তবায়িত হবে বলে নিশ্চয়তা দেয়। এ নিশ্চয়তা ব্রিটিশ সরকার কিংবা থেরেসা মে দিতে পারবেন কিনা বা দিলেও তা কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। ফলে কাতাদাকে বের করতে নতুন করে বেকায়দায় পড়ল ব্রিটিশ সরকার।

এবার আসি চৌধুরী মঈনুদ্দিন প্রসঙ্গে। তাকে দেশে ফেরত নিতে হলে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করতে হবে। চৌধুরী মঈনুদ্দিনের অপরাধ যে আবু কাতাদার চেয়ে গুরুতর সে বিষয়ে অবহিত করতে হবে। তারপর ব্রিটেন তাকে ফেরত দিতে প্রক্রিয়া শুরু করলে অবশ্যই কাতাদার মতো তার ব্যাপারেও ইউরোপীয় আদালত হস্তক্ষেপ করবে।

মনে রাখতে হবে চৌধুরী মঈনুদ্দিন একজন ব্রিটিশ নাগরিক। এরপর দু দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। তাতে হয়তো স্থান পাবে আবু কাতাদার চুক্তির মতো বিভিন্ন বিষয়। এছাড়া বাঙালি কমিউনিটির প্রভাবশালীদের মধ্যে যারা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের অনেকেই চৌধুরী মঈনুদ্দিনের কাছের মানুষ। এ বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে।

ব্রিটেনের গণজাগরণ মঞ্চ চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। তারা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বরাবর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে একটি লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ডাউনিং স্ট্রিট অভিযোগপত্রটি ব্রিটেনের ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসে পাঠিয়েছে। তারা এ বিষয়ে তদন্ত করবে।

আশার কথা হল ইতোমধ্যে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস কাজও শুরু করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের নেতা সাজ্জাদ নূরকে গ্রেটার মানচেস্টার পুলিশ ডেকেছে এবং সার্বিক বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে। সাজ্জাদ নূর যেটুকু জানালেন তাতে বোঝা গেল, মূলত যারা চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিষয়ে অভিযোগ করেছে তারা কারা এবং কী তাদের উদ্দেশ্য তা জানতে পুলিশ তাদের ডেকেছিল। বলা চলে এ প্রক্রিয়া এখনও একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। একে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শুধুমাত্র গণজাগরণ মঞ্চ নয়, বাংলাদেশ সরকারকেও কাজ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর এ নিয়ে ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা নানা কথাবার্তা বলছেন। অনেকে দাবি জানাচ্ছেন চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে যেন তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত নিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ফেরত নিলে তার দোষ অনুযায়ী হয়তো ফাঁসি হতে পারে এটাই স্বাভাবিক। এই একটিমাত্র কারণে তাকে লন্ডন থেকে দেশে ফেরত নেওয়া সম্ভব হবে না বলেই আমাদের সন্দেহ।

মনে পড়ে কোনো একটি সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিচার ব্রিটেনের আদালতেও হতে পারে। ড. আনিসুজ্জামানও একই কথা বলেছিলেন। তা হয়তো সম্ভব। কিন্তু এ দেশে তাকে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা তার অপরাধের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ব্রিটেনের এমপিদের মধ্যেও মতদ্বৈধতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের এমপিদের একাংশ বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। এ বিচার তারা মানেন। কিন্তু তারা ফাঁসি মানবেন না। কারণ ব্রিটেনে ফাঁসির নিয়ম নেই। তবে তারা এ-ও বলেছেন, বাংলাদেশ তার আইন মতো অপরাধীকে শাস্তি দেবে এটাই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থী কিছু এমপি রয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান না। হাউস অব লর্ডসে আছেন কয়েকজন। লর্ড নাজির তাদের অন্যতম। তিনি জামায়াতিদের বিভিন্ন সমাবেশেও যোগ দেন। লর্ড নাজির পাকিস্তানি-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। তাই তার আনুকূল্য পাওয়া জামায়াতকর্মীদের জন্য সহজ হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কয়েকদিন আগে তিনি পদত্যাগ করেছেন।

সবশেষে বলা যায়, ব্রিটেন তথা ইউরোপীয় আদালতের আইন চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে দেশে ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। আওয়ামী লীগ সরকার আর মাত্র কয়েক মাস ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে বলে হুঙ্কার ছাড়ছেন মন্ত্রীরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন বলে তারা ক্ষমতায় এসেছিলেন। আগামীবার সে বিচার হবে বলে আবার যেন নির্বাচনী মূলা ঝোলানো না হয়, সে বিষয়ে জনগণের সতর্ক হওয়া উচিত।

বরং এ মুহূর্তে জরুরি হচ্ছে ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া। কাজটা করতে হবে সরকারকেই।

মিলটন রহমান : কবি ও বার্তা সম্পাদক, বাংলা টিভি, লন্ডন।