ইইউ এবং তুরুপের শেষ কার্ড

নাদিরা মজুমদার
Published : 28 Jan 2017, 12:53 PM
Updated : 23 May 2013, 08:51 PM

অবশেষে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে বিরাজমান ব্যবস্থাদির এসপার-ওসপারে সাহায্য করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান উদ্যোক্তার ভূমিকাটি নিয়েছে। সবাইকে ডেকে কড়া ভাষায় বলেও দিয়েছে যে দরকার হলে তুরুপের শেষ কার্ড ব্যবহার করতেও তারা দ্বিধা করবে না।

ইইউ'র ৬০ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের গার্মেন্টসে সুলভমূল্যে তৈরি ফ্যাশনেবল জামাকাপড় পরে থাকে। ধসেপড়া রানা প্লাজা ভবনের ধ্বংসস্তূপের তলায় অসংখ্য শ্রমিকের অকালমৃত্যু গার্মেন্টস আমদানিকারক হিসেবে ইইউ'র বিবেকও পীড়িত করেছে। এটি ভালো লক্ষণ।

ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্টস আমদানির প্রশ্নে বিচলিত ক্ষুব্ধ ইইউ'র কঠোর ভূমিকা গ্রহণ থেকে স্পষ্ট যে রফতানিকারক ও আমদানিকারক উভয়কে ইইউ সমানভাবে দোষী সাব্যস্ত করছে। কারণ এ রফতানি-আমদানি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ফলে গর্ডন গেকোর প্রসঙ্গ চলে আসে বারবার।

গর্ডন গেকোকে আপনারা অনেকেই চেনেন। 'ওয়াল স্ট্রিট' ফিল্মের এন্টাগোনিস্ট গেকো। ফিল্মটি প্রথম রিলিজ হয় ১৯৮৭ সালে; এন্টাগোনিস্ট গর্ডন গেকোর ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয়ের জন্য মাইকেল ডগলাস শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পুরস্কারটিও পান।

গত শতকের আশির দশকের বাড়াবাড়ি বা 'একসেস' যা-ই বলুন, অর্থাৎ র্মাগারেট থেচারের 'ক্যাসিনো র্অথনীতি' বা রিগানের 'ক্রোনি ক্যাপিটালিজম' বিকাশের দশকের সঠিক প্রতিকৃতিটি ফিল্মটিতে ফুটে উঠে বলে মনে করা হয়। শেয়ারহোল্ডারদের এক মিটিংয়ে নির্বিবেক গেকোর ঘোষণা Greed is right. Greed works, greed clarifies and captures the evolutionary spirit…. গেকোকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

আধুনিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত ইনসাইডার ট্রেডিং, সিকিউরিটিজ ফ্রড, ফ্রন্ট-রানিং ইত্যাদি আচরণ ওয়াল স্ট্রিটের প্রাণকেন্দ্র। এ জাতীয় আচরণ প্রচলিত আইনকানুনের মাধ্যমে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। বরং সর্বজনগৃহীত ও সূক্ষ্ম এথিক্সের সমস্যাই জড়িত বেশি। তবু গর্ডন গেকো শেষ পর্যন্ত ফেঁসে যায়, আট বছরের জেলও হয় তার। অর্থাৎ এথিক্সের জয় হয়। গেকো পরিণত হয় লাগামহীন, নিয়ন্ত্রণবিহীন লোভের আর জটিল দুর্নীতির প্রতীকে।

এফবিআই তার অ্যান্টি-ইনসাইডার ট্রেডিংবিরোধী প্রচারণায় মাইকেল ডগলাসের গেকোকেই বেছে নিয়েছে। ১৯৮৪ সালের ভূপাল ইউনিয়ন কার্বাইড ট্রাজিডি, ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্রাজিডি- ধরনে আলাদা, তবু কত মিল- দু ক্ষেত্রেই লোভাতুর মার্কেটের খেল!

২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা দালানটি ধসে পড়ায় শয়ে শয়ে পোশাকশ্রমিক চিরকালের জন্য চলে গেলেন। ১১২৭ শ্রমিকের লাশ মিলেছে। রানা প্লাজার আগেও পোশাক শিল্প কারখানার দালান ধসে পড়েছে; শ্রমিকের নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কারখানার দালানে অসংখ্যবার আগুন লাগা, আত্মরক্ষার জন্য বের হয়ে আসতে না পারা শ্রমিকের পুড়ে মারা যাওয়া, আহত হওয়া- সবই ঘটেছে।

শেষতক রানা প্লাজা দুর্যোগটিই নির্বিবেক গার্মেন্টস জগতের জন্য শেষ বিষছোবলে পরিণত হয়; ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও তা খেপিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায় লোভাতুর মার্কেট এবার সংযত হতে বাধ্য হবে। ইইউ'র একান্ত জরুরি মিটিংয়ে দ্যাট'স ইটস স্পোর্টওয়্যার লিমিটেড থেকে শুরু করে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ, ফিনিক্স গার্মেন্টস, স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস, গরিব এন্ড গরিব, মেট্রিক্স সোয়েটার, কেটিএস কমপোজিট টেক্সটাইল মিলস, সান নিটিংয়ের দুঃস্বপ্নময় দুর্ঘটনার স্মৃতিগুলোও চলে এসেছে বারবার।

বাংলাদেশের রফতানিকৃত গার্মেন্টেসের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মোট রফতানির ষাট শতাংশ এখানকার বিশাল বাজার শুষে নিচ্ছে। ফলে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারের দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে, চীনের ঠিক পরেই। এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে বৈদেশিক সাহায্যের বদলে বাংলাদেশকে করমুক্ত ও কোটামুক্ত পোশাক রফতানির সুযোগটি মঞ্জুর করা। করমুক্তি ও কোটামুক্তি ব্যবস্থাটি বজায় রাখতে বাংলাদেশকে তার কূটনৈতিক শক্তির সিংহভাগই ব্যয় করতে হয়।

তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একমাত্র নির্ঝঞ্ঝাট উৎস হল প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো নগদ টাকা; বাৎসরিক এ রেমিটেন্সের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপের ত্রিশ দেশে বসবাসরত প্রবাসীর সংখ্যা এক মিলিয়নেরও বেশি। অর্থাৎ ইইউ'র সদস্য দেশগুলোসহ বাড়তি তিনটি নন-ইইউ দেশে বাংলাদেশিরা বসবাস করছে। দেশগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি অতি জরুরি ক্ষেত্রে কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাংলাদেশের নেই।

ফলে প্রবাসীরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রবাসে প্রবাসীর স্বার্থসংরক্ষণে পূর্ববর্তী সরকারগুলো কিছু করেনি; কূটনীতির কিছুটা এ খাতেও নিয়োজিত করার বিষয়টি এখন বিবেচনা করে দেখার সময় এসেছে।

রাষ্ট্রীয় উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় গার্মেন্টস শিল্প বাৎসরিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের (এক বিলিয়ন= একের পর নয়টি শূন্য) রফতানি ব্যবসা হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, একমাত্র ইইউ'র সঙ্গেই রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৩৭ বিলিয়ন ডলার; ২০১১ সালে পরিমাণটি ছিল ১০.৫২ বিলিয়ন ডলার। বাকি ৪.৫৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।

অর্থাৎ বিশ্বমন্দার সময় বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অবস্থা আরও রমরমা হতে থাকে। অপরদিকে ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী, যদিও শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট কর্মরতের ৪৫ শতাংশই নিয়োজিত ছিল বস্ত্রশিল্পখাতে, অথচ বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ে এ খাতের অংশদারীত্বের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ রফতানি ব্যবসা প্রতিবছরই বাড়ছে, কিন্তু জাতীয় আয়ে অংশদারীত্বের পরিমাণটি সে অনুপাতে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

তৈরিবস্ত্র রফতানি খাতে কে কতটা শুল্ক কর কী কর্পোরেট কর ফাঁকি দিয়েছে, বা কে কত টাকা দেশের বাইরে পাচার করছে, সে কাজ অর্থবিষয়ক অপরাধ পুলিশ বা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম পুলিশের, তার হদিস তারাই করুক। তবে রফতানিকারকরা সাধারণভাবে গৃহীত শ্রমিক-কল্যাণ বিধিব্যবস্থার কোনো তোয়াক্কা যে কোনোদিন করেনি, সেটি খুবই স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট।

রানা প্লাজা তার সর্বশেষ মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত। আমরা দেখছি যে যতবার দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রতিবারই ক্ষতিপূরণবাবদ আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে সরকার, উদ্ধারকর্ম পরিচালনায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হচ্ছে। গ্রিড মার্কেট আমাদের এমন উদাসীন, নিস্পৃহ মানুষে পরিণত করেছে যে সলিডারিটির ছিটেফোঁটা দেখাতেও বড়ো সঙ্কোচ আর দ্বিধা আমাদের, গর্ডন গেকোর মতোই।

রানা প্লাজার কথাই ধরা যাক। ইউরোপের সভ্যদেশগুলো যখন আমাদের এ দুর্যোগের পরিমাপ ও মাত্রা দেখে মর্মাহত, তার সরল প্রকাশে দ্বিধাহীন, বাংলাদেশে তখন হরতাল ও 'অবরোধের' নামে আরও জানমালের, সম্পদের যথেচ্ছ ধ্বংসের উৎসব অব্যাহত থাকে। যারা এসব করে, তারা নতুন আরেক ধরনের গর্ডন গেকো।

যাহোক, তৈরি পোশাক প্রসঙ্গে আসা যাক। শিক্ষা, ট্রেনিং, স্বাস্থ্যসহ এমনকি বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য ডিজাস্টার-ফান্ডের মতো কোনো সামাজিক-ব্যবস্থা বস্ত্রখাতে নেই বা গড়ে উঠেনি। পোশাকশিল্পে কমবেশি সাড়ে তিন কি চার মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করে; তারমধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা; মাসে গড়ে তাদের আয় তিন হাজার টাকা, অর্থাৎ ৩৮ ডলারের মতো হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, পেশাগত বৃদ্ধি নামক আন্তর্জাতিক শ্রমবিধির বিষয়গুলোও একেবারেই অনুপস্থিত।

কাজেই করমুক্ত ও কোটামুক্ত সিস্টেম স্থিতিশীল অবস্থা আর যাদের জন্যই নিয়ে আসুক না কেন, পোশাকশ্রমিকদের জন্য অবশ্যই আনেনি।

আশির দশক থেকে এ শিল্পের ক্রমপ্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বস্ত্র ও পোশাকশিল্পকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একক একমাত্র উৎস হিসেবে গড়ে উঠতে ও প্রতিষ্ঠিত হতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে সস্তামূল্যের অসংখ্য অজস্র গার্মেন্টসশ্রমিকের সরবরাহ বিধিবদ্ধ শ্রম-আইন কার্যকরীকরণও অসম্ভব করে তোলে, ন্যুনতম শ্রম-সংরক্ষণ পর্যন্ত অবহেলিত হয়।

ফলস্বরূপ মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমশ টেনশন সৃষ্টি হতে থাকে। এমনকি সময়মতো অর্ডার সাপ্লাইয়ে ব্যর্থ হলে, মালিকপক্ষ তাকে শ্রমিকপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত স্যাবোটাজ বা অন্তর্ঘাত বলে দোষারোপ করে; আবার মাসিক তিন হাজার টাকা মূল্যের নারীশ্রমিক যখন বলে, আমরা সেই সোনালী আঁশের সোনালী মেয়ে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একাধিক সেমিনারে নারীশ্রমিকের পক্ষ থেকে তা উচ্চারিতও হয়- টেনশন উপশমের কোনো লক্ষণ কিন্তু দেখা যায় না।

তাই নগদ মজুরি মিলবে- আশ্বাসবাক্য শুনলে, তিন হাজার টাকা মূল্যের নারী, শিশু, বালক-বালিকা, পুরুষ নির্বিশেষের শ্রমিকরা প্রতিবারই দৌড়ে যায় কাজ করতে। নিয়তিনির্দিষ্ট সেই দিনটিতে রানা প্লাজায়ও তারা গিয়েছিল। ইইউ'র দেশগুলোর পাবলিক টিভিতে আমাদের শ্রমিকের মাসিক মূল্য তিন হাজার টাকা, স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে শিশু ও বালক-বালিকার শ্রমে নিয়োগ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এখনও অব্যাহত রয়েছে, সঙ্গে ফুটেজ। সে সঙ্গে উদ্ধারকর্মেরও উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে; রেশমাকেও দেখানো হয়েছে।

এগুলোকে কিন্তু ইইউ'র 'মেসেজ' হিসেবে নিতে হবে। সলিডারিটি সমৃদ্ধ এ হুঁশিয়ারির অর্থ একটিই: অনেক হয়েছে, সহ্যের রুবিকন অতিক্রম করা হয়ে গেছে অনেক আগেই, আর করা সম্ভব নয়।

রানা প্লাজা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ'র বৈদেশিক নীতিবিষয়ক প্রধান ক্যাথরিন অ্যাস্টন ও বাণিজ্য কমিশনার কারেল ডি গুখট করমুক্ত ও কোটামুক্ত তথা প্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থাটি প্রয়োজন হলে অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। অ্যাস্টন ও ডি গুখট এমনকি গ্যাপ, ওয়ালমার্ট, টেস্কো, মার্কস এন্ড স্পেন্সার, জেসি পেনি, নাইকি, চিবো, কেলভিন ক্লাইন, টমি হিলফাইগার, সিয়ার্স কানাডা, ওয়ালমার্ট কানাডা, লব্ল' সমেত কম করে হলেও ৪৫ টি খুচরো বিক্রেতা কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে একান্ত আলোচনাও করেন।

ইইউ'র তরফ থেকে অ্যাস্টন ও ডি গুখটয়ের বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানির বিষয়টি রফতানিকারকের সঙ্গে পূর্বালোচনা করার পরামর্শটিও কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদের। কারণ গর্ডন গেকোত্বের কিছুটা তাদের ওপরও বর্তায়। এ আলোচনাকালে প্রিমার্ক ও লব্ল' নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সলিডারিটি ঘোষণা করেছে, তারা তা পালন করবে বলে আশা করা যায়। হয়তো আরও রিটেইলারও তাদের শরীক হবে।

তাছাড়া খুচরা বিক্রয় সমিতি রিটেইল কাউন্সিল অব কানাডা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানির জন্য নিজস্ব গাইডলাইনও তৈরি করছে।

এ একান্ত আলোচনায় বাংলাদেশের পোশাক তৈরিকারী ও রফতানিকারকদের সংস্থা বিজিএমইএ-য়ের প্রতিনিধিও ছিল। বিজিএমইএ-য়ের সদস্য সংখ্যা ৪০০০, রফতানিকৃত পোশাক থেকে প্রাপ্ত প্রতি পাঁচ ডলারের মধ্যে চার ডলারের হিস্যাদার তারা। বিজিএমইএ-য়ের সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে একে অন্যের কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী অগ্নিসংযোগজনিত দুর্ঘটনা ইত্যাদি সরেজমিন করে দেখে, কিন্তু নিজের সদস্যকে যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য করার কোনো দায়িত্ব সে নেয় না।

ফলে লেবার স্ট্যান্ডার্ডকে বুড়ো আঙুল দেখানোর শাস্তিস্বরূপ কোনো ব্যবস্থাবিধি সংস্থাটির নেই। বিজিএমইএ আসলে পেশাগত শক্তিশালী লবিং দল, তবে তারা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও অংশ নেওয়া শুরু করেছে। ইউরোপীয় পেশাগত সংস্থা বা লবিং দলের সঙ্গে বাংলাদেশের এ পার্থক্যগুলো লক্ষ্যণীয়।

যেমন, ইউরোপের দেশে ডাক্তারদের পেশাগত সংস্থায় কেউ কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে বা উকিল সমিতিতে কোনো উকিলের বিরুদ্ধে নালিশ করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে; জরিমানা করা, সদস্যপদ ঝুলিয়ে রাখা বা নির্দয়ের মতো সদস্যপদ বাতিলেও দ্বিধা করে না। লবিস্টের রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই।

অ্যাস্টন ও ডি গুখটয়ের একান্ত আলোচনায় সাড়ে তিন কি চার মিলিয়ন বস্ত্রশ্রমিকের কোনো প্রতিনিধি ছিল না বটে, তবে বিশ্বব্যাপী ৫০ মিলিয়ন শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়ন ১৫ মে'র মধ্যে পশ্চিমের খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বস্ত্রকারখানাগুলোর নিরাপত্তা ও অগ্নিনিরোধ সংক্রান্ত চূড়ান্ত একটি ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। সে সঙ্গে শ্রমমজুরি বৃদ্ধি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন-ব্যবস্থাসহ সামাজিক প্রজেক্টের ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। বিজিএমইএ-য়ের কংক্রিট পদক্ষেপ ও ভূমিকা কী হবে, সেটি হয়তো কালক্রমে বোঝা যাবে।

গর্ডন গেকোর ফুলস্টপ রানা প্লাজা- বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প বর্তমানে ইইউ'র সরাসরি মনিটরিংয়ের আওতায় রয়েছে। বাংলাদেশকে সফল হতেই হবে, নয়তো ইইউ তার তুরুপের তাসটি অর্থাৎ প্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থাটি অস্থায়ীভাবে অচল করে দিতে কুণ্ঠিত হবে না মোটেই।

অচল অবস্থা চালু করা যত সহজ, তাকে সচল করার প্রক্রিয়াটি যে কী পরিমাণ কষ্টকর, ভুক্তভোগী দেশ মাত্রই তা জানে। এমনকি অস্থায়ী অচল অবস্থার অনির্র্দিষ্টকালের জন্য সচল না হওয়ার ঘটনাও ইইউ'র ইতিহাসে রয়েছে। কারণ, সচল হওয়ার প্রক্রিয়ায় ২৮ দেশের (জুলাই মাস থেকে ক্রোয়েশিয়া ইইউ'র ২৮তম সদস্য হচ্ছে) প্রতিটির হ্যাঁ সম্মতি লাগবে। ফলে কোনো কারণে কোনো সদস্য সম্মতি প্রদানে গড়িমসি করলে কারও কিছু বলার নেই।

কোনরকমের হস্তক্ষেপ করার ঐতিহ্য নেই বলে অ্যাস্টন কি ডি গুখট-ও কিছু করতে পারবেন না। গর্ডন গেকোত্বর বদলে রলসিয়ান সুস্থ ফেয়ারনেসের অভ্যাস করা শিখতে হবেই।

নাদিরা মজুমদার: বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।