জাতীয় ঐক্য কি ধরে রাখতে পারবেন নওয়াজ

দেলোয়ার হোসেন
Published : 13 May 2013, 07:10 PM
Updated : 13 May 2013, 07:10 PM

পাকিস্তানের নির্বাচন বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের মতে, ১১ মে ২০১৩ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে। এ দেশের ৬৬ বছরের ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে একটি বেসামরিক সরকার আরেকটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। সে দিক থেকে দেখলে পাকিস্তান এমন একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যেটি সে দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও ভবিষতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবেই ইতিবাচক একটি পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ও সেখানে নতুন একটি সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) বিজয়ী হয়েছে। ২০০৮ সালের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটি এবার বিজয়ী হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে পার্লামেন্টে বৃহত্তম দল হিসেবে তারাই সরকার গঠন করবে।

এদিকে সরকারি দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। এ দলের সরকারকে বলা হচ্ছে ঐতিহাসিক সরকার। কারণ পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম একটি সরকার হিসেবে পিপিপি সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। দেখার বিষয় হল, পিপিপি শুধু নওয়াজ শরীফের দলের কাছে পরাজিত হয়নি, তারা উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি ও ক্রিকেটতারকা ইমরান খানের নেতৃত্বে গঠিত তেহরিক-ই-ইনসাফ, পাকিস্তান (পিটিআই) নামের দলটির সমানসংখ্যক আসন পেয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা ছিল, পিটিআই পার্লামেন্টে বৃহত্তম দলে পরিণত হবে। এ সম্ভাবনার চিন্তা থেকে পিপিপি পর্যন্ত ইমরানকে প্রস্তাব দিয়েছিল যদি কোনো দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে পিটিআই-এর সঙ্গে কোয়ালিশন করবে পিপিপি এবং সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হবেন ইমরান খান।

এখন প্রশ্ন হল, এ তিনটি দল কেন এমন ফলাফল করল। মুসলিম লীগ দলটি সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। এটি পাকিস্তানের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনকি নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগও (পিএমএল-এন) দুবার পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিল। একবার ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত। আরেকবার ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত। দুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বলে দলটির অভিজ্ঞতা বিরাট। নওয়াজ নিজে পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পাঞ্জাব হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। এ প্রদেশে যারা বিপুল ভোটে জয়ী হয়, তারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে ষাট শতাংশ ভোটার রয়েছেন পাঞ্জাবে। দ্বিতীয়ত, নওয়াজের পারিবারিক ইতিহাস বর্ণাঢ্য। পাঞ্জাবের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান নওয়াজ নিজেও পরে শিল্পপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। এসব ফ্যাক্টর তার দলকে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে।

তারপরও দেখা গেছে, দুবার ক্ষমতায় থাকার সময় তাকে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথমবার তাকে দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। দ্বিতীয়বার পারভেজ মুশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তিনি দীর্ঘদিন নির্বাসনে ছিলেন। এমনকি তার প্রাণসংশয়ও ছিল। এ জন্ই অনেকের ধারণা ছিল নওয়াজের রাজনৈতিক জীবন শেষ।এমন একটি পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তিনি ও তার আরেক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পিপিপিনেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানে ফিরে আসার সুযোগ পান। পরে বেনজিরকে হত্যা করা হয়। নওয়াজ ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলে তার দল দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এ যে নানা রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নওয়াজ শরীফ এগিয়ে গেছেন এটা তাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। আজ তাই তিনি ফের পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছেন।

তবে মুসলিম লীগের বিজয়ের পেছনে পিপিপির ব্যর্থতাও দায়ী। গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন পিপিপির অজনপ্রিয়তা নওয়াজকে সুযোগ করে দিয়েছে। এ সুযোগে নওয়াজ শরীফ তার নির্বাচনী প্রচারে অভিনবত্ব এনেছেন। তার শ্লোগান ছিল ক্ষমতায় গেলে পাকিস্তানকে 'এশিয়ান টাইগারে'-এ পরিণত করবেন। তিনি পাকিস্তানের শান্তি ও নিরাপত্তার পাশাপাশি উন্নয়নের দিকে ফোকাস করেছেন তিনি। একে সবাই ইতিবাচক মনে করছেন।

এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে একটি ফ্যাক্টর প্রধান ভূমিকা রাখছে। তালেবানরা পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান নিয়ামক শক্তি এখন। বিশেষ করে পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে এদের প্রভাব অনেক বেশি। তবে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপের পর গোটা পাকিস্তানে তালেবানদের এক ধরনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তালেবানরা যদিও সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয় না বা এরা রাজনীতি করে না, কিন্তু এদের একটি প্রভাব রয়েছে। দেখা গেছে, মুসলিম লীগের সঙ্গে তালেবানদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এমনকি ইমরান খানের দল পিটিআই-এর সঙ্গেও এদের সম্পর্ক ভালো। এসব দলের কাউকে ওরা কখনও টার্গেট করেনি। করেছে তুলনামূলক লিবারেল পিপিপি, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) এবং এমকিউএমের মতো দলকে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এবারকার নির্বাচনে তালেবান ফ্যাক্টর নওয়াজের পক্ষে কাজ করেছে।

নির্বাচনে পিপিপির পরাজয়ের আরেকটি কারণ নেতৃত্বের অসারতা। বেনজির-উত্তর সময়ে দলটি নাজুক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বেনজির-হত্যার পর তার তরুণ পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে পিপিপির প্রধান নিযুক্ত করা হয়। নির্বাচনের আগে বিলাওয়ালের নেতৃত্বের অপরিপক্কতা বেশ স্পষ্ট হয়েছে। যেমন তিনি পারিবারিক কারণে তার পিতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন। তারপর তিনি নাটকীয়ভাবে পাকিস্তান ছেড়ে দুবাইতে চলে যান। নির্বাচনের প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রেসিডেন্ট জারদারিকে ছেলের মান ভাঙাতে দুবাইতে যেতে হয়েছে। আবার নির্বাচনের ঠিক আগেও নিরাপত্তার কথা বলে বিলাওয়াল পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান।

একটি দলের প্রধান যখন এ ধরনের হাস্যকর ও নাটকীয় আবহ তৈরি করেন তখন জনগণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। এ ধরনের দ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তা ও অপরিপক্কতার মধ্যেই পিপিপি নির্বাচনি বৈতরণী পার করেছে।

পিপিপির পরাজয়ের পেছনে আরও কিছু ফ্যাক্টরও কাজ করেছে। ক্ষমতার শেষদিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে পিপিপির সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে নানা কারণে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধ ছিল সরকারের। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা গত পাঁচ বছরে পিপিপি ফেস করেছে তা হল 'মি. টেন পার্সেন্ট' হিসেবে প্রেসিডেন্ট জারদারির সেই পুরনো পরিচিতি। ব্যাপক দুর্নীতির জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবসময়ই ছিল। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দুর্নীতির সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়গুলো নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে।

ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিকল্প অনুসন্ধানের চেষ্টা। দীর্ঘদিন ধরে পিপিপি ও মুসলিম লীগ এ দুটি দলই পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিল বা ক্ষমতার বাইরে থেকেও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অন্যান্য ফ্যাক্টরের পাশাপাশি এ দুটো দলও অনেকাংশে দায়ী। তাই এদের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা থেকে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। এটা পাকিস্তানের জনগণের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ছেষট্টি বছর পর তারা একটি বেসামরিক সরকারের হাত থেকে আরেকটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছেন।

সে দেশের রাজনীতির এ জটিল সমীকরণের মধ্যেই ইমরান খানের দল একটি নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জনগণ পিটিআই-কে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জায়গায় দেখতে চেয়েছিল। বিশেষ করে তরুণসমাজের কাছে ইমরানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন ইমরান। ফলে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে প্রবীণদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। অনেক সাবেক আমলা, সেনাকর্মকর্তা ও এমনকি পিপিপির কজন নেতা ইমরানের দলে যোগ দেন।

এভাবে হঠাৎ করে তেহরিক-ই-ইনসাফ একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও আগে অভিজ্ঞতা ছিল না বলে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। তবে পিপিপির কাছাকাছি আসন পাওয়া ভবিষতে তাদের একটি বড় শক্তি হয়ে ওঠার লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে।

পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন যে পরিবেশে হয়েছে সেটিও খুব আকর্ষণীয়। একে অনেকে বিস্ময়কর বলে আখ্যা দিয়েছেন। সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবরকম সহযোগিতা দিয়েছে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর পরিপক্কতার প্রমাণ দেয়। যদিও এ নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে, কিন্তু যেমন ভাবা হয়েছিল ততটা হয়নি।

কথা হচ্ছে, পাকিস্তানের এ নির্বাচন সে দেশের গণতন্ত্রের জন্য কতটা সুফলদায়ক হবে। এ নির্বাচনে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে যে ফ্যাক্টর মানে সামরিক বাহিনী তাদের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। তারা বেসামরিক সরকার ও প্রশাসনকে সবরকম সহযোগিতা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে সেখানে বেশকিছু রাজনৈতিক সংকট ছিল। একসময়কার সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ও তাকে রাজনীতিতে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবু সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায়নি বা ক্ষমতা দখল করেনি। ভবিষ্যতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এ বিষয়গুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

দ্বিতীয়ত, যে ধরনের সরকার এখানে গঠন হতে যাচ্ছে তাকেও ইতিবাচক মনে করা যায়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় এ সরকার নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবে না। তাতে একটি চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে। আরেকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নওয়াজ বলেছেন, তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চান না, সবাইকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এরকম ইতিবাচক অ্যাটিচুড থাকলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাজমান সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক অনৈক্যের ধারাটি বাদ গিয়ে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে।

তবে কাজটা খুব কঠিন। জঙ্গীবাদ এখানকার রাজনীতিতে শেকড় গেড়ে বসে আছে। জাতিগত সহিংসতা বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে। ওদিকে সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে একেক প্রদেশে একক দলের সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ, সিন্ধু প্রদেশে পিপিপি এবং পাখতুনওয়ালাতে তেহরিক-ই-ইনসাফ জয়ী হয়েছে। নওয়াজের সামনে তাই একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠার সুযোগ সীমিত। সেক্ষেত্রে তাকে জাতীয় ঐক্য গঠন করতে হবে। আর সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাকিস্তানের ভেতরে মার্কিন ড্রোন হামলা, আফগানিস্তানে ন্যাটো-মার্কিনের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি ঘটনার কড়া সমালোচক ছিলেন নওয়াজ শরীফ। মার্কিন নীতির বিরোধিতা করে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু এ অঞ্চলে মার্কিনের প্রভাব যে রকম তাকে অস্বীকার করে তিনি কি রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন? পুরো বিষয়টা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও আরেকটি ফ্যাক্টর। গত কয়েক বছরে পাক-ভারত সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নওয়াজ শরীফ দুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিলেন। তাই এ বিষয়ে তিনি পরিপক্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেই আশা করা যায়।

তালেবান আরেকটি জটিল ফ্যাক্টর। আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানে এদের প্রভাব বেড়েছে। পাকিস্তানের তালেবানরা কিন্তু 'মন্দের ভালো' হিসেবে মুসলিম লীগ বা তেহরিক-ই-ইনসাফকে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু ওরা আসলে যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা চায়, একটি মৌলবাদী ব্যবস্থা- সেটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দলগুলো তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। নওয়াজ নিজে একটি পশ্চিমাধাঁচের বহদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চর্চা করেন, মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থাটি একটি বহদলীয় গণতন্ত্র। এ ব্যাপারে সেখানে বড় ধরনের জাতীয় ঐক্য রয়েছে। নওয়াজকে তাই একটি নাজুক ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে তিনি যদি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেন বা পাকিস্তানে ইসলামাইজেশনের জন্য পদক্ষেপ নিতে থাকেন তাহলে সেখানে অস্থিরতা তৈরি হতে থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর বিরাট প্রভাব পড়বে। ফলে সেটাও তার জন্য সুখকর হবে না।

এটা ঠিক যে, পাকিস্তানে পিপিপি ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে উদারনৈতিকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হত। নওয়াজ শরীফের সময় তালেবানরা শক্তিশালী হবে। ওরা কিন্তু এ পর্যন্ত পিপিপি ও এএনপি-র নেতাকর্মীদের ঘোষণা দিয়ে হত্যা করেছে, নওয়াজদের কখনও টার্গেট করেনি। ফলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও দার্শনিকভাবে যারা উদারনৈতিক- নওয়াজের শাসনামলে তাদের আরেকটু চাপের মধ্যে পড়তে হবে।

তারপরও সব মিলিয়ে পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন সে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ অঞ্চলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। বিশেষ করে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল, তাতে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলেই সবার ধারণা। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি শিক্ষা। দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকলে এবং রাষ্ট্রের ভেতরের প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা করলে একটি দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব সেটাই দেখিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান।

দেলোয়ার হোসেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।