লড়াকু রেশমা আর সুলতানা-জমিলাদের প্রতিবাদ

জোবাইদা নাসরীনজোবাইদা নাসরীন
Published : 11 May 2013, 02:32 PM
Updated : 11 May 2013, 02:32 PM

এক

রেশমারা্ বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে ওরা প্রমাণ করে পুঁজিবাদী দুনিয়াতে ওরাই বড় সত্য, এর চেয়ে বড় আর কোনোটি নয়। সাভারে রানা প্লাজা ধসের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া হাজারের বেশি লাশের বহর এখন পর্যন্ত আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট, যন্ত্রণার জায়গা। কিন্তু তবুও ঘটনার সতের দিন পর বাতাস ভারি করা দুর্গন্ধ, শেষ সম্বল ছবিটিকে বুকে আঁকড়ে স্বজনদের আহাজারি, হাড়গোড় আর কঙ্কালের ভিড় ঠেলে জীবিত রেশমা সকল উৎকণ্ঠা, জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় পাশ কাটিয়ে হাজির হয়েছে।

রেশমা আমাদের কাছে ফিরে এসেছে এটাই বড় সত্য। তাই আমাদের চোখের সামনে যখন বারবার আগুনেপোড়া আর ধ্বংসস্তূপে চাপাপড়া জীবনগুলো ছাই হয়ে যায়, আমাদের স্বপ্ন্ থেকে ফসকে যায়, তখন আমরা কেবলই মানবিক হাহাকারের জপ তুলি। কিন্তু কিছুই বন্ধ হয় না। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের আন্দোলিত করে কিছু এজাজউদ্দিন কায়কোবাদের মতো মানবিক মানুষের মুখ। শাহীনার মৃত্যু কাঁদিয়েছে আমাদের, বিনম্র শ্রদ্ধায় চোখের জল আনিয়েছে কায়কোবাদের বিদায় সংবাদটি।

এতকিছুর মধ্যে রেশমার বেঁচে থাকা এবং উদ্ধার হওয়া সকল পুঁজিবাদী বায়নার বিপরীতে বিরাট অর্জন। বিয়াল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা অনেক। দক্ষ জনবলের বিপরীতে মানবিকতার ওপর ভর দিয়ে এদেশের মানুষ সাহসের যে লাঠিটি তুলে ধরেছে উদ্ধারকাজে তা বাংলাদেশ অনেকদিন মনে রাখবে।

দুই

প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশ হয়ে গেল। এ সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রড-সিমেন্ট আর বড় বড় লোহার রডে ছিদ্র ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জীবনগুলোর। আমাদের ভোঁতা হয়ে যাওয়া ইন্দ্রিয়গুলো অবসরে সচল হয়ে ওঠে, আমরা কেবলই লাশ দেখি, কেবলই বাঁচার আকুতি শুনি। আর এ আকুতি আমাদের নিয়ে যায় প্রতিরোধের দরবারে। এদেশের নারীর লড়া্ই বারোয়ারি। ঘরে-বাইরে তার লড়াই। শুধু পুরুষতন্ত্রই তার শত্রু নয়, তার শত্রু অনেক। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা বৈষম্যের উপাদান, সবকিছুই নারীর বিরুদ্ধে কাজ করে। পুঁজিবাদ, ধর্ম, বর্ণবাদ, জাতিভেদ সকল কিছুর সঙ্গে হাত ধরে এগিয়ে চলে পুরুষতন্ত্র আর ব্যবহৃত হয় নারীর বিরুদ্ধে। একেক জন এগোয় এগুলোকে বগলদাবা করে।

বাংলাদেশে যখন চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আন্দোলন, তখনই গজায় হেফাজতে ইসলাম। নারীবিদ্বেষী দুই দফা, সংবিধানবিরোধী আরও কয়েক দফা সম্বল করে দুই পর্বে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। বিরোধী দলনেত্রী চোখ বুজে এ তের দফায় সমর্থনই শুধু দেননি, এ দেশের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে। সরকারি দল সুযোগ করে দিয়েছে এ দফাগুলো প্রচার করার জন্য। কেউ রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেননি। নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করার পাশাপাশি হেফাজত প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধের দাবি তোলে।

এরই প্রতিবাদে ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে নারীরা প্রতিবাদী সমাবেশ-মিছিল বের করে। আজকের এ নারী মহসমাবেশ হেফাজতের নারীবিদ্বেষ কেন্দ্র করে হলেও এ পাটাতন বাংলাদেশের অনেকগুলো অমীমাংসিত বিষয়ের ফয়সালা স্পষ্টতই চায়। বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে নয় বরং নারীবিদ্বেষের সকল দ্বারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই লড়াই-এর ময়দানে থাকতে চায় নারী। আর চায় বলেই এ ময়দানের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক এবং সমতার বাংলাদেশ তৈরি করা নারীর মতাদর্শিক জায়গা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও ওই সমতার জায়গাটি তৈরি করার জোর তাগিদে এ সমাবেশ। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে, একজন শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে আমরা যে গর্ববোধ করি, একজন বীরঙ্গনার সন্তান হিসেবেও পরিচয়ের সমপরিমাণ গর্ব আমরা চাই। মুক্তিযুদ্ধের পৌরুষদীপ্ত ইতিহাসের বিপরীতে লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক ইতিহাস এ নারীরা তৈরি করবেন।

সমাবেশ আরও বলছে নারীনীতির কথা, তা বাস্তবায়নের কথা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরষের সমঅধিকারের কথা, বলছে সিডও সনদ বাস্তবায়নের কথা। নারীর বিরুদ্ধে সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়নের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কথা। আরও বলছে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথের কথা, মতের কথা, ঈর্ষণীয় সংগ্রামের কথা।

তিন

ইবসেনের নোরা সংসার থেকে বের হয়ে গিয়েছিল পুতুলঘরে থাকবে না বলে। আর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর জমিলা ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধাচরণ করে থুতু ছিটিয়েছিল মজিদের মুখে। সুলতানার স্বপ্ন এখনও এ দেশের নারীর আরাধ্য। তবু এ দেশের নারীই পারে সন্তান বুকে নিয়ে, কোলে নিয়ে শরণার্থী হয়ে শিবিরে শিবিরে দৌড়াতে, পারে ভেঙে যাওয়া ভেসে যাওয়া ঘরখানির টুকরো খুঁজে এনে আবার সংসার গড়তে। কলাগাছের ভেলায় কিংবা টিনের চালে বসে খড়কুটো সংগ্রহ করে রান্না করে সকলকে বাঁচিয়ে রাখার স্পর্ধা দেখাতে।

এত সামর্থ আছে বলেই নারীর ঘরে-বাইরে এত শত্রু। আর তাদের মোকাবেলা করেই তাকে টিকে থাকতে হয়। এ জন্য এ দেশের সকল সংগ্রামী নারীর জীবন এত সমৃদ্ধ, এত দৃঢ়। জীবনের বিস্ময় কাটে না এ সংগ্রামী নারীদের পথ দেখে জীবন চিনে নেওয়ার, ছেনে নেওয়ার দুর্দমনীয় সাহস দেখে। শ্লোগানে শ্লোগানে মানবিকবোধের জয়গান শুনে।

আর রেশমাদের সতের দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা পড়ে।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।