Published : 09 Jan 2017, 06:52 PM
কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে কখনও ভাবেনি নাগরিক সমাজ। ওখানে যারা পড়ে তারা অনাথ অথবা গ্রামের গরিবের সন্তান। ধর্ম বিষয়ে স্পর্শকাতর নাগরিক মুসলমানেরা ধর্মচর্চার অলাভজনক দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছে নিম্নবর্গের মানুষের কাঁধে! গরিব শিশুরা দুনিয়াদারিমুক্ত শিক্ষায় মেতে আছে ভেবে এতকাল তৃপ্ত থেকেছে লাভসন্ধানী নাগরিক মুসলমান। কেমন এ শিশুদের জীবন?
হেফাজতের মূল আস্তানা হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তির সময় সব ছাত্রকে উর্দুতে লেখা একটি হলফনামায় সই করতে হয়। মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা কতটা দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ তা বুঝতে এ হলফনামাই যথেষ্ট। এতে ছাত্ররা শপথ নেয়, কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিবে না, কোনো ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হবে না, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত সংবাদপত্র, সাময়িকী ও বই পড়বে না, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো পরীক্ষা দেবে না, টেলিভিশন দেখবে না, খেলাধূলাসহ যে কোনো ধরনের পাঠ্যবহির্ভূত কাজে (এক্সট্রা কারিকুলার) অংশ নেবে না, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবে ইত্যাদি! এটি কি দাসখত নয়? দেশের সব কওমি মাদ্রাসায় একই ব্যবস্থা চালু আছে বলে জানিয়েছেন হ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মুমতাজ আহমদ।
মাদ্রাসাছাত্ররা হুকুমের গোলাম হওয়ায় অসংখ্য শিশু-কিশোরকে ৫ মে ঢাকায় আনতে পেরেছিলেন হেফাজত নেতারা। এসব শিশু-কিশোররা হয় অনাথ অথবা এমনসব পরিবারের সন্তান যাদের অভিভাবকদের গুরুত্ব নেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে। তাই এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এসব শিশুদের নির্দ্বিধায় আনতে পেরেছিলেন তারা। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে আসে নিঝুম পাড়াগাঁয়ের এসব শিশু আর ঢাকামুখো হতে চায় না। বোঝাই যায়, ৫ মে রাতে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির ভয়ঙ্কর শব্দ-হামলায় তাদের কতটা মনোবৈকল্য হতে পারে! আর '১০ মিনিটে মতিঝিল-জয়ের' তৃপ্তি কি চিরস্থায়ী?
ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন শিক্ষকের সহায়তায় করা অধ্যাপক মুমতাজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট দেশে বোমাবাজির পর মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আলোচনায় উঠে আসে। মাদ্রাসায় জঙ্গী তৈরি হচ্ছে এমন আশঙ্কাও দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে আলোচিত হয়।
তিনি জানিয়েছেন, হাটহাজারী মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন আশির দশকে পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে তাদের ছাত্ররা আফগান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তবে 'জিহাদী' তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে তারা যুক্ত নন বলে দাবি করেন। এছাড়া পাকিস্তানের দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষকদের যোগাযোগ থাকায় সেখানকার অনেক ছাত্রও সোভিয়েতবিরোধী ওই যুদ্ধে যোগ দেয়। এ তালিকায় রয়েছে অনেক কওমি ও আহলে হাদিস মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকও।
আশির দশক থেকে পাকিস্তানি মাদ্রাসাগুলোয় জঙ্গী তৎপরতা নিয়ে গবেষণা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনির্ভাসিটি অব নিউ ইংল্যান্ডের গবেষক জাহিদ শাহাব আহমেদ। পাকিস্তানের সাইদ নাদির এল-এদরুসকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, প্যাট্রিক বেলটনের গবেষণায় দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে জঙ্গী তৈরির উদ্যোগ নেয়। সেভিয়েতবিরোধী 'পবিত্র' যুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে ইউএসএআইডি-এর অর্থায়নে নেব্রাস্কা-ওমাহা ইউনির্ভাসিটিতে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়। পাকিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী জঙ্গী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং শিয়াবিরোধী কার্যক্রমে সৌদি আরব দেদার টাকা ঢেলেছে। শাসকের ছত্রছায়ামুক্ত থাকতে ব্রিটিশ সহায়তা বর্জন করেই গড়ে ওঠে দেওবন্দি মাদ্রাসার ধারা। আর তাদেরই উত্তরসূরি এসব খারিজি-দেওবন্দি মাদ্রাসাগুরুরা মার্কিন সহায়তায় জিহাদী প্রকল্প পরিচালনায় নামে! ফলে এ ধারার অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতিতে তফাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'এরা দুনিয়াদারি নিয়ে ভাবে না' এমন আপ্তবাক্যে মশগুল থাকা এবং বাংলাদেশে জঙ্গী ধ্যানধারণার বীজ কতদূর ছড়িয়েছে স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও একে লঘু করে দেখা আহম্মকিই বটে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের জরিপে বলা হয়েছে, আশির দশক থেকেই এ দেশে প্রায় শতভাগ হারে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অসমর্থিত এক হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার নিবন্ধিত কওমি মাদ্রাসায় দুই লাখ শিক্ষক এবং ৪০ লাখ ছাত্র আছে। এর বাইরেও অসংখ্য অনিবন্ধিত মাদ্রাসাও রয়েছে। হঠাৎ কেন এত মাদ্রাসা বৃদ্ধি পেল? এত মাদ্রাসার অর্থায়নই বা আসছে কোথা থেকে? এর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই আলেম-উলেমারা নানা আন্দোলনও গড়ে তুলছেন।
আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় আশির দশক থেকেই মাদ্রাসাগুরুরা নানা সময় সোচ্চার হন। নারী, ফতোয়া ইত্যাদি ইস্যুতে শুধু আন্দোলনই নয় পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামি এনজিও গড়ার কাজেও নামেন তারা। তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি অনুদান আসতে থাকে। আমেরিকা, ইউরোপ থেকেও নানা নামে অনুদান পান তারা। মসজিদ, এতিমখানা, ত্রাণ ইত্যাদি কর্মসূচির নামে আসছে এসব টাকা-পয়সা। এছাড়াও এসব এনজিওকে ইসলামী ব্যাংক ও আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক নিয়মিত অনুদান দিয়েও থাকে বলে জানাচ্ছেন অধ্যাপক মুমতাজ।
সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নামে নাগরিক তরুণ সমাজ। বিপুল সাড়া পেয়ে ফাঁসির দাবি ছাপিয়ে ছয় দফায় গড়ায় তাদের আন্দোলন। জামায়াতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভিহিত করে ইসলামী ব্যাংক বর্জনের আহ্বানও জানান তারা। এমন নাজুক অবস্থায় ব্যাংকটির হর্তাকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে।
শাহবাগের গণজোয়ারে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে জামায়াত-শিবিরও। ব্যাপক সহিংসতা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে চান তারা। এসময়ই 'দৈনিক আমার দেশ' সৃষ্টি করে নাস্তিক ইস্যু। আর তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজত। ব্লগার নেতারা মাথায় টুপি দিয়েও এদের বিরোধিতা থেকে রেহাই পাননি।
আদর্শগতভাবে দেওবন্দি উলেমারা জামায়াতগুরু মওদুদির বিরোধী। তাই হেফাজত জামায়াতবিরোধী শাহবাগ আন্দোলনের কড়া প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠায় অনেকেই অবাক হন। কিন্তু অরাজনৈতিক বলে দাবিদার কওমির অনেক উলেমা খেলাফতে মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নিজাম-ই-ইসলাম পার্টি এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সমর্থক। আওয়ামী লীগ সমর্থক উলেমাও রয়েছেন। এসব উলেমাদের বেশকটি দল বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটেও সক্রিয়। নানা উৎসে বাধা পড়া উলেমাদের কাছে তাই মওদুদি-বিরোধিতা এখন শুধুই বাক্সবন্দি তত্ত্ব। এ কারণেই তাদের ১৩ দফা কর্মসূচিতে স্থান পায় না জামায়াত প্রসঙ্গ।
মুমতাজের জরিপে ৭০ শতাংশ কওমি ও ১৭ ভাগ আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রশিক্ষক মেয়েদের ঘরে আবদ্ধ রাখার পক্ষে মত দেন। ফলে নারীস্বার্থবিরোধিতা তাদের ১৩ দফার মূলে থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে অধিকাংশ উলেমার কাছে মহান নেতা জিয়াউর রহমান; যিনি নারীদের জন্য ৫০ ভাগ কর্মসংস্থান সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করে গেছেন!
ধর্মশিক্ষায় গ্রামের প্রান্তজনের সন্তানরা আটকে থাকায় নাগরিক সমাজের সন্তানরা এক অর্থে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্জন করে আসছে উপার্জনের সব ক্ষেত্র। যাদের কখনও আমলে নেওয়া হয়নি তারাই আজ বড় বাধা হয়ে উঠছে। দেশের উন্নয়ন ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তারা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তানেও এ চিন্তা এখন জোরালো। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিপলস পর্টি মাদ্রাসাব্যবস্থার সংস্কার অতি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
উলেমারা আর আগের মতো মসজিদের ইমাম বা মক্তবের হুজুর হয়ে শুধু দ্বীন নিয়ে বসে থাকতে রাজি নন। দেশি-বিদেশি অর্থের ও স্বার্থের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন তারা। দুনিয়াবিমুখ এ মানুষরা দেখতে পাচ্ছেন দুনিয়ায় তারা এখন কত দরকারি। তাদের অবস্থার এ পরিবর্তনে বড় সহায়ক হয়েছে মুফতে পাওয়া গরিব আদম সন্তানরা। কী-বা করার আছে এতিম ও গরিব শিশুদের? ছেলেগুলো মাদ্রাসায় অন্তত দুবেলা বিনে পয়সায় খেতে তো পায়। তাই লাশ হয়ে ঘরে ফেরা না পর্যন্ত গ্রাম্য অভিভাবকরা বুঝতেও পারেন না সামান্য সুবিধের জন্য আত্মজের বিকাশে কী সর্বনাশ তারা করে চলেছেন!
এখন সময় এসেছে এতিম ও গরিব ঘরের সন্তানদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার। সরকারের জন্য জরুরি কাজ এতিমদের জন্য বিনা খরচে গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক আবাসিক সাধারণ স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং সব শিশুকেই সাধারণ শিক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে কালক্ষেপণ অহেতুক। পকেটে টাকা থাকলে গ্রামের মানুষও পানিপড়া নেওয়ার আগে ডাক্তারের কাছেই যায়।