‘তোমার পতাকা বহিবার শকতি দাও যারে’তারে কি এমন করে মারে!

মানস চৌধুরী
Published : 18 July 2010, 10:04 AM
Updated : 18 July 2010, 10:04 AM

পতাকা যে উত্তোলন করা যেতে পারে বা নিয়মিত উত্তোলন করা হয়, তাতে আমাদের এক বন্ধুর কিছুতেই আরাম হতো না। নিয়মিত পতাকা উত্তোলন হতো। আর ও উসখুস করত। ওর মতে উত্তোলন বললে কেমন ভারী ভারী জিনিস মনে হয়। যেমন ভারত্তোলন। পতাকার মতো ফুরফুরে আর উড়ু উড়ু জিনিসের পক্ষে উত্তোলিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেহেতু এই কাজটি রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনে খুবই নৈমিত্তিক, আনুষ্ঠানিক তো বটেই, আমাদের তো একটা নাম লাগবে! সে কথা ওকে বলতেই ওর ফয়সালা হলো—'পতাকা উড্ডয়ন'। ট-বর্গীয় একটা যুক্তাক্ষরে উড়ু উড়ু ভাবটা খুব যে একটা ফুটল না সেটা ও নিজেও জানে। কিন্তু আমাদেরও মানা ছাড়া উপায় থাকল না যে পতাকা এমন কিছু দু'চার মণ ওজনের না যে উত্তোলন করতে হবে। পতাকা যে এমন উত্তোলনীয় ভারী রূপ ধারণ করতে পারে সে বিষয়ে কিছুমাত্র অনুমান যদি তখন করতে পারতাম তাহলে বন্ধুকে নিরস্ত করা যেতে পারত। এমন ভবিষ্যৎ-গণনা কি আর সাধারণ লোকে পারে?
———————————————–
খবর: জাতীয় পতাকা অবমাননার শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
———————————————–
৪ঠা জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমন এক জিনিস পাশ হলো যা নিয়ে শৈশবে আমাদের অনেক মাথাব্যথা ছিল। আমাদের বলতে আমার তো ছিলই, আমার পরিচিত রুচিকাতর বেশ দু'চারজন শিশুর কথাও আমি মনে করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের ছবি ঠিকঠাক সোজা করে টাঙানো হলো কিনা, নজরুলের চুল আঁকতে গিয়ে কোঁকড়াটা নষ্ট হলো কিনা, কিংবা ১৬ই ডিসেম্বর ডিসিকে স্যালুট দিতে গিয়ে হাতার পাতার এ্যাঙ্গেল আসলে ঠিকঠাক মতো রাখতে পেরেছিলাম কিনা; ইত্যাদি নানান কিছু। আমি নিজে সবচেয়ে কষ্ট পেতাম যখন কেউ রবীন্দ্রনাথকে আঁকতে গিয়ে শ্যামলের দাদু বানিয়ে ফেলত। এসব কার্যকলাপ তখন বাঙ্গালা সংস্কৃতির প্রতি চরম এক চপেটাঘাত মনে হতো। আর খোদ সংস্কৃতিকে মনে হতো ভক্তিসাপেক্ষ এক নাজুক জুবুথুবু বিষয়। একটা চপেটাঘাতে সে বুঝি খোয়া যাবে। বড় হয়ে যাবার পর বুক-পকেটে-আগলে-রাখা এক চড়ুইয়ের বাচ্চা হিসেবে সংস্কৃতিকে দেখার আর কোনো কারণ পাই না।

সুবিধাটা হচ্ছে, সংস্কৃতি নিজে পুলিশ না, পুলিশ নিয়োগ করে তার ভক্তিভাব নিশ্চিত করতেও হয় না। সংস্কৃতির হয়ে মানুষজন নিজেই পুলিশগিরি করে দেয়। মর‌্যাল পাহারাদারি নিশ্চিত করে। তারপরও যথেষ্ট হিংস্র না-হলে মানুষজনের সেই পাহারাদারিটা সামাল দেয়া যায়। মোকাবিলা করার উপায় বের করা যায়। সেটাও সংস্কৃতি বটে। অসুবিধাটা হচ্ছে, রাষ্ট্র যখন ভক্তিভাব জাগাতে মরিয়া হয়ে যায় তখন সে সত্যি সত্যি পুলিশি ব্যবস্থা কায়েম করে। জাতীয় পতাকা কিংবা প্রতীকের প্রতি সম্মাননা নিশ্চিত করার জন্য যে পদক্ষেপ সম্প্রতি মন্ত্রীসভা নিয়েছে সেটা এই ধরনের উদ্যোগের গুরুতর উদাহরণের একটি। আমার নিজের জন্য তবু আরামের কথা হচ্ছে জাতীয় ফলের প্রতি অবমাননার বিষয়ে কোনো আইন পাশ হয়নি। নচেৎ এই বয়সে কাঁঠাল-সেবনের মতো প্রকট একটা কাজ নতুন করে আমার রপ্ত করতে হতো। এবং হঠাৎ কাঁঠাল-সেবন-জনিত ফলাফল আমার ছোট্ট বাসার আশপাশের প্রতিবেশিদেরও হাতে-নাতে মানে নাকেমুখে পেতে হতো। তাঁরা তাতে বিশেষ খুশি হতে পারতেন বলে মনে হয় না, কাঁঠাল তাতে যতই সম্মানিত হয়ে উঠুক না কেন।

জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কাঁঠাল নিয়ে এখনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমার। শৈশবেই স্পষ্ট বুঝে গেছিলাম এটি আমার পছন্দের ফল নয়। আমার নবরুচিলব্ধ মা-বাবা এ নিয়ে কসরৎ করতে যান নাই আমার সাথে। বরং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পতাকা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে অনেক আগেই। প্রথমে তো পতাকার নানাবিধ লাল, নানান মাপের বৃত্ত দেখে দেখে বড় হয়েছি। দেশের প্রতি প্রেম বস্তুটা যে অনেক টান পড়ে গেছে তাতে তা কোনোদিন মনে হয়নি, বড় হয়ে। আর জাতীয় সঙ্গীত। হেন সুর নাই যাতে এই গানখানা গাওয়া হয়ে থাকে না। হেন বাণী নাই যা আরাম-আয়েশে এই গানের চরণে ঢুকে পড়ে না। বিভিন্ন স্কুলে ব্যাজারমুখো বাচ্চারা যখন ততোধিক ব্যাজার মুখে ঠা-ঠা রোদ্দুরে ভুরু কুঁচকে এই গানখানা গাইতে থাকে আর কর্তব্যবিহ্বল ও গানবিবর্জিত সরকারী স্কুলের শিক্ষক কুল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ঐতিহাসিক কারণে, সেই গান শুনতে থাকেন এবং হয়তো নিজেদের আর গাইতে হয় না ভেবে পরিতোষের কারণও খুঁজে পান, তখন শৈশবে আমার দেশপ্রেমের টান পড়লেও বড় হয়ে মনে হয়েছে এই গানখানিকে সংরক্ষণের সবচেয়ে মহৎ উপায় গানটা গাইতে না দেয়া বরং। হঠাৎই এক ঘটনায় মনে হলো হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাটাই সবচেয়ে ভারী, সবচেয়ে সংরক্ষণযোগ্য বস্তু। আর সেই পতাকা সংরক্ষণ করার দায়দায়িত্ব প্রধানত বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের, এবং অতি অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের।

সময়কালটা এতদিন পরে ঠিক মনে নেই। তবে বিল ক্লিনটন একবার বাংলাদেশে আসতে মনস্থির করেছিলেন। তিনি সম্ভবত পাশের দেশ পর্যন্ত চলেও এসেছিলেন। এরপর বাংলাদেশের কোন ধানক্ষেত থেকে তাঁর উপর সম্ভাব্য মর্টার কিংবা রকেট কিংবা হয়তো মিসাইল আক্রমণের লক্ষণ আবিষ্কার করে ফেললেন তার গোপন প্রতিরক্ষা বিভাগ। তিনি আর এলেন না। তবে তিনি না এলেও আমাদের মিত্রদের পরিকল্পনা ও উদ্দীপনা একই থাকল। যেমনটা থাকল তাঁর ভক্ত রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের। আমরা রাস্তায় নেমে তাঁর সফরের এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা কড়া সমালোচনা করে শ্লোগান সাজালাম। দু'চার শ' লোক মিলে মিছিলও হলো। আমাদের পরিকল্পনা মাফিক আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাও নিয়ে এসেছিলাম। পল্টন এলাকায় মিছিল শেষে সেই পতাকা পুড়িয়ে মার্কিন সমালোচনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে যাচ্ছিলাম আমরা। এতক্ষণ যেসব পুলিশেরা আমাদের সাথে সাথে কৌতূহল ও কৌতুক নিয়ে ঘুরছিলেন তাঁরা এখন ভ্যান-ট্যান থেকে নেমে চৌকষ একটা পিটানি লাগিয়ে দিলেন আমাদের। এত পেশাদার ছিল সেই পিটানি যে অনেকেই তাদের সদ্যকেনা জুতো-টুতো ফেলেই দৌড়াদৌড়ি করল। তবে পুলিশও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার সম্ভাব্য কোনো অবমাননাই ঘটতে দিতে যাতে না হয় সেজন্য দোকান পাটে ঢুকে, পাশের মার্কেটের গলিতে ঢুকে টেনে-হিঁচড়ে পতাকাবাহী ও মিছিলকারী দলের সকলকেই ন্যূনতম একটা অন্তত লাঠির-বাড়ি দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। আমরা কেউ কেউ, ক্রোধজনিত কারণেই, পুলিশেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাকরি করে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। আর কেউ কেউ ওই পতাকা ওদের ভ্যানে লাগিয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। যাঁরা পুলিশ বিভাগের কর্তব্যে এহেন সংযোজন করেছিলেন তাঁদের কপালে দু' ঘা বেশি জুটেছিল পরামর্শ-মজুরি হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ, হিংসুটে ও যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে ওই বিকেলে ওরকম একটা বিপ্লব শেষে আমরা সম্ভবত খানিক হতাশ হয়েছিলাম এই বাস্তবতায় যে এর থেকে ঢের ঢের সহজে মার্কিন নাগরিকেরা নিজ পতাকা পোড়ানোর সুযোগ পেয়ে থাকে। নিউ ইয়র্কে বা ওয়াশিংটনে বা বস্টনে থাকা আমাদের সম্ভাব্য কোনো গ্লোব্যাল মিত্রের মার্কিন পতাকা পোড়ানোর সেই কল্পদৃশ্য দেখে আমাদের হতাশ হবারই কথা। বিপ্লব এই পোড়ানোতে হয়তো এসে হাজির হন না, কিন্তু চেতনার একটা পাবলিক প্রদর্শন তো হয়! কী আর করা! বাংলাদেশ রাষ্ট্র কিংবা বাংলাদেশী পুলিশ আমাদের চেতনা ধুয়ে কি পানি খাবে!

এতদিন পরে মন্ত্রীসভা বাংলাদেশের পুলিশি ব্যবস্থার জন্য মার্কিন পতাকার পাশাপাশি স্বপতাকাও সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে পেরেছে। কিন্তু প্রশ্নটা মাথায় থেকেই যায়। এর দরকারটা কী পড়েছিল? এরকম পাহারাদারি করে কীসের মর্যাদা নিশ্চিত করছেন মন্ত্রীসভা? কী আবশ্যকতা এর? আমার খুবই কৌতূহল এই মন্ত্রীসভা কিংবা এর অনুষঙ্গ সরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় সঙ্গীতটা, একত্রে বা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, গাইতে শুরু করলে শ্রোতাদের জন্য কী ধরনের অনুভূতি সঞ্চার করবেন। প্রধানমন্ত্রী বরং একান্তে তাঁদের সকলের অডিশন নিতে পারেন। কিংবা ইভেন্ট ডেভেলপমেন্টের এই মিডিয়া-কালে কোনো টেলিভিশন চ্যানেল এই আয়োজনটা করে দেখতে পারেন। 'মন্ত্রীদের জাতীয় সঙ্গীত আইডল কমপিটিশন'।

নিয়মমাফিক শাস্তি দিয়ে জাতীয় পতাকা কিংবা সঙ্গীতের প্রতি সম্মাননা নিশ্চিত করার বুদ্ধিটাই বেশ আজিব ধরনের। নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেককেই বলতে শুনি 'দু'চার বছর জেল জরিমানা হলে সবাই টাইট হবে।' কে টাইট হবেন? এত টাইটে রেখে কী নিশ্চিত করছে আমাদের রাষ্ট্র? আর তাঁদেরই বা কী উপকার হয় এতে? কথা শুনে মনে হয় রাষ্ট্রের পাহারাদারিতে থাকতে তাঁদের ভাল লাগে। হতে পারে এই লোকজনই 'জরুরি অবস্থা'কে দেশের অগ্রগতি ভেবেছিলেন; কিংবা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে ঘটে-চলা গুপ্তহত্যায় মাস্তানি কমছে বলে প্রচার করছিলেন; কিংবা তাঁদের জানমালে শান্তি নিশ্চিত হচ্ছে বলে খুশি খুশি ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রশ্নটা যদি সম্মাননার (বা অবমাননার) হয় তাহলে তো শাস্তির পরিমাণ একটা ব্যাপার। যেহেতু সম্মান মাপার ব্যবস্থা হচ্ছে, ফলে শাস্তি পরিমাপনও একটা কর্তব্য। বিষয়টা তুলনামূলক হয়েই পড়ে। একটা ছাগলও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে তাতেও বোধহয় একটা ৬ মাস এক বছরের জেলের ব্যবস্থা আছে। মানে ছাগলের মালিকের, ছাগলের না। তবে হ্যাঁ, গ্রামদেশে কিছুকাল আগেও ছাগল-গরুর হাজতখানা বা ফাটকের ব্যবস্থা ছিল। মুদ্রার অঙ্কে জরিমানা দিয়েই ছাগলকে ছাড়িয়ে আনা হতো। বলাই বাহুল্য, ছাগলের মালিকই সেই গচ্চা দিতেন। যাহোক, এখন চার ছাগলে দুই বছর জেল হয় বলেই তো আর চারটা ছাগল জাতীয় পতাকার সমমর্যাদার হয়ে গেল না। সম্মান বা অবমাননা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হলে লিবেরেল শাসন কাঠামোতে তার গুরুত্ব অবশ্যই স্বতন্ত্র। ছাগলীয় ব্যবস্থায় ফসল রক্ষা পায়, বা পেতে পারে; কিন্তু বিধি বা সংস্কৃতির প্রতি (তাও রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি/রেওয়াজ) অবমাননা প্রতিরোধ করবার এরকম ব্যবস্থায় কী রক্ষা পায়?

আমার ধারণা অনেকেরই মনে হবে একটা গৌণ বিষয়ে কথা কইছি। কিন্তু বিষয়টা আমার জন্য গৌণ নয়। রাষ্ট্রকে নানান ধরনের নব নব বিষয়ে পাহারাদারি করতে দিয়ে আমার শান্তি হয় না। বলাই বাহুল্য, জুতার মডেলে 'আল্লাহু' আবিষ্কার করাতে 'ইসলামপন্থী'দের জজবা নিয়ে খবর পাঠককুলের বড় অংশের অশান্তি হয়েছিল। কিংবা একটা কার্টুন নিয়ে তাঁদের শো-ডাউন করার প্রক্রিয়াতে। 'ইসলামপন্থী'দের প্রতীক লালন-পালন কুৎসিৎ আর রাষ্ট্রীয় প্রতীক লালন-পালন দেশপ্রেমীয়–এত নিশ্চিত ঈমান আমার নেই। প্রথমোক্তদের পাহারাদারি নিকৃষ্ট আর রাষ্ট্রের পাহারাদারি মহত্তর–এরকম ভাবার মতো জায়গায় আমি নেই। এই হলো আমার অশান্তি।

(লালমাটিয়া ১২ ও ১৩ই জুলাই, ভাষানটেক ১৫ ও ১৬ই জুলাই; ঢাকা ২০১০।)