জাতীয় ট্র্যাজিডি অতঃপর রাজনৈতিক সংকট

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 6 May 2013, 07:36 PM
Updated : 6 May 2013, 07:36 PM

সাম্প্রতিকের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করছে। ২৪ এপ্রিল সাভারে একটি ভবন ধসে পাঁচটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শতশত শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ভেঙে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরাতে গিয়ে প্রতিদিনই মিলছে লাশ। এরকম একটি বিশাল বড় জাতীয় ট্র্যাজিডির মধ্যে আমরা কঠিন একটি সময় পার করছি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সামান্য কয়েকজন লোকের লোভের ফলে এমন ঘটনা ঘটেছে। রানা প্লাজার মালিক ভবনটি তৈরিতে অনিয়ম করেছে নিজের স্বার্থেই। আর এরকম একটি ভবনে নিজেদের গার্মেন্টস স্থাপন করে মালিকরা তাদের লোভীমনের পরিচয় রেখেছে। এরা সব নিকৃষ্টতম অপরাধী।

আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা যে নতুন তাও নয়। গত কয়েক বছর ধরেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগা বা ভবধসের মতো দুর্ঘটনায় শত শত মানুষ মারা যাচ্ছেন। কয়েক মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনস নামের একটি গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডে দেড়শ মানুষের মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছি, এভাবেই কি চলতে থাকবে? অতিলোভীরা চাচ্ছে গার্মেন্টসে অনেক কম টাকা খরচ করে প্রচুর মুনাফা করতে। সরকার যদি এসব লোভীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিত তবে এরা সাহস পেত না।

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা দেখা যাতে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়। প্রতিটি পোশাক কারখানা সব শর্ত মেনে শ্রমিকদের কাজের উপযোগী পরিবেশ ও নিরাপত্তা দেওয়ার মতো করে এগুচ্ছে কিনা সেটি দেখাও সরকারেরই কর্তব্য। এসব জায়গায় সরকারের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ মুহূর্তে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের এসব পদক্ষেপ নিতে হবে।

পাশাপাশি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকাটাও জরুরি ছিল। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের এখন এ অধিকার দিতে হবে। তবে এ জন্য কিছু সতর্ক পদক্ষেপ দরকার। যেমন, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করবেন সত্যিকারের শ্রমিক, বাইরের কেউ নয়। প্রকৃত শ্রমিক যখন কারখানায় তার অধিকার বুঝে পাবেন, তখন তিনি কারখানা ও শ্রমিক উভয়ের স্বার্থে কাজ করবেন। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকের এ অধিকার নিয়ে অন্য কারও ফায়দা লোটার সুযোগ থাকবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দাস নন। তাদের দাসের মতো বিপদের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করা সভ্যতার পরিপন্থী। এ জন্যই এ ধরনের কাজ যে মালিকরা করছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আরেকটি কথা, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা এভাবে বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণ করার সাহস কোথায় পেয়েছে? নি:সন্দেহে তার পৃষ্ঠাপোষক হিসেবে আলোচিত-সমালোচিত স্থানীয় সংসদ সদস্য। এতবড় দুর্ঘটনার পর তাকেও কেন বিচার বা আইনের আওতায় আনা হল না, সে প্রশ্নও রয়ে যাবে।

সাভার ট্র্যাজিডি আমাদের এতসব নেতিবাচক ঘটনার মধ্যেও ইতিবাচক অনেক কিছু দেখিয়েছে। সবচেয়ে বেশি দেখেছি আমরা এ ঘটনা যে, উদ্ধারকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন সাধারণ মানুষ। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তারা ধসে পড়া ভবনের মধ্যে জীবনের সন্ধান করেছেন। হাজার হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে সাধারণ মানুষের এ স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে।

এমনকি এভাবে ঝুঁকি নিতে গিয়ে উদ্ধারকারীদের অনেকেই আহত হয়েছেন। একজনের আঘাত গুরুতর ছিল বলে তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেলে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মনুষ্যত্ববোধ আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে। দেশপ্রেমও প্রত্যেকের অমূল্য চেতনা। আমি সে মানুষদের শ্রদ্ধা জানাই যারা দুর্গতদের উদ্ধারে সময় ও শ্রম দিয়েছেন। নিহত ওই উদ্ধারকর্মীর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

উন্নত দেশের মানুষ কিন্তু এ ধরনের জাতীয় ট্র্যাজিডিতে মিলেমিশে কাজ করেনা আমাদের দেশে অবস্থা ভিন্ন। এতবড় একটি দুর্ঘটনার শোক আমরা এখনও সামলে উঠতে পারিনি, ধ্বংসস্তূপ সরানো হচ্ছে আর সেখান থেকে উদ্ধার হচ্ছে লাশ। এমন এক সময়ে রাজনীতিবিদরা রাজনীতির মাঠ গরম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমাদের রাজনীতি আসলে এখন এতবেশি নিম্নমানের হয়ে গেছে যে আমরা মনুষ্যত্ববোধও হারিয়ে ফেলেছি।

আর এর ফলেই রাজনীতির ময়দানে নানা ধরনের ঘটনায় দেশ আবার অনিশ্চয়তায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, আমাদের দেশে ইসলাম এসেছে সুফীদের হাত ধরে। তাই সুফীবাদের প্রভাবে আমাদের দেশে ইসলামের মধ্যে এক ধরনের উদারতা রয়েছে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে যার যার ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে টিকে থাকা এটাই হল এ ভূখণ্ডের বৈশিষ্ট্য।

একাত্তরের আগে পাকিস্তানের দুই যুগের শাসনামলেও আমরা দেখেছি, আমাদের চেতনার মধ্যে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা এভাবে প্রকাশ্যে বলা না হলেও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। শব্দটির অর্থ কিন্তু সংকীর্ণ নয় যেভাবে অনেক সময় একে উপস্থাপন করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রথম কথা হল, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখতে হবে। আমরা কিন্তু সবসময় এ দুটিকে এক করেছি। গোঁজামিল দিয়েছি। ফলে ধর্ম ও রাজনীতি দুটোই কলুষিত হয়েছে।

আমাদের তাই এখন এসব নিয়ে ভাবতে হবে। পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বরাবরই, আমাদেরটি তা নয়। এখানে শিক্ষাকে সবার আগে ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে। আধুনিক একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা বহাল রেখে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা গত চার দশকে মান্ধাতার আমলের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে বাতিল করা তো দূরের কথা, একে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছি।

এর ফল কী হয়েছে তা এখন দেখাই যাচ্ছে। ৫ মে ধর্মভিত্তিক একটি দল হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছিল। তারপর ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করেছে তারা। সমাবেশ শেষে এরা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করলে সরকারকে সেটি পণ্ড করতে হয়েছে। ৫ মে রাতের পুলিশি অভিযানের সময় জানা গেল, মাদ্রাসার হাজার হাজার অনাথ শিশুকে ওরা ব্যবহার করেছে। আঠার বছরের নিচে বয়সী এ শিশুদের মগজ এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে এরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এত ঝুঁকির মধ্যে ঢাকায় এসেছে, অবস্থানে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের অপব্যবহার করছে।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট খুবই গভীর সন্দেহ নেই। আমি এ জন্য বলব, এ থেকে ত্রাণ পেতে হলে সবাইকে শান্তিময় পথে এগুতে হবে। শক্তি নিয়ে কখনওই কোনো সমস্যার সমাধান করা যায়নি। রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে হলে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। কোনো রকম ইগো রাখা যাবে না।

আত্মসমালোচনা, আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মশুদ্ধির বিকল্প নেই। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, করে জানতে হবে কেন এসব ঘটছে। পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকলে ভুল বোঝাবুঝি শুধু বাড়বেই। তাই সেসব বাদ দিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।

আমি আশা করব, প্রার্থনাও করব সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে।

ড. সালাহউদ্দিন আহমদ : জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।