বিপর্যয় ও দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি

চিন্ময় মুৎসুদ্দী
Published : 28 April 2013, 07:34 AM
Updated : 28 April 2013, 07:34 AM

কন্যা পিতাকে ফোন করে বলছেন, "বাবা, আমি আটকে আছি সাত বান্ধবীসহ, আমাদের বাঁচাও।" বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পিতা-কন্যা মোবাইলে কথা বলেছেন। সন্ধ্যার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছেন আশা করি সেখানে কন্যাটি রয়েছেন। না থাকলে কী সান্ত্বনা দেবেন পিতাকে?

রোজিনা ও আলতাফ হোসেনেরর ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক। বিমের নিচে আটকে আছেন তারা। কাতর কণ্ঠে বলছেন, "বিম সরিয়ে আমাদের বাঁচান।" আটকেপড়া এক নারী একজন উদ্ধারকর্মীকে বলছেন, "কিছুক্ষণ পর তো মরেই যাব, একটু কথা বলেন আমার সঙ্গে।" উদ্ধারকর্মীসহ সকলেই তাদের দেখছেন, তাদের কথা শুনছেন। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। মানুষের জন্য বড় বেদনাদায়ক এমন পরিস্থিতি।

এত দুঃখের মাঝে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর যখন বলেন, "দুর্ঘটনার আগে কিছু মৌলবাদী ও বিএনপির ভাড়াটে লোক সাভারের ভবনটির গেট ও বিভিন্ন স্তম্ভ ধরে 'নাড়াচাড়া' করেছিল। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে একেও 'একটি কারণ' হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে," তখন আমরা যারপরনাই বিরক্ত হই।

আওয়ামী লীগ নেতারাই মন্ত্রীর এ কথায় ক্ষুব্ধ। মোহাম্মদ নাসিম তো বলেই দিয়েছেন মন্ত্রীরা যেন কম কথা বলেন। তিনি আরও বলেছেন, সব ব্যাপারে অন্যকে দোষ দেওয়ার মানসিকতা ঠিক নয়। সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের। বিশেষজ্ঞরাও মন্ত্রীর এ বক্তব্যকে 'অপ্রকৃতিস্থ' বলে মন্তব্য করেছেন।

একইসঙ্গে ঘটনাটি আবার প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব প্রকট। একটি নয়তলা ভবন ধসে যাওয়ার ঘটনায় সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ভূমিকম্পে একসঙ্গে ১৫/২০টি উঁচু দালান ধসে পড়লে সরকার কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবেন? জাতীয় সংসদেও এ ধরনের জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে পরিকল্পনার ব্যাপারে এমপিরা সোচ্চার হন না, তাদের অনেকেই ব্যস্ত থাকেন ট্যাক্সমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ স্থায়ী করতে, এলাকার নামে গম বরাদ্দ নিয়ে তা আত্মসাত করতে।

দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় রয়েছে, ইউএনডিপিসহ একাধিক উন্নয়ন ও দাতা সংস্থার অনেক প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু কোথাও পার্সপেকটিভ প্ল্যান নেই। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এখানে মানা হয় না। প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন, ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি 'বিল্ডিং কোড' না মেনে নির্মিত হয়েছে। রানা প্লাজায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। ভবনধসের কোনো ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি না পাওয়া সরকারের চরম ব্যর্থতা।

গত এক দশকে অনেক ভবনধসের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের আগস্টে শাঁখারীবাজারে ভবনধস, ২০০২ সালে শাহজাহানপুরে ছয়তলা ভবনে, ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে ধস, ২০০৬ সালে ফিনিক্স ভবন, ২০১০ সালে বেগুনবাড়িতে ভবনধস, ২০১০ সালে কাঁঠালবাগানে সাততলা ভবন, ২০১০ সালে দক্ষিণখানে তিনতলা ভবন, ২০১১ সালে নাখালপাড়ায় নির্মাণাধীন হাসপাতাল ধসের কথা। এসব ঘটনায় শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। কেউ যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। অপরাধীদের কেউ শাস্তি পাননি। সুশাসনের অভাব কি আর আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে?

উদ্ধারকাজে যে সমন্বয়হীনতা ঘটেছে তাও সুশাসনের অভাবেই হয়েছে। উদ্ধারের দ্বিতীয় রাতে পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যায়নি। ছোটখাটো হাতিয়ার যেমন হাতুড়ি, করাত, শাবল, ড্রিল মেশিন, রডকাটার যথাসময়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মীরা কাজ করছিলেন স্বউদ্যোগে, কোনো কেন্দ্রীয় কমান্ড ছিল না। সেনাবাহিনির প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধারকর্মীরা সহজে অবগত হননি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না। কিন্তু সাভারের ঘটনাটি মানুষের তৈরি। এ মানবিক বিপর্যয় আমাদের সামনে তুলে ধরছে লোভ ও দায়িত্বহীনতার চরম দৃষ্টান্ত। চার গার্মেন্টস মালিক নিজেদের ব্যবসার কথা ভেবেছেন কেবল কিন্তু ভাবেননি সেসব মানুষের কথা যাদের শ্রমের বিনিময়ে তারা স্বল্প সময়ে বিত্তবান হয়ে উঠছেন।

এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদেরও দায় নিতে হবে। সস্তা শ্রমের সন্ধানে তারা এখানে এসেছেন। অর্থাৎ এখানকার শ্রমজীবী মানুষকে ঠকিয়ে তারা তাদের দেশে ক্রেতাদের কাছে কমদামে পোশাক বিক্রি করছেন। ৩২ ডলারে একটি টি শার্ট কিনতে পেরে ওই ক্রেতারাও তৃপ্তি পান। বিদেশি ক্রেতা, স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানার মালিক এবং সরকার মিলেই যেন দরিদ্র মানুষদের শোষণের এক দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছেন।

অথচ এই শ্রমজীবী মানুষের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। মাত্র কদিন আগে তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন বলে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা কার্যকর হতে আরও বেশ কিছুদিন লাগবে।

রানা প্লাজার কারখানাগুলোয় জো ফ্রেশ, চিলড্রেন প্লাস, ওয়াল-মার্ট, ড্রেস বার্ন এবং প্রাইমার্কের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে সুপরিচিত ব্র্যান্ডের কাপড় তৈরি হত। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের পণ্য সংগ্রহ করেন বলে অনেক সময় দায় এড়িয়ে যায়। কমপ্লায়েন্স অনুযায়ী কারখানা চলছে কিনা সে ব্যাপারে ততটা মাথা ঘামায় না।

বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন-এর মুখপাত্র টেসেল পাওলি। তিনি বলেছেন, "এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ না করানোর বিষয়ে একটি বাধ্যতামূলক চুক্তিতে সম্মত হতে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর অস্বীকৃতি আমাকে বিস্মিত করেছে।" তার দাবি হল, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিপূরণ দিতে ব্র্যান্ডগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিকারকদের প্রতি প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের দাবি জানানো হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর তত্ত্বাবধানে এ চুক্তির খসড়া প্রণীত হয়েছে।

বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকেও ক্ষতিপূরণ নেওয়ার ব্যাপারে উদযোগী হতে হবে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং সরকারকে। রানা প্লাজা ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর কোনো গাফিলতি আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন।

উল্লেখ করতেই হয়, মানবিক এ দুর্যোগের সময় সাধারণ মানুষ এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের সমন্বিত প্রচেষ্টার এক অনন্য দৃষ্টান্তের কথা। প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটকেপড়া মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, কখনও সফল হয়েছেন কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ মানুষ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।

এরপরও প্রশ্ন এসে যায়, সাধারণ মানুষকে কেন বারবার এভাবে মরতে হয়? অনেকেই বলছেন, এসব দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। লুটেরা বুর্জোয়ার স্বার্থে বলি দেওয়া হচ্ছে দরিদ্র মানুষগুলোকে। এদের আমরা বলছি গার্মেন্টস শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকের মর্যাদা থেকেও তারা বঞ্চিত। তারা হয়ে আছেন মজুরির দাস। এ ডিজিটাল যুগে মজুরি দাসপ্রথা জিইয়ে রেখে কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করছি?

শে্ণিবিভক্ত সমাজে আমরা শ্রেণিস্বার্থের উর্ধে উঠতে পারছি না। সম্ভবত সে জন্য এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আমরা এখনও শাহবাগে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিতে পারিনি। আবার শুক্রবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয় 'জমজমাট তারার মেলা', যখন কয়েক কিলোমিটার দূরে শত শত মানুষ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। জীবন থেমে থাকে না এ দর্শনের আলোকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কৌশলে কথার ফুলঝুড়ি ফোটানো হয়, আর নাচ-গানে মুখর হয়ে ওঠে হলঘর। এতে অর্ধকোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

তহবিল গঠন প্রশংসনীয়, কিন্তু টাকাটাই কি সব? এক সপ্তাহ পর তো অনুষ্ঠানটি হতে পারত। হয়নি কারণ, যারা মারা গেছেন, যারা পঙ্গু হয়েছেন, তাদের আমরা করুণা করি, আপনজন মনে করে ভালবাসি না!

চিন্ময় মুৎসুদ্দী : লেখক, সাংবাদিক।