একটি অস্তিত্ববাদী ফটোগ্রাফ এবং অস্তিত্বহীনের বাস্তবতা

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 27 April 2013, 08:46 AM
Updated : 27 April 2013, 08:46 AM
একটি ফটোগ্রাফ। ইট-বালু-সিমেন্ট-রডের গুঁড়োর ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে শুধু একটি মুখ। আর পুরো শরীরই ডেবরিসের তলায়। তবে ডেবরিসের উপর দৃশ্যমান আছে শরীরের আরও একটু অংশ; একটা হাতের কবজি আর আঙুলে ফিতা দিয়ে পেঁচানো আইডি কার্ড।

বয়স কত হবে ফটোগ্রাফের মানুষটির? মুখ দেখে বোঝা যায়, ছেলেটির বয়স কোনোক্রমেই আঠারোর বেশি নয়। নিতান্ত কিশোর। আঙুলে এমনভাবে প্যাঁচ দিয়ে সে তার আইডেন্টিটি কার্ড বেঁধে রেখেছিল যেন শরীর-মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও প্রিয়জন-পরিজন তাকে চিনে নিতে পারে।

অস্তিত্ববাদের দার্শনিক কিয়ের্কেগাদের তত্ত্ব তার জানা নেই সেটা ধরে নিয়ে বলব- অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার এ ব্যাপকতাগ্রাসী আতঙ্ক মানুষের সাধারণ ইন্সটিংক্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নিও-ক্যাপিটালিজম, নিও-লিবারালাইজেশনের সমাজ-অর্থনৈতিকতার বাস্তবতায়। কিন্তু ওই ফটোগ্রাফের কিশোর আঙুলে যতগুলো প্যাঁচ দিয়ে পরিচয়পত্র আটকে রেখেছে, তা তার সাম্প্রতিক বাস্তবতার রিফ্লেকশন নয় কি? অস্তিত্বময় থেকে তাদের হঠাৎ অস্তিত্বহীন করে ফেলার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার একটি পোর্ট্রেইট।

প্রিয় নারী ও পুরুষ পাঠক, সাভারের নয়তলা রানা প্লাজা যখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে ক্লাব স্যান্ডউইচের মতো ল্যাপ্টাল্যাপ্টি খেয়ে গেল- মালিক সোহেল রানা তার অস্তিত্বরক্ষার জন্যই প্রভাবশালী 'হস্ত' স্থানীয় সাংসদ মুরাদ জংয়ের সহায়তায় পালিয়ে গেল। কিন্তু শ্রমিকদের তো কোনো প্রভাবশালী হস্ত, পদ, মস্তক কোথাও থাকে না- তাই তাদেরই নাম-পরিচয়-ঠিকানাহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি।

গার্মেন্টসের ভয়াবহ সব সিরিয়াল দুর্ঘটনা শ্রমিকদের মগজে এ কোড পাঠিয়ে দিয়েছে যে, ''তুমি হয়ে পড়তে পার বেওয়ারিশ, আঞ্জুমানে মফিদুলের গাড়ি এসে তোমাকে সাঁই সাঁই করে নিয়ে গিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিবে। আর তোমার পরিবার-পরিজন সারাজীবন অপেক্ষা ও হাহাকারের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে!''

বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোরের ফটো গ্যালারিতে যখন কিশোরটির মুখ ও আঙুলে বাঁধা আইডি কার্ডের ফটোগ্রাফটা দেখছিলাম, আরও অনেকের মতো আমার মনেও একটি প্রশ্ন জাগছিল- মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি গিয়ে বা কোন পর্যায়ে তার সচেতনতা তাকে একমাত্র এ বার্তাই দিয়েছিল যে, শক্ত করে বেঁধে রাখ তোমার পরিচয়পত্র; এ শহরে, এ দেশে খুব সহজেই, স্থায়ী নাম-পরিচয়-ঠিকানাওয়ালা জীবিত মানুষেরা গার্মেন্টেসে ভয়াবহ আগুন বা সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনির হাতে মরে হয়ে যায় 'বেওয়ারিশ' লাশ। লাশকাটা ঘর থেকে শুরু করে নদীতে ভেসে ওঠা বেওয়ারিশ লাশ- কত কত ঘটে যাচ্ছে আমাদের যাপনে-উদযাপনে।

গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, উদ্ধারকর্মীরা নিখোঁজের যে তালিকা তৈরি করেছেন, তাতে উঠে এসেছে ৬৫৯ জনের নাম। যে ৩০৬ লাশ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অর্ধশতের নাম-পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। এরা কোথায়? ঠিক ৫ মাস আগে, সেটাও ছিল ২৪ তারিখ, নভেম্বরের ২৪, সেদিন তাজরীন গার্মেন্টসের আগুনে পুড়ে ছাই-কয়লা হয়ে যাওয়া ৫২ লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানরা। এসবই তো 'বেওয়ারিশ' হয়ে পড়ার আতঙ্কের মনোভূমি।

ন্যাশনাল আইডি কার্ড এবং ভোটার আইডি কার্ড নামে একটা মহাযজ্ঞের ডাটাবেজ ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে করা হয়েছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টায়; এবং তা নিয়মিত আপডেট করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নাম-পরিচয়হীন লাশ অথবা নিখোঁজ ব্যক্তিকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এটা কাজে দিয়েছে কি? অথচ ভারতে ও নেপালে এ ডাটাবেজ নিখোঁজদের খুঁজে বের করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

গার্মেন্টস শ্রমিকরাই তো মালিকদের বিত্তবান বানাচ্ছেন, ঝনঝনে মুদ্রা তাদের পকেটে ভরিয়ে দিয়ে। মালিকদের যে সংগঠন বিজিএমইএ, সেখানে কি সব শ্রমিকের নাম-পরিচয়-ঠিকানা বা তালিকা আছে? নিশ্চিতভাবেই নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক চাপা পড়ে মরে গেছেন, যাচ্ছেন অথবা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন- ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিক কি শ্র্রমিকদের তথ্য সরবরাহ করতে পারে না? তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কত তথ্যই তো কতদিকে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ সর্বাধিক বিদেশি মুদ্রা অর্জনের কারিগর শ্র্রমিকদের তথ্য কোথাও ঠিকঠাক নেই!

কেন নেই? ওরা গরিব। সাবঅল্টার্ন। অস্ত্র ঠেকায় না। দুর্নীতি করতে পারে না। ভোট দেওয়াকে নাগরিক অধিকার মনে করে ভোটের বাক্সে একটা ব্যালট পেপার ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। বিশ্বাস করে রাজনৈতিক নেতাদের। যত বয়স্কই হোক না কেন, তবু ওরা সবসময় 'ছোট'। আর পঁচিশ থেকে পঁচাত্তর সব বয়সী শ্রমিককেই লাঠির ভয় দেখিয়ে রানা প্লাজার মতো মৃত্যুকূপে ঢুকিয়ে দিতে পারে মালিকরা। হরতাল-হরতাল খেলায়। কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি দেখানোর কাজে সহজেই ব্যবহার করা যায় ওদের। এভাবেই যেন ওরা সুমন চট্টোপাধ্যায় ওরফে কবির সুমনের গানের এসেন্স নিয়ে হাজির হয়: 'বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই/ ছোটরা খেলবে, আসুন আমরা বোমা বানাই'।

বিশ্বজোড়া খবর হওয়া এ ঘটনায়, এখানে লাক্ষ্ণৌতে বিভিন্ন দেশের বন্ধুরা চরম বিস্ময় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'ওটা কি আসলে শপিং মল ছিল, নাকি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি? কত বছরের পুরনো ভবন? মাত্র তিন বছর?' কম্বোডিয়ার ভোনন চিন বিস্ময় নিয়ে বলল, 'ইটস অল অ্যাবাউট মিসম্যানেজমেন্ট আ্যান্ড করাপশন'।

তাহাদের অস্তিত্বশূন্য বা বেওয়ারিশ করে দেওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদেরই, কারণ দেশটা আমাদের, আর সংখ্যায় আমরাই বেশি।

শামীমা বিনতে রহমান : লেখক ও সাংবাদিক। ভারতের লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষার্থী।