দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

আবদুল মান্নান
Published : 26 April 2013, 05:17 AM
Updated : 26 April 2013, 05:17 AM

লেখাটি যখন লিখছি তখন সাভারের রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে নিহতের সংখ্যা আড়াইশ ছাড়িযেছে। সংখ্যাটি যে আরও বাড়বে সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। রানা প্লাজায় গত বুধবার যা ঘটেছে তা কোনো অবস্থাতেই দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। শুধু কিছু মানুষের লাগামহীন লোভের কারণে এত মানুষ মৃতের মিছিলে সামিল হলেন।

এই 'কিছু' মানুষের মাঝে আছে ভবনের মালিক সোহেল রানা আর ওই ভবনে অবস্থিত তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা। বাংলাদেশে গত দু'দশকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অনেকবারই ঘটেছে, জীবনহানি হয়েছে কয়েকশত মানুষের। কিস্তু যারা এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের কারও সাজা হয়নি, এবং তা যে হবে তাও মনে হয় না। কারণ ঘাতকদের হাত অনেক দীর্ঘ।

গার্মেন্টস দুর্ঘটনায় যারা মালিক তাদের তেমন ক্ষতি হয় না, হয় গরীব শ্রমিকদের, দেশের অর্থনীতি্র আর ওই শিল্পের, সর্বোপরি বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজে বা সুনামের। বুধবারের ভয়াবহ ঘটনাটি বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে, এবং কোনো কোনো গণমাধ্যম বলেছে এমন ঘটনা দেশটিতে নিয়মিত ঘটে থাকে।

এমনিতে গত কিছুদিন ধরে ১৮ দলের সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে প্রাণঘাতী সহিংসতা, মতিঝিলে কয়েক লাখ হেফাজত-ওয়ালার আষ্ফালন আর কিছুদিন আগে তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৫৮ শ্রমিকের অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণহানি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। এখন তার উপর সামিল হয়েছে রানা প্লাজার ভবনধসের ঘটনা আর হত্যাকাণ্ড।

বালাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে জিএসপি সুবিধা পায় তা বহাল রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। 'রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড' তাই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হযে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে সরকারের কিছু শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তির অসংলগ্ন কথাবার্তা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ''ওই ভবনের লোকজনকে আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যারা ওই ভবনে আটকা পড়েছেন বা নিহত হয়েছেন তারা সেখানে তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আনতে গিয়েছিলেন।'' পুরো বিষয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে সঠিকভাবে ব্রিফ করা হয়নি। তিনি যা শুনলে স্বস্তি পাবেন তাঁকে তাই শোনানো হয়েছে। এটি একটি বিপজ্জনক সংষ্কৃতি।

শ্রমিকরা ওই ভবনে অবস্থিত পাঁচটি কারখানায় সে সময় কর্মরত ছিলেন, এবং তাদের অনেকটা জোর করে মালিকরা সেদিন কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। পাঁচটি কারখানায় তিন হাজারের উপর শ্রমিক কাজ করতেন। নিচে ছিল মার্কেট। স্বাভাবিক সময়ে এখানে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ অবস্থান করেন। তবে সেদিন হরতাল ছিল বলে মার্কেট বন্ধ ছিল। আগের দিনই ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় ব্র্যাক ব্যাংকের শাখাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তা না হলে হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হত।

ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ''হরতাল আহ্বানকারীরা ওই ভবনের একটি পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করেছে বলে ভবনটি ধসে পড়েছে।'' এটি কি বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য হতে পারে? তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অনেকে ঠাট্টা করে লিখছেন, ''দুবাইতে র্বুজ-আল-খলিফা ভবনের কাছে বাঙালিদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ তারা হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নয়তলা ভবন ফেলে দিতে পারে!''

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন কেন বুধবারের ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলছি। দুর্ঘটনা কোনো পূর্বাভাষ ছাড়া হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। রাস্তায় মানুষ গাড়িচাপা পড়লে অথবা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ হতাহত হতে পারে। এসব ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে যায়। কিন্তু একজন মানুষকে একটি ভবনের ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলে অথবা সবকিছু জেনেও মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলে যদি তার প্রাণহানি হয় তাহলে তা কোনো অবস্থাতেই দুর্ঘটনা নয়, স্রেফ হত্যাকাণ্ড।

অনেক ক্ষেত্রে আবার ঘাতকরা মানুষ হত্যা করার জন্য ফাঁদ পাতে। সেই ফাঁদে পড়ে যদি কেউ মারা পড়ে তা নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ড। ঠিক এ কাজ হয়েছে রানা প্লাজায় গত বুধবার। ভবনটি নির্মিত হয়েছে একটি ডোবা ও জলাশয় ভরাট করে। তাও কাঠের গুঁড়ো দিয়ে,মাটি ছিল সামান্যই। এমন জমিনে একটি টিনের চালার ঘর তৈরি করা যেতে পারে, নয়তলা ভবন নয়।

কিন্তু স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানা তো আর টিনের চালার মানুষ নন। তার প্রয়োজন নয়তলা ভবন। অতএব সেখানেই তিনি রাতারতি উঠিয়ে ফেললেন মরণফাঁদ, রানা প্লাজা।

সাভার রাজউকের আওতাধীন থাকলেও সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সে ভবনের অনুমোদন দিয়েছিল সাভার পৌরসভা। একটি পৌরসভার এ ধরনের ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা সাধারণত থাকে না, সাভার পৌরসভারও ছিল লা। একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করার কিছু সুক্ষ্ম হিসেব-নিকেশ রয়েছে। পাশাপাশি যেসব মালমশলা দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হবে তার কিছু ন্যুনতন মান বজায় রাখতে হয়। রানা প্লাজা নির্মাণের সময় এসবের কিছুই মানা হয়নি বলে জানা গেছে। এভাবে নির্মিত একচি ভবন নির্মিত হলে সে ভবন যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে।

কয়েক বছর আগে প্যারিস বিমানবন্দরের একটি টার্মিনাল ভবনের বর্ধিত অংশ ধসে পড়েছিল। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় ধসে পড়েছিল একটি শপিং মল আর একটি ফ্লাইওভার। এসব ধসে পড়ার কারণ 'হিউম্যান এরর', বা নির্মাণের সময় মানুষের স্বাভাবিক ভুল, যেগুলো সাধরণত ইচ্ছাকৃত নয়।

কিন্তু রানা প্লাজা বা তাজরীন গার্মেন্টসে হত্যাকাণ্ডের কারণ কোনো অবস্থাতেই তা ছিল না। রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দিয়েছিল বেশ কদিন আগে। এ সম্পর্কে কোনো কোনো পত্রিকায় সংবাদও প্রচারিত হয়েছিল। একুশে টিভি আগের দিন এ সম্পর্কে ভবনের মালিক সোহেল রানার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি সরাসরি বলেন, 'বিষয়টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়'। তিনি নাকি কোনো কোনো প্রকৌশলীকে দিয়ে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়েছেন এবং তারা তাকে বলেছেন সব ঠিকঠাক আছে। যখন ক্যামরার সামনে কথা বলছিলেন তখন তাকে মোটেও প্রকৃতিস্থ মনে হয়নি।

বিপদ আঁচ করতে পেরে মঙ্গলবার ওই ভবনের সব কারখানায় আগাম ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ভবনের দোতলায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। গোল বাধল পরদিন যখন গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধিরা মাইকিং করে, মোবাইল ফোনে সব শ্রমিককে কাজে যোগ দিতে বলল। শ্রমিকদের এটাও জানিয়ে দেওয়া হল যে, কাজে না এলে তাদের চাকুরিচ্যুত করা হবে।

শ্রমিক কখনও চান না তার চাকুরিটা চলে যাক। কারণ একটি চাকুরি গেলে আরেকটি চাকুরি পাওয়া সহজ কাজ নয়। ভবন মালিক রানা গার্মেন্টস মালিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ভবনটি নিরাপদ। এই বিশ্বাসেই তারা হয়তো তাদের কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রানার মতো একজন ব্যক্তির কথায় এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের অবশ্যই উচিত হয়নি।

আর তাই ২৪ এপ্রিল ঘটে গেল বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ একটি বিপর্যয়। ঘটনার জন্য রানা প্লাজার মালিক আর গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা তো অবশ্যই দায়ী, তার সঙ্গে দায়ী রাজউক ও সাভার পৌরসভা।

বাঙালি আবারও প্রমাণ করেছে জাতীয় সংকট বা দুর্যোগের সময় তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা অপরিসীম। বুধবার রানা প্লাজার ঘটনার পর উদ্ধারকাজে স্থানীয় জনগণ, ফায়ার ব্রিগেড, সেনা ও নৌবাহিনি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সদস্যরা, স্থানীয় ক্লিনিক ও সর্বোপরি এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।

তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হাজারের উপর মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা রক্তদান করার জন্য যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাতে সাড়া দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে রক্ত দিলেন। এসব কর্মকাণ্ড জাতি হিসেবে আমাদের নিঃসন্দেহে অভিভূত করেছে।

আগে এ ধরনের যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার কোনোটারই বিচার হয়নি। এবার কি দেশের মানুষ আশা করতে পারেন যে, ভয়াবহ এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করা হবে?

ড. আবদুল মান্নান : গবেষক ও বিশ্লেষক।