দেশী জাতের ধান কেন নয়?

কিউ আর ইসলাম
Published : 15 July 2010, 10:12 AM
Updated : 15 July 2010, 10:12 AM

সত্তর বছর আগে ডক্টর হেক্টর-এর এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন মৌসুমে ১৮,০০০ জাতের ধান আবাদ হতো। এ সমস্ত জাতের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টের জন্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে বৈচিত্রিক জাতের ধানের কেন্দ্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। গত শতাব্দির আশি দশকের শুরুতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সারাদেশে আবাদকৃত প্রায় ১২,৫০০ জাতের নাম সংগ্রহ করেছিল। নতুন জাতের ধানের আবাদের ফলে এই দেশীয় সম্পদ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে হয়তো এর ৫ ভাগও আবাদ হয় না। দেশী জাতের কোনোটার ভাত হতো মিষ্টি, কোনোটা থেকে হতো সুস্বাদু চিড়া, কোনোটা থেকে মচমচে মুড়ি, কোনোটা থেকে তৈরি করা হতো পিঠার জন্য আটা, আবার কোনোটার চাল থেকে রান্না হতো শুধুমাত্র পায়েস। দুধ ও কলা দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য আবাদ করা হতো বিশেষ জাতের। এ সমস্ত জাতের নামও ছিল বিচিত্র। যেমন মাছরাঙ্গা, ঘিকাঞ্চন, গৌরকাজল, সূর্য্যমনী, কলমীলতা, বনফুল, ভাটিয়াল, মেঘলাল, সাগরদীঘি ইত্যাদি।

দেশী জাতের ধান গাছ ছিলো লম্বা, ৩ থেকে ১৫ ফুট। এর পাতা হতো পুরু ও লম্বা। ফলে ধান ক্ষেতে আশ্রয় নিতে পারত অনেক জাতের প্রাণী। পানিতে ডুবে গেলে ধানের ক্ষেত হতো মাছের, ব্যাঙের, কাঁকড়ার আবাসস্থল। গাছের কাণ্ডে আর পাতায় জমে থাকা শেওলা হতো মাছের প্রিয় খাদ্য। ধান পেকে গেলে ক্ষেত ভরে যেত নানা জাতের পাখিতে। ধানের খড় ছিল গরুছাগলের পুষ্টিকর খাদ্য। পুরু ও নরম ভূষি ছিলো হাঁসমুরগী আর মাছের খাবার। দেশী জাতের ফলন কম হতো কিন্তু ধানের ক্ষেতে আর বিলে ছিলো প্রচুর নানা জাতের মাছ, ঘরে ঘরে ছিল গরুছাগল আর হাঁস মুরগী। ফলে মাছ, মাংস, ডিম কেনার প্রয়োজন হতো না। এখন নতুন জাতের আবাদি এলাকা বিস্তারের ফলে এবং বিস্তর রাসায়নিক সার আর কীটনাশক প্রয়োগ করায় ধানের ক্ষেতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বসবাস বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। নতুন জাতের গাছের দৈর্ঘ্য কম, মোটা খড়, ভুষি হয় পাতলা ও শক্ত; গরুছাগল, হাঁসমুরগীর তা পছন্দ নয়। বিদেশ থেকে খাবার আমদানী করে আলাদা খামারে এখন মাছের চাষ আর গরুছাগল ও হাঁসমুরগী পালন করতে হচ্ছে। নতুন জাতের ধানের চাল ঘষে-মেজে সরু লম্বা করে দেশী চালের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।

বর্তমানে অর্ধ শতাধিকের বেশি সংখ্যক নতুন জাতের ধানের চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। এগুলো উচ্চ ফলনশীল বা আধুনিক ধানের জাত হিসেবে পরিচিত। সেইসাথে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড ধান। বর্তমানে প্রতি বছর ২ কোটি ৬০ লক্ষ একর জমিতে ধানের আবাদ হয়। এর মধ্যে নতুন জাতের আবাদ করা হয় ১ কোটি ৮৮ লক্ষ একরে। দেশী জাতের আবাদ দ্রুত কমে যাচ্ছে। সত্তর দশকে আমাদের দেশে শতকরা ৯৭ আগ জমিতে দেশী জাতের ধানের চাষ হতো। দেশী জাতের ফলন কম হওয়ায় তখন আমাদের হয়তো কম ভাত খেতে হতো কিন্ত খাওয়াতে ছিলো তৃপ্তি। নতুন জাতের চাষ করে আমরা একই জমিতে ধানের উৎপাদন ৩ গুণ বৃদ্ধি করেছি, ভাত বেশি খেতে পারছি কিন্তু তৃপ্তি কম।

নতুন জাতের ধান আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সত্তর দশকের শেষের দিকে মাথাপিছু বছরে ১৬০ কেজির কম চাল উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযাযী ১৮০ কেজির উপরে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযাযী ২০০ কেজির উপরে পৌঁছেছে। আধুনিক জাতের আবাদ করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য মাটির উর্বরা ক্ষমতা বজায় রাখতে বছরে সারা দেশে প্রায় ৪০ লক্ষ টন রাসায়নিক সার, ফসলের অনিষ্টকারক কীটপতঙ্গ (বালাই) দমনে ২৫ হাজার মেট্রিক টন বালাইনাশক এবং প্রায় ৪২ লক্ষ হেক্টর ধানের জমিতে ভূগর্ভস্থ পানি সেচ করতে হচ্ছে। তাছাড়া স্থানীয় পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে আবাদকৃত ধান ও অন্যান্য ফসলের দেশী জাতসমূহের অধিকাংশ বিলুপ্ত প্রায়। ফসলের ক্ষেত এখন বৈচিত্রহীন। বিভিন্ন প্রাণী হারিয়েছে তাদের আবাসস্থল। মাটির, পানির গুণাগুণে হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। সেচের জন্য পানি নিয়ে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। এ সমস্ত কারণে আধুনিক ধানের ফলন হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে সার, বালাইনাশক ও সেচ পানি ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে চাষাবাদ খরচ বেড়ে যাবে, মুনাফা হবে কম। তাছাড়া জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তার ফলে আধুনিক ধানের আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। অধিক বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদি বৃদ্ধির ফলে আধুনিক ধানের আবাদ হতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে দেশী জাতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে দেশী জাতের গুণাবলী সংযোজন করে স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন অপরিহার্য্য। সেই সাথে দেশী জাতের সংরক্ষণ ও আবাদ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের সময় দেশী জাতের আবাদ করে খাদ্য চাহিদা পূরণে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশে খাদ্য চাহিদায় চালের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। নব্বই দশকের তুলনায় বর্তমানে প্রতি বছর মাথাপিছু আমরা শতকরা ৫ ভাগ কম ভাত খাচ্ছি। অন্য দিকে আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা মাথাপিছু প্রতিদিন আলু, সব্জি, ফল ও ডাল প্রতিদিন ২৫০ গ্রাম বেশি খেতে পারছি। একই কারণে দেশী সরু চালের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন নাইজারশাল, কাটারিভোগ ও বাশফুল। পাইকারি বাজারে বিক্রিত চালের শতকরা ৩০ ভাগ সরু। দেশী সরু চালের উৎপাদন কম থাকায় মোটা চাল মিলে সরু করে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আশা করা হচ্ছে যে চলতি শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকবে। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে ভবিষ্যতে দেশী ধানের আবাদ বৃদ্ধি করার সুযোগ হবে।

প্রথম দিকে নতুন জাত উদ্ভাবনে শুধুমাত্র ফলনের বিষয়টি বিবেচনা করা হতো। এ ধরনের জাত কতটুকু পরিবেশ-বান্ধব তা বিবেচনা করা হয়নি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) স্থানীয় চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে দেশী জাতের গুণাবলী সংযোজন করে নতুন জাত উদ্ভাবন শুরু করেছে। স্থানীয় কৃষি পরিবেশ, ভূমি ও মাটির ধরন, স্থানীয় বৃষ্টিপাত, বন্যা প্রকৃতি, নিষ্কাশন, সেচ ব্যবস্থা, বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, জীবনকাল, গাছের বৈশিষ্ট্য (যেমন উচ্চতা, পাতা ও কাণ্ডের ধরন), শর্করা তৈরির ক্ষমতা, চালের বৈশিষ্ট্য (আকার, রং, আমিষ ও এ্যামাইলেজের পরিমাণ), ভাতের স্বাদ ইত্যাদি গুণাবলী যত বেশি সন্নিবেশিত হবে ততই নতুন জাতের চাহিদা ও আবাদের ব্যাপকতা বারবে। যেমন ব্রিধান ২৮ চাষ করে ১৪০ দিনে ফলন পাওয়া যায়, সার প্রয়োগ হার কম, হেক্টর প্রতি ৫ টন ধান পাওয়া যায় এবং চাল বেশ চিকন ও সাদা এবং ভাত স্বাদের। ব্রিধান ২৯ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৭ মেট্রিক টনের বেশি, চাল আকর্ষণীয় আকৃতির এবং ভাতও স্বাদের। তবে ফলন পেতে সময় লাগে ১৬০ দিন। এই দুটো জাতই বোরো (শুষ্ক) মৌসুমে চাষ হয়। অন্যদিকে আমন (বর্ষা) মৌসুমে বিআর ১১ ব্যপক হারে চাষ হয়ে থাকে। এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৬.৫ মেট্রিক টন এবং ১৪৫ দিনে ফলন পাওয়া যায়। আউস (বর্ষাপূর্ব) মৌসুমে বিআর ২ ও ১৪, ব্রিধান ৪২ ও ৪৩, ইত্যাদি জাতের ব্যাপক চাষ হযে থাকে।

সাম্প্রতিক কালে মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি বোরো, ৪০ ভাগের উপরে আমন ও ১০ ভাগের কম আউস মৌসুমে উৎপন্ন করা থাকে। বোরো মৌসুমের শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি জমিতে আধুনিক জাতের চাষ হয়। অন্যদিকে আমন মৌসুমে শতকরা ৪০ ভাগ জমিতে ও আউস মৌসুমে শতকরা ৫০ ভাগ জমিতে দেশী জাতের ধান আবাদ হয়। সত্তর দশকের শেষ দিকে মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৫৮ ভাগের উপরে ছিল আমন, ২৩ ভাগ আউস এবং ১৯ ভাগ বোরো মৌসুমে। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় কলাই, মসুড়ি, মটর, মুগ, ছোলা, সরিষা, গম, আঁখ ইত্যাদি ফসলের আবাদ মারাত্বক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সমস্ত ফসলের জমিকে এখন সার আর সেচ দিয়ে নতুন জাতের বোরো ধানের আবাদ হ্েচ্ছ। অন্যদিকে আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ডাল, খাবার তৈল, গম ও চিনি আমদানী করছি। আমন ও আউস মৌসুমে ধান উৎপাদন খরচ কম। তবে ফলন হার কম হওয়ায় মুনাফা কম। এই দুই মৌসুমে উন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশী জাতের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। এতে করে সার ও বালাইনাশক ব্যবহার এবং সেচের উপর নির্ভশীলতা কমে যাবে। অন্যদিকে বোরো মৌসুমে ধানের বদলে গম, সরিষা, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করে বিদেশ থেকে এগুলোর আমদানী কমানো যাবে।

সম্প্রতি আফ্রিকার কৃষি অর্থনীতি বদলে দেয়া নিরিকা জাতের ধান বাংলাদেশে আবাদ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই জাতের বৈশিষ্টসমুহের মধ্যে অন্যতম হল বছরের সব সময়ই আবাদ করা যায়, সবধরণের তাপমাত্রার ফলন দেয়, অধিক খরা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে, জীবনকাল ৯০ থেকে ১১৫ দিন, ফলন ৪ থেকে ৪.৬ মেট্রিক টন এবং বাংলাদেশে ৮০ দিনেও ফলন পাওয়া যাবে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে স্বয়ং নিরিকা জাতের ধানবীজ নিয়ে আসেন। অচিরেই কৃষকদের মাঝে আবাদের জন্য এ ধান বীজ সরবরাহ করা হবে। তবে কী ভাবে এই দান বদলে দেবে কৃষি অর্থনীতি, কী ধরনের পরীক্ষামূলক আবাদ করে সুফল পাওয়া গেছে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) কাছে মজুদকৃত ১ মেট্রিক টন নিরিকা ধানের বীজ কীভাবে এলো এ সম্পর্কে সুষ্পস্ট কোন ব্যাখা নেই।

বর্তমানে উৎপাদিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের তুলনায় আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত নিরিকা জাতের ধানের কী কী বৈশিষ্ট্যের কারণে উৎকৃষ্ট, উপযোগী বা বাংলাদেশে আবাদ করা হবে তা পরিষ্কার নয়। বর্তমানে আবাদকৃত জাতের মধ্যে উল্লেখিত বৈশিষ্টের কোনটি অনুপস্থিত সেটা চিহ্নিত করা হয়নি। এ জাতটি বাংলাদেশে ৮০-৯০ দিনে ফলন দিয়েছে বলে তথ্য দেয়া হয়েছে। কিন্ত ফলন কত হয়েছে বলা হয়নি। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি দেশী জাত ৮০-৯০ দিনে ফলন দেয়। তবে জীবনকাল যত কম হবে ফলনও কমে যাবে। বিআর ৯ ও ১৫ এ দুটি আধুনিক জাত আউস মৌসুমে ১২০ দিনে হেক্টর প্রতি ৫ টন ফলন দেয়। বোরো মৌসুমে ফলন দিতে ৩০ থেকে ৪০ দিন বেশী লাগে তবে হেক্টর প্রতি ফলন ০.৫-১.০ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়। বিএডিসি'র নিজস্ব দু'তিনটি ফার্মে সীমিত পরিমাণের বীজ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে নিরিকা বীজের পরিবর্ধন ও কৃষকদের নিকট বিতরণ ঠিক হবেনা। তাছাড়া এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্ব বিএডিসি'র নয়। এ ব্যপারে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতামত, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা কর্তৃক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে প্রদর্শনী ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তবে সবার আগে আমাদের দেশে এ ধরণের বিদেশী জাতের আবাদের প্রয়োজন আছে কি না ভেবে দেখা উচিত। এ প্রসঙ্গে আফ্রিকান মাগুরের কথা বলা যেতে পারে। দু'যুগ আগে আমিষের অভাব দূরীকরণে বেশ জোরেশোরে এই মাছের চাষ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাক্ষুসে মাছ আখ্যা দিয়ে আফ্রিকান মাগুরের চাষ বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ওরিজা স্যাটিভা (Oryza sativa) প্রজাতির ইন্ডিকা (Indica) ইকোটাইপ এর অন্তর্র্ভুক্ত জাতের ধানের আবাদ হয়ে আসছে। যথাসম্ভব বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (BARD) এর উদ্যোগে ওরিজা স্যাটিভা'র অপর একটি ইকোটাইপ জাপোনিকা (Japonica) ধানের আবাদ করার চেষ্টা করা হয় কুমিল্লাতে নব্বই দশকের শুরুতে। ফলাফল খুব বেশী আশাব্যঞ্জক হয়নি। তবে জাপোনিকা ও ইন্ডিকার সাথে সঙ্করায়ণ করে উদ্ভাবিত জাত দিয়ে এ দেশে নতুন জাতের আবাদ শুরু হয়। অন্যদিকে নিরিকা জাত সম্পূর্ণভাবে অন্য প্রজাতির ধান। এই প্রজাতির নাম ওরিজা গ্লোবেরিরমা (Oryza glaberrima)। বাংলাদেশে সম্ভবত ইতোপূর্বে এ প্রজাতির বা এই প্রজাতির সাথে ওরিজা স্যাটিভা সঙ্করায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত কোনো জাতের ধানের চাষ হয়নি। সুতরাং নতুন কোন প্রজাতির প্রচলন শুরু করার আগে সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেয়া ভালো। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধানের ফলন বা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে নতুন কোন জাতের প্রচলন থেকে চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন জরুরী। যেমন বন্যা, নিষ্কাশন, সেচ, সার, মৃত্তিকা, বালাই ব্যবস্থাপনা। চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করে ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

জাপান ধান উৎপাদনে অনেক আগে থেকে স্বয়ংসম্পুর্ন। বিভিন্ন জাতের উদ্ভাবন করে এ দেশের লোকদের পছন্দনীয় স্বাদ ধরে রাখা হয়েছে। এ জন্য বিদেশী কোন জাত আমদানী করতে হয়নি। প্রতিবেশী ভারতেও বিদেশী কোন জাতের আবাদ হয় বরে মনে হয়না। বরং দেশী জাত যেমন বাসমতির ফলন বৃদ্ধি করে বছরে প্রায় ১০ লক্ষ মেট্রিক টন বিদেশে রফতানী করে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। পাকিস্থানও বছরে ৭-৮ লক্ষ মেট্রিক টন বাসমতি রফতানি করে থাকে। মূল্য সাধারণ চাল থেকে প্রায় ১০ গুন বেশী। আমাদের দেশেও দেশী জাতের চালের মূল্য আধুনিক জাতের থেকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্দি পাচ্ছে। নির্ভেজাল কাটারিভোগ কেজি প্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা।

আমাদের দেশে শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নয়, ভবিষ্যতে ২৫ কোটি মানুষের বসবাস উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যেও আধুনিক বা বিদেশী জাতের পরিবর্তে দেশী জাতের ধানের আবাদ বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে ধান উৎপাদনে বৃদ্ধির হার, মাথাপিছু চালের চাহিদা ও সরবরাহ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ক্রয় ক্ষমতা, শহরমুখী মানুষের সংখ্যা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং আগামীতে এগুলোর সম্ভাব্য পরিবর্তন হার ইত্যাদি বিবেচনা করে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ সমস্ত বিচেনা করে হয়তো দেখা যাবে যে ভবিষ্যতে ধানের চাহিদা মিটাতে নতুন জাতের আবাদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না, দেশীয় জাতই যথেষ্ট হবে।