আরেকটি ‘গার্মেন্টস হত্যাকাণ্ড’ এবং লুটেরা বুর্জোয়ার স্বার্থ

হায়দার আকবর খান রনো
Published : 25 April 2013, 05:23 AM
Updated : 25 April 2013, 05:23 AM

গার্মেন্টস শিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনা। শত শত প্রাণহরণ। মাত্র কয়েক মাস আগেই তাজরীন ফ্যাশনসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতপ্রাণ ঝরে যাওয়ার পর গোটা দেশ শোকে বিহ্বল হয়েছে। তাতে কী? আবারও মৃত্যুর মিছিলে গার্মেন্টস শ্রমিক। ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা নামের একটি ভাঙনোন্মুখ ভবনে অবস্থিত কয়েকটি গার্মেন্টসে ঘটে যাওয়া বীভৎস 'হত্যাকাণ্ডের' পর আমি বাকরুদ্ধ। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা!

কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে এ সম্পর্কে আমি বলব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকরাই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। কিন্তু তাদের বিচার হচ্ছে না, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে না তাদের। ফলে ওদের সাহস বেড়ে যাচ্ছে, আস্কারা পাচ্ছে ওরা। অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ, সেখানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না রাখা, একটিমাত্র গেট রাখা বা অন্যান্য গেট বন্ধ রাখা, কারখানার নিচে গেটের কাছে দাহ্যবস্তু রাখা ইত্যাদি কাজ তো ওরা করছেই। ফলে আগুন লাগা বা দুর্ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক, এবং সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিলটাও দীর্ঘ হচ্ছে।

সাম্প্রতিকের প্রায় প্রতিটি গার্মেন্টসে আগুন লাগা বা দুর্ঘটনা ঘটার পর যে বিষযটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হল শ্রমিকদের নির্গমনের পথগুলো বন্ধ করে রাখা। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই 'পাশবিক' এ কাজটি নিয়ে আমরা অনেকদিন আলোচনা-সমালোচনা করি। তারপর সেই একইভাবে আবার আরেকটি গার্মেন্টসে আগুন লাগে বা অন্য কোনো ঘটনা ঘটে- এই গতকাল যেমন ভবন ধসে পড়ল- আবার শ্রমিকের মৃত্যু- ছোট ছোট পিঁপড়ার প্রাণের মতোই যেন এ সমাজে ওরা মূল্যহীন।

গত নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে ১১২ জন শ্রমিকের লাশের মিছিল আমরা দেখলাম- যদিও মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে- কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের জন্যই বা আমরা কাকে দায়ী করেছি? তাজরীনের মালিক এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী ছিল। তাকে কি বিচারের মুখোমুখী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

ওই মালিক দায়ী মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, ওখানে ভবনটি নির্মিত হয়েছিল অবৈধভাবে। দ্বিতীয়ত, ভবনটিতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করলেও মালিকপক্ষ আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা রাখে নি বা রাখলেও সেগুলো তখন ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। তৃতীয়ত, সেই একই পুরনো পাশবিক পদ্ধতিতে আগুন লাগার পর শ্রমিকদের বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে।

এসব কিছুর দায় কিন্তু মালিককেই নিতে হবে। কারখানার সুপারভাইজার বা অন্যরা গেট বন্ধ করে দেওয়ার কাজটি করলেও এর মূল দায় মালিকের। পাশাপাশি দায়ী ওই কর্মচারী বা কর্মকর্তারাও। আমরা কি এদের কাউকে গ্রেপ্তার বা বিচারের মুখোমুথী হতে দেখেছি?

২৪ এপ্রিলের রানা প্লাজার দুর্ঘটনাটি আগুন লাগা নয়, ভবন ধসে পড়া। পুরো বিষয়টি এখনও জানা যায়নি। কিন্তু নিশ্চিতভাবে এখানেও অসংখ্য অনিয়ম রয়েছে। ভবন নির্মাণে অনিয়ম তো থাকতেই পারে, পাশাপাশি ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করানোর মতো বিষয়-আশয় রয়েছে। এভাবে বারবার মৃত্যুকূপের মধ্যে শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়ার পর এই একুশ শতকেও মালিকরা পার পেয়ে যাচ্ছে, কোনো দায় ছাড়া। ভয়াবহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছে ওরা। এতবড় মাপের 'হত্যাকাণ্ড' ঘটিয়েও ওরা রক্ষা পাচ্ছে প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের আনুকূল্যে।

তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর শ্রমিক সংগঠনগুলো বড় বড় সমাবেশ করেছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মালিকসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার কিছুই করতে পারেনি বা করেনি। মালিকের টিকিটি ছোঁয়া যায়নি। এভাবে মানুষ মেরে এবং আ্ইন ভঙ্গ করে ওরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে মালিকদের দুটি সংগঠন আছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। এসব সংগঠন এ ধরনের যে কোনো দুর্ঘটনার পর মালিককে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। ওরা এটা করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এসব মালিক তো ওদের সংগঠনের সদস্য। তাজরীনের মালিককে দেখেছিলাম টেলিভিশনের টক শো'তে এসে বড় বড় কথা বলে গেছে। দুর্ঘটনার সব দায় চাপিয়ে গেছে ওই শ্রমিকদের উপর, যারা অসহায়ভাবে ওইদিন 'খুন' হয়েছিল অথবা কোনোরকমে প্রাণে বেঁচেছিল।

বলবেই-বা না কেন, তার পক্ষে তো আছে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। কারণ মালিকদের ওইসব সংগঠন বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ ছাড়াও সরকার তাদের পক্ষে কাজ করে। মালিকদের বাঁচায় সরকার, শ্রমিককে নয়। শ্রমিকের প্রাণের দাম এখানে তুচ্ছ। মা্ত্র কয়েক লাখ টাকায় এখানে প্রাণহরণের দায় শোধ হয়। 'খুনি' শাস্তি পায় না। ফলে নতুন নতুন খুনি তৈরি হয়। অন্য খুনিরা সাহস পায়।

গার্মেন্টস শিল্পে সুস্থিরতা আনতে হলে একে মৃত্যুকূপ বানানোর এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। এখানে নানা বৈষম্য ও নিপীড়নের মধ্যে শ্রমিকরা কাজ করেন। আট শ্রমঘণ্টার বদলে ষোল ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের। বেতন-ভাতা এখনও অপ্রতুল। অনেক জায়গায়ই মজুরি কাঠামো মানা হয় না। বেতনভাতা অনেক জায়গায় অনিয়মিতও বটে। কখনও কখনও অন্যায়ভাবে কর্মচ্যুত হয় শ্রমিকরা। অন্যান্য অধিকার তো উপেক্ষিত হয়ই। অধিকার নেই ট্রেড ইউনিয়ন করার। যার ফলে ন্যায়সঙ্গত ও পদ্ধতিগত উপায়ে দাবি-দাওয়া আদায়ের কোনো সুযোগই নেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের। আমাদের দেশে শ্রমিক শোষণের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা আর নেই।

এমন অবস্থায় গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক জাতীয় অর্থনীতির জন্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। সেক্ষেত্রে তাদের কর্মপরিবেশটিও যদি উন্নত না হয় বা সেখানে অন্তত বিপদের আশঙ্কামুক্ত হয়ে তারা কাজ করতে পারবেন এমন সুযোগটিও যদি না থাকে তাহলে সেটা দীর্ঘদিন ধরে মেনে নেওয়া যায় না। এই রাষ্ট্র শ্রমিকদের সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গার্মেন্টস শিল্পের পরিপূর্ণ বিকাশ ও এ শিল্পের স্থিরতা আশা করতে পারে না। এখন যদি আমরা সচেতন না হই, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কাজ করতে না পারি তবে আশার আলো দেখা যাবে না। এভাবে চলতে চলতে একদিন এ শিল্প তার সঞ্জিবনী শক্তি হারিয়ে মৃতশিল্পে পরিণত হবে।

আমাদের এখানে বুর্জোয়ারা হচ্ছে লুটেরা। তারা তাৎক্ষণিক লাভকে বড় করে দেখে। ফলে শিল্পের স্বার্থের কথা তারা ভাবে না। যদি ভাবত তাহলে শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষা করার দিকে মনোযোগ দিত। লুটেরা বুর্জোয়াদের পক্ষে এটা সম্ভবই নয়। সত্যিকারের শিল্প বুর্জোয়া শ্রেণি যেটির বিকাশ ঘটেছে পশ্চিমে, এর ফলে সেখানে শিল্পায়ন হয়েছে এবং শ্রমিক তার ন্যুনতম অধিকারগুলো পাচ্ছে। আমাদের দেশে এমনটি হলে কারখানায় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নত হয়ে শিল্পের উত্তরোত্তর বিকাশ হত।

আরেকটি বিষয় উদ্বেগজনক। গত কয়েক দশকে গার্মেন্টসে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বাইরের বিশ্বে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প বাজার হারাচ্ছে। ক্রেতারা নানা অভিযোগ তুলছে। এ সব দুর্ঘটনা বন্ধ করতে বলছে তারা, বলছে গার্মেন্টসে কর্মপরিবেশ উন্নত করতে। বিষয়টি নিয়ে আমরা না ভাবলে শিগগির এ শিল্পটি বাইরের বিশ্বে বাজার হারাবে।

আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে আজ যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তার বড় কারণ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেওয়া। এটা মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানেও এর স্বীকৃতি আছে। শ্রমিকরা যদি আজ ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারত তবে তারা শ্রম আইন মানার ব্যাপারে মালিকদের বাধ্য করতে পারত। সংগঠিত হয়ে ও যথাযথ পদ্ধতিতে মালিকপক্ষের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারত। শ্রম আইনে আছে মালিকরা শ্রমিককে আট ঘণ্টার বেশি খাটাতে পারবে না। আর যদি খাটাতেও চায় তবে কয়েকটি শর্ত মেনে নিতে হবে। যেমন শ্রমিকের পূর্ণ ও স্বাধীন সম্মতিক্রমে এবং তাকে দ্বিগুণ বেতন দিয়ে তার কাছ থেকে বাড়তি শ্রম নেওয়া যাবে।

আজকে শ্রমিক সংগঠন আইনসিদ্ধভাবে প্রতিটি গার্মেন্টসে কাজ করতে পারলে যেসব জায়গায় আগুন লাগছে সেসব জায়গায় আগুন লাগত না। কারণ শ্রমিক সংগঠন সেখানে সজাগ থাকত। তারা আগুন নেভানোর যথাযথ ব্যবস্থা রেখে দিতে মালিক ও কারখানা প্রশাসনকে বাধ্য করত। আবার যে ভবনে দুর্ঘটনা হচ্ছে সে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হলেই শ্রমিকরা ওখানে কাজ না করানোর জন্য মালিকদের চাপ দিত। এগুলো তো নেতিবাচক কিছু নয়। তাতে গার্মেন্টস শিল্প এভাবে মৃত্যুকূপ হয়ে উঠে বাইরের বিশ্বের বাজার নষ্ট করত না।

সমস্যা হচ্ছে আমাদের সরকারগুলো শ্রমিকবান্ধব নয়, মালিকবান্ধব। সরকারে যারাই থাকেন তারা চলেন গার্মেন্টসের টাকায়। সংসদ সদস্যদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ গার্মেন্টসের মালিক। ফলে মালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকার প্রতিটি গার্মেন্টসে র‌্যাব ও পুলিশের সহযোগিতায় শ্রমিকদের দমনের কৌশল গ্রহণ করে রেখেছেন।

এর আলটিমেট ফলাফল এই সব 'খুনোখুনি' এবং 'নৈরাজ্য'। আজ যখন এ শিল্পের কোনো প্রতিষ্ঠানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে, অনেক মানুষ 'খুন' হবেন, মালিককে বিচারের মুখোমুখি করা তো দূরের কথা, তাকে সমাজে সদম্ভে বিচরণের সুযোগ করে দেওয়া হবে- তখন শ্রমিকদের মধ্যে দানা বাঁধা ক্ষোভ একভাবে না একভাবে প্রকাশিত হবেই। সেটি তো খুব একটা সুখকর হবে না। তখন আবার তারাই বলবেন যে শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। এখন কথা হল, শ্রমিকও তো বলতে পারেন যে, মালিকদের ওই সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করে দেওয়া হোক, কারণ ওরা শ্রমিক-স্বার্থ ক্ষুণ্ন করছে, তাহলে কী হবে? আমার প্রাপ্য অধিকার, সংবিধানসম্মত অধিকার আমাকে না দেওয়ার তুমি কে?

শ্রমিকের মৌলিক অধিকার ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ দিতে এরা খুব ভয় পান। ভয় পান সরকার ও পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। তারা মনে করেন ট্রেড ইউনিয়ন করলে শ্রমিক যদি ন্যায্যটা আদায় করে নেন তাতে মালিকের লাভ কমে যাবে। এ কারণে শ্রমিককে এক সর্বগ্রাসী শোষণের মাধ্যমে মালিকদের লাভের অংক বড় করে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্মম মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের। এটাই যেন এখন আমাদের তৈরি পোশাক খাতের বাস্তব চিত্র। ইতিহাসের কাছে এর দায় কি শোধ করতে হবে না?

আমাদের যেসব রাজনৈতিক দল আছে তার বেশিরভাগই ওই লুটেরা বুর্জোয়া ও ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের স্বার্থরক্ষা করে। ফলে সরকার পরিবর্তন হলে যে শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে তা নয়। বরং সেই একই চক্রে ঘুরপাক খাবেন শ্রমিক। শ্রমিকবিদ্বেষী, জনমানুষবিদ্বেষী এসব সরকারের কাছে শ্রমিকদের জীবনের দাম খুবই অল্প।

আমাদের দেশে সত্যিকারের শিল্প বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে না উঠলে অথবা সত্যিকারের জনগণের দল সরকার গঠন করতে না পারলে গার্মেন্টসে এমন 'হত্যাকাণ্ড' চলতেই থাকবে।

হায়দার আকবর খান রনো: কমিউনিস্ট নেতা ও প্রাবন্ধিক।