‘নোয়াখালীর হিন্দু আর বিহারের মুসলমান’

Published : 24 April 2013, 03:39 AM
Updated : 24 April 2013, 03:39 AM

''গত রোববার গভীর রাতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর খরনদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠপুরা গ্রামের শাক্যমুনি বৌদ্ধ মন্দিরের দানবাক্স লুট করে মূর্তিতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।'' একটি অনলাইন দৈনিকে পোস্ট করা খবরটি পড়ে চল্লিশ দশকের এক যশস্বী কবির লেখা ওই লাইনের কথা মনে পড়ে গেল… ''মরণের পরে সবাই সমান, নোয়াখালীর হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।''

এটির এক অংশকেই তাই লেখার শিরোনাম করলাম। যদিও মন্দির ভাঙার কাহিনি এখন নিত্যদিনকার।

মন্দির ভাঙার ইতিহাস আজকের নয়। সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন, কালাপাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস আমরা জানি। তখন প্রতিদিন মন্দিরে আগুন অথবা ভাঙচুর-লুটপাট চালানো হত কিনা জানি না, তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা প্রচুর ঘটছে। আমরা তাই সাম্প্রতিক কাহিনিতে যাব।

১৯৯৩ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার জের ধরে মানিকগঞ্জের নিভৃত গ্রাম গাংডুবীর প্রবেশমুখের দুটি হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সে গ্রামেই ছিল আমার বড়দির বাড়ি। বছর কয়েক আগেও পায়ে হেঁটে বা নৌকায় সে গ্রামে যেতে হত, অন্য কোনো যান ওখানে চলেনি। এ গ্রামেই মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার শৈশব আশ্রয় নিয়েছিল।

ওই ঘটনার পর গ্রামের হিন্দুদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিটেমাটি ফেলে কোলকাতার আশেপাশে অথবা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর এলাকায় পালিয়ে যান। এর পরপরই অস্থায়ী ভিত্তিতে তৈরি গ্রামের মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলা হয়। কোনো এক শুক্রবারে জুমার নামাজ শেষে মাত্র কয়েকজন মুসল্লি মিলে কাজটা করেন। অন্য মুসলামানরা বাধা দিতে গেলে ওই দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। অথচ পাকিস্তান আমলেও ওই গ্রাম ও এর পাশের গ্রামগুলোতে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশেই ছিলেন।

গাংডুবীর একটু দূরেই ঢাকা-আরিচা সড়কের ধারে অবস্থিত বানিয়াজুড়ি গ্রাম। ষাটের দশকে এ গ্রামের জমিদাররা সব ফেলে দেশান্তরি হয়েছিলেন। ওরা যে পাড়ায় থাকতেন তার নাম ছিল 'রাথুরা'। আসলে গ্রামের ভেতর আরেক গ্রাম। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসের অবসরে বা কোনো উছিলায় জমিদারদের ফেলে যাওয়া জরাজীর্ণ পুরনো বাড়ির কয়েকটিতে আমরা ঘুরে বেড়াতাম। দেখতাম সোনা দিয়ে গড়া রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি। আরও ছিল নাড়ু-গোপাল, মাটি দিয়ে বানানো গৌড়-নিতাই, লক্ষ্মী আর গরুড়পাখির মূর্তি। মন্দিরগুলো ছিল কাঠের কাজ করা। কোনোটি ছোট, কোনোটি বড়। জীবনে প্রথম দেখেছি কাঠের কাজ করা এমন মন্দির।

জমিদার বাড়িতে আরও ছিল নানা রকমের মঠ, জগন্নাথ দেবের রথ। জমিদাররা যখন ছিলেন তখন ঘোর শ্রাবণে মাঠে রথের মেলা বসত। বিপুল লোকসমাগম হত মেলায়। আর শ্রাবণের অঝর বর্ষণের ফলে মেলা চলার সময় থিকথিকে কাদায় ভরে যেত চারপাশ। তারপরও মেলায় উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে আমি নতুন অভিজ্ঞতার আস্বাদ নিয়ে ভীষণ রঙ্গিন হয়ে উঠতাম।

আজও, এই ইট-কাঠ-পাথরের অট্টালিকার ভিড়ে বসে যেন আমি সত্তর দশকের গোড়ার দিকের সেসব দিনের গন্ধ ও বর্ণের ছোঁয়া পাই। আমার সে অসাধারণ শৈশবের গভীর ভালো লাগার মন্দিরগুলোর সব মূর্তি পরে ভেঙে ফেলা হয়েছে। কারা যেন সেসব মন্দিরে আগুনও দিয়েছে। তিরানব্বইয়ের ওই কর্কট রোগটি কিন্তু এখনও সারেনি। বরং এর প্রদাহ আরও ব্যথাতুর করছে আমাদের সমাজকে।

মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন রাজাকারদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে। হালের গরু লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। স্বাধীনতার এত বছর পরও শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা একটুও কমেনি বরং বেড়ে গেছে।

এখন সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারী, শিশু, মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক শ্রেণির লোক লুটেরা ও কালো টাকার মালিকদের হাতে জিম্মি ও নির্যাতিত। মুক্তচিন্তার মানুষরাও এ দেশে এখন সংখ্যালঘু। কিন্তু সে নির্যাতনের চরিত্র ভিন্ন। ধর্মীয় কারণ সেখানে অনুপস্থিত। রামু ও বাঁশখালীর পোড়াবাড়ি, চোখ খুঁড়ে নেওয়া বুদ্ধমূর্তি, লোকনাথ মন্দিরের পোড়া ছাই, মন্দিরের চারপাশ ঘিরে ক্রন্দনরত অসহায় মানুষের মুখ আর খুব বেশিদিন আমরা দেখব কি? মনে হয় না। ওরা একসময় পূর্বসূরীদের মতোই নিভৃতে দেশান্তরি হবেন।

১৯৫০ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে আমাদের এ অ্ঞ্চলে কয়েকবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। তখন দুটি পক্ষ পরষ্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হত। অর্থাৎ বিষয়টা ছিল দ্বিপাক্ষিক, তাই প্রতিরোধও ছিল। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের উপাসনালয় বা সম্পদ ধ্বংস করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হত। এমনকি নিজ সম্প্রদায়ের কাউকে অন্য সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত করতে দেখলে অনেকেই বাধা দিতেন।

এখন কিন্তু সহিংসতার রূপটা একেবারে ভিন্ন। যারা এমনকি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকর্ম করেন না- অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডার সাহায্যে দুর্বৃত্তরা তাদেরও দলে ভিড়িয়ে নিচ্ছে। ফলে একতরফা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা। আরেকটি সমস্যা হল, এ সহিংসতার বিষয়টি অস্বীকারের প্রবণতা। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংঘটিত সহিংস ঘটনার কথা ঢাকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সাংবাদিকদের জানানো হলে প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চাননি। পরে একটি শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক থেকে দক্ষিণবঙ্গের ভোলায় প্রতিবেদক পাঠানো হয়। উঠে আসে মর্মন্তুদ সব কাহিনি। হতভম্ব হয়ে যান সবাই। পরে অবশ্য এ বিষয়ে ওই দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আমরা বারবার ভুলে যাই যে, এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসীসহ সকল সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই সংখ্যাগুরু আর একাত্তরের পরাজিত শক্তি মূলত সংখ্যালঘু। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। যে অসুরের লালন ও বর্ধন এই রাষ্ট্রে হচ্ছে– যে বিষবৃক্ষের বীজ এখানে অতিযত্নে রোপণ করা হয়েছে– সে অসুরের অসুরিক বিস্তার ও সে বিষবৃক্ষের ডালপালার প্রসারণ হচ্ছে সর্বত্র। কাচঘেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে তত্ত্বচর্চা করে, বড় বড় কথা বলে সে সবের বিরোধিতা করা যাচ্ছে কি? লেখা হয় 'দেশভাগের গল্প', 'ভয়ের সংস্কৃতি'। নানা রকমের ব্যাখ্যা আসে। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিষয়ে প্রচলিত ব্যখ্যার সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরা হয়। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। গতির সূত্রে কাল গড়িয়ে যায়। অসহায় এই সব দিনরাত্রি কোনো বিন্দুতে গিয়ে স্থির হয় না।

আমি বলব, এ জন্য ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে সংখ্যালঘুদের নেতারাও কি কম দায়ী? তারা তো শত্রু-মিত্রই চেনেন না। আর যদি-বা কেউ কেউ চেনেন তারাও আপোষকামী চিন্তা থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সঠিক লড়াইয়ের নীতি-কৌশল গ্রহণ করেন না। তাছাড়া বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই অনেক সংখ্যালঘু-নির্যাতক নেতা রয়েছেন। প্রকাশ্যে-গোপনে, দিনের আলোয় বা রাতের আঁধারে তারা লোভ ও রিরংসা, অন্ধত্ব ও গোঁড়ামির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন নানা মাত্রায়, নানা কায়দায়। আবার এই বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা দিনের বেলায় সংখ্যালঘু ধর্মীয় পরিচয়ধারীদের শান্তি-স্বস্তির বরাভয় দান করেন কিন্তু রাতে তাদের মুখ চেনা যায় না। তখন সবাই মুখোশ-পরা। তাই ,'তোমার মুখোশ দেখে হেসে ওঠে আমার মুখোশ'।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ১৯ এপ্রিলের ত্রিবার্ষিক অষ্টম জাতীয় সম্মেলনে এসব থেকে মুক্তি পেতে অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যের বিকল্প নেই বলে বক্তরা মতপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাতে না পারলে কি এসব কথা বলে সুফল পাওয়া যাবে? ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের চর্চা কোন দলের মধ্যে নেই? কোন দল ভোটের জন্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দেয় না?

আমরা বলছি অনেক কথা, লিখছিও অনেক কিছু। কিন্তু ঘোর তমসা কাটছে না। এ আকাল শুভকাল পানে কীভাবে ধাবিত হবে সেটিই আজ বড় প্রশ্ন।