হিংস্রতার হাত ধরে লালসার পথে

মোহীত উল আলম
Published : 14 July 2010, 03:37 PM
Updated : 14 July 2010, 03:37 PM

'মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর', কবি নজরুল লিখেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ক্রমবর্ধমান অন্তর্কোন্দলের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় বেশ কিছু ছাত্র (?) আহত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি ছবিতে আছে তিন-চারজন যুবক ছাত্র মাটিতে পড়ে কাতড়াচ্ছে। এদেরকে নাকি প্রতিপক্ষ দলের ছাত্ররা তিনতলার ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

প্রতিটি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে হিংস্রতা এবং নিষ্ঠুরতা জড়িত থাকে। সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়ার পারদ ওঠানামা করে ঘটনার মধ্যে হিংস্রতার চেয়েও নিষ্ঠুরতার পরিমাণের ওপর। মৃত্যুতো আছেই, কিন্তু মৃত্যুর ধরনের রকমফেরের ওপর অভিমত তৈরি হয়। একটি লোককে গুলি করে যেমন মারা হয়, তেমনি তাকে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েও মারা হতে পারে এবং দ্বিতীয় মৃত্যুটাকে সবাই অধিকতর নিষ্ঠুর বলবে। যেমন একটি ইঁদুরকে পিটিয়ে মারলে তা'তে মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া হয়, কিন্তু ঐ ইঁদুরকে যদি জীবন্ত ঝুলিয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে সেটা হবে নিষ্ঠুরতা। ছাত্র-সন্ত্রাসী ছাত্র-সন্ত্রাসীকে গুলি করে বা পিটিয়ে মারছে হর-হামেশা। হিংস্রতা আছে অবশ্যই। কিন্তু তিনতলা থেকে ফেলে দেওয়ার মতো কাজ হলো চরম নিষ্ঠুরতা। গ্রিক বীর একিলিস তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রয়ের যুবরাজ হেক্টরকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে মেরেছিলেন। হেক্টরের মৃত্যু তাই ধ্রপদী সাহিত্যে নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন।

কোত্থেকে আসে এ নিষ্ঠুরতা? ব্যক্তির অর্ন্তগত কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে, কোন জিনগত কাঠামো থেকে, নাকি সামাজিক পরিবেশ থেকে? ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের শুরুতে ম্যাকিয়াভে্িল্ল অভিমত দিয়েছিলেন যে মানুষ যতটা না স্বয়ংক্রিয় তার চেয়ে বেশি সে সমাজসৃষ্ট জীব। অর্থাৎ মানুষ প্রধানত সমাজ নিয়ন্ত্রিত জীব। এ কথাটা অন্যভাবে কার্ল মাক্স এবং দার্শনিক ফুকোও বলে গেছেন। এঁদের ধারণা হলো সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা ক্ষমতাসীন সরকারের লক্ষ্য থাকে অন্যের জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। একটি রাজনৈতিক সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নানারকম চাল দেওয়া হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু এ নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া সামরিক শাসন বা মৌলবাদী শাসনের মতো সরাসরি হয় না। হয় অলক্ষ্যে, কখনো রাষ্ট্রনিরাপত্তার নামে কখনো বা  গণতন্ত্রের নামে, কখনোবা জনকল্যাণকর কোন ব্যবস্থার ধুয়ো তুলে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে ব্যবসা-পুঁজি ঠিক রাখা, বিদেশভ্রমণের সুবিধা নিশ্চিত করা এবং নিজের দলের পক্ষে জনমত তৈরি করা। নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা চালু রাখার একটা বিরাট উপায় হলো ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসমনস্ক যুবগোষ্ঠীকে নানারকম অবৈধ সুযোগের সুবিধা দেওয়া। এ জন্য এ যুবকদের পেছনে কিছু গডফাদারের ভূমিকা থাকে।  আবার এ যুবকেরাও যখন বুঝতে পারে তাদের রক্ষা করার লোক আছে তখন তারা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। বেপরোয়া ভাব থেকে নিষ্ঠুরতায় পৌঁছানো কেবল এক কদম দূরত্বের ব্যাপার। ক্ষমতার এ আকর্ষণীয় নিয়ন্ত্রণবলয় আছে বলে রাজনৈতিক দলগুলো এত ক্ষমতার লড়াইয়ে অবর্তীণ হয়। কারণ ক্ষমতায় না থাকলে তারা নিয়ন্ত্রণবলয় হারিয়ে ফেলে, বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই ক্ষমতায় যারা নাই, তাদের সমর্থক ছাত্রদের রক্ষকও নাই, তাই তারা বেপরোয়া হতে পারে না। এসময় যুবসন্ত্রাসী ছাত্ররা দলবদলে প্রবৃত্ত হয়। ছাত্র রাজনীতির ধারা যখন সন্ত্রাসী ধারার সঙ্গে একীভূত হয়, তখন ছাত্রদের পক্ষে প্র্রথমে বেপরোয়া এবং তারপর নিষ্ঠুর হওয়াটা সম্ভব হয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসমর্থকদের পক্ষে নিষ্ঠুরভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়া সম্ভব হয়।

ছাত্ররাজনীতির জগত ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও এমন কিছু উপাদান তৈরি হয়েছে যা মানুষকে নিষ্ঠুর হতে প্রণোদিত করছে। বস্তুত শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি নয়, ঢাকায় সংঘটিত কিছু কিছু ঘটনার মধ্যে বিবেকহীন নিষ্ঠুরতার প্রকাশ দেখছি। জুরাইনে সংঘটিত মা-সহ দুই শিশুর আত্মহননের ঘটনার পর মায়ের লিখিত ডায়েরি পত্রিকায় পড়ে জানতে পারছি যে মহিলার প্রতি তার স্বামী এবং শ্বশুরকূল চরম নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশের নারীসমাজ যে কীরকম সামাজিক নিষ্ঠুরতার শিকার এ ডাইরিটি তা বহন করছে। আদাবরের শিশু সামিউলের হত্যাকান্ডের মধ্যেও চরম নিষ্ঠুরতা দেখতে পাচ্ছি। শিশুটিকে গলা টিপে হত্যা করে বস্তাবন্দী করে ফেলে রেখেছিল ঘাতক আরিফ। শিশুটির মা আয়েশাও এ হত্যাকান্ডের সংগে জড়িত কি না পুলিশ তা এখন তদন্ত করছে। আরিফ এবং আয়েশার অবৈধ সম্পর্কের জেরস্বরূপ এ শিশুর মৃত্যু ঘটে। আরো একটি নিষ্ঠুর ঘটনার কথা মনে পড়ছে, এ ঢাকাতেই এক বিবাহপ্রত্যাশী যুবক তার প্রেমিকার মা-বাবকেই গুলি করে মেরে ফেলে। আবার আরেক বখাটে যুবক তার পছন্দের মেয়েটির গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে মেয়েটির মৃত্যু হয়  হাসপাতালে । এরকম ঘটনা আরো অজস্র ঘটে যাচ্ছে সমাজে।

জাহাঙ্গীরনগরের সন্ত্রাসী ছাত্ররা যে তাদের সহপাঠিদের তিনতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, তার পেছনের কারণটা শুনেছি জায়গা-জমি দখল ও টেন্ডারবাজি। প্রভাব প্রতিপত্তি এবং লাভের বখরা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারিটা লেগেছিল। এখানে অবৈধপথে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা আছে। যারা জমি ও টেন্ডার দখলের জন্য এ ছাত্রদের নেপথ্যে ছিল তাদের উস্কানিতে এ মহড়াগুলো হয়। দুর্নীতি ও অবৈধপথে অর্থ উপার্জনের এ চক্র ভাঙার কোন উপায় নেই। কারণ এসব সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষীয় মহলে যত ওপরের দিকে যাবে, তত এ ঘটনার তাৎক্ষণিক হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার ব্যাপারটি ফিকে হয়ে যাবে, তখন জায়গা পাবে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধিতার ব্যাপারটি।

যেমন ধরুন দুই প্রতিবেশির বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া হলো, এবং এতে অভিভাবকেরাও জড়িয়ে পড়লেন, এবং একটা রক্তারক্তি কান্ড হয়ে গেল। পাড়ার মোড়ল যখন এ ব্যাপারটি নিয়ে মীমাংসায় নামবেন, তখন তার দেখার ব্যাপার হবে বিবদমান দুই পরিবারের মধ্যে কোনটির প্রতি তাঁর সমর্থন আছে, বা কোন পরিবারটি তাঁকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

ছাত্রদের সন্ত্রাসমূলক ঘটনাগুলোও ওপরের স্তরে গেলে ঘটনার তাৎক্ষণিকতার ব্যাপারটি ফিকে হয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়, সে জন্যই গত ঊনচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও ছাত্র-রাজনীতিতে কোন উন্নতি হয় নি।কান টানলে মাথা আসে। যদি সংসদ পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করতে না পারে, তা হলে দেশের রাজনীতি দিগনির্দেশনা পাবে কী করে? ছাত্র-রাজনীতিরও বা উন্নতি হবে কেন?