ধর্মীয় রাজনীতি : নতুন বোতলে পুরনো মদ

আহমদ রফিক
Published : 10 April 2013, 05:45 PM
Updated : 10 April 2013, 05:45 PM

সম্প্রতি যুদ্ধারাধের বিচারের ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডব ও সহিংসতার পর দেশে ধর্মীয় রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে নানা দিক থেকে আলোচনা চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের অতি-সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যেটি রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার কুফল নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবসসময়ই ছিল। আর এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় ধর্মীয় রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত ঘটেছিল যথারীতি তার সহিংস উন্মাদনা নিয়ে। দেশবিভাগ সত্ত্বেও সে উন্মাদনার অবসান ঘটেনি। ওটির প্রেতাত্মা এখনও সমাজের ঘাড়ে চেপে আছে। সমাজ ও রাজনীতি দুই-ই এজন্য দায়ী। একাত্তরের পূর্ববাংলায় আমরা ওই অপশক্তির প্রেতনৃত্য দেখেছি। সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, একাত্তরে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নরনারী-শিশুহত্যার বর্বরতায় পাকসেনাদের সঙ্গে যোগ দিতে দেখেছি জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ নামীয় সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের। সে সঙ্গে জামায়াতের তরুণগোষ্ঠী আলবদর, আলশামস সদস্য এবং বাঙালি-বিহারি সমন্বিত রাজাকার বাহিনী কুখ্যাতি অর্জন করেছিল ঘাতক ও ধর্ষক হিসেবে।

কথাটা ইতিহাসে বহুকথিত যে, স্থানীয় জামায়াত-রাজাকার-আলবদর সদস্যদের সাহায্য না পেলে পাকসেনাদের পক্ষে অচেনা শহর-গ্রামে এত সহজে, এত অধিক সংখ্যক হত্যা ও ধর্ষণ ঘটানো, এক কথায় ব্যাপক গণহত্যা-গণধর্ষণ সম্ভব হত না। সে হিসেবে, এ মাটির সন্তান হিসেবে গণহত্যার দায়ে এদের অপরাধ অনেক বেশি। যুদ্ধের ন'মাসে এদের তৎপরতা বরাবর সচল ছিল, তবে তা বর্বরতার দিক থেকে অতীতের অনেক ইতিহাস ম্লান করে দেয় যুদ্ধশেষের দিনগুলোতে, অর্থাৎ একাত্তরের ডিসেম্বরের প্রথম দু'সপ্তাহে। বুদ্ধিজীবী হত্যা এর একটি উদাহরণ মাত্র।

দুই

যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে এদের নেতা-ক্যাডারদের জান বাঁচাতে আত্মগোপনে যেতে হয়। পালের গোদা কেউ কেউ পাকিস্তানে বা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমায়। কেউ কেউ ধরা পড়ে কারাগারে ঠাঁই পায়। মানুষ তখন অপরাধীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত স্বজন-হত্যাকাণ্ডের জবাব দিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন তাদের সবার বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি; যেমন পারেনি যুদ্ধাপরাধী পাকসেনাদের বিচার করতে।

জামায়াত বা মুসলিম লীগের পক্ষে তখন রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া দূরে থাক, জনরোষের কবল থেকে জান বাঁচানো ফরজ হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো এ কারণে জামায়াত ও মুসলিম লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দরকার মনে হয় নি। কেউ ভাবেন নি তারা আবার রাজনীতিতে, রাজপথে ফিরে আসতে পারে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত তখনকার বহুকথিত নামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোলাম আজম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলিম, ফরিদ আহমদ, মতিউর রহমান নিজামি, মওলানা আবদুল মান্নান, সাকা চৌধুরী এবং প্রত্যক্ষ ঘাতক হিসেবে কুখ্যাত সাংবাদিক চৌধুরী মঈনুদ্দিন প্রমুখ। আন্তর্জাতিক আইনেও যুদ্ধকালে নিরীহ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বিচারযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশের দূষিত রাজনীতি একাত্তরের ঘাতকদের স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বাসনে সাহায্য করেছে; নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে বা সমর্থনের পাল্লা ভারি করতে ঘাতকদের কাছে টেনে নিয়েছে। যদিও তখন তাদের জনসমর্থন প্রায় শূন্যের কোঠায়। ক্রমে তাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে নানা কূটকৌশলে এবং রাজনীতির নৈরাজ্যিক আবহাওয়ায়। সে পরিবেশে গুটিকয় বিভ্রান্ত রাজনীতিকের তৎপরতায় ধর্মবাদী রাজনীতিরও প্রকাশ, এবং এর সামাজিক বিকাশ। এক অর্থে এরা সংবিধানিক স্বীকৃতিও পেয়ে যায় পরোক্ষে।

অবশ্য এটাও দু:খজনক যে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর একাংশ এত দ্রুত একাত্তরের গণহত্যার বর্বরতা ভুলে যেতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ধর্মভিত্তিক ও সম্প্রদায়বাদী দলগুলোর প্রতি সমর্থনও জানাতে পেরেছে। এসব সংগঠন ১৯৭৯ সালে প্রকাশ্যে দলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান, আয়তনে যত ছোটই হোক, নির্দিষ্ট করে নিতে পেরেছে। এর জন্য তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বা কথিত গণতন্ত্রী দলের বা ব্যক্তির অবদান সবচেয়ে বেশি। সে সময় সাধারণ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে কয়েকটি আসনে জামায়াত জয়লাভ করেছে।

তিন

এই আমাদের একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ। এ অঘটনের জন্য আমরা কাকে বা কাদের দায়ী করব? রাজনৈতিক দল বিশেষকে? বিশিষ্ট নেতাকে? না কি ভোটদাতা জনসাধারণকে? কিংবা সুশাসনের অভাব এজন্য দায়ী! যে কারণে থেকে-থেকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর হামলা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ২০১৩ সালে পৌঁছেও মানবতাবিরোধী অপরাধ অর্থাৎ গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের কারণে দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস হামলা চলেছে।

আরও অদ্ভূত ঘটনা যে, গণতন্ত্রী নামে পরিচিত রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের শরিকদল জামায়াত-শিবিরের এ সহিংস তাণ্ডবের জন্য উল্টো দায়ী করছে সরকারকে, আর পরোক্ষে দায়ী করছে শাহবাগের তরুণদের যারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে আন্দোলন শুরু করেছে। তারা লক্ষ্য করছে না যে, লাখ লাখ জনতা শাহবাগী তরুণদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে, এবং এ সমর্থন বিস্তার লাভ করছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের সমর্থনে গণস্বাক্ষর এখন প্রায় দশ লাখের কাছাকাছি।

এদের দাবি : 'রাজাকারদের ফাঁসি চাই' অচিরে ব্যাপক গণদাবিতে পরিণত হবে। তেমন আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে সে সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলে রাখতে হয়। গত তিন দশকে অর্থনৈতিক ও নানামাত্রিক সাংগঠনিক দিক থেকে জামায়াত যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের অর্থনৈতিক শক্তির উৎস রক্ষণশীল মুসলিম রাষ্ট্র, মূলত মধ্যপ্রাচ্য। আর গত ত্রিশ-বত্রিশ বছরে তারা বাধাহীনভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে তাদের হিংস্র ক্যাডারবাহিনী ও সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা কোথায় নয়?

তাই তাদের শিকড় উপড়ানো বেশ কঠিন। তাদের অপরাধী নেতাদের বিচার ও যথোচিত শাস্তি যেমন দরকার তেমনি তাদের মোকাবিলাও করতে হবে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করে তোলা জরুরি। আর দরকার জনগণকে বোঝানো যে, কেন ধর্মীয় দলের সব সামাজিক সংগঠনগুলোকে (যেমন চিকিৎসা, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি খাতের) বয়কট তথা বর্জন করতে হবে। একাত্তরের বিচার শুধু আদালতেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবেও করতে হবে। আর এভাবেই আমরা একাত্তরের ঘাতক ও তাদের উত্তরসূরিদের সহিংসতার জবাব দিতে পারব। ক্রমশ বাংলার মাটি থেকে তাদের নির্মূল করতে পারব। কাজটি অবশ্য কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী।

কারণ সময়ের ফোঁড় ঠিক সময়ে না দেওয়ার কারণে শুধু তাদের শক্তিবৃদ্ধিই নয়, বাংলাদেশের দূষিত রাজনীতিতে এক অশুভ সমীকরণ তৈরি হয়ে গেছে একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তির। সম্প্রতি তার সমর্থনে বেরিয়ে এসেছে গোঁড়া ধর্মীয় শক্তি কওমি মাদ্রাসার সদস্য ও কর্তাব্যক্তিগণ যারা আল্লামা মাশায়েখ নামে পরিচিত, তারা শাহবাগ-তারুণ্যকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করছেন 'নাস্তিক, মুরতাদ' বলে, দাবি ওদের মৃত্যুদণ্ড, দাবি দেশে 'ব্লাসফেমি' আইন প্রণয়নের, দেশকে শরিয়া আইনে চালানোর।

এ রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ মাত্রকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধের লৌহপ্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। আধুনিকতার পথে যাত্রিক বাংলাদেশকে তো পেছনে ঠেলে দেওয়া যায় না। কিন্তু ওরা ধর্মভীরু মানুষের বিশ্বাস ও চেতনায় ঘা দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাচ্ছে। এখানেই যত সমস্যা।

একাত্তরের চেতনা সামনে নিয়েই এ রক্ষণশীলতা প্রতিহত করতে হবে।

আহমদ রফিক : ভাষাসৈনিক, কবি, রবীন্দ্র-গবেষক।