প্রথম বাংলাদেশ সরকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

শারমিন আহমদ
Published : 16 April 2013, 07:47 PM
Updated : 16 April 2013, 07:47 PM

তাজউদ্দীন আহমদ ও ঐতিহাসিক প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন নিবিড়ভাবে জড়িত। ৩০ মার্চ, ১৯৭১, কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী, জীবননগর এলাকার টুঙ্গি নামক স্থানে, সেতুর নিচে আশ্রয়প্রাপ্ত এ দূরদর্শী মানুষটি স্বাধীন সরকার গঠনের চিন্তা করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির নির্মম আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিকল্প নেই, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই সরকার গঠনের কথা ভাবলেন তিনি।

যখন চিন্তা করেছিলেন তখন জানতেন না যে এ ব্যাপারে ভারত সরকার তাঁদের কতখানি সহায়তা করবে বা তাদের কাছ থেকে আদৌ সাড়া পাওয়া যাবে কিনা। ব্যরিস্টার আমীর–উল-ইসলাম যিনি ছিলেন তাঁর দুর্গম যাত্রাপথের সঙ্গী, তাঁকে বললেন, ভারত সরকার যদি তাঁদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে, তবেই তাঁরা ভারতে আশ্রয় নেবেন।

এভাবেই শুরু। এসপি মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-এ-এলাহি চৌধুরী জিপে করে এই দুই ক্লান্ত, অনাহারে ক্লিষ্ট স্বাধীনতাকামীকে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বারতা ওপারে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনির পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ইনস্পেক্টর জেনারেল গোলোক মজুমদার এ বিষয়ে তাঁদের সম্পূর্ণ আস্থা প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মর্যাদায় গ্রহণ করা হয়।

আলাপের প্রাথমিক পর্যায় গোলোক মজুমদারের কাছে তাজউদ্দীন আহমদ শরণার্থীদের আশ্রয়দান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে ভারত সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানান। গোলোক মজুমদার জানান যে, তাঁর পক্ষে ছোটখাট অস্ত্র যোগাড় করা সম্ভবপর হলেও, বড় পর্যায়ের সাহায্যের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করা দরকার।

১ এপ্রিল রাত ১০ টায় একটি মালবাহী পুরনো রাশান অঘ ১২ সামরিক বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যরিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, গোলোক মজুমদার ও বিএসএফ-এর নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় গোপনে নয়াদিল্লির পথে রওয়ানা দেন। সেখানে ভারত সরকার তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে, তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবর্তমানে মূল ব্যক্তি।

৩ এপ্রিল, ১৯৭১, রাত দশটায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের বাহুল্যবর্জিত পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হল, স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এ যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে, ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। যুদ্ধ করতে হবে এ দেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্রশক্তি, এবং দেশটি বাংলাদেশকে গণ্য করবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।

সেদিনের আলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ-রসদ প্রদান, শরণার্থীদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তারও ব্যাখ্যা দেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিমালা হবে জোটনিরপেক্ষ। সবার প্রতি বন্ধুতের হাত এবং কারও প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলাদেশ সবসময় মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষ সমর্থন করবে এবং সংগ্রাম করবে জুলুম, নির্যাতন, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। ধীশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

ইন্দিরার সঙ্গে সফল্ সাক্ষাতের পর ভারতসহ সারা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শুরুতেই বলেছি, দূরদর্শী ও ঐতিহাসিক এ চিন্তা তাঁর মাথায় উদয় হয়েছিল কুষ্টিয়া সীমান্তে। এর বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি ও আমীর-উল-ইসলাম কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন এম আর সিদ্দিকী, আবদুর রউফ ও সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধরত মেজর আবু ওসমান চৌধুরীসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাষাসৈনিক রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া এবং আরও অনেকে সরকার গঠনের পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করেন।

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। হাইকমান্ড নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রথম কাজ হয় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করা।

কলকাতায় এম মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামানকে খুঁজে পাওয়া গেল। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক যাঁরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা হয়। এম মনসুর আলী ও এ এইচ কামরুজ্জামান স্বাধীন বাংলা সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সরকার গঠনের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের শাণিত যুক্তি ও বক্তব্য সবাই মেনে নেন।

ইতোমধ্যে ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় শিলিগুড়ির জঙ্গলে অবস্থিত গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সুদীর্ঘ দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচারিত হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বর্বরতার বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা।

১১ এপ্রিল বিএসএফের সহায়তায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এমপি আবদুল মান্নানের খোঁজ পাওয়া গেল। ময়মনসিংহর তুরা পাহাড়ের কাছে ডাকোটা প্লেন থেকে নেমে তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে আলাপ করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। সব শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন এবং সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ মত দিলেন। এরপর ডাকোটা প্লেনে চড়ে আগরতলায় পৌঁছে তাঁরা খুঁজে পেলেন মন্ত্রিসভার অপর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। সেখানে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হল। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে প্রথাগত যুদ্ধের বিপরীতের এ জনযুদ্ধকে গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন। ওসমানী পরে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

১৭ এপ্রিল, তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সূচিত হয় নয়া ইতিহাস। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে প্রথম বাংলাদেশ সরকার। সেদিনের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত পাঠ করেন পাশের গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ বাকের আলী। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করেন এসপি মাহবুব উদ্দীন আহমেদ। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যা ব্যরিস্টার আমির-উল-ইসলাম ১০ এপ্রিল সরকার গঠন উপলক্ষে রচনা করেন, তা পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।

তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্যের এক অংশে বলেছিলেন, "পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।———- সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য। দুনিয়ার কোনো জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।—— আমরা কোনো শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না- আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারও তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।"

একটি আত্মনির্ভরশীল, সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছিলেন সেই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও। প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে তিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের কাঠামোয় সংহত করে বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন 'মুজিবনগর' যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানেই যাবে সে স্থানের নাম হবে 'মুজিবনগর'। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা। তিনি বন্দী অবস্থাতেও চেতনায় ছিলেন উপস্থিত। কিন্তু সে চেতনাকে বাস্তবে রূপদানের জন্য তাঁর নিকটতম সহচর তাজউদ্দীন আহমদের এক মুহূর্ত অনুপস্থিত থাকার উপায় ছিল না। এক নির্মোহ ও নিঃস্বার্থ সাধকের মতোই তিনি হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের।

তখন মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তারা পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। যোদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় যুদ্ধ করতে পারে তাঁরা নেতা হয়ে কেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন না। অন্যান্য সদস্যদের পক্ষে সে প্রতিজ্ঞা পালন করা সম্ভব না হলেও তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড তথা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানীর (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরনী ) অফিসকক্ষে দিবারাত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। বাইরে পরার কাপড় ছিল একটিমাত্র খাকি শার্ট যা তিনি নিজ হাতে ধুয়ে পরতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়টি প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পাড়ি দিতে হয় পিচ্ছিল সর্পিল পথ, মোকাবিলা করতে হয় জটিলতর পরিস্থিতির। বাইরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনির হামলা, ভেতরে বৈদেশিক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের পাকিস্তান ও সিআইএর পক্ষ হয়ে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি পরিচালিত যুব দলটির বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর পৃষ্ঠপোষকতায় মুজিববাহিনি গঠন করে মুক্তিবাহিনির ওপর হামলা- সবই সামলাতে হয়েছে এ সরকারকে। এ যুব দলটির কোনো এক নেতার নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদের প্রাণনাশের চেষ্টাও চালানো হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐক্য-দ্বিখণ্ডকারী এ সব ভয়াবহ পরিস্থিতি তাজউদ্দিনকে মোকাবিলা করতে হয়েছে গোপনে। বাইরের কাউকে বুঝতে না দিয়ে তিনি ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে সব ষড়যন্ত্র বানচাল করতে সক্ষম হন। জাতিসংঘে যোগ দিয়ে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন মোশতাক। সেটা ভেস্তে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিও তাঁকে ছাড়তে হয়। তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধে বিভেদ ও নাশকতা সৃষ্টিকারী মুজিববাহিনির ট্রেনিং বন্ধের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানান। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে দেরাদুনে মোটা ভাতা ও সুবিধাপ্রাপ্ত মুজিববাহিনির ট্রেনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হল যে, বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুজিববাহিনিতে যোগ দেননি। তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বড় তিনটি অর্জন হল :

প্রথমত, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরই মুক্তিবাহিনির সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এ শর্তের উল্লেখ ও বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, সে সময় দলের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা দাবি করছিলেন যে, স্বীকৃতির দরকার নেই, ভারতীয় সেনা যেন অবিলম্বে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেশমুক্ত করে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে এ চুক্তি করা যে বাংলাদেশ সরকার যতদিন চাইবে ভারতীয় সেনাবাহিনি ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকবে, তারপর তাদের ফিরে যেতে হবে। বিশ্বইতিহাসের ওই বিরল চুক্তিটি প্রমাণ করে যে ভিনদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে, তাদের সাহায্য-সমর্থন লাভ করার পরও নিজ রাষ্ট্রর মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কতখানি আপোষহীন ছিলেন এ সুউচ্চ চিন্তাশক্তির অধিকারী বিরল রাষ্ট্রনায়ক।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করা।

স্বাধীন বাংলাদেশে পবিত্র ধর্মের অপব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট তথাকথিত ধর্মবাদী দলগুলো যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে সে জন্য বিজয়ের আগেই, ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় সম্মিলিতভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন কোরআনে হাফেজ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ছিলেন জনকল্যাণমুখী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। সুতরাং তিনি এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সমমনা সহকর্মীবৃন্দের উদ্দেশ্য ধর্মকে আঘাত করা ছিল না; বরং ধর্মের নামে মানবতা-লঙ্ঘনকারী, প্রতিক্রিয়াশীল ও যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর হাত থেকে ধর্মকে উদ্ধার করা।

তিনি বলেছিলেন যে, এ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হতে হবে। তাদের বিচার প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাধারা ছিল স্বচ্ছ। তিনি বলতেন যে, পাকিস্তানি আর্মির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এবং বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে বাংলার মাটিতে। গোলাম আজমের নাগরিকত্ব যখন বাতিল করা হয় তখন তিনি দ্বিমত পোষণ করে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, যারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার অধিকার আমাদের নেই। বরং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশে এনে তাদের বিচার করতে হবে। বিচারে গোলাম আজম বা অন্য কেউ যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু দেশের মাটিতেই এ বিচার হতে হবে যাতে মানুষ তাদের অপরাধ সম্পর্কে জানতে পারে।

তিনি বলতেন, আমরা এমন কাজ যেন না করি যাতে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একদিন ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ স্বাধীন করার "অপরাধে" আমাদেরই উৎখাত করতে সচেষ্ট হবে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে আয়োজিত সভায় এক বক্তব্যে তিনি বলেন, "সবাইকে নিজ নিজ ঘর থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে হবে।— অন্যথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ হবে না এবং বাংলাদেশ থেকে দুনীতি কখনও যাবে না। উপর থেকে আদর্শ–অনুশাসন করে দেখাতে হবে। তাহলে কর্মীরা উৎসাহ ও প্রেরণা পাবে। উপরে বসে দুর্নীতি করে আদর্শবান নাগরিক হওয়ার উপদেশ প্রদান করা উপহাস মাত্র। এতে দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। —- যদি সময় থাকতে মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টায় আমরা ব্রতী না হই, তাহলে নিম্নচাপের ফলে অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবের গতিধারায় আমরা শুধু ভেসেই যাব না, ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়েও নিক্ষিপ্ত হব। অতএব সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।"

দূরদ্রষ্টা তাজউদ্দীন আহমদের সতর্কবাণী সেদিন শুধু উপেক্ষিতই হয়নি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিগৃহীত হয়েছিলেন তিনি।

প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হল। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সৎ, নির্লোভ, স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টভাষী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর মতো রাজনীতিবিদ আমাদের রাজনীতিতে বিরল। তাঁর অনেক কথাই আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

নিজেকে আড়াল করে, কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু আজও রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে তাঁর এ অবদানের মূল্যায়ন হয়নি। ইতিহাসপ্রমাণ মানুষটি আজ পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। এ দুর্ভাগ্য তাঁর নয়, দুর্ভাগ্য এ জাতির।

তারপরও আশা থাকবে যে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ইতিহাসের কলঙ্ক মুছতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে গণআন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছে, তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে শেকড় গাড়া সকল প্রকার কলুষতা, অসত্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেতনার নবজাগরণ ঘটাতে; চেতনার রূপান্তরিত নিষ্কলুষ বিকাশে জন্ম নেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মতো সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক নতুন শিশু। তারা বাংলাদেশকে পথনির্দেশ করবে আলোর দিকে।

প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের অমর স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে সকল প্রেম ও জ্ঞানের আধার স্রষ্টার কাছে এ প্রার্থনা রইল।